বাঁশ চাঁছতে চাঁছতে, ঘরের দিকে মুখ করে হাঁক দেয় মালেক : শুনছো, এটটু আগুন দিয়া যাও।
সাজু শুকনো পাটখড়িতে আগুন নিয়ে আসে। বিড়িটা ধরাতে ধরাতে খিঁচিয়ে ওঠে মালেক : কথা কইলে কানে যায় না, না?
সাজু চুপ করে শোনে । খড়িখানা হাতে নিয়ে বলে, সফি আইছে।
মালেকের হাতের দা থেমে যায়। ‘কী কইলি!’
সাজু জবাব দেবার জন্যে আর দাঁড়িয়ে থাকে না সেখানে ।
চোখ তুলে সাজুর বদলে যাকে দেখে চমকে ওঠে মালেক, সে সফি। চেঁচিয়ে ওঠে : ক্যান্ আইছোস হারামজাদী? তোরে না সিবার কইদিলাম আর আইবি না!
‘ওরা আমারে ধাওয়ায় দিছে বাজান। কইছে আর খাওয়াতি পারবে না।‘ সফি কাঁদে । ফ্যাকাশে হলুদ ফোলা গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে।
মালেক মেয়েকে দেখে। শুকনো কাঠি-কাঠি হাত পা। পেট ফোলা। তাহলে কি আবারও…? সাজু এগিয়ে এসে বলে, তুমি রাগ করতিছো ক্যান? সতীনের ঘরে বিয়া দিলা- এহন –
‘এই মাগী চুপ।’ মালেকের প্রচণ্ড ধমকে সাজু থমকে যায়। মেয়ের হাত ধরে ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ে।
মালেক চেঁচায় : “মা, মেয়া ঘরথনে বারা। আমি খাওয়াতে পারুম না। যে চুলোয় খুশি দূর হয়া যা।’
দা ফেলে উঠে যায়। ভেবেছিল ঘরখানা ঠিক করবে। হল না। মেজাজ না খিঁচড়ায় কার! ঘরে খাবার নেই। কোলে পেটে বাচ্চা নিয়ে মেয়ে এসেছে। মালেক রাগে গরগর করতে থাকে। মনিবকে বলে এসেছিল আজ আর রিকশা নেবে না। নেবে না। গত রাত্রের বৃষ্টিতে ঘর পুকুর হয়ে গেছে। ঘরের জন্যে খাটবে ভেবেছিল। উটকো আপদ এসে জুটলো। খাওয়ার কী ব্যবস্থা হবে কে জানে। তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে মনিবের বাসায় আসে মালেক। লাভ হয় না। ভাড়া দিয়ে দিয়েছে রিকশা ।
বেলা একপ্রহর চেষ্টা করে রিকশা একটা জোগাড় করতে পারলো। অথচ দু-এক প্যাডেল টেনেই হাঁফ ধরে গেল। খাটতে পারে না। শরীরে যেন একফোঁটা শক্তি নেই ।
অথচ দিন ছিল একদিন। রিকশা থামিয়ে, রাস্তার পাশে গাছতলায় বসে মালেক। সাঁ সাঁ করে ছুটছে ছোকরা রিকশাঅলারা। মালেকেরও দিন ছিল। আর ছিল অপরিমিত শক্তি মালেকের পেশিতে। শস্তা ফিলমি গান মুখে রিকশায় তো ছোটেনি, যেন পঙ্খীরাজের সোয়ারী। গোটা শহর চষে হাত ভরে গেছে কাঁচা টাকায়। আসমানী, টগর, বেগম— ঘরের কথা বেমালুম ভুলে থেকেছে। ঘর মানে তো সাজুর মিইয়ে যাওয়া কণ্ঠ। ন্যাতনেতে শরীর। ও তখন অগ্নি সোয়ারি। ফিলমের নায়িকা যেন আসমানী। আজো ভোলেনি। গোটা যৌবনটা তো ওরই কাছে নিঃশেষে বিলিয়ে দিয়েছে।
আজ মালেকের মিইয়ে যাওয়া শরীরের দিকে ফিরেও তাকায় না আসমানী। আসমানী নেই তবু আকাঙ্ক্ষা আছে। আকাঙ্ক্ষার নিবৃত্তির জন্যেই প্রৌঢ়, আতুর, পরাক্রান্ত শরীর নিয়ে ধেনোমদের দোকানে গিয়ে দাঁড়ায়। আকাঙ্ক্ষা মেটে না। বরং অনির্বাণ হয়ে বুকটা কুরে কুরে খায়।
