আমি রাস্তা সুদূরের পথে চলেছে রাস্তায় একটি গরু - নিষ্পাপ, সাদা মালিকের সন্ধানে চলেছে সুদূরের পথে মালিক সুদূরে থাকেন, মালিক ছড়িয়ে থাকেন চারিদিকে গরুটির গলা অবধি অসীম রাস্তা, গরুটির মালিক নেই, গোয়াল নেই শুধুই রাস্তা চারিদিকে শুধুই না ফুরোনো রাস্তা, অথৈ রাস্তা সব বাধা বাঁধন খুলে সে চলেছে মালিকের সন্ধানে গলায় ছেঁড়া সংসারের দড়ি গলায় পৃথিবীর শেষ ঘণ্টা গরুটি টুংটাং চলেছে পথ থেকে আরও পথে, পথকে ছাড়িয়ে বাবা শিশুটি হাঁ করে বৃষ্টি দেখছে জানলা দিয়ে তার বাবা নিরুদ্দেশ, সম্ভবত গিয়েছে উটের দেশে ছেলেটি বৃষ্টিকে বলছে – ‘আমাকে বড়ো করে দাও’ বৃষ্টি তাকে কথা দিয়েছে হাতে করে বড়ো করার ছেলেটি হাত বাড়ায় বৃষ্টি ভিজিয়ে দেয় তার হাত ছেলেটি ভিজে হাতে ছুঁয়ে দেয় জানলার গরাদ দিগন্ত ভাঙে, উট ভাঙে জানলা দিয়ে ছাট আসে বাবার গন্তব্য ট্রেনে চাপলে অনেকদূর যাওয়া যায়। কিন্তু আমি তা যাব কেন? আমি তো পায়ে হেঁটে কাছে কোথাও যেতে চাই। কাছেই। আরও কাছে। কাছেই অসীমদের বাড়ি, অসীমের বাবা গান জানে। আমার ওই গানটুকু শোনা ছাড়া আর কোনো গন্তব্য নেই। চলে যাচ্ছ চলে যাচ্ছ? আর আসবে না? দেখা হবে না কোনোদিন? দাঁড়াও একটা প্যাথোজের ব্যবস্থা করি। করুণ সুর। ভায়োলিন। তোমার কথা মাঝে মাঝে মনে পড়বে, পড়বেই। আমি তখন বিপ্লবীদের দলে ভিড়ে যাব। ওদের চা করে দেব, সেবা ও শুশ্রুষা। বন্দুকের নল পরিষ্কার করে দেব। বন্দুকের সাথে ভায়োলিনের কোনো তফাত নেই। চলে যাচ্ছ যাও। আমি তোমার যাওয়াটুকু দেখি। আমার দেখাও তোমার সঙ্গে যাবে। তোমায় ট্রেনে তুলে দেবে। কবিদের বউ কবিদের বউরা আসলে হাসপাতালের জানলা দিয়ে দেখা দূরের সবুজ গাছ, যার আশেপাশে ছায়ার নির্মাণ চলছে... হাওয়া এসে আমাকে জাগায় আমার মাথার কাছে জানলা জানলা দিয়ে পাশের ফ্ল্যাটের জানলা দেখা যায়। সেখানে ঝুলছে তরুণীর পোশাক, ওই পোশাকের পাশে হাওয়া। সেই নিশিডাক হাওয়া এসে আমাকে জাগায়। দেবাঞ্জলি মুখোপাধ্যায় দেবারতিদির বোন দেবাঞ্জলি মুখোপাধ্যায়ের কথা মনে পড়ছে খুব, পাতার মানবী লিখেছিল সে – দেখলাম কবি অরণি বসুও পাতার মানবীকে নিয়ে লিখেছেন কবিতা। আমি জানলার বাইরে গাছপালার দিকে তাকিয়ে কবি দেবাঞ্জলির কথা ভাবি। সে এখন কোথায়, কত দূরে? শিলিগুড়ির আশ্রম পাড়ায় গেলে তাকে পাবো বলে মনে হয়। একজন কবির জন্য এতো মনখারাপ, যেন ভিতরের পাতা সব ঝরে যাবে। যেন কিছুতেই লাগছে না রোদ আমার উঠোনে। এলোমেলো ঝড়ের মধ্যে, গাছেদের ভয়ার্ত গান, তার মধ্যে দিয়ে আসছেন বোধহয় ওই পাতার মানবী! কিন্তু না, সে তো দেবারতিদির বোন দেবাঞ্জলি না তো! সে আসলে আমাদের অনেক চাওয়া ও না-পাওয়ার