এ বাড়িতে এলে সবার আগে আমি মেজেনাইন ঘরটায় চলে আসি। ঘরের দেয়ালজুড়ে আলমারিভর্তি পুরনো বইপত্র। আরেক দেয়ালে বেশ কিছু পারিবারিক ছবির ফ্রেম। আমার যে শুধু বই পড়ার প্রতি অনুরাগ তা কিন্তু নয়। পুরনো জিনিসের প্রতিও আগ্রহটা আছে। প্রতিবারই এখানে এলে সেটায় আবার হাওয়া লাগে।
তাছাড়া এ ঘরের আরেকটি ভালো দিক হলো বিছানার একপাশজুড়ে চওড়া জানালা। সে জানালা ভেদ করে আকাশটা ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে। একটু কাছে গিয়ে চোখ রাখলে হিজিবিজি গাছপালার ওপারে পাহাড়ের বাদামী সবুজ শরীরটা দেখা যায়। মাঝেমাঝে শিশির চুঁইয়ে পড়া ভোরে আমি যখন সেদিকে তাকাই মনে হয় হাঁটু ভাঁজ করে কোনো কিশোরী মেয়ে বসে আছে অনন্তকালের অভিমান নিয়ে। সে মেয়ের নাম, ঠিকানা আমার খুব ভাল করে জানা।
দেড়তলা এই ঘরের সিলিংটা অনেক উঁচুতে। সিলিং ফ্যানের বালাই নেই। বিশ্রী গরমের দিনগুলিতে মাথার কাছে চার্জেবল ফ্যানটা চালিয়ে রাখি। আর পাল্লা খুলে দিলেই তো জানালা টপকে হাওয়ার দল ভেতরে ঢুকে পড়ে।
কিন্তু মশার উৎপাতে সে সুখ পেতেও সতর্ক থাকা জরুরি। ম্যালেরিয়া জ্বরের চিকিৎসা আজকাল বেশ ঝটপট পাওয়া গেলেও প্রতিবছর ফাঁকফোকর দিয়ে সেরেব্রালেও কম লোক মারা পড়ে না। যেমন আমার মায়ের নানাজান। তীব্র জ্বরে ভুগে মাত্র দুদিনের মধ্যেই জলজ্যান্ত লোকটা নাই হয়ে গিয়েছিল। এই তিনতলা বাড়িটির প্রাক্তন মালিক ছিলেন তিনি।
নানাজানকে মা ডাকতেন আজু-পিজু। আমিও তাই ডাকতে চেষ্টা করতাম। আজু-পিজু প্রিয়তোষ বাবুর একমাত্র ছেলে আর ছেলের স্ত্রী অর্থাৎ আমার মায়ের বাবামা গত হয়েছিলেন প্রায় বছর কুড়ি আগে। সে বছর বেশ কয়েকটি পাহাড়ে রহস্যজনক কারণে আগুন লাগার ফলে অসংখ্য আদিবাসী লোক ঘরহারা হয়েছিল, গভীর রাতে ঘুমের ভেতরেই প্রাণ হারিয়েছিল বেশ কিছু লোক। আমার মা আর মুঝি সে বছর বিজু উৎসব উপলক্ষে এ বাড়িতে বেড়াতে এসেছিল। ফলে তারা ভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে যায়৷ তখন থেকেই আজু-পিজু আমার মা আর মুঝির অভিভাবক।
প্রিয়তোষ চাঙমাকে খুব বেশিদিন আমি পাইনি। সরল সৌম্য মুখটা সময়ের সঙ্গে বেশ আবছায়া হয়ে গেছে। আমি আধো বুলিতে ‘আদু-আদু’ বলে ডাকতাম তাকে। মা শুধরে দিতে চাইলে আব্বা কখনো আড়ালে, কখনো সবার সামনেই ধমক লাগাতেন। বলতেন- পরনানা বল ব্যাটা!
