মানুষটির নাম সম্ভবত আজুউদ্দিন অথবা আজিমউদ্দিন ছিল। তা না হলে আমাদের কাছে নামটি পৌঁছাতে পৌঁছাতে আইজু হয়ত হয়ে যেত না।মানুষটির নাম নয়, মূলত সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তার শারীরীক অবয়ব। তবে আমরা শুরুতেই সেদিকে যাবো না। আমরা বরং জেনে নিই এই মানুষটি কেন আলোচনায় এলো।
মফস্বলের জীবন নিতান্তই নিরিবিলি হবার কথা। সেই নিরিবিলি জীবনে শহুরে সব সুবিধা যুক্ত থাকলে তাকে সুখী এলাকা বলাই যায়। এর সাথে সোনায় সোহাগা এলাকার নামটিও।
এই এলাকার নাম সুখপুর।
সেই সুখপুরেই এমন বিভৎস ঘটনাটি ঘটে গেলো। ঘটনার বিভৎসতায় আমরা যে শুধু চমকে উঠি তাই নয়, সাথে সাথে কুণ্ঠিতও হই নিজেদের কাছে।
তবে এই বিভৎস ঘটনাটি নয়, আজ আমাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে হলো অন্যদিকে।
বেশ নাটকীয়ভাবেই আইজু মিয়া এলো আমাদের সকলের দৃষ্টিতে। নাটকের সূচনা হলো এভাবে,
সুখপুর শহর সকাল থেকেই বিভৎস এক ঘটনার আকস্মিকতায় হতবিহ্বল।তারমধ্যেই জানা গেলো কেউ একজন এলাকার পানি উন্নয়ন বোর্ডের একমাত্র উঁচু পানির ট্যাংকির মাথায় দাঁড়িয়ে আত্মহত্যার হুমকি দিচ্ছে। সারা শহরের মানুষ গিয়ে জড়ো হলো সেই ট্যাংকির নিচে। সেখানে একে একে সাইরেন বাজিয়ে ক’খানা ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি এসেও জড়ো হলো।
এদিকে কেউ মোবাইলে ভিডিও করছে, কেউ ফেসবুক লাইভে আইজু মিয়ার কান্ড কারখানা দেখানোর সাথে সাথে ধারাবর্ণনা করে যাচ্ছে, আবার কেউ কেউ কিছুক্ষণ পর পর চেঁচিয়ে উঠছে ‘ ঝাঁপ দিলো রে… ঝাঁপ দিলো…..’। এতসব হৈ হট্টগোলের ভেতরেই ফায়ার সার্ভিসের লোকজন উঁচু মই ট্যাংকিতে লাগিয়ে নিচে জাল নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। ওদিকে থানা থেকে আসা পুলিশ হ্যান্ড মাইকে ক্রমাগত বলে চলেছে,
‘ আপনার জীবনের দাম আমাদের কাছে অনেক। আপনার জন্য আমরা সবাই আছি। সুখপুরের সবাই চায় আপনি সুস্হভাবে নিচে নেমে আসুন…….’