ভিতর দিয়ে আসা অন্ধ গীতা! তবে দেবাঞ্জলি বোধহয় ডুয়ার্সের গভীর কোনো গাছের আড়াল থেকে লিখছে কবিতা, চোখে কাজল তার। সে নিজেকে আর অপব্যয় না করে আমার মনখারাপের খাতার পাশে ব’সে, বেজে ওঠে ভীতু ও নরম হয়ে। কে আসবে? সে আসবে! তোমার অনেক বয়স হয়ে গেছে, তবু তুমি গালে রং, সদ্য যুবতীর মতো লাল লিপস্টিক, চোখে অশ্রুর বদলে কাজল - এই রাত ন’টাতেও উল্টোডাঙা ব্রিজের ওপর অপেক্ষা করছ। কে আসবে তোমার কাছে তার শৈশব নিয়ে? তোমার স্তনে আর কোনো যুবক কোনোদিন চঞ্চল হবে না, ওতে এখন মায়া আর শুশ্রুষার আলো। তুমি এতো রাতে উল্টোডাঙা ব্রিজে দাঁড়িয়ে কলকাতাকে সংবর্ধনা জানাবে? কে আসবে আকুতি নিয়ে তোমার এই অপরূপ ভাবের কাছে? তুমি কী আলোর সীতা? কিন্তু অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আর কতকাল তুমি অপেক্ষা করবে তাঁর জন্য, ভক্তির জন্য? বরং বাড়ি যাও, কলকাতা এখন ঘুমোবে। কলকাতা তোমাকে জড়িয়ে তার সুখ-দুঃখ পার হবে এখন। রুদ্রবালা রকমারি স্টোর্স বাড়ি মানে একটা ডায়েরির শেষ হয়ে আসা পাতা। আবার নতুন খাতা, তাতে আঁকিবুঁকি নৌকোর দুলুনির মতো তোমার সৌন্দর্য। এঁকেবেঁকে রান্নাঘর অব্দি যায়, থমকে দাঁড়ায়। একদিন হাওয়া দেবে খুব, একদিন নৃত্যের আসর। শ্যাওলায় বছর কাটে। অঙ্কে বছর কাটে। উঠোনে মায়ের শবদেহ, ছাদে আকাশ। এইভাবে খাতা শেষ হয়ে আসে – নতুন খাতা শুরু হয়, নিজেকে প্রমাণ করার। ফণা যে কথা মনে আসছে তা বলতে সংকোচ হচ্ছে, বলার পর যদি আপনি রেগে যান! আমার রাগে খুব ভয়, তবু বলতে ইচ্ছে করছে কথাগুলো, না হয় একদিন রাগের মুখোমুখি হলাম। ক্রোধের (যতদূর জানি) আদি নিবাস গোলাপ ডাঙার পাশের গ্রামে। যেখানে গোলাপের কাঁটা থেকে ক্রোধের বীজ হয়, ক্রোধে তাই গোলাপের গন্ধ, ক্রোধে তাই নীরবের সাধনা। আমি ভয়কে পাশে রেখে শেষমেশ কথাটা বলেই ফেললাম, দেখলাম আপনি রাগলেন না, ক্রোধে অগ্নিশর্মা হলেন না, বরং যেন আয়না অনুবাদের মতো আমার দিকে এমন তাকিয়ে আছেন – আমি তাতে কথা আরো এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সাহস পাই, দেখি ঝাঁপি থেকে সাপ নয়, পূর্ণিমার চাঁদ যেন ফণা তুলছে একটু একটু ... একটু একটু করে পশুর মাংসও যেন ফুটে সেদ্ধ হয়ে এলো।
রাণা রায়চৌধুরী
জন্ম ১৯৬১, কলকাতায়। এখন থাকেন ব্যারাকপুরে। কবিতার বই ১৩টি,গদ্য ৪টি,উপন্যাস ১টি। ভ্রমণ কাহিনী পড়তে ভালোবাসেন। পড়তে পড়তে চলে যান দূর দেশে। বাস্তবে অবশ্য সাইকেল আর হেঁটেই তার ভ্রমণ। ভালোবাসেন গান শুনতে আর নিজের সাথে আড্ডা দিতে। প্রিয় রঙ নীল। প্রিয় খেলা ফুটবল। পেশায় অবসরপ্রাপ্ত প্রাথমিক শিক্ষক। ফলে ছেলেমানুষি তার মজ্জাগত।
Facebook Comments Box