মিজ এগনিজ বাট্টার সাথে আমার যখন দেখা হয় তখন ঝলমলে রোদ আকাশে; এর আগে ফোনে কথা বলতেই বললো আমি কালো টি-শার্ট আর কালারফুল প্যান্ট পরেছি, আর তুমি কী পরেছো! আমি কেবল বললাম ব্ল্যাক লাইক ইউ! আমি তখন টিজা নদীর পাড়ে বসে আছি সমূহ সমুদ্র ভেবে। জীবনের ভয়ংকর সিদ্ধান্ত নিবো কয়েক মুহূর্তে। ফিনফিনে শীতের দুপুরে আমি তখন ঘামছি যেন টিজার জলীয়বাষ্প আমাকে নিয়ে যাচ্ছে বুড়ো একটা বটগাছের কাছে। বিশ্বাস ছিল আমার যে, জীবনে কেবল নিজের কাছেই গল্প করতে হয়, শুনতে হয় অন্যের আখ্যান। আমার এই যাত্রায় যে কদমগুলো আমি নিচ্ছিলাম তাতে পাহাড়ের সমপরিমাণ ভার একাই বয়ে গেছি। বলে নিচ্ছি হাঙ্গেরি সরকার প্রদত্ত স্কলারশিপে পিএইচডি প্রোগ্রামে আমি তখন সীমানার কাছে এক শহরে যার নাম সেগেড।বাঙ্গালি বলতে সে শহরে কেউ নেই, ভারতীয় থাকতে পারে জনাকয়েক। একেবারে আদিশহর বলতে যা বুঝায় তেমন। শুনশান নীরবতার সড়কের দুই পাশে রাশিয়ান কলোনির আদলে ভবন। টেসকো থেকে বাজার করে ফেরার এক রাতে সেই আদি রাশিয়ান এক নারীকে দেখেছিলাম যার ঠোঁটে আর চোখে ছিল ভয়ঙ্কর আভিজাত্য। এক বিকেলে এক আফ্রিকান আমাকে দেখে হাই বললে আমি জেনে যাই আদতে আমরা যারা নিজেদের শঙ্কর বা যাই বলি আদতে আমরা আদি কালো জাতি। এখানে এই জিনিসগুলো খুব জটিল। আমার বিভাগের ইয়েমেনের মেয়েটার কাছে শুনেছি এক প্রফেসরের খারাপ ব্যবহার করার গল্প; আমার সাথেও করেছেন। তবে তিনি কালোদের দেখতে পারেন না, এটা বিভাগের সবাই জানে। আমাকে সে মন খারাপ করতে মানা করে। আমি সমস্ত ছেড়ে চলে আসবো আমার দেশে, আমার আঙিনায়, মায়ের কাছে, আমাদের নদীটার কাছে; আমার নিজের কাছে যারে দাম দিয়ে কিনেছি আমি আমার বিলুপ্ত শৈশব থেকে। এই ফিরে আসা প্রত্যাবর্তন নয় বরং আশ্রয়। এই আমার খানিক উৎসব, আমার বিচলিত সময়ের পরিত্রাণ!