এই জায়গাতে একটু থেমে আবার পুলিশ বলা শুরু করলো,
‘ আপনার সকল সমস্যার কথা আমরা শুনবো। আপনি নিচে নেমে আসুন আইজু মিয়া’।
ভিড়ের ভেতর থেকে কেউ কেউ হাত তুলে ডেকে চলেছে,
নেমে আসেন…..নেমে আসেন
এতসব আহ্বান ঠিক কতটুকু আইজু মিয়ার কাছে পৌঁছাচ্ছে তা ট্যাংকির নিচ থেকে বোঝা যাচ্ছে না। তবে এতটুকু পরিষ্কার সুখপুরের নির্ভেজাল জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত সকলে পর পর ঘটে যাওয়া দুটো ঘটনায় বেশ আলোড়িত। সাধারণত অন্যদিন এই সময়ে সুখপুরের সবাই যে যার অফিস, স্কুল-কলেজ, দোকানপাট, ঘরসংসার নিয়ে ব্যস্ত থাকে। নিয়মমাফিক জীবনে অভ্যস্ত সুখপুরের মানুষগুলোর কাছে আজকের দিনটি এসেছে সকল অনিয়মের খতিয়ান নিয়ে।
মধ্যবিত্ত আধিক্য এই সুখপুরের আরেকটি চেহারা হলো ক্ষুদ্র হতদরিদ্র একটি অংশ। যাদের প্রায় সকলেই বাস করে একটি নির্দিষ্ট পাড়ায়। সেই পাড়ার নাম ঈশ্বরদিয়া।
ঈশ্বরদিয়া পাড়ায় খুব স্বাভাবিকভাবেই আজ ভোর এসেছিলো। অন্যদিনের মতো স্বাভাবিকভাবেই সে পাড়ার নিবাসী আয়েশা বেওয়ার দিন শুরু হয়েছিলো। বয়োঃবৃদ্ধ হলেও কাজে সক্ষম আয়েশা বেওয়া। তাঁর কাছে কাজ মানেই অন্নের যোগান। এই অন্নের প্রতি আয়েশা বেওয়া দূর্বলতাও অন্যরকম,
আহারে ভাত, এই ভাতের লাইগ্যা কত কাঁনছি, ভাত না পাইয়া কচু সেদ্ধ খাইছি……..
এজন্যই প্রতিদিন ভোর থেকে এ দোকান ও দোকানের সামনে ঝাড়ু দিয়ে, খাবারের হোটেলগুলোয় পানি টেনে দিয়ে আয়েশা বেওয়া ভাতের ব্যবস্হা করতো। আয়েশা বেওয়ার ছেলে রিক্সা চালিয়ে যা পায় তাতে তাঁর ভাতের অভাব হবার কথা ছিল না। তবে ওই যে ভাতের অভাব যে জীবনে একবার দেখেছে তাঁর কাছে ভাত যোগানই অভ্যাস হয়ে দাঁড়ায়।তাই ভোর থেকে উঠেই শুরু হয়ে যেত তাঁর ভাত সংস্হানের ব্যবস্হা।
আজ ভোরে দুয়ারে আলো জ্বালিয়ে উঠোনে নামতেই একটা শীনশীনে হাওয়ায় কেঁপে উঠেছিলো আয়েশা বেওয়া।
তবে আশ্বিনের জাড় যতটুকু তাঁকে বেসামাল করছিলো তারচেয়ে বেশি বেসামাল করেছিলো নিজের সন্তানের মাতলামি। সারারাত নেশা করে ঘরের সামনের নিচু আঙিনায় পড়েছিলো সে। আয়েশা বেওয়ার সাড়া পেয়েই সেই ছেলে বলতে শুরু করেছিলো,
তুই মা না, তুই একটা রাক্ষসী, তোর লাইগ্যা আমার জীবনে সুখ নাই…তুই একটা ডাইনি…
ছেলের এসব গালিগালাজে আয়েশা বেওয়া অভ্যস্তই ছিল। তবে এরপরে ছেলে যা বলেছিলো তাতে নিজেকে ধরে রাখা অসম্ভব হয়ে গিয়েছিলো আয়েশা বেওয়ার,
বইত্যাল তুই আমার সংসার বানতি দেস নাই…
এমনিতেই বয়স্ক শরীরে ধৈর্য কমে গিয়েছিলে আয়েশা বেওয়ার আর শরীরটাও ঝামেলা করছিলো, রাগে আর ঘৃণায় মাতাল ছেলেকে কষে একটা চড় মেরেছিলো।
