কে কাকে বোকা বানাল? পর্দার আড়ালের গল্পটা কেউ জানবে না কোনো দিন, জানলেও কী এসে যায়, বোকা কী তবু আমরা বনি না? এই যে শ্যামল, ওষুধের দোকানের ছেলেটা, সামান্য তোতলা কিন্তু কী পর্যন্ত পরিশ্রম করত, ঘুরেঘুরে ব্লাড স্যাম্পল নেওয়া, ওষুধ ইত্যাদি বাড়িতে দিয়ে আসা। সে যখন বলেছিল **** ফান্ডে টাকা রাখো, তখন আমরা অনেকেই জেনেশুনে দিয়েছিলাম ও টাকা যাবে। আমি অন্তত জানতাম, তবু ছেলেটার লাভ হবে খানিক এই আশায় কিছু বলিনি। তারপর একটার পর একটা কেলেঙ্কারি ধরা পড়তে লাগল, সে মুখচুন করে ঘুরে বেড়ায়, একদিন পিটুনিও খেয়ে গেল। সে বেচারার কী দোষ? কিন্তু গায়ের ঝাল মেটানোর জন্য সেই রয়েছে, আসল যাদের কাছে টাকা গেল তারা তো বহাল তবিয়তে ছড়ি ঘোরাচ্ছে।
তাহলে বোকাটা কে? আমি, সেই ছেলেটা না যাকে মুখের ভাষায় বলে পাবলিক? আসলে সবাই। যদিও কেউ স্বীকার করতে চায় না। কেই বা চায়। তাই অন্যকে ধাপ্পা দেওয়ার খেলাটাতেই যা আনন্দ।
এ খেলার শুরু ভারতে, যেমন আরো অনেক খেলা দাবা, ক্রিকেট, ফুটবল ইত্যাদি ইত্যাদি। সব চুরি হয়ে গেছে। আপনারা জানেন নিশ্চয় কালিদাসে ছিল যে বালকের দল একখান গোলাকে কাঠের টুকরো দিয়ে পাং-পটাং করে মেরে যাচ্ছে আর তার পিছনে ছুটছে? তারপর তো কী কাণ্ড আল বিরুনি না ইবন বতুতা এসে ব্যাপারটা শুনে লিখে নিল। তারপর হল ক্রুসেড, সেই যে মেরি ম্যাগডালেনের মর-শরীর খুঁজতে এসে নাইট টেম্পলাররা দেখল এমন একখান খেলাও আছে। ব্যাস তারা সেই হোলি গ্রেইল নিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে খেলাটাও নিয়ে গেল। ইতালিতে বোকাচ্চো-দাদা যখন ডেক্যামেরন লিখলেন তার একটা পরিচ্ছেদে ছিল এই খেলা। কিন্তু হল কী, সে তখনকার ছাপা বই, কীভাবে হারিয়ে গেল একটা ফর্মা, আমাদের কালেজ স্ট্রিটের প্রকাশকদের যেমন হয় আর-কি। কিন্তু নাইট টেম্পলাররা ইংল্যান্ডেও ছিল তারা তাদের মঠে গোলা আর লাঠি নিয়ে খেলতে লাগল। ব্যস আসতে আসতে সে খেলার নাম হয়ে গেল ক্রিকেট। আমরা ভাবলাম সাহেবদের খেলা। আর এমন বোকা দেখুন আমাদের ঐতিহাসিকরা, ওদের মুখের ঝাল খেয়ে বসে আছে, বলছে না যে খেলাটা আমাদের। এতগুলো টাকা, এত খেতাব, কাপ পাওয়ার পরেও হুঁশ ফেরে নাকো। কী নিমকহারাম, কী নিমকহারাম।