জোরে একটা ঠাণ্ডা বাতাস এলে মনে হলো আমার উঠতে হবে। এখানে আবহাওয়া আমার মনের ঠিক সমান্তরাল। যেন আমরা জানি না আমাদের কী করতে হবে পরবর্তী পদক্ষেপে। এরপর আমি কয়েক কদম হেঁটে এসে আমি বসি ক্যাফে এনটিকের সামনে।বিশ্ববিদ্যালয়ের এইদিকে আমার আসা হয়নি মোটেও। অবশ্য এই এক মাসের মধ্যে কে বা এত কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়। দুপুর গড়িয়ে আসছে তখন; এরমধ্যেই গাড়ি থেকে নামে আমার মায়ের বয়সী এক নারী; ফিনফিনে সাদা ছোটো ছোটো চুল আর ভারি স্বাস্থ্য মিলিয়ে একেবারে ঋষি কাপুর। ঝটপট ঢুকেই বলে তুমি কী খাবা! আমি কিছু বলার আগেই ও দুটো কফি অর্ডার করে, সম্বিৎ ফিরে আমি বলি- আই উড লাইক টু টেইক টি! ওওওও…
একটি চা আর একটি কফির সাথে দুটো বড়ো বড়ো ব্রেডের মতো কিছু একটা আসে। রুটিগুলো দেখতে মহিষের শিং এর মতো। আমার নাকে বেশকিছুদিন ধরেই খাবারের গন্ধটা আঁশটে লাগলেও খিদাটা টের পাই ঠিক তখন কারণ তখন আড়াইদিনের বেশি আমি খাই না কিছু। এই কয়দিন আমি ডিপ্রেশনে চলে গেলাম। বিদেশের মাটিতে এমন হওয়া খুব স্বাভাবিক সবাই বললেও আমি ঠিক মানতে পারছিলাম না। পার্কের শেষ বেঞ্চে বসে থেকে পাতা ঝরা গুণতে গুণতে মনে হতো দেশের নাটাই সুতা আমার আরাধ্য। ঠিক বলা যাবে না কে টানছে আমাকে অবাক আকর্ষণে!আমার মনে হতে থাকে আমাদের বাড়ির কাছে যে মেলা বসতো সেখানে আসা অচেনা দুটি চোখ আমাকে বলেছিল কাচের চুড়ি কিনে দিবে! এমন একজনের জন্যে হলেও এমন বিদেশ ছেড়ে চলে যাওয়া যায়। ঠিক তখন আমার জন্যে আসা চা চুমুক দিতেই বেশ ফুরফুরে লাগে, ততক্ষণে এগনিজ একটা রুটি খেয়ে নিয়েছে। আমরা গল্প করছি আর বসে আছি। যে যাচ্ছে পাশ দিয়ে সে তার সাথে কথা বলছে এগনিজ।
আমি চোখ বড়ো করে আরেকটা রুটির দিকে তাকিয়ে আছি, দেখলাম ও একটা কুকুরকে আদর করছে! আমার মনে ক্ষীণ আশা জাগে যে একবার হলেও সে আমাকে বলবে রুটি খাবার কথা না আমারই বলা প্রয়োজন যে আমার খিদা লেগেছে এবং আমি এটি খেতে চাই। আমার তখন চোখে ভেসে আসে মায়ের হাতের ধনে পাতার ভর্তা আর গরম চিতই পিঠার একটি চিত্র। ম’ ম’ কড়া গন্ধে যে উৎসবের রাত নেমে আসতো আমাদের ঘরের টিনের চালার শিশিরে তার টপটপ শব্দেরা আমার ইন্দ্রিয় অনুভূতিতে যে তোলপাড় করে যাচ্ছিল তার ভাষারা অচেনা শহরে আমাকে তীব্র সেলাই করে যাচ্ছিল। এবং খানিক পরে মিগ বাট্টা তার সেই হাতটা বাড়িয়ে দেয় আবারও দ্বিতীয় রুটিটার দিকে। আমি মুখ ফিরিয়ে চায়ে আরেকটা চুমুক লাগাই। এতক্ষণে আড়ালের রোদটা আমার মাথার উপর দিয়ে বইতে শুরু করেছে, আমার সদ্য রংকরা চুলের চমক খেয়াল করেই এগনিজ আমার দিকে আবার তাকালো। মিষ্টি হেসে বললো – ইউ আর বিউটিফুল, ডু ইউ লাইক এনার্জি ড্রিংক? আমি মাথা নাড়াই। ততক্ষণে কিছু ছেলেমেয়ে হেঁটে যায় আমাদের অতক্রম করে, যাদের প্রত্যেকের হাতে ড্রিংক!