খুব সামান্য ঘটনা, মাকে অসম্মান করায় ছেলে চড় খেয়েছে।
কিন্তু ওই যে আজ দিনটি সুখপুরে এসেছিলো অন্যভাবে। অন্যদিন হলে মাতাল ছেলে আরোও খানিক সময় গালিগালাজ করে থেমে যেত। আজ আর তা হয়নি। উঠোনে পড়ে থাকা একটা ইঁটের টুকরো দিয়ে আয়েশা বেওয়ার মাথা নির্বিকারে থেঁতলে দিলো ছেলে।
ব্যস্, নিষ্কলঙ্ক সুখপুরের গায়ে লেগে গেলো মাতৃহত্যা নামক কলঙ্ক।
থানা পুলিশ আয়েশা বেওয়ার বিভৎস লাশ নিয়ে ব্যস্ত হতে না হতেই আইজু মিয়ার পানি ট্যাংকির ঘটনা সবাইকে ব্যতিব্যস্ত করে তুললো।
সুখপুরকে দুশ্চিন্তায় ডুবিয়ে আইজু মিয়া এখনো ট্যাংকির মাথায় দাঁড়িয়ে আছে। ফায়ার সার্ভিসের লোকজন এরই মধ্যে প্রায় পৌঁছে গেছে আইজু মিয়ার কাছাকাছি। আর এই সময়েই ঘটে গেলো আরেকটি বিপত্তি।
নিচে দাঁড়িয়ে থাকা অসংখ্য উৎসুক লোকজন চেঁচিয়ে উঠলো,
পড়লো রে…পড়লো…
ঝাঁপ দেওয়া থেকে বিরত হলেও আইজু মিয়া সেই উঁচু শব্দসীমার বাইরে থেকে কিছু একটা বলছিল। তবে শুধু বললেও না হয় পরিস্হিতি সামাল দেওয়া যেতো। উত্তেজনায় আইজু মিয়া যে ট্যাংকির এ মাথা ও মাথা করছিলো তাতেই বিপত্তি ঘটলো। পা ফসকে আইজু মিয়া ট্যাংকি থেকে প্রায় পড়েই যাচ্ছিলো।
কোনোরকমে বেরিয়ে থাকা একটি লোহার রড ধরে এখন ঝুলছে আইজু মিয়া।
আমাদের চোখে পড়লো আইজু মিয়ার বেখাপ্পা শারীরীক গড়ন। ট্যাংকির মাথায় ঝুলে থাকা আইজু মিয়ার ঘাড় একদিকে হেলে আছে বেখাপ্পাভাবে।
নীচে কৌতূহলী জনতার ভেতর থেকে কেউ বলে ওঠে,
আহারে, এইভাবে ঝুলে থাকা যায়? হাত ফসকে পড়ে না যায়।
সমবেত সবাই চেঁচিয়ে ওঠে,
কিছু করেন ভাই তাড়াতাড়ি আপনেরা, মানুষটা ওইখানেই মইরা যাইবো…
এবার জাল ধরা হলো লোহার রডে ঝুলে থাকা আইজু মিয়ার নিচে। হ্যান্ড মাইকে পুলিশ অনবরত বলে চলেছে,
আইজু মিয়া শক্ত করে ধরে থাকেন লোহার রডটাকে, আমাদের লোকজন আপনার খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেছে।
এদিকে সকাল থেকে ঘাড় উঁচু করে উপর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সমবেত জনতার কারো কারো ঘাড় ব্যথা হয়ে গেছে। কেউবা অনবরত চেঁচিয়ে গলা ভেঙে ফেলেছে। আবার কেউ কেউ বসে পড়ে হা হুতাশ করছে।
তবে সময় তো আর বসে নেই।
ওদিকে আয়েশা বেওয়ার সুরতহাল হয়ে গেছে এরমধ্যেই। পুলিশ রিপোর্টে লেখা হয়েছে মাথায় আঘাতজনিত কারণে মৃত্যূ। পুলিশ বাদী হয়ে মামলাও দায়ের করেছে আয়েশা বেওয়ার ছেলের বিরূদ্ধে। তাই আয়েশা বেওয়ার নৃশংস মৃত্যূ নিয়ে কারো মনে আপাততভাবনা নেই তেমন।
সুখপুরের সব ভাবনার কেন্দ্রবিন্দুতে এখন পানির ট্যাংকিতে ঝুলতে থাকা ওই মানুষটি।
