ট্রেন অনেকক্ষণ ধরে চলছে। ট্রেনটা ভালো যাচ্ছে। অনেকক্ষণ ধরে সবুজ দেখা যাচ্ছে। কিছু কিছু অংশ বেশি সবুজ। ধানক্ষেত আর ধানক্ষেত। মাঝে মাঝে বাড়ি। স্টেশন। সব স্টেশনে ট্রেন দাঁড়ায় না। ট্রেনের দায় আছে, তাড়া আছে। বিপুল তার শরীর, তীব্র তার গতি। উল্টোদিকের সিঙ্গল সিটে এক অল্পবয়সী ছেলে কানে ইয়ারপ্লাগ দিয়ে সমানে কথা বলে যাচ্ছে প্রেমিকার সঙ্গে। পাশের সিটগুলো ভর্তি। কেউ ফোনে গেম খেলছে। কেউ ফেসবুক দেখছে। মোটামুটি সবারই ফোন হাতে। ওপাশের জানলায় এক মহিলা শুধু দৃশ্য দেখতে দেখতে যাচ্ছে।
অলীক বোধহয় বাড়ি যাচ্ছে। বাড়িই যাচ্ছে বোধহয়। অর্ধেক জীবন সে বাড়ি খুঁজে খুঁজে কাটিয়ে দিল। আজ একটা হালকা ব্যাগ আর বিরাট একটা স্মৃতির মোট ছাড়া তার সঙ্গে কিছু নেই।
অগ্নিময় লাল চিহ্ন। সার্বিক অন্ধকার নেমে এসেছে। এই অন্ধকার এত বড়, এত বিস্তারিত, এত ব্যাপক- ট্রেন যতই দূরে যাক, এই বিস্তৃত অন্ধকার ছাপিয়ে যেতে পারছেনা। ছাড়িয়ে যেতে পারছেনা। শুধু দূরে একটা কিছু জ্বলছে। অন্ধকারের সিঁথিতে লাল সিঁদুরের মত আগুন, মাদরফুলের মত আগুন অনেকক্ষণ নির্নিমেষ জ্বলতে লাগল।
অন্ধকার। আকাশ কলুষবর্ষী। আকাশের দিকে যতদূর চাও, মাটিকে যত পরখ কর, দেখবে আঁধার, আঁধার, অকল্প আঁধার। মাঝেমাঝে মানুষ ভয়ের চোটে জায়গায় জায়গায় আলো জ্বেলে রেখেছে। যেমন- স্টেশন। অনেক বদলে গেছে স্টেশনটা। তিনটে প্ল্যাটফর্ম, দুটো ওভারব্রিজ। কিন্তু নামল খুব অল্প লোক। যৎসামান্য। ফলে স্টেশনটা আবার দেখতে পারল ভালো করে। মূল ধাঁচাটা একইরকম আছে। পুরোনো বিল্ডিং, ব্রিটিশ কাঠামো। বড় ওয়েটিং রুম। সেখানকার বিরাট টেবিলটার খানিক অংশ দেখা যাচ্ছে। হয়ত ওখানে ক্ষুধিত পাষাণের গল্প আবার নতুন করে বলা হবে। গল্পের মধ্যে গল্প, তার মধ্যে গল্প, তার মধ্যে গল্প। এখন তাকে একটা টোটো ধরে ম্যাকেঞ্জি পার্ক নামতে হবে। রুটি-তড়কা কিনে পিতার তৈরি সেই আশ্চর্য স্থাপত্যে সেঁধিয়ে যেতে হবে। এখন বাবা-মা তো নেই। বাবা-মার স্মৃতি আছে। এই স্মৃতিটুকু তার সম্বল। কিছু কিছু জিনিষ লিখতে নেই। একান্ত নিজের করে রাখতে হয় তাকে। যেমন রবীন্দ্রনাথ। স্যারের কাছ থেকে সে রবীন্দ্রপাঠ পেয়েছিল। সত্যিকারের পাওয়া। সেই থেকে আর রবীন্দ্রনাথ নিয়ে কিছু লেখেনা। বাঁচার অংশী হয়ে গেছেন তিনি।
শুধু এই বাড়িটা আছে। বাড়ির উপরে ঠাকুরঘর। যেন একটা বাতিঘরের মতো দূর থেকে দেখা যায়। বাড়িটার প্ল্যান ও দৃশ্যরূপ তার কাছে হাতের তেলোর মতো। বাঁক ঘুরতেই দেখতে পেল সামনের তৃপ্তিমাসিদের বাড়িটা সম্পূর্ণ ভেঙে দেওয়া হয়েছে। লোহার ছক সিমেন্ট ঢালা হচ্ছে। এক ইঞ্চি জায়গাও ছাড়া হয়নি। এইই বোধহয় আধুনিক পৃথিবীর প্রধান নিয়ম। সর্বত্র গাজোয়ারি ও লড়াই। কোন ছাড়ছুট নেই। শুধু প্রোডাক্টগুলোতে থার্টি পার্সেন্ট অফ। তিনশো পার্সেন্টের থার্টি পার্সেন্ট। এই আর কী! এই পার্সেন্টেজের ওপর সমাজ চলছে একটা। নম্বর কত পার্সেন্ট। ঘুষ কত পার্সেন্ট।
শুধু তার বা তার মতদের জীবনের প্রায় সেন্ট পার্সেন্ট নষ্ট হয়ে গেল এই চক্করে। চল রে হারানিধি, ঘরকে চল।
বাড়ি ঢোকার আগে সরু বারান্দায় চোখ গেল। যথারীতি একটা বেড়াল কয়েকটা বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে শুয়ে আছে। এখনও মরেনি ওই বিড়ালটা। ওর নাম করিনা। বারান্দায় ধুলো জমেছে। গ্রীলে জং। অনেক কসরত করে তালাটা খুলল। খুলেই ঘরদোর কালো বিড়ালের মতো অন্ধকার। এ ধরণের অন্ধকার সাধারণতঃ ঝুপ করে নেমে আসে। লাইটার জ্বালিয়ে ক্রমশ দেওয়ালের দিকে সরে মেনটা অন করে আর আলোটা জ্বালায়। টিউবটা কয়েকবার দপদপ করে জ্বলে ওঠে।
‘সন্ধ্যার পর থেকে রুটি আর মোরগা’ পাওয়া যায়। দোকানটাতে একপাশে হেলে থাকা সাইন বোর্ডে লেখা ছিল। আজকে অন্তত খাওয়ার চিন্তা নাই। সে ধপ করে একটা চেয়ারে বসে পড়ে। দেওয়ালে ঝুল, বন্ধ জানলাগুলোয় ঝুল। সে পটাপট কয়েকটা জানলা খুলে ফেলে। ওপাশের জমিটা যা প্রকৃতির নিজের হাতের তৈরি যাদুঘর, কী যাদুতে এখনও ফাঁকা। জমিটা বিক্রি করে নি রতনবাবুরা। অনেক পাখি আসে, অনেক মৌমাছি, প্রজাপতি। পলিথিন, আবর্জনা অনেক আছে, কয়েকটা গরু আসে ঘাস খেতে। এখন ল্যাম্পপোস্টের আলো, কচুবনে কিছু জোনাকি দেখা যাচ্ছে। এক এক করে সব আলগুলো জ্বালাতে হবে। দূরবর্তী এই নিশুতিপুর। অনেক অন্ধকার।
সবকিছুর মধ্যে থেকেই সে যেমন কিছুর মধ্যেই নেই, সেরকমই বাড়িটাও। ক্রুশো আইল্যাণ্ড। এই বিচ্ছিন্ন দ্বীপেই সে ভালো থাকে। কিন্তু চিরসময় কী বিচ্ছিন্ন থাকা যায়? যায় না বোধহয়। কিন্তু এই বিচ্ছিন্নতার মধ্যেই মানুষ মহাসময়কে খানিকটা বুঝতে পারে। কতদিন বেঁচে আছ পৃথিবীতে! মাস, বছর বাদ দাও। অনন্ত, অনন্ত প্রহর।
সকালে উঠে সে সামনের দোকানে চা খেতে গেল। চা আর সাদা বিস্কুট। এখানকার স্পেশাল। একটা কুকুর পায়ের কাছে ঘুরঘুর করছিল। দোকানী যাঃ যাঃ করল। জল ছেটাতে যাচ্ছিল। সে মানা করে। আরেকটা বিস্কুট ভেঙে কুকুরটাকে দিল। সে কামনা করল, কুকুরদের যেন আর কুত্তা বলা না হয়।
সামনে একটা কালভার্ট, ওটা পেরিয়ে, ইণ্ডিয়ান ব্যাঙ্ক পেরিয়ে অলীক বাড়িতে এসে তালা খুলল। দেখে ধূসর রঙের কুকুরটা পায়ে পায়ে এসেছে। করুণ চোখে সে তাকিয়ে আছে তার দিকে।
এই বাড়ি যেন এক জাহাজ। ডেক আছে, কামরা আছে। মাথার উপরে আকাশ আছে। সে ডেকবয়, চিফ মেট, মজুর খালাসি। কিন্তু ক্যাপ্টেনের দেখা নেই। ক্যাপ্টেন, আমি হাজার বছর অপেক্ষা করছি, কোথায় তুমি।
এই ঠা ঠা গ্রীষ্মে ছাদে যেতে ইচ্ছে করেনা। ছাদ তেতে আগুণ হয়ে আছে। আকাশ পোড়া সরা। তবু ওপরের ঘরটাতেই সে যায়। এই ঘরই তার খাসতালুক। ছাত্রবয়সে সে ব্যাগটা রেখেই হুস্ করে ওপরের ঘরে চলে যেত। ভাই তাই তার নাম লিখেছিল, হুস্। সেই ঘরেই ঢুকে সে একটা বিড়ি ধরায়। বইগুলোয় ধুলো জমেছে। কত বই, কত বাঁধানো পত্রিকা! হাতে এখন টাকা থাকলে সে কাঁচের শার্সি বসিয়ে দিত তাকগুলোতে। যত্নের খুব অভাব। আসা হয়না। এবারে সে একটু যত্ন নেবে। ঘরদোর পরিষ্কার করতে হবে। সে নিজেই করবে। একটু কোমর বাঁধতে হবে। একটা পুরোনো গামছা জোগাড় করে সে বইগুলো ঝাড়তে থাকে। কত ঝাড়া বই সে ফেরৎ পায়নি! সে দু একটার বেশি বই আজ অবধি ঝাড়েনি। কাকে বলবে, লিখিও উহা ফিরৎ চাহ কিনা!
