সারণী 'ওই দূরে দূরে আলো জ্বলছে কুঁড়ে ঘরে, ও কার ঘর, অর্পিতা?’— আমার আমার বলে ছুটে যাই পথে ধুধু ওড়ে, তীব্র রাগ, অঙ্গের বসন ওড়ে ক্লান্ত মুখের ছায়া বুকে ওড়ে, দেখি ঐরাবত দেখি সুখের মাজারে জল দিই, পানি আব্বা পানি আনো হেই সামালো ধান- ওঃ! যেন পুবের বারান্দা… যেন দক্ষিণ বাতাসে শ্যামরাই দোলে আসমানে খেলা করে ওড়নার ভাঁজে একদিন মুঠো ছিঁড়ে জীবনের থেকে বহুদূরে ছড়িয়ে পড়বে আলো, ও অর্পিতা, এই পথ, ওই আলো তবে এত সঙ্গোপনে ছিল, এত অভিঘাতে! তুমি তো রক্তের মধ্যে ধরে রেখে দিয়েছ তোমাকে! আবার নতুন পথ গড়ি, মূর্তি গড়ি, গাছের গাছের আর বনের বনের ধূপগুড়ি, ঢুকে পড়ছে সবুজ বলয়ে দেখো শ্যাম, দেখো রাই, ওই চলন্ত ছবির অন্তে নিভে এলো আলো, কুয়াশায়… রিপু ১ ছিঁড়ে ছিঁড়ে বেঁচে থাকা। জায়মান নিভৃত শরীর আর্তির অবগত – শ্বেত, ধ্রুব চণ্ডালের বেশে তুমি কার অমলিন হাতে ক্ষুধা ভিক্ষা করো, হে তস্কর! শরীর হাক্লান্ত নয়, তৃণভোজী দ্বারে তার মুখ নিয়ত দূরবীন। ক্লেশ বলো, শোক বলো, জ্বালা- আমার প্রাণের কাছে কেউ নয়, কিছু নয় আশ্বাসের সমতুল। মলিনতা ছুঁয়ে এই হাত তোমাকে ছুঁয়েছে, বারণ শুনো না তুমি- ছিঁড়ে ছিঁড়ে উপগত হও, অমানিশা পার হয়ে গেলে হরিণী আসবে এক লবণাক্ত গন্ধ বেয়ে নদীটির কাছে! ২ উপলক্ষ বলে নেই মন, নেই সুরাহা নিশ্চয় তাঁতির আবাদি সুর তাঁত বোনে, চরকায় বিবিধ স্থানীয় কীট, জলচর, শ্যাওলা অশ্লীল– পোশাকের ব্যবধানে ডিঙির শরীরে বিঁধে যায় লগ্ন চিতার ওঠে শ্বাস, দরবারে যে শুভ সম্পদ রেখেছ মানিক করে, জান্তব করোনি তার ধিকিধিকি মন উপলক্ষ নেই বলে নির্বিচারে থরে থরে গুলির আগায় ঝরে পড়ে… ৩ বড় যে বিচ্ছেদ ব্যথা বুকে নিয়ে ঘর করো, কাঁদো আঁধারে সেঁধিয়ে যায় দিনলিপি, অধরা ব্যাখ্যান নীলমণি তুমি, কী উপায়ে বিজ্ঞান ফলাও বনে, চারাগাছে জল দাও? অন্ধ বায়স উড়ে আসে– ছড়ানো ছিটানো অন্ন মুখে তুলে কোন অভিমুখে যাত্রা করো তুমি অগ্রদানী, একবার পিছুও ফেরো না! ৪ পৈশাচিক বিত্ত বিনিময়। আমার যা নিজস্ব ছিল দিয়েছি গা থেকে খুলে খুলে, পরিবর্তে সনাতন মল মূত্র থুতু পিত্ত কফ– অথচ চর্বন সুখ মিথ্যা করে দিয়ে গড়ি গর্ভপথ, আকারে ইঙ্গিতে লঘু ছিল, বিষ ছিল, ক্রিয়া সেই হেতু নিবারণ। পৈশাচিক বিভিন্ন কারণ একে একে লিখে রাখি গদ্যের খাতায়। চুপ। নির্বিকার রাখি ভগ্ন স্তূপ– বিপাকীয় গ্রন্থিগুলি শেষ বিনিময়ে হাসে জোরে… ৫ আমারও তো অনেকগুলি স্বর! ভিন্নমাত্রার ব্যবধানে তাদের জীবিত করে রাখি। তাদের সচল আয়ু লুক্কায়িত রেখে স্তনে, কখনও ব্রীড়ায় অধোমুখ— ডেকেছি পার্বণ, তুমি এসো, তুমি আনো অন্ধকার আমি গলা চিরে পান করি