নানাজানই যখন আর রইল না তখন এই সম্বোধন নিয়ে খুব বেশিদিন মাথা ঘামাতে হয়নি। আর মায়ের নানীকে আমার জ্ঞান হবার পর থেকে দেখেছি বিছানায় শয্যাশায়ী। কারো ডাকে সাড়া দেবার অবস্থা ছিল না তার। আমি তবু সারাদিনে কয়েকবার করে তার ঘরে ঢুঁ মারতাম। কানের কাছে গিয়ে সজোরে চ্যাঁচাতাম ‘বুড়ি বেই,ও বুড়ি বেই’ বলে। সাড়া না পেয়ে চুপিচুপি চিমটি কাটতাম পাটকাঠির মতো সরু হাতের ঝুলঝুলে চামড়ায়। মা টের পেলে কান মলে দিত আমার।
আমার মা মধুমতী চাঙমা, এফিডেভিট করে যার নাম হয়েছিল মিতা খানম, তার অবশ্য সহজে সময় হত না নানীর দেখভাল করার। এখানকার এক প্রাথমিক স্কুলের সহকারী শিক্ষিকা ছিলেন আমার মা। স্কুলের পর বাড়ি ফিরে দুই ব্যাচ ছাত্র পড়িয়ে আর সংসারের কাজ শেষ করে তারপর দম ফেলবার অবসর হত তার। আমি তখন চার কি পাঁচ। মায়ের একমাত্র বোন, মুঝি ছিল আমার সারাদিনের সঙ্গী।
মুঝির সঙ্গে আমার বয়সের পার্থক্য মাত্র নয় বছরের। অবস্থানগত দূরত্ব অবশ্য এখন অযুত নিযুত মাইল। অলি মুঝি দেশ ছেড়ে গেছে বহুদিন। মেলবোর্ন শহরে স্বামী সন্তান নিয়ে এখন ভরপুর সংসার তার। আমার সঙ্গে প্রতি উইকেন্ডে না হলেও মাসে দুয়েকবার করে কথা হয়। ঘন্টার পর ঘন্টা হোক আর মিনিট দশেক, ফোন রাখার আগে মুঝি প্রতিবারই আমাকে প্রশ্ন করে ‘কবে আসবি সুনয়ন?’ আজকাল অবশ্য আমিই তাকে বাড়ি ফিরে আসতে বলতে পারি।
মুঝির কথা ভাবতে গেলে অবচেতনে আব্বার কথাও মনে আসে। আর আমার সমস্ত অন্তঃকরণ অসহনীয় এক অনুভূতিতে কুঁকড়ে ওঠে। মুশতাক আলম, আমার আব্বা একজন দাপুটে লোক ছিলেন। এ এলাকায় অসংখ্য পাহাড়ি জমির মালিক তিনি। ঘরে বাইরে তার কথায় লোকজন ওঠবস করতো। কিন্তু মজার ব্যাপার হল অলি মুঝি একদিন এই লোকটার গায়ে স্যান্ডেল ছুড়ে মেরেছিল। মুঝির বরাবরই অনেক রাগ। মায়ের ঠিক উল্টোটা।
আমি সেদিন সেখানে ছিলাম। চিলতে উঠানে বসে পুরনো ক্যাসেট প্লেয়ারের কলকব্জা খুলছিলাম আর জুড়ছিলাম। অসেমা একপাশে পিঁড়ি পেতে মাছ কুটছিল। আর অলি মুঝি তার আজানুলম্বিত ভেজা চুলগুলো দুই ভাগে ভাগ করে নিয়ে রোদে শুকাচ্ছিল।
ঘটনার আকস্মিকতায় আব্বা একেবারে থতোমতো খেয়ে গিয়েছিলেন। আর আমরা একে অন্যের দিকে স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিলাম। এরপর সেদিনের ঘটনার কথা ভেবে, চোটপাটওয়ালা লোকটার ঐ বিব্রত চেহারা মনে করে আমার নয় বছরের বালক মন গোপনে খুশি খুশি হয়ে উঠেছে কতদিন! শুধু আমার বইয়ের পাতাগুলো ছিঁড়ে ফেলার জন্য নয়, বুদ্ধি হবার পর থেকে লোকটার যতগুলো খারাপ কাজের নমুনা দেখেছিলাম, সেদিন আমার মনে হয়েছে এতকাল পর অন্তত একটা শাস্তি পেয়েছে সে।