সারাটা জীবন সে নিজেকে ও নিকটদের জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খেয়েছে। এখন নৌকা পুড়িয়ে ঘরে ফিরতে চায়! কিন্তু ঘর! ঘর কোথা! এক দুর্মদ রোদ্দুর ধীরে ধীরে ঘরটা পোড়াতে থাকে। এই ঘরে প্রাক্ যৌবনের একাংশ রয়ে গেছে। অনেক স্মৃতি! তাকে কী পোড়ানো যায়! যায়না বোধহয়।
সত্যি বলতে কী সে ভাবেনি এখানে এসে কী করবে? সে চলে এসেছে না ফিরে এসেছে তা সে জানেনা। তার শুধু মনে হচ্ছে, অনেক ঝুল জমেছে,। পরিষ্কার করতে হবে। ঝাড়ুদার হতে হবে। ছাদের বাগানটা সাজাতে হবে। যত্নআত্তি করতে হবে। আস্ত একটা বাগান আর একটা লাইব্রেরি যার আছে, তার আর কিছুর দরকার নেই। আর হ্যাঁ, খাওয়া-পরা। সেটা চলে যাবে। ভালো খাবার খুব খেতে ইচ্ছা করলে শিপ্রা কেবিনে গিয়ে একটা চপ খেয়ে নেবে। লেখা লিখবে। কাউকে পড়াবে না। খুব বেশী ইচ্ছা করলে না হয় ফেসবুকে একটা পোস্ট দিয়ে দেবে। ব্যাস হয়ে গেল আত্মপ্রকাশ। মজাই তো বেশ।
দিন দ্রুত চলে গিয়ে রাত্রি এল। সে ভাবে সে আজ বাইরে বেরোবে কি না! প্রায় তিনবছর সে এখানে আসেনি। বাড়ির বাইরের গাছপালাগুলো ঘটনাচক্রে একই আছে। বাইরের অগোছালো গাছপালা। প্রকৃতির নিজস্ব যাদুঘর। কিট্ কিট্ কিট্ কিট্ কী একটা পোকা ডাকছে। ডেকেই চলেছে। অলীক নামের বস্তুটিরও মনের মধ্যে এরকমই একটা পোকা যেন সর্বক্ষণ ডাকছে। কী তার বক্তব্য! কী সে চায়, কিছুই বোঝা যায় না। কিন্তু ডেকে চলেছে। সমস্তকিছুর মূলে, সমস্তকিছুর নীচে এরকমই কীট ডেকে চলেছে। পাখা ধড়ফড় করছে। চুপে যাচ্ছে। আবার ডাকছে। অলীক নামের এই বস্তুটি তো নেহাতই সাদাসিধা নিরীহ জীব। বাইরের কে দেখে বলবে, কী কীট আছে ভেতরে, কোন অগ্নুৎপাত, কোন ঝড়, কোন উদ্বেল সমুদ্রপ্রবাহ। শুধু ভেতরে অরিজিনে কীট ডাকছে কিট্ কিট্ কিট্ কিট্। দূরে হালকা একটা হ্যালোজেনের আলো। প্রকৃতির যাদুঘরে অজস্র পলিথিন, আবর্জনা সে দেখতে পেল। চক্চক্ করছে।
চুপচাপ, সে এখন একটু চুপচাপ থাকতে চায়। এই চেয়ার, টেবিল, ঘড়ঘড় করে ঘোরা ফ্যান- সমস্তই সে একটু বুঝে নিতে চায়। সে একটু থকে আছে। জীবনের তালে উত্তালে সে ভিতরে ভিতরে ঘেমে আছে দীর্ঘদিন। সে রক্তাক্ত হয়ে আছে। সে ভালোই জানে কেউ শুশ্রূষায় এগিয়ে আসবে না। পৃথিবীর মানুষেরা উদ্ধারব্রতে ব্রতী নয়। তাদের নিজের নিজের কাজ আছে। খুব নিষ্ঠুর এই খররৌদ্রের পৃথিবী। এ পৃথিবী হিংসাব্রতে, হিংসা যাপনে, হিংসা ব্যবসায়ে লিপ্ত। সে একটু বিশ্রাম চায়, তারপর আবার সে রণানিমিত্ত জেগে উঠতে পারে। প্রায় জেমস বণ্ডের মতো অল ইজ্ সিঙ্গল ইন হিস্ ডোমেইন। একা ওঠা, একা বাজার, একার রান্না। আস্তে আস্তে সে বুঝেছে কোনো ব্যাপারেই কারুর সাহায্য নিয়ে বা প্রত্যাশা করে লাভ নেই। সে দুটো জিনিষ অনেক রক্ত ব্যয় করে শিখেছে। এক, লেখালেখি, দুই হাউ টু সার্ভাইভ অ্যালোন।
এখন একটু নিজের দিকে তাকানো। এখন একটু স্তব্ধতা। যে পাত্রে জীবনের লক্ষ্যগুলি আবার মুখর হতে পারবে।
অনেকক্ষণ বসে থাকতে থাকতে ঘুম এসে যাচ্ছিল। শরীরটা খানিকটা শ্লথ হয়ে এসেছে। ঠ্যাং ছড়িয়ে বসে ছিল চেয়ারে। পরনে প্রিয় পোশাক বারমুডা। ঘুম যেন ছড়িয়ে আছে ঘরটায়। কেমন একটা ঘুমঘুম ঘোরঘোর ভাব। নিজেকে যেন বিছিয়ে দিতে ইচ্ছা করছে ঘরটা জুড়ে। একটু চপমুড়ি খেলে ভালো হত। অলীক ভাবে। কিন্তু ঘরটা খানিক গোছানোর পর যেন সাধকদের ঘর হয়ে রয়েছে। ছড়ানো, ছেটানো। কোনো তাড়া নেই, কোনো ত্বরা নেই। হোটেলে ছুটির ভাব। খানিকটা হাসপাতালের ভাবও বটে। এইখানে এলেই এই ভাবটা হয়, সময় যেন থমকে আছে। যেন অনেক সময় অত্বরভাবে সব কাজ সমাধা করা যাবে। কিন্তু সন্ধ্যা আসছে আসছে ভাব। আকাশের সমুদ্রে রঙ লেগেছে। একটু বেগুনি, গেরুয়া, লাল। নীলের ভাব ফ্যাকসা হয়ে আসছে। পাখিদের ডাকাডাকি শুরু হয়েছে। ছাদে চলে গেলে দেখা যাবে অনেক পাখি পশ্চিমে কোর্টের বটগাছটার দিকে উড়াল দিয়েছে। অনেক বাদুড়। দিন নেমে আসছে। ওদের থাকার জায়গা কমে আসছে। এই পাখিদের দেখলে আজও তার পুলক হয়। আজ ঈর্ষা হল। ওদের একটা সাকিন ঠিকানা আছে। এই পথে
গিয়ে ওরা একই পথে কুলায় ফিরে আসে। অনেকটা চাকরির মতো। এই আর কী!
সে ভাবছিল বিশ্রাম নেবে। কোথাও বেরোবে না। কিন্তু বাড়িতে থাকতে পারল না। কেন পারল না! সুমন্ত একবার বলেছিল, শ্মশানের এক সাধু সম্পর্কে। ওই সাধুকে চোখে চশমা পরে, মাথার জট খোঁপা করে অনেকদিন বসে থাকতে দেখেছিল সে। সেদিন গোবর্ধন যাত্রার মেলা সদরঘাটে। মেয়ে টেয়ে যাচ্ছে। ভিড়। শ্রীমন্ত মিষ্টির দোকানে সাধুকে দেখে বলেছিল “আজকের দিনে ও- ও আর বসে থাকতে পারেনি।” অলীকও বসে থাকতে পারল না। রাস্তায় বেরোতে সে একটু সতর্ক হল। এতদিন পড়ে ফিরে আসা মানে পরাজয়ের ড্রাম মাথায় করে হাঁটা। সে সতর্ক হয়। নিজেই নিজের হাত ধরে হাঁটতে থাকে গলি ধরে। মেঘের ওপারে চাঁদ উঠেছে। ওই চাঁদ নিজেরই শহরে তারই মতো আগন্তুক। ভাবছিল একটা টোটো ধরবে। সে পৃথিবীর সবচেয়ে অথেন্টিক টোটো কোম্পানি। সে ভাবল, সে হাঁটবে। এই শহরের বুকে পরিব্রাজকের মতো হেঁটে বেড়ালে কেমন হয়। বস্তুত, সে তো আগন্তুকই। হাঁটতে থাকে। বাবা সত্তর বছর বয়সেও কী স্পিডে হাঁটত। তার হাঁটা, ধীর, মন্থর। বাবা অনেক লড়াকু ছিল। সে চলেছে দৃশ্য দেখতে দেখতে, শুনতে শুনতে। তার একটাই সমস্যা, সে সবকিছু বুঝতে চায়। যেখানে বোঝার নেই, সেখানেও বুঝতে চায়। তার চরিত্র দর্শকের। সে দেখেই গেল সারাটা জীবন। খুব কোনকিছুর প্রতি ইন্ভল্ভড্ হয়ে পড়া তার ধাতে নেই। কিন্তু হয়ে পড়লে মারাত্মক। তার ধাক্কা এখনও শোধ করছে। হয়ত বাকিজীবন শোধ করতে হবে এভাবেই। একটু দ্রুত হাঁটতে চায় সে। আগন্তুক চাঁদ তার সঙ্গে সঙ্গে যাচ্ছে। সে কালিকলম দোকানে থেমে গেল। একটা পেন কিনবে, পাঁচটাকা দামের বা দশটাকা। এই পেনগুলো তার অস্থাবর সম্পত্তি।
সে খানিকটা শ্রাদ্ধের মুখ নিয়ে ঢুকেছিল বটে। দোকানদার কারো সঙ্গে কথোপকথন করছিল। ফোনে।
“ট্রেন ঢুকেছে?”