রুধির তোমার… পুরাণের যুগ থেকে আরও পুরাতন যুগে ফিরি শ্বাস বন্ধ, উর্ধ্বে আঁখি, আরও উর্ধ্বে হেঁটমুন্ড আমি গলায় গর্দান ধরি, ব্রজবালা অঙ্গে ধরি স্বর তোমার বুকের ‘পরে জঘন রেখেছি, ঊরু, ভর― ছিটকে ছিটকে ওঠে গলামধ্যে, অনন্ত নক্ষত্র মালা ক্ষুধিত অক্ষর… আবর্ত এই যে মনের স্রোত, তাকে মনে বয়ে যেতে বলি বলি যে, শোনো হে মন, কারও মুখে চেয়ো না কখনও যেখানে নিরেট অমানিশা, খুচরো পাথরে ঠেকে পা, মন, তুমি পাশ ফিরে শোও তোমার স্রোতের মুখ তা’বলে ফিরিয়ে নিও না! ফেরাতে ফেরাতে দেখো একদিন ঠেকবে পাহাড়ে চূড়ায় চূড়ায় লেখা জলের আয়না ভরা লিপি পাহাড় রাখবে ঢেকে আনত লোহিত ঋজু বুক এই ভরসায় মন তুমিও আদেশ না মেনেই এতদিন আবর্তে ঘুরেছ, ঘুরেছ, ঘুরতেই… না মন না, তাকে বয়ে যেতে বলো তুমি, বেশ? দিদিমণি, ভোটকর্মী ‘সকলই মহৎ হতে চেয়ে শুধু সুবিধা হতেছে; ’ ‘ভাষিত’ (১৩৪৯), জীবনানন্দ দাশ এত নৃশংস ছাপে তোমাকে দেখিনি তোমাকে দেখিনি এত কালো জলে, দূর থেকে দূরে পড়শির কান্নায়; মরা যুবকের অবিনাশী প্রেতে হাতিয়ার। তাঁবুগুলি পাশে ছিল, আরও পাশে কোলের শিশুকে নিয়ে মায়েদের অধিকারী ভোট ব্যালটে ব্যালটে ছিঁড়ে, নাম লিখে, যেদিন ছাইয়ের স্তূপে ফেলে এলে বিষাক্ত বিশ্বাস, তোমাকে দেখিনি আমি! না দেখে, না শুনে, না বলে, চুপ থেকে আমিও তো সাজিয়েছি ইঁট আমাদের মাঝে—নিরাকার প্রাচীর তুলেছি; টেবিলের এপ্রান্তে বসে দেখে গেছি ছাত্রদের ভগ্ন মনোবল অসৎ আশ্বাসে প্রাণ শান্ত করে ঘুমিয়েছি, ফিরে সে-প্রাচীর যদি আজ আমাকে নিক্ষেপ করে নরকে, ভাগাড়ে তবে, এসে বসি, কাঁদি, ঘন গাছের তলায় হাহাকারে বুক চাপড়ে বলি, এ-পাপে আমারও ভাগ আমার অংশীদারি আমাকেই আজ চুমু খেয়ে সন্তানের মুখে পাঠিয়েছে, খালি হাতে ভোটকেন্দ্রে, দগ্ধে, ভয়ে, ত্রাসে মরতে, মার খেতে খেতে… একা!
অর্পিতা কুন্ডু
লেখালেখির শুরু কিশোর বয়স থেকে. কিন্তু প্রথম সেই অর্থে কবিতা প্রকাশিত হয় ২০০৮ সালে. নিয়মিত কবিতা প্রকাশ পায় ২০১২ থেকে. দেশ, কৃত্তিবাস, কবিতীর্থ, কবিসম্মেলন প্রভৃতি বিভিন্ন পত্রিকা ও নানা ওয়েব ম্যাগাজিনে নিয়মিত প্রকাশিত হয় কবিতা. লিখেছেন কবিতা সংক্রান্ত একাধিক প্রবন্ধও. প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘গাঙ্গেয় যমুনার তীরে’ প্রকাশিত হয় ২০১৭ য়. এই কাব্যগ্রন্থের জন্য ২০১৯ সালে পেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি শক্তি চট্টোপাধ্যায় স্মারক সম্মান ও কৃত্তিবাস পুরস্কার. কবির দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘পরিযায়ী…প্রত্নতাত্ত্বিক’ প্রকাশ পায় ২০২১ সালে.
Facebook Comments Box