আমি অবশ্য ক্রিকেটের ইতিহাস নয়, খুঁজছিলাম ধাপ্পার ইতিহাস। ধাপ্পাই কী আমাদের প্রাচীনতম পেশা? তা গিলগামেশ পড়লাম, তালমুদ ঘাঁটলাম, বেদ উপনিষদ কিচ্ছু বাকি রাখিনি জানেন। গুগুল ঘেঁটে এসব তথ্য পাওয়া যায় না। ওরা লেখে চসার সাহেবের কবিতায় প্রথম পাওয়া যায় এপ্রিল ফুল-এর খবর। বললেই হল? পাবলিক এমনি এমনি একখান বই পড়ে ধাপ্পা দিতে শিখল? এমন বুদ্ধি ওদেরই হয়। না-কি আমাদের ধাপ্পা দিল? তো আমি অনেক খুঁজে বের করলাম বোকা বানানোর খেলার ইতিহাস। আমাদের নানা বইয়ে নানাভাবে সেটা লেখা রয়েছে, মোক্ষমুলার সাহেবের চোখ এড়িয়ে গেছিল বলে লেখেননি আর আমরাও তিনি লেখেননি বলে জানার চেষ্টা করিনি। চাণক্য, ওহ প্রাতঃস্মরণীয় গুরু, লিখে গেছেন কৈতববাদ আমাদের রাষ্ট্র পরিচালনার একটা প্রধান অঙ্গ। সেটা কী বুঝলেন না তো? সংস্কৃত শিক্ষাহীন পাষণ্ড, তার মানে হল ঢপ। জুমলা। যার সাহায্যে মহান গ্রিকদেরও আমরা কাৎ করে দিয়েছিলাম, পুরু আলেকজান্ডারকে হারিয়ে দিয়েছিল। তারপর সেই মহান গুপ্ত বংশের সাম্রাজ্য সুপ্ত প্রতিভার মতো ছড়িয়ে পড়েছিল এশিয়ায়। তখনই তো বাৎস্যায়ন লিখলেন কামসূত্র।
ব্যাস যেই বললাম হয়ে গেল তো? পড়েছেন তো স্টেশনের দোকান থেকে কিনে মুচমুচে কাগজে ঝ্যালঝ্যালে ছবিওলা চটি ওই নামে, আর নাহয় আঁতেল হলে মিরা নায়ারের সিনেমায় যেখানে ইংরেজিতে কথা বলে উজ্জয়িনীর সুসভ্য নাগরিকেরা। আসল বইখানা পড়লে বুঝতেন সেখানেও আসল কথা হল ধাপ্পা। গোটা দেশ জুড়ে তার নাগরিক ও নাগরিকারা কীভাবে ধাপ্পা দেয়, তার কত রকম কৌশল ও প্যাঁচ পয়জার। সে-সব মেনে ধাপ্পা না দিলে গ্রামীণ, মূর্খ, বর্বর বলত সে-সময়। যেমন ধরুন গঙ্গারিডির নাগরিকা যদি ডান চোখ ডান দিকে ঘুরিয়ে তাকায় তো বুঝতে হবে আজ সন্ধ্যায় তার স্বামী ঘরে আছে এসো না, আবার বামচোখ যদি উপর থেকে নিচে করে তো তার মানে কাল দুপুরে অভিসারে আসব তোমার ঘরে। এ আবার সব ক্ষেত্রে এক নয়, যদি বিন্ধ্যর দক্ষিণে যায় নাগর, সে যদি সেখানকার অভিসারিকার কটাক্ষ দেখে এমন মনে করে তো বেহদ্দ বোকা বনবে। এর মানে ওদিকে পুরোই আলাদা।
এসব তখন জানতে হত জটায়ুজি, না হলে সব সাহারায় বিভীষণ হয়ে যাবে যে। আমরা ভুলে গেলাম তাই সতের অশ্বারোহীর পিছনে লাখো লাখো তুর্কি এসে গিলে ফেলল দেশটা। তারপর তো ক্লাইভ সাহেব কী গোলটাই না দিল। সিরাজ কেঁদে বললেন এই নাও মীরজাফর তোমার সামনে খুলে রাখলাম তাজ, মীরজাফর ভিজে চোখে বললেন আমি তোমাদেরই লোক। তারপর আসল সময় দেখা গেল তিনি বলছেন আমি কোম্পানির দলে মানেই নবাবের দলে, নবাবের দলে মানেই কোম্পানির দলে। আর এই যে আমরা বাঙালী ভেবেছিলাম ব্যাটারা এসেছে ব্যবসা করতে, দেখা গেল নামেই কোম্পানি আসলে দেশ চালায় তারাই। সে কোম্পানির নাম ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, শেয়ার বাজারে এখন তার নাম বদলেছে, কাম বদলায়নি। কিন্তু এখনকার নাম নিলে, মশাই পাকিস্তান না আফগানিস্তান না উজবেকিস্তান কোথায় পাঠিয়ে দেবে, আমি অত উজবুক নই যে লিখে কেস খাব।