“ফেইলড্ ট্রেন ঢুকেছে।”
“না, মেল ট্রেন ঢুকেছে।”
সে কী ভুল শুনল! তাকে দেখেই মেল ট্রেনকে কেন ফেল্ড ট্রেন বলল লোকটা। ছাত্রদশাতেও এর কাছ থেকে পেন কিনেছে সে।
সে জানে সে ভুল শোনেনি। কানের মাথা খায়নি সে। সে জানে পরাজয়ের গুণাগার। খুব সফল হলেও তাকে কিছু না কিছু শুনতে হত। সোসাইটি এইভাবে অপারেট করে। কিন্তু সে শিকারী। সমাজেরই ভেতরে একলা মানুষকে খোঁজে ও খুঁজে পায়। পেয়ে এসেছে বরাবর।
ব্যক্তি বলে কি কিছু আছে এই সমাজে! কোথায় ব্যক্তির রুচি, শিক্ষা, টাকা, পয়সা, চাকরি, বেকারি, ব্যবসা, বিউটি পার্লার- সবই তো প্রোডাক্ট। প্রত্যেকেই প্রোডাক্ট, ফিনিশড্ প্রোডাক্ট হতে চাইছে। তার এক কলেজজীবনের ইঞ্জিনিয়ারিং- এর বন্ধু বলেছিল ডিগ্রি টিগ্রি নিয়ে নিজেকে একটা প্রোডাক্ট হিসেবে বেচব। পরিষ্কার। তখন ক্যাম্পাসিং-এর মরসুম। নিজেকে তখনও এবং এখনও তার প্রোডাক্ট মনে হয়না। চেয়েও পারেনি। ফলে ফিনিশড্ প্রোডাক্ট হওয়া যায়নি। বাজারে তার মূল্য কমতে কমতে শূণ্য হতে চলেছে। সেই জন্যই সে এখানে ফিরে এসেছে। বিশ্রাম নিতে। তা আজীবনের বিশ্রামও হতে পারে। দেখা যাক। সে নিজের জীবনকে দেখে পর্যালোচনা করে বুঝেছে, সামাজিক জীবনের বাইরেই থাকে এক ‘স্বাভাবিক’ মানুষ। ‘স্বাভাবিক’ মানুষ। প্রাকৃতিক বা ঈশ্বরিক কিছু। যেখানে দিনের পরে দিন কাটে। আলো আসে, আলো নেভে, আবার আলো জ্বলে ওঠে। যেখানে সময় দিন, ঘণ্টা, মিনিট, সেকেণ্ডে বিভক্ত নয়। সেই নীরবতা ও নিঃসময় তার সঙ্গে আজীবন ছিল। আজীবন থাক, তাইই সে চায়। সেই সময়টাই সৃজনের সৈকত। সময়প্রবাহের পথের পাশে বসে গান গায় রাত্রির পাগল। শুধু সমুদ্র, আর সমুদ্র। পাশে এক ক্ষীণ বেলাভূমি। সেখানেই আসল তুমি থাকো।
পাঠক, আমি ভোরবেলায় বসে ওই শহরের রাত্রির বর্ণনা করতে পারব না। আমি ঊনকবি, ঊনলেখক, ঊনমানুষ। তবু বলি, অলীক দেখল, এক উড়নচণ্ডী হাওয়া বইছে শহরের বুকে। অনেক কিছু ভেঙে পড়েছে। নিত্যনতুন ইমারত, ফ্ল্যাটও হচ্ছে। নিত্যনতুন দোকান। খানিক উন্নয়নের ফলে একরাশ নতুন চাকরিজীবীতে মফঃস্বল ভরে গেছে। তাদের হাতেই টাকা আছে। তারাই দোকানগুলোকে ভরিয়ে রেখেছে, চালু রেখেছে, তারাই খদ্দের। খোলনলচে বদলে বদলে এক নতুন মফঃস্বল হচ্ছে। মোটরবাইক চিরদিনই ছিল, এখন সবসময় রেস হচ্ছে। একটা মোটরসাইকেল হু হু করে চলে গেলে তার রেশ অনেকক্ষণ রয়ে যাচ্ছে। তার আগেই আর একটা, দুটো-তিনটে। মোটর সাইকেল স্ট্যাটাস সিম্বল। গাড়িও প্রচুর। কোথায় সেই টিমটিমে চল্লিশ- ওয়াটের ল্যাম্প। কোথায় সাইকেল- ভ্রমণ আর দু-বিনুনী মেয়েরা। সব হট্, শট্, ঝাঁ চকচকে। অলীক ভেবেই রেখেছিল, তবু মনখারাপ আটকাতে পারল না।
এখন সে খাদ্যের সন্ধানে বেরিয়েছে। খাদ্যাখাদ্য ভেদ নেই তার। একটা টোটো সামনে এল। থামল। এই টোটো গাড়ি তার খুব ভালো লাগে। নামটাও সুন্দর। টোটো। বেশীরভাগ সময় ফাঁকা থাকে। বেশ রাজসিংহাসন মনে হয়। অসম্ভব হালকা গাড়িটা। প্রায়ই উল্টে যায়। আবার ধরাধরি করে সকলে তোলে। এরকম হালকা যদি মনটা হতে পারত। বেশ তাজা, ফুরফুরে। অনেকদিন গেছেও তার ওইরকম। সেইজন্যই হয়ত ভাগ্য তার শোধ নিচ্ছে। পুরোনো লোকেরা জিজ্ঞাসা করে তুমি এমন ঝিমিয়ে গেলে কেন? কী উত্তর দেবে? উপদেশ ঝেড়ে তারা বেরিয়ে যায়। তাই সেও বেরিয়ে এসেছে। এখানে যদি শুভার্থীর ভিড় একটু কম হয়। কিন্তু সুধীজন, জীবনে অর্থ, কীর্তি, সফলতাই সব নয়। আসল, বুকের গভীরে, নিজেকে নিজে, জীবনকে তুমি কীভাবে বুঝলে, জানলে, অনুভব করলে। তা ছেঁড়া সাদা পাতায় লেখা থাকবে, হাজার অপমানেও মুছে দিতে পারবে না।
সে ভাবে এখানেই থাকতে এসেছে সে। অথচ সদাসর্বদা মনের মধ্যে শঙ্কা, আশঙ্কা। এই বুঝি পুরোনো কারুর সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। তাকে দেখে তাদের মনে বাঁকা চাঁদের মতো হাসি ফুটে ওঠে। অবশ্য অলীক ভাবে, মানুষকে খুশি করার, খুশি দেখার একটা আলাদা আনন্দ আছে। সবসময়ই আছে। বস্তুত এসমস্তই সে হাড়ে হাড়ে চিনে গেছে। সবকিছু বাদ দিয়ে বা সবকিছু ঝেড়ে ফেলে সে ভাঙতে ভাঙতে এমন একটা জায়গায় পৌঁছতে চায় বা পৌঁছেছে, যাকে আর ভাঙা যায় না। যাকে আগুনে পোড়ানো যায় না, জলে ভেজানো যায় না, বাতাসে শুকোনো যায় না, সর্বোপরি যাকে আর অপমান করা যায় না। সেই অ্যাটমটা সে খুঁজছে। সেই অ্যাটমটা সে হতে চায়, যাকে আর ভাঙলে বিস্ফোরণ হবে। নাঃ, সে সেটাও চায় না। যে যতই পাক, পরিণত মানুষ বড় দুঃখে আছে এদেশে, আগে সেই দুঃখ কিছু ঘুচুক।
ভাবতে ভাবতে সে গঙ্গার ধার অবধি এসে গেছিল। এটা সদরঘাট, ফলে স্মৃতি। একটু পথ ঘুরে সে গঙ্গার দিকে গেল। গান বাজছে, “আকুল মন, কাঁপে তরাসে।” কারণ সন্ধ্যা নেমে এসেছে। সেই সাইকেলের, সাইকেল ফেলে আসার দিনগুলো আর নেই। সাইকেল যথাস্থানে যে সে কীভাবে পেতো। হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে ফেরত নিয়ে চলে আসত। এটা স্থানমাহাত্ম্য। সেই স্থানমাহাত্ম্যের কিছু অবশিষ্ট আছে কীনা দেখতে সে গঙ্গার দিকে তাকালো। অন্ধকারেও বোঝা যায় চলোর্মি বয়ে চলেছে। বড় শান্তি লাগে। সে হেঁটে গিয়ে পাতা ডোবানো জলে দাঁড়ালো। গঙ্গার জল হাতে মাথায় দিয়ে ঘাটের উপরে উঠে এল। ঘাট পিছল। সাবধানে উঠে আসতে হয়। এবার একটা সরু কালভার্টে বসে চুপচাপ জলের দিকে তাকিয়ে থাকা। যেন এটুকুর জন্যই সে এখানে এসেছে। পাশে যে যার মতো ফোনালাপ করছে। সে কিছু শুনছে, কিছু শুনছে না।
হঠাৎ সে বিপ্লবকে দেখল। অন্ধকারে একটু সরে বসল সে। পরিচিত কারুর সঙ্গে দেখা হোক সে চায় না। চায় না তার অস্থিরতা কোথাও প্রকাশ পাক। এই অস্থিরতা থেকে বিরতি নিতেই সে এখানে, এইখানে, গঙ্গার ধারে এসেছে। গঙ্গা চলোর্মি, স্বতঃসিদ্ধ তার সমুদ্রাভিসার কোথাও আটকায় না। এখানে একটা লাইব্রেরি করলে হয় না? প্রায় বইএর দোকান আছে তার। একটা লাইব্রেরি খুলে বসা যায়। সামান্য টাকার বিনিময়ে যে কেউ এসে বই পড়তে পারে। ভাঙাচোরা ল্যাপটপটা বসিয়ে রাখা যায়, কেউ ভালো সিনেমা দেখতে পারে। একটা সামাজিক কাজও হল। এলাকার উন্নতিকল্পে। এত সামাজিক তুমি? অলীক না হেসে পারে না। তার খুব অসহায় লাগে, সব ছাড়তে এসেও তার মস্তিষ্ক ফিকির ভাঁজছে। বিড়ম্বনা ছাড়া আর কী!
গাড়িতে করে এসেছে সে। ভাবল ফেরার পথটা সে হেঁটেই যাবে। হাঁটতে ইচ্ছা করেনা। সে কেন বাবার মত হাঁটতে পারে না। কি দ্রুতগতির লোকটা! সে বরাবর পিছিয়ে পড়ত। তাল রাখতে পারত না। কিন্তু হেঁটে যাওয়া ভালো। সেই হাইস্কুল, অবশেষে পেরিয়ে সোজা হেঁটে আর এক হাইস্কুলের পাশ দিয়ে সে গলির মুখে পৌঁছল। এবার নিশ্চিন্তে হাঁটতে হাঁটতে সে বাড়ির দিকে যেতে লাগল। অন্ধকারে মনে হল রূপেন দাঁড়িয়ে আছে। রূপেন না, রূপেনই তো! সে আর দেখলনা। ভালোই। বাকী পথটুকু যেতে হবে। ওইতো বাড়ি। বাড়ির সামনে এসে সে কিছুক্ষণ থামল। কত যত্নের এই বাড়ি। কি পরিশ্রম আর স্বপ্নে তৈরি। এই বাড়ি এক জাহাজের মত। সে নিঃসঙ্গ নাবিক। জাহাজ ছাড়তে চায়না সে। চিরকাল যে ল্যাদ তার ছিল, আজ ঝিমুনিতে দাঁড়িয়েছে। সে এখন এই একমাত্র ছাদটার নিচে কিছুক্ষণ ঝিমোতে চায়। কিন্তু ঝিমোতে কী পারবে সে? সাড়ে উনিশটা বছর মহানগরীতে কাটানোর পর সে নগরীর কীট হয়ে গেছে। অথচ হতে চেয়েছিল উড্ডীন পারাবতকূলের একজন। আকাশের দেবতা। সেই আকাশসন্ধান তাকে কুয়োয় এনে ফেলেছে। শেষ কৈশোরের সেই দিনগুলিতে সে যদি জানত, এমনটা হয়। এমনটা হতে পারে। তবে নিজেকে সে অন্যভাবে সাজাত। জীবনকে সে অন্য আকার দিতে চেষ্টা করত। আজ সব পিছলে গেছে। আচ্ছা এরকম কী হতে পারে! হওয়া সম্ভব যে জীবনই আস্তে আস্তে গড়ে নিল তাকে। একদম মাপসই, শক্তপোক্ত করে। কিন্তু ক্রমাগত বাঁশ নিয়ে চলা, দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর বাঁশের আয়োজন ছাড়া জীবন তো অন্যকিছু নয়। আশ্চর্য বাগানের ওপারে যে কুয়াশাঘেরা সূর্যাস্ত সে দেখেছিল। তা তাহলে কী ছিল?
