তবুও আমরা অসুখী ছিলাম সেইসব দিনে যখন চাইলেই ছুঁয়ে দেয়া যেতো থোকা থোকা ফুল, মধুমঞ্জরি কিংবা কাঠগোলাপ। দোকানির সঙ্গে দরদামে কেনা যেত আঙুর বেদানা, লাল ফেটে যাওয়া তরমুজ। আমাদের রিকসাগুলো আমাদের নিয়ে যেতো সেই যে কোথায়, যেখানে আমরা তুচ্ছ কারণেও যেতে চাইতাম; অধিক ভাড়ায় মেটাতাম মধ্যবিত্তের শখ। আমরা শুনতাম ভেঁপুর সম্মিলিত চিৎকার। তালগোল পাকানো সুরহীন তালহীন একঘেয়ে আওয়াজ। আমরা দল বেঁধে বানাতাম রঙিন পোশাক। কেউ শাড়ি, কেউ কামিজ, পুরুষের পাঞ্জাবিতে থাকত হাজারও আঁকিবুকি, রমণীয় দাগ। আমরা গাইতাম সেইসব ভিড়ের গান যাকে বলে কোরাস। আমাদের পিচ্ছিল লাল শরীর বেয়ে টপ টপ করে ঝরতো ঘাম। আমরা রোদে শুকাতাম আমাদের হাসি, বাঁকা ঠোঁট আর রঙিন পাড়ের আঁচল। কাঁচা নোনতা স্বাদের আশায় খুঁজতাম ছোট্ট এক চিলতে শর্ষে মাখানে আমসাজি। আমাদের মধ্যে একদল উঠে পড়ে যেতো এইসব আয়োজনের অসারতায়। কেউ আওয়াজ তুলতো অর্থহীন ডিপ্রেশনের। বিরুদ্ধপক্ষ হাসতাম আমরা অথবা গিলে ফেলতাম তাদের এইসব অহেতুক উলম্ফন। কত শত হাত ধরাধরি, শরীরে শরীর মিলানো আয়োজনে কাটতো আমাদের টগর-হাস্নাহেনার দিন। মেদুর নিটোল দিনে স্বপ্নালু চোখের ভাঁজে থাকতো প্রেমিকের বিচ্ছেদ। আমাদের রমনা ছিল, রবীন্দ্রসরোবরও। ছিল চৈত্র-সংক্রান্তির দিনে রঙিন পুতির মালা। বাতাসে উড়তো ধুলো ধুলো মেঘ। কোনো কোনো সন্ধ্যায় ঘনিয়ে আসতো ঝড়; পূর্ণিমায় খরস্রোতা বান। বেশ কিছু নতুন মানবিক বোধ গজিয়ে যেতো সেই উত্তাল সংকটে অথবা পরিচর্যার বেড়ে উঠতো আরো কিছু সম্পর্ক। তবুও আমরা অসুখী ছিলাম। আমাদের অসুখ ছিল কী নেই কী নেই হা-হুতাশ। ট্যাপা পুতুল ও ক্রোধান্ধ রাজার মুখোশে আমাদের দরজায় যে নতুন দিন আসতো তার বরণেও গাইতাম ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম আমরা, আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম!’ ইদানীং সময় পাল্টেছে। পাল্টেছে হাওয়া। শরৎ আসে শিউলিও ফোটে। আসে শীত। আমাদের চকচকে হাসি আজ বাজায় মোহন সুর। মুখবইয়ের নীল দরিয়ায় সুখ সুখ বন্যা, নিত্যই পার্বণ আমাদের। ঝর ঝর মুখর বাদল দিনে আমরা খিচুড়ি মাংসের ঝোল আর ইলিশ সাজাই। কদম গুঁজি খোঁপায়, বসন্ত বাতাসে আমদের গাদাফুল মন বিভোল হয় হলুদে। আমাদের আক্ষেপ নেই আর। মাঘের শিশিরেও কৃষ্ণচূড়া ফোঁটে লাল লাল কমলা। আমরা সুখী ভীষণরকম সুখী, নিঃসঙ্গ বিছানায় স্মৃতি কাততারতার গোঙানি আমরা গিলে ফেলি আরো নিঃশব্দে। সামাজিক সম্মেলনে আমাদের সুখের কথা মহাকাব্যের মতো চর্চিত হয় রোজ। আমরা চকচকে। আমরা হার্দ, আমরা বন্ধুপ্রবর। আমাদের প্রাপ্তির সানবোর্ড ঘোরে সবার দরজায়। উপচে পড়া অন্তর্গত ঘৃণা কোথায় লুকাই কোথায় ঢাকি কেউ জানে না, কেউ না। আঙুল চলে নাচন, লাইক,কমেন্ট, রিপ্লাই, শেয়ার অপশন। প্রেমময় আত্মরতিতে নিজেই বাজি, নিজেই কাঁদি নিজেই পুড়ি ঈর্ষার জ্বরে। একলা খাঁচায়, একলা বাঁচায়
আমাদের বর্তমানটা এভাবেই ভ্রান্তিহীন সুখের গন্তব্য পৌঁছায় আড়ম্বড়ে,আয়োজনে।
Facebook Comments Box