এ ঘটনার পর বাড়ির পরিস্থিতি বদলে যেতে থাকে। আমার মা, চিরকাল যাকে শান্ত, ধীর স্থির দেখেছি সেই মানুষটা প্রায় প্রতিদিন দরজা লাগিয়ে আব্বার সঙ্গে তুমুল ঝগড়া করতেন। আমি উঁকি দিয়ে দেখতে না পারলেও এপাশ থেকে সব শুনতে পেতাম।
থমথমে দিনগুলি থিতিয়ে আসে মুঝির মেডিকেল কলেজের ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পর। আমি ততদিনে বুঝে গেছি এ বাড়িতে মুঝির আর বেশিদিন ঠাঁই নেই। কিছুদিনের মধ্যে আমার আশঙ্কাকে সত্যি প্রমান করতেই যেন খুব আয়োজন করে গোছগাছ শুরু হলো। মুঝি তার প্রায় সবকিছুই তুলে তুলে বাক্স প্যাটরায় ভরতে লাগল যেন আর কক্ষনো সে ফিরবে না। আমি মুখ ভার করে ওর পিছু পিছু ঘুরতাম। মেয়েটা নির্বিকার ভঙ্গিতে কাজ করে যেত,মাঝে-মাঝে মনে হতো এ বাড়ি ছাড়তে পেরে ও হাফ ছেড়ে বেঁচেছে।
যাবার সময় অলি মুঝি আমার জন্য বেশ কিছু বই রেখে গেল। এ ঘরটায় সেই বইগুলো গোছানো আছে। বইয়ের পাতা খুললেই ভেতরে গোটা গোটা হরফে লেখা থাকে ‘অলিপ্রিয়া চাঙমা।’ আমারও অনেক বই আছে এখানে। কিছু বইতে আমি পৈত্রিকসূত্রে প্রাপ্ত উপাধিটা অস্বীকার করে মুঝির মতো করে লিখতাম ‘সুনয়ন চাঙমা’। বাড়িতে সবাই আমাকে নয়ন বা ছোটন ডাকলেও, সার্টিফিকেটে ‘জাহাঙ্গীর আলম’ থাকলেও মুঝির দেয়া নামটাই বেশি মনে ধরেছিল আমার। মুঝির যখন মন ভালো থাকত তখন সে সুর করে করে ডাক দিত -‘সুনয়ন,ও সুনয়ন!কই গেলি?’
আব্বা শুধু কিছু বই ছিড়েখুঁড়ে ফেলে ক্ষান্ত হননি। মুঝির ঘরটার প্রতি তার আক্রোশ কম ছিল না। লোকটার চিরকালের ধারণা ছিল অলিপ্রিয়া চাঙমা কুবুদ্ধি দিয়ে দিয়ে আমার মাথা খেয়েছে। তাই মুঝি চলে গেলে বেশ কিছুদিন এ ঘর তালাবন্ধ ছিল।
আব্বার দখলকৃত এ বাড়ি এখন জনমানুষহীন। একসময় এর উল্টোটা ছিল। আত্মীয়স্বজন দিয়ে গিজগিজ করত প্রতিটা ঘর। সন্ধ্যার পর বাইরের ঘর কখনো ফাঁকা থাকতে দেখিনি। এসময় আব্বার কাছে ধরনা দিতে আর নানারকম ধান্ধায় প্রায় প্রতিদিনই অন্তত জনা বিশেক লোক আসত এ বাড়িতে।
এরকম সময়ে আমার সর্বশেষ আশ্রয়স্থল, আমার মা মধুমতী চাঙমা ওরফে মিতা খানম একদিন ঘুমের মধ্যেই মারা গেলেন। আমি এখন বুঝতে পারি মা আসলে প্রতিদিন অল্প অল্প করে মরছিলেন। কিন্তু তখন ঐ সদ্য কৈশোর পেরুনো এই আমার ‘মা আর নেই’ ব্যাপারটা বুঝে উঠতে অনেকটা সময় লেগে গেল।
মা যখন রইলেন না, অলিপ্রিয়া চাঙমাও ডাক্তারি পাস করে এ শহরে কিংবা এ বাড়িমুখো হল না আর। ফলে এ বাড়ি আমার কাছে একেবারে রাক্ষসপুরী হয়ে উঠল। আব্বার সঙ্গে এক ছাদের নিচে এক একটা দিন কাটাতে গিয়ে প্রতিনিয়ত আমার দমবন্ধ হয়ে আসতে চাইত। কবে এ বাড়ি ছাড়ব তার অপেক্ষায় দিন গুনতে শুরু করলাম আমি। মুঝিকে আসতে বললে প্রতিবারই সে অনুরোধ উপেক্ষা করেছে। অলিপ্রিয়া চাঙমা প্রতিবারই আমাকে নিরুত্তর করে দিয়ে বলেছে- পারলে আমাদের বাড়িটা, পাহাড়টা ফিরিয়ে দে। তখন হাজারবার আসব।