মাঝেমাঝে মনে হয়, এই ক্ষয়ার্ত আয়োজন, এই বিভীষিকার মধ্যে থেকে এক টুকরো ছবি, একটু গান যে চুরি করে আনতে পারে সেই কিছুটা পারল। পুরষ্কার হৃদয়ে ঈগলচঞ্চু। কারণ সে প্রমিথিউস, স্বর্গের আগুন সে চুরি করে এনেছে। সে ভাবে- “হৃদয়ে প্রেমের গান স্তব্ধ হয়ে গেলে……”। কীট্ কীট্ কীট্ কীট্ সেই পোকাটা আবার ডাকতে শুরু করেছে।
পোকাটিকে সে খুঁজতে চেষ্টা করল বাইরের বনের মধ্যে। বন নয়, আগাছাসম্ভার। তার মধ্যেই শব্দের উৎস ধরে সে লোকেট করার চেষ্টা করে জায়গাটা। শব্দ হয় কীট্ কীট্ কীট্ কীট্। সে প্রায় ছুটে ওপরে যায়। চাবি দিয়ে দরজা খুলে ছাদে যায়। কই আর তো কেউ ডাকছে না।
এবারে এই প্রথমবার আকাশের দিকে তাকায়। কুতকুতে এক চাঁদ একদিকে। অন্যদিকে আকাশের গায়ে চক-খড়ি দিয়ে কে যেন এক সিংহের ছবি এঁকে রেখেছে। সিংহরাশি। কিছুক্ষণ বিহ্বল হয়ে একটা আবেশ আসে। কত ক্ষুদ্র ও সামান্য সে এই মহাবিশ্বে। তবু এরই অংশ। অদ্ভুত এক আনন্দে তার গা রোমাঞ্চিত হয়। নেমে আসতে ইচ্ছা করে না।
সকাল হয়েছে। গা টা কেন জানি জ্বালা করছিল। গরম জলে স্নান করতে হবে। এই জ্বালা ধরা ব্যাপারটা নতুন। বড়মামা, ছোটমামার গা জ্বলতে থাকে। গরম জলে ধুয়ে নিলে চলে যায়। স্নান করতে হবে। এই ফ্যামিলির যেখানে যতটুকু খারাপ, তা কী কেবল আমারই ভাগে পড়েছে। রক্তের রোগ, মানসিক রোগ, অ্যালার্জি। সমস্ত, সব, সব।
কিন্তু তার আগে নিয়োগীর দোকানে গরম গরম ডালপুরি হলে ভালো হয়। বস্তুত বিগত দশবছরে সে নিশুতিপুরে এসেছে শুধুমাত্র খাওয়ার জন্য। এখানে এমন খাবার আছে যা কলকাতায় পাবে না। পাকুড়তলার সিঙাড়া, নিয়োগীর ডালপুরি, প্রশান্তর দোকানের চপ, ভবেশের দই- আহা! বোধহয় এই খাদ্য বা সুখাদ্যগুলোই একটা শহরকে বেঁধে রাখে। কলকাতাতেও আছে দ্বারিকের মিষ্টি, মোল্লারচকের দই, বসন্তকেবিনের কাটলেট, গোলবাড়ির কষা মাংস। তবে সে সমস্ত আন্তর্জাতিক। আন্তর্জাতিকের সীমানার বাইরেও কতকিছু থাকে! বহুজাতিক পুঁজি এখন গ্লোবাল হয়ে এই জায়গাতেও ঢুকে পড়তে চাইছে। ধরে ফেলতে চাইছে। বেশ কিছু রেস্তোরাঁ এবং তিনটে শপিং মল এ শহরে গজিয়ে উঠেছে। চপের বদলে পকোড়া। মোমো। তবু কী! গঙ্গার বাতাসটা থাকার ফলে এই শহর চপ ছাড়তে পারছে না।
ব্যাগ থেকে ব্রাশ আর পেস্টটা বের করে, একটু আয়নাটা মুছছে। ঠিক আছে সময় লাগুক না। এখন তো অনেক সময়, সময় আছে হাতে।
একটা টোটো ধরে নেয়। নিয়োগীর দোকান যেতে দু-মিনিট লাগবে, যে সময়ে একটা ম্যাগী হয়ে যায়। দোকানটার বাইরের দিকটা সেই কুড়ি বছর আগের মতোই আছে। ভেতরে অবশ্য সানমাইকা বসানো। দেখবার বিষয়, জলের কলটা ঠিক যে জায়গায় ছিল, সে জায়গাতেই আছে। এতটুকু নড়েনি। দেখে ভরসা পেল। কালের কলপ্রবাহে তাহলে কিছু কিছু জিনিস একই থাকে। নড়ানো যায় না।
পরপর সাতটা ডালপুরি সে পেটে চালান করল। খিদেটা খুব বেশী পেয়েছে। একজন পাশের অন্ধকারে কালো হয়ে যাওয়া গুমটি ঘরে বসে তাল তাল ময়দা মাখছে।
আরো দু-চারজন বসে খাচ্ছিল। কিছু কিছু কথা কানে আসছিল।
“ও এখন সব জমি কিনে লিবে।”
“কে?”
“ওই যে হোসেন।”
“হোসেন সব জমি লিয়ে লিবে। টাকা দেদার, বুঝলা!”
“টাউনের সব জমি ওর।
বেরিয়ে যথারীতি সে হেঁটে ফেরার সিদ্ধান্ত নিল। সিদ্ধান্ত নিতে হল না, ভরাপেটে তার হেলেদুলে যাওয়ার ইচ্ছা স্বাভাবিক ভাবেই এল। ওই তো খাদিমসে্র জুতোর দোকান, ওই তো দরবেশপাড়া, ওই তো ঠাকুরদালান, আহা কী সুন্দর ডাকের সাজের ঠাকুর হত এখানে, এখনও হয়। ঠাকুরদালানের পাশে বড় করে ‘গোপনে মদ ছাড়ান’-এর বিজ্ঞাপন। তারই পাশে ছোট্ট একটা বিজ্ঞাপন- ‘খালি জায়গা ও বাড়ি খরিদ করিতে চাই, যোগাযোগ……..।’ চমকে গেল সে এই অবাক বিজ্ঞাপনটা দেখে। অসাধারণ বলা যায় না ঠিক, কিন্তু বেশ আনইউজুয়াল বিজ্ঞাপন।
হাঁটতে হাঁটতে তার মাথার মধ্যে বিজ্ঞাপন বুজকুড়ি কাটছে। নাকি মাথায় দেওয়ার মতো কিছু নেই বলেই কথাটা ফিরে ফিরে আসছে। ‘খালি জায়গা, খালি বাড়ি খরিদ করতে চাই।’ অনেকটা ‘দিবারাত্র ফটো তোলা হয়’ টাইপের। কাব্যিক। এর মধ্যে কবিতা লুকিয়ে আছে।
বাড়ির কাছে পৌঁছতে দেখল আবার সেই বিজ্ঞাপন। ‘দিবারাত্র ফটো তোলা হয়’ অর্থাৎ ‘ফাঁকা ও খালি জমি ও বাড়ি খরিদ করিতে চাই।’ আশ্চর্য, সে খানিকটা চমকে গেল। অর্থাৎ, বিজ্ঞাপনটা জায়গায় জায়গায় লাগানো হয়েছে, এবং বয়ান একটু করে বদলে যাচ্ছে। এ দুটোই শেষ বয়ান হয়ত। সে না ভেবে পারল না যে সামনে তৃপ্তিমাসিদের অতবড় জায়গাটা বিক্রি হয়ে গেছে। রাতারাতি ভেঙে সেখানে ঢালাই শুরু হয়েছে। আশ্চর্য!