কিন্তু সময়ের চাকা ঘোরে। ধাপ্পার ইতিহাস নিয়ে চর্চা না হোক, তার প্রয়োগ আমরা ফিরিয়ে এনেছি। মার্ক্স সাহেবও বলেছিলেন চেয়ারে বসে চুলকিও না, আসল ব্যাপারটা হল প্র্যাক্সিস, প্রয়োগ। আমরা ধাপ্পার পূর্ণ প্রয়োগ করেছি। আগে সার্টিফিকেটে বয়স ভাঁড়াত শুনেছি লোকে এখন আমরা পুরো সার্টিফিকেট ভাঁড়িয়ে দিই। ইস্কুলের মাস্টারি থেকে সরকারি চাকরি সবেতেই আমরা চমৎকারভাবে ধাপ্পার দক্ষতা অনুযায়ী সুযোগ পাই। নেতারা এ বিষয়ে প্রকৃত নেতৃত্ব দেন আর আমরাও মাঝে সাঝে ভোটটোট দিয়ে তাদের চমকে দিই। এমনকি এটা যে জীবন যাপনের একমাত্র উপায় তা বুঝতে আপনার দশ মিনিট লাগবে বা। কোনো ট্রেনে, বাসে উঠুন দেখবেন ফোনে বলছে এই তো আমি গড়িয়াহাট ছাড়িয়েছি, বাইরে তাকান দেখবেন সেটা গড়িয়াহাট ছাড়া যে কোনো জায়গা হতে পারে।
তো এই হল জীবন। ছোট খাটো ব্যাপার মনে হচ্ছে? একটা মহাকাব্যিক ধাপ্পার কথা বলি, বা যে মহাকাব্যর গল্পের বিষয় হল ধাপ্পা। গ্রিকদের দেবরাজ জিয়ুস এক মহিলাকে ভোগ করবেন, প্রেমটেম নিবেদন না করে রাজহংস সেজে তাকে বলাৎকার করলেন (তখন কনসেন্টের গল্পই ছিল না)। সেই সঙ্গমের ফলে ঐশ্বরিক ডিম প্রসব হল এবং তার থেকে জন্ম নিলেন হেলেন। বিশ্বসুন্দরী প্রতিযোগিতা তখনও ছিল, তবে তা দেবীদের মধ্যে, মর্ত্যে আসেনি। তো সেখানেও ঘোটালা হল, সেই ঘোটালার ফল হিসেবে প্যারিস পেলেন হেলেনকে। দেবীর কৃপায় সুন্দরী হেলেন প্রেমে পড়ে পালালেন স্বামীকে ছেড়ে প্যারিসের সঙ্গে। রাজা রাজড়ার ব্যাপার তাই ডায়মন্ড হারবারের হোটেলে কয়েক রাতের বদলে একেবারে নিজের দেশ ট্রয়ে নিয়ে গেল প্যারিস। ব্যাস তারপর সে-আমলের বিশ্বযুদ্ধ। খুব ধর্মযুদ্ধ হল? আজ্ঞে না, স্বয়ং যুধিষ্ঠিরকেও ঢপ দিতে হয়েছিল যুদ্ধে, কাজেই সে কি আর হয়? গ্রিকরা হেক্টরকে মেরে ফেললে তবু যুদ্ধে যেতে না। বাড়ি ফিরতে হবে, ওয়ার অন টেররই হোক আর ভিয়েতনামই হোক, শেষ একটা চাই। তো তারা পরামর্শ করলে, একটা কাঠের ঘোড়ার মধ্যে কিছু সৈন্য লুকিয়ে ফেলে আসা হবে ট্রয় নগরীর দেওয়ালের সামনে। এবং সেই দিনটা পয়লা এপ্রিল ছিল নিশ্চয়ই। হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে গেল ট্রয়ের লোকেরা, যেমন আমরা পুট করে না জেনেই ট্রোজান ভাইরাসওলা কোনো লিংক ক্লিক করে ফেলি। তারপর একেবারে মাঝরাতে কচুকাটা হল তারা।
আমার এই গল্প বলার উদ্দেশ্য হল যে আজকের জুমলা থেকে কালকের যে কী ফ্যাচাং হতে পারে তা জানে মহাকাল। কাজেই যতই অল ফুলস ডে-র বদলে অল ডে ফুলস করে একে অপরকে আমরা আহ্লাদে আটখানা হই না কেন, কখন যে কী ঘটে যাবে কিচ্ছু বলা যায় না। তখন মুচকি হাসবে ইতিহাস।