যে মানুষটার জন্য মুঝি এ বাড়ি ছেড়েছিল, তার মৃত্যুর পর কিন্তু আর কোনো বাধা রইল না। বাড়িটি এখন উত্তরাধিকার সূত্রে আমার। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছুটিতে এলে নির্জনপুরীতে একা একা ভীষণ হাঁপিয়ে উঠি। অসেমা বুড়ি অবশ্য এখনো আমার জন্য দুইবেলা রাঁধতে আসে। তার ছেলে উনুমঙ রাতে বাড়ি পাহারা দেয়।
সারাদিন একলা আমি বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়াই। বনপাতার জংলী ঘ্রাণে নিঃশ্বাস নিতে নিতে গলা ফোলা ছাতারের ক্যাচক্যাচ শব্দে কান পাতি। আমাদের বাড়ির উল্টোদিকের বৈলাম গাছটায় ছাতারের দল এসে রোজ এমন কলকল করত। গাছটা আর নেই, বন ছাতারের রোজকার বৈঠকটাও অনেক বছর হয়ে গেল আর শুনতে পাই না। ওদের শব্দ পেলেই মুঝি হাতের ইশারায় ডাক দিয়ে বলত-দ্যাখ দ্যাখ কেমন ঝগড়াটে পাখিগুলো, ঠিক আমার মতো!
যেদিন আব্বার ভাড়া করা লোকগুলো গাছটার ডালপালা আর গুড়িসুদ্ধ সব উপড়ে নিয়ে গেল, সেদিন খুব তোলপাড় হয়েছিল বাড়িতে। বাইরের ঘরে আব্বার জিনিসপত্র সব লণ্ডভণ্ড করে রেখে নিজের ঘরে এসে দরজায় খিল দিয়েছিল মুঝি। সারাদিন দরজা খোলেনি, মুখে খাবার তোলেনি। আমি ঠিক গাছের শোকে যতটা নয় তারচেয়ে বেশি কেঁদেছিলাম মুঝির ওরকম পাথর মূর্তি দেখে। তখন থেকে আমার প্রতিদিন মনে হত মুশতাক আলমকে যদি নিজের হাতে শাস্তি দিতে পারতাম।
লোকটার মৃত্যুর পর একদিন কথাপ্রসঙ্গে মুঝিকে জিজ্ঞেস করলাম সেদিনের ঘটনার কথা। তখন জানলাম ওর ফেলে যাওয়া ডায়েরিটার কথা।। মুঝি বলেছে এবার আর সে ডায়েরি পড়তে আমার বাধা নেই।
ঈদের ছুটিতে বাড়ি এসে সবার আগে ওটা খুঁজে বের করেছি। গতকাল রাত থেকে পড়ছি ওর ডায়েরি। পড়তে পড়তে অদ্ভুত এক আরামবোধ হচ্ছে আমার। বহুদিনের জমে থাকা গ্লানিগুলো ক্রমশ প্রশমিত হয়ে আসছে। নিজের পিতাকে ঘৃণা করার গ্লানি, প্রতিনিয়ত তার মৃত্যু কামনার গ্লানি। শেষ দিনটিতে আমার নিস্পৃহতার গ্লানি। সেদিন লোকটার ডাকে সাড়া না দেবার কারণে যে অপরাধবোধ আমাকে এখনো গিলে খায়, এতদিন পর আমি সেসব থেকে মুক্তি পাচ্ছি। আমি এখন নিশ্চিতভাবে জেনে গেছি মুশতাক আলম লোকটা আসলে এসবেরও যোগ্য ছিল না।
ডায়েরিটা পড়তে পড়তে আমি অবাক হয়ে লক্ষ করলাম অলিপ্রিয়া চাঙমাও এ লোকটাকে খুন করতে চাইত। সেদিনের তারিখটা মোটা হরফে লিখে তার নিচে ও লিখেছে-
‘আজকে আমি লোকটাকে জুতা ছুঁড়ে মেরেছি। অসেমা সামনে ছিল। সুনয়নও। শুয়োরটার ঐ ভয় পাওয়া চেহারাটা মনে করলেই বুকটা একটু হালকা লাগছে আমার। আমি জানি বাথরুমের জানালায় ফুটোগুলো ঐ লোকটা ছাড়া অন্য কেউ করেনি। এরপর সুযোগ পেলে ওকে আমি খুন করব।‘