হাঁটতে হাঁটতে সে বাড়ি ফেরে। আশ্চর্য। দিনের বেলায় বাড়িটা সাদামাটা বাড়িই মনে হচ্ছে। আদৌ জাহাজ মনে হচ্ছে না। চারিদিকে আরও বাড়ি। তার মধ্যে টিলার মতো বাড়িটা উঁচু হয়ে আছে কেবল। কেউ বলবেনা, জ্যোৎস্নায় ছাদে পরী নেমে আসে। আকাশখসা এক আধটা গান শিশির হয়ে টবে জমে। ডেক, মাস্তুল ও যন্ত্রঘর সহ সময়ের সমুদ্রে এই বাড়ি পাড়ি দেয়। ওঃ না, সব তো কল্পনা।
সে ভাবতে থাকল, আর এখানে কতদিন থাকবে? থাকা যাবে এখানে! একদম একা হয়ে কী থাকা যায়? তাকে তো লোকজনের সঙ্গে, সমাজের সঙ্গে লিংকড্ হতে হবে। ভাবামাত্র সে নীলোৎপলকে একটা ফোন করে। ফোন বিজি। ফলে কেটে দেয় ফোনটা। সমস্তকিছুই ঠিক প্রসেসে হয় না। আচমকা আপতিক অনেক কিছু ঘটে জীবনে। সেগুলোর জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়। কিন্তু কীভাবে একটা মানুষ সদাপ্রস্তুত থাকবে, সেই হল প্রশ্ন। সম্ভব! সদা বাঁশের জন্য অপেক্ষা, প্রস্তুতি ইত্যাদি। সদাপ্রস্তুত হয়ে থাকা যায় না। বিশেষ করে সে দেখেছে, যে ক্রিয়েটিভ, তাকে বীর হতেই হয়। ওই বীরতাই অনেককিছু রিসিভ করতে সাহায্য করে। অনেক কিছু বুঝতে, ভাবতে সাহায্য করে। আর ভাবনাচিন্তা ছাড়া কি লেখা যায়, না ফিল্ম বানানো যায় না গান পাওয়া যায়। যায় না। নিজের শ্লথতা নিয়ে অনেক ভেবেছে সে বুড়ো কচ্ছপের মত। শেষে ফয়সালা হয়ে গেছে, সে স্লো, স্লো-ই থাকবে। স্লো বাট নট স্টেডি থেকে স্লো বাট স্টেডিতে নিয়ে আসতে হবে নিজেকে। এটুকুই সে নিজের জন্য করতে চায়। তারপর আসুক দিনান্ত।
জীবনে জয়লাভের স্বাদ সেও মাঝেমধ্যে পেয়েছে। লোকের তেরছা উক্তি এবং ঘৃণা তার থেকে এসেছে। আবার আজ যে জীবন সে বেছে নিতে চাইছে, তা এক ধূসর পরাজয়ের জীবন, তার মধ্যে উদ্বেগ নেই, কিন্তু নানানভাবে সে কটূক্তি, ইশারা ফেস করছে, করতে হবে।
তাহলে বিষয়টা কী দাঁড়াল। তুমি যাই কর, সমাজ সমঝে দিতে চাইবে। বিষয়টা দুঃখের হলেও সংক্ষেপে হাস্যকর। কিন্তু এরকম হাসি সে বেশিদিন হাসতে চায় না। নিজের ও সমাজের ব্যাধিগুলোর চিকিৎসা দরকার। কে পারবে? পারলে কোন কবিই পারবে। কিন্তু অজস্র কবিতা লিখলেই, সে কবি, বা কবি হয়ে উঠেছে, একথা ভাবলেই হাসিই পায়। আর কিছু না। নদী, নদীটার জন্য এই শহরে থেকে যেতে ইচ্ছে হয়। সত্যি কথা বলতে কি গঙ্গা ছাড়া সে বেশিদিন থাকতে পারে না। চলোর্মি প্রবাহিত। কলকাতাতেও গঙ্গা আছে। প্রতিবার বাস থেকে যখন দেখে ওই বিস্তৃত গঙ্গাকে সে প্রণাম না করে পারে না। এটা সংস্কার। আসলে বড় কিছুর কাছে নত হওয়াতে আনন্দ রয়েছে। বাড়ি, আত্মীয়ের পুজো- পার্বণে সে যায় না। কিন্তু সে ভাবে যদি অন্তত কোনোকিছুর প্রতি ভক্তি না থাকে, মানুষের জীবনে যদি অর্চনা না থাকে, তবে কিরকম কিম্ভূত হয়ে উঠবে সেই জীবন? কোন এক সাধনা দরকার, পূজা দরকার জীবন, নরনারীর প্রেমের চেয়েও অনেক আস্বাদ্য স্টেবল ভাব হল ভক্তি। কিন্তু অন্ধভক্তি নয়। এখানেই মানুষ ডোবে। সাধে কী প্রথম গ্র্যাজুয়েট বঙ্কিমচন্দ্র থেকে নিরক্ষর রামকৃষ্ণদেব সকলেই ভক্তির আশ্রয় নিয়েছিলেন উনিশ শতকে। হয়ত এই ভক্তির মধ্যেই লুকিয়ে আছে অ- কলোনিয়াল চিন্তনের রসদ। কে জানে! নাও হতে পারে।
নিজেকে ফেলে ছড়িয়ে এসমস্ত ভাবতে বড় ভালো লাগে। ‘আমার কী আক্কেল হবে না’- মনে মনে সে আওড়ায়।
দিনে দুপুরে একটা লোক। রাস্তায় বসে থাকছে আজ দুদিন। উটকো লোক যেন। একমুখ দাড়িগোঁফ। একটা জামা, সাদা, কিন্তু কালো বলে মনে হচ্ছে। রাস্তার উপর, কখনও কালভার্টে বসে থাকছে। আজকে দেখল, তাদের বাড়ির সিঁড়িতে বসে আছে। জটমাথা মাটির দিকে ঝোঁকানো। বসে বসে দুলছে আবার স্থির হচ্ছে। এক বিমর্ষ শকুন যেন বসে আছে বাড়ির উঠোনে।
অলীকের দেখে খুব খারাপ লাগছিল। কষ্ট হচ্ছিল ভিতরে। সে নিজেও ভুগেছে, ভুগছে এই রোগে। সিজোফ্রেনিয়া। আজকের পৃথিবীর রাজরোগ। এর চেয়ে খারাপ রোগ বোধহয় পৃথিবীতে আর দু-একটাই আছে। তার দুটো পাউরুটি ছিল প্যাকেটে।
সে প্যাকেটশুদ্ধ তার কাছে নিয়ে বলল, “খাবে? খিদে পেয়েছে?”
পাগলটা একবার তার দিকে তাকাল, খুব জিজ্ঞাসাভরা চোখে। তারপর, হাতছুঁড়ে রুটিটা ফেলে দিল।
নিশুতিপুরের পাগল খ্যাপানোর ঐতিহ্য সুদীর্ঘকালের। সে ছোটবেলা থেকে দেখে আসছে। এক ছিল আশার মা নেংড়ি, তাকে নিয়ে কত রগড়। সে নিজেও এককালে ওই রগড় উপভোগই করেছে। একটু করে খ্যাপানো হত আশার জন্মরহস্য ইত্যাদি নিয়ে। আর নেংড়ি ক্ষেপে যেত। অকথ্য গালাগাল দিত, আর সেই মজায় লোক আহ্লাদিত হয়ে উঠত। তারপর ইঁট ছুঁড়ত নেংড়ি। তখন বাবুরা একে একে বিদায় নিতেন।
ছিল প্রবোধ, পোবধ্যা। একটু অপ্রকৃতিস্থ, ধুলোমলিন জামাকাপড়। মাথায় উস্কোখুস্কো সাদা চুল। যেকোনো নিমন্ত্রণবাড়িতে হাজির। একদম ফার্স্ট ব্যাচ। তার খাওয়া থেকে শুরু করে হাত ধোওয়া অব্দি বহু মানুষের সহাস্য অবলোকন ও টীকাটিপ্পনি চলত।
এক ছিল মামলাখ্যাপা। সে সব কথার শেষেই বলত, ‘বুদ্ধি করে, চিন্তা করে’ করতে হবে। ওফ্, তাকে নিয়ে কী রগড়!
একজনের তো রাস্তার মাঝে লুঙ্গি খুলে নেওয়া হয়েছিল। অর্থাৎ, মানসিক রোগের প্রাথমিক লক্ষণ দেখা দিলেই সদলবলে তাকে বাড়িয়ে তোলা, তাকে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করা- এই সমাজের কাজ। নিশুতিপুরে এই ট্র্যাডিশন খুব বেশি করেই আছে।
এখন এই পাগলটাকে নিয়ে কী করে সে? নাম কী, বাড়ি কোথায়- সব জিজ্ঞাসা করে কোনো উত্তর পায় না। সে উকুন মারতে ব্যস্ত। দুএকবার হেসেও উঠল। কী আর করা যাবে ভেবে, সে বাড়িতে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। পাম্প চালানো যাবেনা, এখন মিউনিসিপ্যালিটির জল আসে। পরিশোধিত গঙ্গার জল। তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। কাজ করতে হবে। চা তৈরি হয়নি এখনও। সিটিসি চা আছে। আগে এই বাড়িতে দার্জিলিং চা-এর সঙ্গে সিটিসি চায়ের মিশেল দেওয়া থাকত। সেসব দিন গেছে। আসলে মা-বাবা দুজনেই খুব চা-খোর ছিল। চায়ের নেশাটা সেখান থেকেই। মা-বাবার মধ্যে যে সহজ- স্বাভাবিক সম্মানের সম্পর্ক ছিল, তা’ই যেন সে খুঁজছে নিজের জন্য।
পরে বোঝা গেল ওটা পাওয়া যাবে না এই একবিংশ শতাব্দীতে। সেটা বুঝে যাওয়ার পর সেসব চিন্তা ছেড়ে দিয়েছে। যা আছি, ঠিক আছি। “এটা বারবার ভাববে।” মা বলত। এখন অত চাওয়া-পাওয়ার ভাবনা মাথায় আসেনা। পৃথিবীতে আসলে কোন সমস্যা নেই। একমাত্র সমস্যা মানুষ। মানুষ আর তার রিপুসমূহ। পোকার মতো পৃথিবীটাকে শেষ করার আয়োজনে রত তারা। মানুষ নামের পোকাটি ডাকছে- কিট্ কিট্ কিট্ কিট্।
দুপুরে দরজা খুলে সেই পাগলটিকে আর দেখতে পেল না। বাপ্, এত রকম পাগল আছে পৃথিবীতে, কাব্যোন্মাদ, দিব্যোন্মাদ, অর্থোন্মাদ, প্রেমোন্মাদ। তুই সেসব ছেড়ে এই দশায় কেন এলি? কী কষ্ট ছিল এত জীবনে? অত কষ্ট পেতে নেই কোন কিছুতে জানিসনা! বুদ্ধিমানরা জানে। তারা সব জানে, তারা প্র্যাকটিকাল। কিন্তু জানে না তারাও একদিন মরে যাবে, এ পৃথিবীতে। চালাক সবই বোঝে, শুধু বোঝেনা, তার চালাকি সবাই ধরতে পারছে।
যাই হোক, ক্ষোভ পুষে, গ্রাজ্ পুষে লাভ নেই। যা হবার হয়েছে, যা হবার হবে। সে শুধু নির্লিপ্ত দর্শক হতে চায়। কিন্তু সমাজ কী তা মেনে নেবে?
সমাজ সমাজ সমাজ। সমাজের চরিত্র বুঝতে একটা ডিসিপ্লিন দাঁড়িয়ে গেল। কিন্তু সমাজ জটিল হলেও এর কোড নির্দিষ্ট। কোডগুলো কেউ বলে দেয় না, দিলে ভালো হত। কিন্তু কোড ব্রেক হয়ে গেলেও সমাজের মাথা থেকে পা পর্যন্ত এক ভাষায় কথা বলতে থাকে। সেখানে কোন শ্রেণিচেতনা কাজ করে না। হাই ক্লাস, মিডল ক্লাস, লোয়ার ক্লাস সকলেই একই ভাষায় চলে। কথা বলে। অথবা, বলে না। ইঙ্গিত করে ও একটা কথা বুঝিয়ে দেয়- “তোমার জীবন আমরা হেল করে দেব।”
অনেক যুঝেও শেষ পর্যন্ত না পেরে সে এখানে পালিয়ে এসেছে। ফিরে যেতে হলে শক্তিসঞ্চয় করে ফিরে যেতে হবে। একটু, সাময়িক হলেও নিশ্চিন্তি দরকার। যে নিশ্চিন্তের ভেতর সে কদিন থাকবে। একটু ঢিলেঢালা, একটু শান্ত হয়ে আসবে সবকিছু, জীবনটা। শান্ত জলে নিজের ছায়া দেখা যাবে। জীবন গোছানোর আগে, নিজের চিন্তাগুলোকে এবং নিজেকে সে গুছিয়ে নিতে চায়।
আর একটা ব্যাপার। সেল্ফ অ্যাফিশিয়েন্ট হবার ব্যাপারটা। সেটা হতে হচ্ছে এবং হবে। কাচাকুচি থেকে পড়াশুনা। সবটাই নিজেরটা নিজেকে করতে হবে। যতসময় লাগে লাগুক। দেখা যাক।
একেকটা সময় সব তছনছ করে দিতে পারে। তার ব্যাক্তিত্বের মধ্যে একটা তছনছ আছে অনেকেই বলেছে। কারণ লেখায় তছনছটা ভালভাবেই ফুটে ওঠে। এই তছনছটা তাকে গাড্ডায় নিয়ে গিয়ে ফেলল। একটা সময় নিজেকে ছিঁড়ে, কেটে, ফুটিফাটা করে, চুরমার করে সে দেখছে। ওই বয়সটাই বোধহয় তাই। “আর কিছু না থাক্, ইগো আছে ষোলো আনা।” রুমকি বলেছিল। রুমকির এই কথাটা কেন জানি আবার মনে পড়ল। সেসব গতজন্মের কথা। বা আরও অনেকজন্ম আগের কথা। প্রথম বই বেরোনোরও আগের। সমাজে সত্যিই সে ব্যর্থ, কিন্তু একজীবনে কটাজীবন সে কাটালো তাই ভাবে।
আসলে কোয়ালিটি অফ লাইফ, এটা অনুভবসাপেক্ষ, প্রধানতঃ বস্তুগত নয়। একটা বস্তুগত ভিত্তি তার দরকার, কিন্তু সেটুকুই, তার বেশী নয়। সে কী ভাববাদী? প্রশ্ন করে নিজেকে। থাক। অত নাই বা জানলাম। তবে বস্তুবাদ মানুষকে কোথাও পৌঁছে দিতে পারে না, একথা সত্যি।
পাগলটা আজকে আবার দেখা দিয়েছে।
এই গলিতে ওর কি আছে কে জানে!