আমার বুঝতে দেরি হলো এগনিজ আরও কারো জন্য অপেক্ষা করছিল, একজন এসে বসতেই বললো- মিট সি ইজ মিজ বৌল! আমি হাসি দিলাম। ওরা ওদের ভাষায় বেশ কিছুক্ষণ কথা বললো, ফাঁকে যতগুলো কুকুর এলো গেলো সবাইকে আদর করে দেয় মিজ বাট্টা। আমার খানিক খানিক মনে হচ্ছিল এই বিদেশের মাটিতে কেউ যদি আমাকেও আমন আদর করে দিত আমি হয়তো থেকে যেতে পারতাম আরও কয়েক মুহূর্ত! এখানকার কুকুর বিড়াল সম্ভবত নিজেদের হিওম্যান বিং মনে করে। নিজেকে কুকুর ভাবার কোনো কারণ এদের নেই।
এবার এগনিজ আমার হাতটা ধরে, দু’দিন হাসপাতালে থেকে আমার চোখগুলো তখন বসে গেছে, হাতটা কাঁপছে থরথরে পাখির মতো। সম্ভবত আমার ভেতরটা ওর হাতের ভিতর দিয়ে হৃদপিণ্ডে চলে গেছে। ও আমাকে জড়ায়ে ধরলো।
আরও একবার হাসপাতালে যেতে হলো সাবার সাথে। পৃথিবীর সমস্ত হাসপাতালের গন্ধ একরকম। মরা মাছির ঝাঁক সেখানে দৌড়ায় কল্পনায়। আমার হাতটা সাবাহ শক্ত করে ধরে রেখেছিল রাত একটা পর্যন্ত। আমার প্রফেসর জড়িয়ে ধরে কান্না করছিল, সাবাহ কান্না করছিল, কেবল আমি পিছনে তাকিয়ে দেখিনি,,, জানালার কালো কাচের হালকা বৃষ্টির জলে তখন ছুটি শেষের বার্তা। যখন ফিরছি পথে ধূপের ঘ্রাণ তখন শরীরে। ফিরছি গণ্ডি অতিক্রম করে টপটপ চোখের কাজলে। মাছের মাথা চিবানো আয়েশের দুপুর কাঁপিয়ে দিচ্ছে তখন মনমরা কাক। অথচ ছুটতে হয়, খোকনের দোকান পেরিয়ে বড় কড়ইতলার পাশে স্কুলঘর রেখে। এতবছর পরেও ফিরে যেন একবার তাকাই স্কুলের নতুন ভবনে। ছোট ছোট গলিগুলোতে খুঁজে নিতে চাই বলিষ্ঠ কৈশোর। মানুষের মুখগুলো স্মৃতির করিডোর দিয়ে চলে যায় দূর থেকে দূরে, পরিচিত রঙের শাড়ি, অপরিচিত কিছু নাম, থাকা না থাকার দুঃখ অভিমান সব। একটা মেয়ে রাস্তায় ভিজছে দাঁড়িয়ে, গন্তব্য শহরের টানে, এই টানাটানি পুঁই ডগার কচি ফুলের মতো আমায় এখন টানছে! এরপর…
উৎসবের শারদ অন্ধকারে গান শুনছিলাম, নেগেটিভ পজেটিভের বৃত্তাংশের তখন থেকেই নিজেকে আলাদা রাখার ব্যাসার্ধে। আমি এদিনগুলোতে গণিতের ভেতর ঢুকে পড়ি অহরহ। ক্যালকুলাসের বহুমুখী বাজেট পরিবর্তন করতে করতে এগিয়ে যাই নিজেকে ধ্রূবক জেনে। প্রতিটি সূর্যাস্তের সাথে দেখা করতে পারাই হয়তো জীবন, অসমীকরণের সাথে সামেশন করতে গিয়ে দেখলাম প্রভাবকগুলোও স্বার্থপর। অতঃপর তারা ফিরছে ঘরে, নিজস্ব দেবালয়ে – যেন একটা একুরিয়াম ভর্তি একদল গোল্ডফিশের যৌনজীবনই পরিবার। ছুটছে শিকারের অপ্রতুলতার কারণে। লগের সূচকের উত্থান-পতনে কেমন ঘ্রাণ বসে আছে প্রজাপতি হয়ে, নিলামের পাখনাযুক্ত হাওয়ায় উড়তে ভয় লাগছে তখন আমার। জানালার গ্রিল জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে অন্ধকার, আমার চোখের আলোর সাথে দেখা করতেই এহেন পীথাগোরাসের আগমন…