‘শুয়োরটা এখন দিদির মতো আমাকেও ওর কোনো পছন্দের সাগরেদের সঙ্গে বিয়ে দিতে চায়। পুরোপুরি কবজা করতে চায় আমাদের। আরেকবার এমন পায়তারা করলে সত্যি সত্যি জুতোর বাড়ি পড়বে ওর গায়ে।‘
‘আমার শুধু দিদির জন্য কষ্ট হয়। পায়ের কারণেই বোকা দিদিটার জীবন এমন হয়ে গেল। ‘
মায়ের বাম পাটা পোলিওতে দুর্বল ছিল ছোটোবেলা থেকেই। ফলে দেখতে শুনতে আর স্বভাবে যত ভালো হোক না কেন সব ঢাকা পড়ে গেল এই একটা খুঁতের আড়ালে। অন্যদিকে মুশতাক আলম সমতলের প্রভাবশালী লোক। টাকা আর ক্ষমতার জোর ছিল তার। স্কুল কমিটির মিটিংয়ে মধুমতী চাঙমাকে দেখামাত্রই মুগ্ধ হয়ে প্রেমে পড়ে যায়নি সে। কিন্তু নিজের দুরভিসন্ধি সফল করতে মিথ্যা প্রেম আর সব রকম ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে এ পরিবারের অনাথ কন্যাটিকে বিয়ে করতে তার খুব বেশিদিন সময় লাগেনি।
তবে সময় চিরকাল একজনের অনুকূলে থাকে না।অসীম ক্ষমতা দিয়েও তাকে নিয়ন্ত্রণ করা রক্তমাংসের মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই আমি জানতাম মুশতাক আলমেরও পতন অনিবার্য। কিন্তু সে পতন যে এতটা আক্ষরিক হয়ে উঠবে তা ভাবতে পারিনি আমি।
সেদিন ভোরেই আমি কলেজের ছুটিতে বাড়ি এসে পৌঁছেছিলাম। সারাদিন তুমুল ঝড়বৃষ্টি হল। রাতে সিঁড়িঘরের বাতি নিভিয়ে বিছানায় পিঠ রাখতেই পায়ের শব্দ পেলাম। আব্বা নামছেন। ছাদের খোলা হাওয়ায় সিগারেট ফুঁকবার অভ্যাসটা তার পুরনো। অন্যপাশ ফিরে শুতে শুতে আমার মনে পড়ল সিঁড়িতে অনেকখানি জল দেখেছি৷ বৃষ্টির জল। বহুদিন এমন বৃষ্টি হয়নি এদিকটায়।
তারপর ঘুম লাগা চোখেই শুনতে পেলাম বীভৎস সেই আর্তনাদ। বালিশের তলায় কান দু’হাতে চেপে মাথাটা গুঁজে রেখেছিলাম আমি। বিছানা ছেড়ে উঠে সিঁড়িঘরের বাতি জ্বালাইনি। পা দুটো অসাড় হয়ে গিয়েছিল। অদ্ভুত এক উত্তেজনায় দেয়ালের দিকে মুখ করে আমি বিছানায় শুয়ে ছিলাম পুরোটা রাত।
আজকাল প্রায় প্রতি রাতেই জানালা মেলে দিয়ে বাদামি পাহাড়টার দিকে চোখ রাখি। ব্যাঙের ছাতার মতো প্রতিদিন ছোট ছোট টিনশেড ঘর উঠছে তার গায়ে। সারারাত মিটমিটে বাতি জ্বলে সেখানে। মাঝেমাঝে আগুনের শিখায় গাছপালা ঘরবাড়ি উজাড় হতেও দেখা যায়। কখনো ওর শরীরের অনেকখানি কেটে নিয়ে সমতলের দানবেরা নিজেদের মনমতো রাতারাতি নতুন সব বসত গড়ে তোলে।
সেদিকে নির্নিমেষ চোখ ফেলে আমার মাঝেমাঝেই মনে হয় অভিমানী মেয়েটি হাঁটু ভাঁজ করে বসে সেই একই ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে। জন্ম থেকে দেখছি তার এ ভঙ্গি। আমি তার নাম রেখেছি অলিপ্রিয়া।