ঢলা আলখাল্লার মত একটা পোশাক। ধূলিধূসরিত আঁশটে গন্ধ ছাড়া একটা পাজামা।
ত্রিকোণ মুখ। মাথায় জটা।
মনে হয় এককালে ও কবি ছিল।
ইচ্ছে হল ওকে গিয়ে জিজ্ঞেস করে আবার কিছু লিখবে নাকি?
কিন্তু সে সব না বলে অলীক বাজারের ব্যাগটা নিয়ে হনহন করে পাশ দিয়ে হেঁটে গেল।
একটা বোঁটকা গন্ধ এল নাকে।
খুব দুঃখের, অসহায়তার একটা অনুভব হল। মনে হল কাকে? কাকে তোমরা তবে বাঁচাতে পারলে? নিজেকে সুদ্ধু সে জিজ্ঞেস করে, এত অহংকার তবে কীসের?
বাজারের ব্যাগটা ঠিক বাজারের উদ্দেশ্যে নয়। সকালে যে তরকারিওয়ালা ফেরি করতে আসে, তার কাছেই তরকারি রেখেছে সে। চারটে ডিমও কিনে রেখেছে সামনের দোকান থেকে। সে একটু কম্পিউটার ধাবায় যাবে। একটু ফেসবুকটা খুলে দেখবে কে আছে কেমন, তারপর বন্ধ করে দেবে। আর কমপিউটারে বোল্ড করে একটা বাংলা বিজ্ঞাপন লিখে ছাপিয়ে নেবে। তারপর কুড়ি কপি জেরক্স। “বাড়ির নীচতলা ভাড়া দেওয়া হবে। দুটি ঘর, ডাইনিং, পায়খানা, বাথরুম- ফোন-……..।” একটু হুট করেই সিদ্ধান্তটা নিল অলীক। এখানে সে থাকুক আর নাই থাকুক। ভাড়াটা পেলে কিছুটা সুরাহা হয়। সেই ভেবে কাজ বিশেষ সে করতে চায় না। কারণ, কাজের সূত্রে সেই উন্নতির প্রশ্ন, সেই প্রতিযোগিতা- আবার সমাজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়তে হবে। এভাবে কী থাকা যায়! দেখা যাক! অর্থাৎ, অলীক নেহাত বাধ্যের মতো আর একটি নতুন এক্সপেরিমেন্টের মধ্যে যাচ্ছে।
অর্থাৎ, বিজ্ঞাপনটা সাধু থেকে মুখের লব্জে পোঁছে গেছে। ভালোই লাগল তার। ফাঁকা বাড়ি তারও আছে ভেবে বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল হঠাৎ। যাক্গে, এসব ছ্যাঁত করে ওঠায় তার অভ্যাস আছে। নিজেকে এর জন্য বা এসবের জন্য প্রস্তুত রাখতে হয়েছে দীর্ঘদিন। সে হাঁটতে থাকল। দরবেশপাড়ার মোড়ে এসে ডানদিকে বাঁক নিল।
পরপর জামাকাপড়ের দোকান, জুতোর দোকান, শাড়ির দোকান। তারপর সেই ডালপুরির দোকান। দু-চারটে ডালপুরি খেয়ে নেবে কী সে? নাঃ, টেনশন থাকলে খাওয়া হয় না। সে এবার বাঁদিকে সোজা হাঁটতে রূপশ্রী স্টুডিও। তার পাশে খোকনের দোকান।
খোকন বিভিন্ন রকম মানুষের অফিসিয়াল কাজ উদ্ধার করে দেয়। বিবিধ ফর্ম ফিলাপ। বুঝে শুনে টাকা নেয়। ফলে তার কাছে সবসময় দীর্ঘ লাইন থাকে। কিন্তু আজ অন্য কম্পিউটারগুলো ফাঁকা ছিল। একটাতে বসে সে বোল্ড হরফে বিজ্ঞাপনটা লিখে ফেলল। তারপর একটা প্রিন্ট বার করা। এরপর জেরক্স। এখন জেরক্সের জন্য বসে থাকতে হবে। দুজন আছেন। এক ভদ্রলোক টাকমাথা, সাধারণ শার্ট পরা, তার কাজটাই এখন হচ্ছে। অন্যজন মুসলিম গৃহবধূ। মাথায় কাপড় দেওয়া। একটা বোরখাজাতীয় পোশাক পরে এসেছেন। অনেকক্ষণ ধরে তারা বসে আছে। খোকন কী খুটখাট করে।
“দ্যাখেন তো ওটিপি এল?”
ভদ্রলোক ফোন ঘেঁটে বললেন “এসেছে।”
যাক্, এই কাজটা নামল।
এখন ভদ্রমহিলা ও সে অপেক্ষা করবে।
“একটু জেরক্সটা করে দিন না ভাই।”
“দিচ্ছি।”
ফেরৎ আসার সময় ভাবল, একবার ডালপুরির দোকানটা ঘুরে যাবে। কিন্তু! না থাক। জীবনে কিছু করতে গেলে লোভকে সদাজাগ্রত রাখতে হয়, সোজা কথা। কিন্তু সে যখন সব ছেড়ে এসেছে, তখন থাক্। থাক্ না। সে নিজেকে বোঝায়। একটা টোটো হাত দেখিয়ে দাঁড় করিয়ে উঠে পড়ে। বাড়ির দোরগোড়ায় মিষ্টির দোকানের সামনে দেখে ভিড়ে ভিড়াক্কার।
একটু ভেতরে ঢুকে উঁকি দিয়ে দেখে, সেই পাগলটা।
চুপ করে বসে আছে।
একজন বলছে-“ভুঁড়ির মাংস না, তুলে লিব।”
“খাস কোথায়?”
“দে বে, শালার গায়ে জল ঢেলে দে। জল আন্।”
“কী হয়েছে? কী করেছে ও?” অলীক বলে।
“এ পাড়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছে দাদা, কি লোক, কি ব্যাপার, কে জানে!”
“কথাও বলছে না।”
বলতে বলতে একজন একগেলাস জল ওর মাথায় ঢেলে দেয়।
এই প্রথমবারের মত অলীক ফুঁসে ওঠে।
“কী করছেন আপনারা? ওর রোগ আছে। সিজোফ্রেনিয়া নাম শুনেছেন? আমি ওকে ডাক্তার দেখাব। সরুন, সরুন আপনারা।”
কি একটা যেন হয়, ঘটে। অলীকভাবেই যেন লোকগুলো সরে যায়।
“দাদা, পুলিশে দিন।” একজন বলে ওঠে।
আস্তে আস্তে পাগলটার হাত ধরে গলিটা পেরোয় অলীক। বারান্দায় একটা টুলে বসিয়ে দরজাটায় তালা দিয়ে দেয়। দেখা যাক, কী করা যায়! সূর্য একটু মেঘে ঢেকে যায়।
পাঠক, আপনি বুঝতে পারছেন, কেন আমি চরিত্রটাকে একা রেখেছি। মানুষকে একা পাওয়া খুব মজার, বুঝলেন। দলবদ্ধভাবে আপনি এ মজা নিয়েছেন কখনো কখনো। কিন্তু পাঠক, একা একটা মানুষকে ধরতে পারলে আপনি আস্তে আস্তে ঠিকই বুঝতে পারবেন এ জগতে কোথায় কী চলছে! কোথায়, ঠিক কোথায় অস্বস্তি? কোথায় পোকাটা ডাকছে- কিট্, কিট্, কিট্, কিট্। আমাদের আহার, বিহার, বাসনা, সন্ন্যাস- সবকিছুর মধ্যে পোকাটা ডাকছে- কিট্, কিট্, কিট্, কিট্। নাঃ আর কিছু বলব না, সব বলতে নেই। ঘড়িতে দ্বিপ্রহর দুটো।
এই জীবটিকে নিয়ে কী করবে, অলীক প্রথমতঃ ভেবে পায় না। নড়েও না, চড়েও না। বয়স, প্রায় অলীকের বয়সীই হবে। আরও দু পাঁচ বছর বেশী হলেও অবাক হবার কিছু নেই।
একটু একগুঁয়ে টাইপের।
বিস্কুটের প্যাকেট খুলে ধরিয়ে দিলেও খেল না।
কিছু পরে পাউরুটি সেঁকেও চেষ্টা করা হয়েছিল।
অলীক নিজে খেতে বসার আগে- খানিকটা ডালভাত, আলুসিদ্ধ ঠিক করল। সামনে একটা ট্রেতে রাখবে টুলের উপর।
তা-ই রাখল।
মানসিক রোগ বিষয়ে টুকটাক সাজেশন সে বন্ধুদের দেয়। দীর্ঘদিন ধরে এর সঙ্গে লড়াই করে এই রোগের নানা অন্ধিসন্ধি, গলিখুঁজি সে জানে। কোন ওষুধে কাজ দেয়, কোন ওষুধে দেয় না, তার অজানা নয়। সাইকিয়াট্রির হেন কোন ওষুধ বোধহয় নেই, যা সে খায়নি বিগত দশ বছরে। প্রতিটি ওষুধের অভিজ্ঞতা তার মনে আছে। ঠিকঠাক ডাক্তার পাওয়াও এক সমস্যা। যাইহোক, এবারের ডাক্তার তাকে অনেকটা পথে এনেছে। বছর দুয়েক ধরে ভালো আছে। ভালো, মানে ম্যানেজেবলের বেশী কিছু না, তবে চলছে। মনে হয় দশ দশটা বছর একটা টানেলের মধ্যে দিয়ে হাঁটছিল, শেষে একটু আলো। অথবা, দশ বছরের কারাবাসের পর দুনিয়াটা দেখছে। কিছুই নেই তার। এই আকাশ, আলো, গাছপালা, পশুপাখি আর হ্যাঁ, মানুষ মানুষজন ছাড়া। ‘মানুষ’ এই জীবটা যেমনই হোক, শেষ অব্দি তো তাদের জন্যই বেঁচে থাকা। এটা বড় বড় মানুষরা বলে গেছেন। সেও এটা মেনে নেওয়ার বা বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করছে। কার কী বিপদ হবে আগে থেকে তো বলা যায় না। তবে তার নিজের এই পরিণতিটা হয়ত হবারই ছিল, এটা অ্যাকসেপ্ট করে নিতে হবে। সেটাই সে চেষ্টা করছে। হায়, ফুকো সাইকোসিস ঘটিত জ্ঞানকে বলেছিলেন, ভেরি নেসেসারি নলেজ। নাঃ একে নেসেসারি সে কোনমতেই ভাবতে পারছে না। কোন দরকার ছিল না, প্রয়োজন ছিল না। সমাজ বলে কোনকিছু যদি না থাকত, কোথাও পাগল বলে কেউ থাকত না। কিন্তু সমাজ তো আছে। এই সমাজের রেওয়াজ ও নানা অকথিত রীতিগুলো সে অল্পবয়সে বুঝতে পারে নি। তারই গুনেগার দিতে হয়েছে এতদিন ধরে। ব্যাস, আর কিছু না, আর কোনো কারণ নেই।