রিকশা পথের পাশে নামিয়ে রেখে মালেক এক আশ্চর্য ভাবনায় ডুবে যায়। জীবনটাকে পেছন ফিরে দেখা। অথচ ওর আর বসে থাকা চলবে না। ঘরে খাবার নেই। মেয়ে এসেছে। ওরই দোষ, সাজু ঠিকই বলেছে। সতীন আছে জেনেও মেয়ের বিয়ে দিল। আগেও একবার পেটে বাচ্চা নিয়ে এসে ক’মাস থেকে গেছে। আবার এসেছে, এবার শরীরও শেষ। রক্ত নেই, সে তো মুখ দেখেই বোঝা যায় ।
যৌবন বড় অবুঝ, ভেবে কাজ করতে দেয় না। মেয়ে বড় হয়েছে, সাজু রোজ বিরক্ত করে। সম্বন্ধ আসতে আর দেরি করেনি। মালেকের চোখে তখন রঙীন স্বপ্ন। রাত । আহা, কখন আসবে মায়াবী রাত।
জোরে প্যাডেলে চাপ দেয় মালেক। পা দুটো ভেঙে পড়তে চায়। বুকে ব্যথা। পাঁজরে কটকটে আওয়াজ আর্তনাদ করে ওঠে। পাশ দিয়ে ছোকরা রিকশাঅলারা সাঁই সাঁই ছোটে। ওদের দেখে-দেখে আবার এক আশ্চর্য ভাবনার শিকার হয় মালেক। ইচ্ছে হয়, ওদের ডেকে দুটো কথা শোনাতে। ইচ্ছে হয় বলে, ‘আস্তে চল্ ব্যাটা। অত জোরে ছুটিস না। দ্রুত ছোটার মধ্যে থাকে দ্রুত ফুরিয়ে যাওয়ার ইংগিত। একটু ধীরে, বুঝে সুঝে জীবন খরচ কর। ফুরিয়ে যাওয়া বড় যন্ত্রণার।
ফুরিয়ে গেছে তবু বুকের ভিতর আগুন হয়ে জ্বলে আকাঙ্খা। জীর্ণ কখানা ধুক পুকে হাড়। কলজেটাও নিঃশেষ। বিষাক্ত কীটের সাধের আবাস জীর্ণ হাড়ের বুকেও আকাঙ্খা তার সৌধ গড়ে যায়।
অথচ এ শুধু স্বপ্ন। রাত্তিরে কাশতে কাশতে হাঁপরের মত বুকখানা ওঠে নামে। সাজু তেল গরম করে ঘঁষে। মানেনা। দলা দলা রক্ত বেরিয়ে আসে বুকটা জ্বলতে জ্বলতে। আকাঙ্ক্ষার সমিধ যেন ওগুলো।
এমনি খোঁয়ারির মধ্যে রাত ফুরায় শুরু হয় ক্ষুধার দিন।
যৌবন ছুটি দিয়েছে। আসমানি উপেক্ষায় ফিরিয়ে নিয়েছে মুখ। তবু আকাঙ্ক্ষার মত জীবনের হাতে বন্দী মালেক। সারাজীবন হাতকড়া পরিয়ে রেখেছে যে জীবন সেই জীবনের তাগিদই ওকে ঘাড় ধরে ওঠায়।
এত বঞ্চনার মধ্যেও মৃত্যুর কথা ভাবেনা মালেক। নিয়তির হাতে মার খায়, ফুঁসে ওঠে তবু প্রতিকারের উপায় ভাবেনা।
মালেকের বাপ দাদা রিকশা টানেনি। গাঁয়ে থেকে অন্যের জমিতে খেটেছে।
মালেক শক্তি ফুরিয়েছে রিকশা টেনে, তারা নিঃষেশিত হয়েছে অন্যের জমিতে প্রানান্ত খেটে।
ওরা শ্রম বিমুখ নয়। শ্রম ওদের পর্যাপ্ত অর্থ দেয়না। নিরাপত্তা দেয়না। খেটেছে সর্ব শক্তি দিয়ে নিঃষেশিত হয় তাই হাতে কিছু না রেখে।
মালেকের ছেলেও রিকশা চালায়। অফুরন্ত শক্তি স্বাস্থ। বখে গেছে। রাতে বাড়ি ফেরে না।
সাজু বিয়ে দেয়ার জন্য ধরেছে। অথচ মালেক জানে রফিক তো মালেকেরই প্রতিচ্ছবি। এই দুরারোগ্য ব্যাধি। ফিরবার নয়।
একমাত্র মেয়েটির কপাল মন্দ। গালাগাল করেছে তবু মেয়ের দুঃখী মুখটা বুকের মধ্যে জ্বালায়।
জোরে প্যাডেল টানে মালেক। চাল আটা কিছু নিয়ে ঘরে ফিরতে হবে। হবে ওকে।

কবি
জন্ম: ১০ এপ্রিল, গোপালগঞ্জ
নব্বইয়ের দশকের উল্লেখযোগ্য এই কবি গৎ বাঁধা কবিতার ধারণাকে পাশ কাটিয়ে লিখে চলেছেন নিজস্ব ভঙ্গিতে।