এখন এই এক পাগল এসে জুটল। এর কেয়ার দরকার। চিকিৎসা দরকার। কে করবে সেসব। বহরমপুরে নিয়ে যাওয়া যায়। কিন্তু সেখানে তো ডুবে যাবে। সংসার বিযুক্ত হয়ে এ কোন্ সংসার এসে জুটল! আর পারা যায় না।
বস্তুত অলীকের যেহেতু মনে হয়েছিল, সে অনেক লড়েছে। মানসিক, সামাজিক সবরকম। অনেক হারিয়েছে, অনেক পেয়েছে। জীবনকে ভালোবেসে, ঘৃণা করে করে সে দেখেছে, প্রবাদপ্রতীম নারীকুল- তাদেরও সে দেখেছে কাছ থেকেই, ভালোবেসে, ঘৃণা করে, কাছে থেকে বা সরে গিয়ে। এখন তার আর কিছু পাওয়ার বা হারানোর ইচ্ছা অবশিষ্ট নেই। নিজেকে ছাড়া কিছু হারাবারও নেই। ভেবেছিল এখানেই একটা পুরোনো বাঁশির মতো রেস্ট নেবে, পড়ে থাকবে, হয়ত থেকেই যাবে। উদ্যমের ব্যথা আর হবে না সহিতে।
এই তো সেদিন অশোকের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। তাকে দেখে মোটরসাইকেলটা থামাল। ‘ওই অলীক’ বলে ডাকল। তারপর এটা সেটা কথা। ‘আড্ডায় আসিস’ বলেই বলল- “আমাদের আড্ডা আর আগের মতো নেই রে।” বলে বসল সে। ‘জানি’ অলীক মনে মনে বলল। অশোক প্রাইমারি স্কুলের টিচার। ফলে মোটরসাইকেল। “তুই সবার সঙ্গে কথা বল্। লিঙ্ক কর। একা একা কী করছিস? পলিসিটা করবি বলেছিলি, করলি না তো!” অশোক বলে।
“করব কদিন পরে।”
অলীক বলে “তোর মেয়ে হয়েছে না! ফেসবুকে দেখলাম।”
“মেয়ে না, ছেলে, ছেলে।” উৎফুল্ল হয়ে ওঠে অশোক। “আচ্ছা, আসছি রে, দেখা হবে।”
মোটরসাইকেল স্টার্ট দিয়ে ছেলেটা উধাও হয়ে যায়। নিশুতিপুরের হরাইজনটা বদলে যাচ্ছে।
সে আবার যেতে পারে। দুএকটা ফোন করে আড্ডায় উপস্থিত হতে পারে ভূতের মতন। কিন্তু এতদিন বেঁচে না থেকে, কোনো জীবনের আয়োজনে সে কী আর যোগ দিতে পারবে? হয়ত পারবে না।
সকালে উঠে দেখলাম, জীবটা মাটিতে শুয়ে ঘুম দিচ্ছে।
আচ্ছা, ঘুমাক। কেননা, সাইকিয়াট্রিতে ঘুম ভীষণ জরুরি। কিন্তু ওর পাশে একটা বেড়াল দুটো বাচ্চা নিয়ে শুয়ে আছে। পা ছড়িয়ে। রিল্যাক্স করছে। যেমন করে এরা। ওদের খুব কদর ছিল একসময় এ বাড়িতে। এখন সেসব অতীতের কথা।
নিজে থেকেই ওর ঘুম ভাঙুক।
ওর শরীর, মন ঠিক করুক কখন ও জাগবে।
আজ একটু বেশীই ভোরে উঠে পড়েছে। দূর থেকে আজানের শব্দ ভেসে আসছে। একটা নয়, দুটো মসজিদ থেকে। আরেকটু কান পাতলে দূর থেকে রেলগাড়ির আওয়াজও হয়ত শোনা যাবে। আগে যেত। পাশের খণ্ডিত অরণ্যে টুকটাক অনেক পাখি ডাকতে আরম্ভ করেছে অনেক আগে। সে-ই জবাগাছটা এখনো ফুল ফুটিয়ে যাচ্ছে। যদি একটু চেষ্টা করা যায়, তাহলে হয়ত ফুল ফোটার শব্দও শোনা যাবে।
আলো আসার প্রক্রিয়া অত্যন্ত ধীর একটি প্রক্রিয়া, পরিবর্তন কিন্তু দেখতে দেখতে ঘটে যায়। এ এক এমন বিপ্লব, আমরা যা অনেকেই প্রত্যক্ষ করি না। ভোরের প্রথম আলো দেখলে মনে হয় আমি সূর্যাংশী। ওই ভোরসূর্যের একটি আলো, একটি কিরণ, কোনোভাবে আমার মধ্যেও রয়েছে, তাই হাজার অন্ধকারের মধ্যেও আমি রয়ে যাচ্ছি, টিকে থাকছি, এগিয়েও যাচ্ছি হয়ত।
পাগলটা কী যেন ভাবছিল।
তাকে একটা প্লেটে চা-পাউরুটি দিয়ে রেখেছিল অলীক। জানলা দিয়ে দেখেছে সে পাউরুটিটা অর্ধেক খেয়েছে।
দেখে সে ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। পাগল তো যে- সে কিছু নয়। সে ভাবে। কুকুর, বিড়াল নয় মানুষ। বন্ধনহীন মানুষ। সে কখন- কী করবে তার ঠিক কী? ভাবতে ভাবতে রে রে করে এক ভয় ঢুকল মনের মধ্যে। সে জানে সে আদপেই এক ভীতু মানুষ। কিন্তু অন্য সব কিছুর মতো সে পুরোপুরি ভীতুও হতে পারে না, হারিয়ে যাওয়া পঁচিশ পয়সার মতো মধ্যবিত্তের বিবেক জেগে ওঠে। তখন সে অনেক কিছু করতে পারে।
আপাতত সে জামাপ্যান্ট পরে লাইট টাইট নিভিয়ে দরজা লক করে বাইরে বেরোল। ম্যাকেঞ্জিপার্কের দিকে হেঁটে যেতে হবে। কিছুপরেই ব্যাঙ্ক, জেরক্সের দোকান। স্বপ্নের হ্যাণ্ডবিলওয়ালাদের হাতে জেরক্সগুলো তুলে দিতে হবে তার। যদি বাড়িটা ভাড়া দিতে হয়। তবে ওপরটা না, নিচটাই ভাড়া দিতে হবে। নিচের জিনিসগুলো আস্তে আস্তে ওপরে নিয়ে যেতে হবে। নিজেকেও। কিন্তু নতুন অতিথিকে সে কোথায় রাখবে তাহলে, অলীক কিছু চিন্তিত হয়ে পড়ে। দুটো টেবিল, দুটো খাট, বাসনপত্র আর অনেক বই, সব কী ওপরে সঙ্কুলান হবে? সবচেয়ে বড় কথা তার নিজের সঙ্কুলান হবে কি? একা মানুষ, তবে তারও কিছু আয়োজন রাখতে হয়। কাকে কন্টাক্ট করা যায়- সে ভাবতে থাকে, শেষে ভাবে, যাক্ আজকেই তো দরকার হচ্ছে না! এইরকম ভাবনা তার স্বভাবসিদ্ধ। সে ভীতু, ল্যাদখোর এবং স্বার্থপর। ভাবা যায়, এই অলীকেরই বাইশটা রেফারড্ প্রবন্ধ আছে। শ’খানেক ছাপা কবিতা! লুপ্তপ্রায় মধ্যবিত্তের মতোই ভীতু, অলস ও স্বার্থপর- কোনটাই সে পুরোপুরি হতে পারেনি। আর ব্যালান্স রয়েছে, মঝঝিম বা মাঝখানে সেটাও আয়ত্ত হয় নি, তবে চেষ্টা চলছে।
এর মধ্যেই একটা ফোন আসে।
তারা বাড়ি ভাড়া নিতে চায়, কিন্তু আর্জেন্ট।
অলীক বলে, সমস্ত কিছু গুছিয়ে নিতে একটু সময় লাগবে, অন্তত একমাস।
কিন্তু তাতে তাদের একটু অসুবিধা আছে।
কিন্তু, অলীক ভাবে ফোন আরো আসবে। একমাস নয়, তিনমাস সময় তার চাই।
ঘরটাকে অ্যারেঞ্জ করতে হবে। যখন একুশ-বাইশ বছর বয়স ছিল, তখন পৃথিবীটাকেই একটু রি-অ্যারেঞ্জ করার স্বপ্ন দেখত মাঝেমাঝে। এখন অ্যারেঞ্জ করার বিষয় মানে একটা দুটো ঘর। তবু এটুকু যে আছে, তা সৌভাগ্যই বটে।
এবার একটা রিস্ক নেবে অলীক। ওই লোকটার খাবারে একটা অ্যান্টি- ডিপ্রেসান্ট আর একটা অ্যান্টি সাইকোটিক ড্রাগ মিশিয়ে দেবে। চিকিৎসা শুরু হোক। এখুনি ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া যায় কী করে! অ্যারেঞ্জ করে নিতে, মানে সবটা গুছিয়ে নিতে অন্তত তিনমাস লাগবেই।
লোকে ইতিমধ্যে কথা বলছে। হয়ত এরপর থ্রেটও আসবে।
কিন্তু মা সবসময় বলত, কে কী বলল, তা নিয়ে মাথা ঘামাবে না। নিজের কাছে নিজে ঠিক থাকবে, তা হলেই হল।
সে নিজের কাছে ঠিক আছে।
যা সে করছে, তা অন্যায় নয়, অন্যায়ের কাছাকাছিও নয়।
তবে!!!
জানলার ওপাশ থেকে সাদা আকাশ উঁকি দিচ্ছে।
সে জানে মৃত্যুর পর সে আকাশে মিশে যাবে।
আর কিছুটা মাটিতে, কিছুটা জলে- পরজন্ম বলে যদি কিছু থাকে, তবে যেন সে গাছ হয়।
বাইরে টুলটা গড়িয়ে পড়ার শব্দ হল। এবার বাইরে যেতে হবে। আজ শুক্রবার। ওই পাগলের নাম হোক ফ্রাইডে।
10/05/2023
আমি ডায়েরি রাখতে শুরু করলাম। ফ্রাইডে এখন অনেকটা সুস্থ। বাথরুম, পায়খানা ব্যবহার করে। খেতে দিলে খায়। কোনো উচ্চবাচ্য করে না। কিন্তু কোন কথা বলে না। জয়দেবকে বলে ওর চুল-দাড়ি কাঁটার ব্যবস্থা করেছি। কোনো কথা ও বলে না। বেশিরভাগ সময় আকাশ, গাছপালা দেখে। খুব ভেতর থেকে একটা নিঃশ্বাস উঠে আসে ওর। লক্ষ্য করেছি। এই দীর্ঘনিঃশ্বাসের রহস্য বোধ হয় আমি জানি।
14/05/2023
ফ্রাইডেকে এখন ঘরে আসতে দিই। চান খুব একটা করতে চায় না। কিন্তু ঠিকঠাক জামাকাপড় পরে। আমি ভাবছিলাম এইসব স্কুলিং এর মধ্যে দিয়ে আমি কী সমাজকেই ওর ওপরে চাপিয়ে দিচ্ছি না। ওতো এসবকিছু কাটিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু আমি তো ওর ওপর আবার সমাজের বসন- ভূষা চাপিয়ে দিচ্ছি। ও স্বাভাবিক ছিল, ওকে সামাজিক হতে হচ্ছে এখন। দেখা যাক।
16/05/2023
আমি আস্তে আস্তে অ্যান্টি- ডিপ্রেসান্টটা বাড়িয়ে দিয়েছি। আমি চাই, ও সুস্থ থাকুক। সামাজিক না হয়েও ন্সুস্থ থাকা যায়। ওকে আস্তে আস্তে কিছু কাজ দিতে হবে বোধহয়। তুলসীবিহারীর মেলা থেকে ওকে একটা বেলুন কিনে দেব।
22/05/2023
কিন্তু ফ্রাইডে তো আমার সন্তান না, শিষ্য না, আশ্রিত শব্দটা খুব নির্লজ্জ। ফ্রাইডেকে তার ভাষা ফিরিয়ে দিতে হবে। বস্তু আছে। তার নাম আছে। সর্বোপরি, নিজের জায়গা থেকে আর-এক-জনের কাছে পৌঁছনর ইচ্ছা আছে। ওর সেই ইচ্ছা ফিরিয়ে দিতে হবে। ফ্রাইডে কী আমার বন্ধু! হতে পারে! না, তাও নয় বোধহয়।
03/06/2023
ফ্রাইডে দেখেছি বাইরে পাখির কলকাকলি শুরু হলে খুব উদ্বেল হয়ে ওঠে। ওর কী পাখি ভালো লাগে! ও এখনও সমাজে প্রবেশ করেনি। ওর সমস্ত খেলা এখনও প্রকৃতির সঙ্গে। ও আকাশের দিকে দেখে। পাখির ভাষায় চমকিত হয়। অর্থাৎ, ওর সাড় ফিরে আসছে। আমি এর মধ্যে বাজার থেকে এক খাঁচা পাখি কিনে এনেছি ওর জন্য। ও কি পারবে পাখিগুলোর যত্ন নিতে! আপাতত ওর যত্ন নিই। আমার কাজ ছিল না। একটা কাজ পেয়েছি। কাজ করি।
18/06/2023
একটা ফোন এসেছিল। আনক্যানি ফোন। বলল- “আপনার বাড়িটা দেখতে আসব।”
আমি বললাম- “ভাড়ার জন্য?”
-“না, কিনব।”
আমি বললাম- “আমি তো বাড়ি বিক্রি করব না।”
উত্তর এল- “সেটা দেখা যাবে।”
“হ্যালো, আপনি কে বলছেন?”
“আমি আবু হোসেন বলছি।” ফোনটা কেটে গেল।
23/06/2023
ফ্রাইডে বোধহয় আস্তে আস্তে স্মৃতি ফিরে পাচ্ছে। টুকটাক কাজ বললে সে করছে। এই টুলটা সরানো। এই দরজাটা লাগানো। সে নিজের থালা নিজে ধুচ্ছে। বলতে হয় না। আমি ভাবছি, যে স্মৃতি ওকে উন্মাদ করেছে, সেই স্মৃতি ফিরে আসা ওর পক্ষে কী ভালো হবে। কে জানে! এই জাহাজে ক্যাপ্টেন কে? আমি না ও। ও ওর অসহায়তা দিয়ে আমাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে আজকাল। পাখির খাঁচার সামনে। আমি একটা টুল এগিয়ে দিই।
27/06/2023
আজকে আবার ফোনটা এসেছিল। ওরা দেখা করতে বলছে। বাড়ি দেখতেও আসবে। নিজের মুদ্রাদোষে আমি আত্মীয়- বন্ধু সব হারিয়েছি। জানিনা কি করব! ফ্রাইডে আর আমি নিচের টেবিলটাকে ধরাধরি করে উপরে তুলেছি। চেয়ার দুটো। ফ্রাইডে কোন কথা বলে না। কিন্তু আজকাল পাখিদের খাবার দেয়। যখন তখন খাবার দিতে থাকে। ওকে শাসন করতে হবে।
আবু হোসেন নিশুতিপুর ও তার বাইরেও তিনটে প্লাস্টিক ফ্যাক্টরির মালিক। এছাড়াও তার নানা ব্যবসা আছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই তাকে রাজনৈতিক নেতাও হতে হয়েছে। অদ্ভুতভাবে সে নিশুতিপুর এলাকার প্রায় সমস্ত ফাঁকা জমি এক এক করে কিনে নিচ্ছে। শ্রীমন্ত সিংদের বাড়িটাও কিনে নেবার সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে। কেন! ইগো! একটা গোটা শহর দখলে রাখার আমেজ! নাকি অন্য কোন পরিকল্পনা। প্রাচীন ঐতিহাসিক এই গাঙ্গেয় শহর কী কোনভাবে শিল্পনগরী হয়ে উঠবে? হতে পারে। আবার নাও হতে পারে। আবু হোসেন করিৎকর্মা শাঁসালো লোক। এদের বোঝা মুশকিল। প্রায় সম্পূর্ণ দরিদ্র শিক্ষাহীন পরিবেশ পরিবার থেকে সে এই জায়গায় এসেছে। শানিত বুদ্ধির সঙ্গে পাগলামির মিশেল না হলে তা হয়না। কে বুঝবে আবু হোসেনকে।
অলীকদের বাড়ি তার দেখা হয়ে গেছে। আসলে সে বাড়ি নয়, বাড়ির জায়গাটা দেখে। পাশে যে চার কাঠা জায়গা রয়েছে, সেটাও সে দেখে নিয়েছে। ফলে আর নিজে না এসে অলীককে সে সরাসরি ডেকেছে। কিন্তু অলীক যে পনেরো বছরের কিশোর। তারপর বয়স বাড়েনি। দুনিয়ার নিয়মকানুন সে জানলেও বুঝতে যে পারে না। এইধরনের পাওয়ারফুল লোকের ভয়, ফিয়ার অফ পিপল যে তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে সেঁধানো। আত্মহত্যা সে পারেনি, আত্মপ্রত্যাহার সে করে নেবে ভেবেছিল। এসে লুকিয়েছিল এই মফঃস্বলের গুহায়। এখন কোন্দিকে সে যাবে! দুপুর দুটোর সময় মিটিং। আগেই চান খাওয়া করে, ফ্রাইডেকে খাইয়ে সে চুপচাপ চেয়ারে বসল, নিজেকে তৈরি করে নিতে হবে।
যখন সে আবু হোসেনের ডেরায় পৌঁছল কোর্টের উপরে খড়খড়ি মজানদী। তা বুজিয়ে বড় তৈরি হয়েছে রাতারাতি। আগে ইঁটভাটার মালিকদের এলাহি বাড়ি ছিল এইখানে। এখন প্লাস্টিকের যুগ। আরো আরো এলাহি বাড়ি। হিন্দী সিনেমার মন। অলীকের মনে পড়ে ছোটবেলায় উইকেট টুইকেট গুটিয়ে যখন বন্ধুরা বাড়ির দিকে হাঁটা দিত। সে তখন একা একা বিভোর হয়ে সূর্যাস্ত দেখত। দিগন্তে সূর্যের সেই ভেসে যাওয়া! এখন সূর্য ঢাকা পড়ে গেছে।
কিছুক্ষণ পরেঃ
“আপনার বাড়িটা আমার দরকার।” গোঁফ দাড়ি ফতুয়া পাঞ্জাবি পরা সম্ভ্রান্ত চেহারা। সামনে হুইস্কির গ্লাস। হাতে একটা দামি সিগারেট নিয়ে সে কথা বলছিল।
সে হুইস্কি অফার করে।
“আমি সবসময় খাই না।” অলীক বলে।
“আমি বাড়ি ভাড়া দিতে চেয়েছি, বেচতে নয়।”
“কিন্তু আমার দরকার। আমি শহর নতুন লোকে ভরে দেব। এটা মাল্টি সিটি হবে। সব আমার লোক।”
“কত নিবেন? পঞ্চাশ, ষাট, সত্তর। যা নিবেন, নিয়ে নিন। পরে আর একপয়সাও মিলবে না।”
“টাইম নিন। একটু ভাবুন।”
“আচ্ছা আসি।” অলীক বলে।
“আমার কিন্তু জবাব চাই।”
অলীকের কেমন গা বমিবমি করতে থাকে।
“আমি বেচব না।” প্রায় মরিয়া হয়ে অলীক বলে।
“ভেবে দেখবেন। এখনো টাইম আছে।”
লোকটার কথা কোনো মুর্শিদাবাদী টান নেই। বোধহয় মুছে ফেলছে।
“আসছি।” বলে অলীক দ্রুত বেরিয়ে আসে।
রাত্রের দিকে অলীক বসে ভাবছিল বা ভাবনাই অলীক হয়ে উঠেছিল। এখন সে কী করবে!
দুদিন পর লোক দিয়ে উঠিয়ে দেবার প্রসঙ্গ আসবে।
তবে এই বাড়ি যদি বিক্রিও করে এভাবে হুমকি খেয়ে সে বিক্রি করবে না।
তার সংসার নেই। কিন্তু সংসারের আদল আছে। কিছু রেস্তও আছে।
ফ্রাইডে আজকাল টুকটাক কাজ করে। পাখিদের খাবার দেয়।
এখন লড়াই আর অপেক্ষা। ফ্রাইডে একদিন ভাষায় ফিরে আসবে। তখন হয়ত সত্যিই অন্য কোন দিনে আমরা পৌঁছে যাব।

কবি
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে পিএইচডি
পেশায় অতিথি অধ্যাপক