অবশেষে বেশ কয়েক ঘন্টার কায়দা কসরতের পর ফায়ার সার্ভিসের লোকজনের হাতে সাফল্য ধরা দিলো। ঝুলে থাকা আইজু মিয়াকে পুরোপুরি সুস্হ অবস্হায় নামিয়ে আনা হলো নিচে।
আর ঠিক তখনি চোখ আটকালো মানুষটির চোখের দিকে। আগেই আমরা জেনেছি আইজু মিয়ার ঘাড় একদিকে হেলানো বিধায় মাথাটা কাত হয়ে থাকে। এজন্যই আইজু মিয়ার চোখ দু’টো ক্রমাগত এদিক ওদিক ঘুরতে থাকে। তার অসম্ভব জ্বলজ্বলে চোখের মণি দুটোতে কেমন যেন একটা অবিশ্বাস আর সন্দেহের ছায়া। সবাই যেন আমরা তার বিরূদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত।
চোখ দিয়ে সবাইকে দ্বিধাগ্রস্ত করে দিলেও কর্তব্য থেকে তো আর বিচ্যুত করতে পারে না। তাই থানা থেকে আসা পুলিশের একটি দল আইজু মিয়াকে নিজেদের কব্জায় নিয়ে নিলো ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের কাছ থেকে।
নিয়ম অনুযায়ী আইজু মিয়াকে সাথে সাথেই থানায় নিয়ে যাবার কথা। কিন্তু আজকের সুখপুর তা হতে দিলো না। সুখপুরের নেতা ধরণের কেউ একজন প্রথমে কথাটি তুললো,
আইজু মিয়ার মতো নির্ভেজাল মানুষটি কেন আজ আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলো সেটা জানা প্রয়োজন। কথা ওঠার সাথে সাথে
কেউ কেউ পথ আগলে দাঁড়ালো পুলিশের। দাবি একটাই আইজু মিয়াকে এখানেই বলার সুযোগ দেওয়া হোক। সেখানে দাঁড়ানো সমবেত জনতার সাথে আমাদের মনেও দরদ জাগে আইজু মিয়ার জন্য,
আহারে, না জানি কত দুঃখে সে আজ আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলো! জানাই যাক সেই দুঃখের কথা আইজু মিয়ার বয়ানে।
বেকায়দায় পড়ে পুলিশের দল নিজেদের হ্যান্ড মাইক ধরিয়ে দিলো আইজু মিয়ার হাতে।
শুরুতেই আইজু মিয়া হ্যান্ড মাইক হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ এদিক ওদিক ঘুরিয়ে দেখলো, এরপর বাম হাতে মাইক নিয়ে ডান হাত দিয়ে কিছুক্ষণ মাথা চুলকে নিলো, এরপর হঠাৎ করেই চোখ দুটো বুজে ধপ করে বসে পড়লো।
আইজু মিয়া মাটিতে বসে পড়তেই সমবেত সবাই আবার হা হুতাশ করা শুরু করলো,
আহারে জন্মের দুঃখ মানুষটার, কথা বলতেও পারছে না!
হ্যালো…হ্যালো
ফ্যাসফ্যাসে গলায় আইজু মিয়া কথা শুরু করতেই সবার কথা বন্ধ হয়ে গেলো।
আরোও ক’বার হ্যালো হ্যালো করে মূল কথায় এলো আইজু মিয়া,
এই পানি ট্যাংকিখান ছাড়া আরকিছু খুঁইজা পাই নাই ঝাঁপ দেওনের…
সমবেত জনতা উসখুশ শুরু করলো, যেন পানির ট্যাংকির কথা নয়, আমরা শুনতে চাই ঝাঁপ দেবার কারণ।
জনতার দিক থেকে আবার আমাদের দৃষ্টি ঘুরিয়ে নেয় আইজু মিয়া,
সইত্য কথা হলো এই পানির ট্যাংকিত না উঠলি পারে জানবারই পারতাম না সুখপুর উঁচা থ্যাইকা কত সুন্দর দেখা যায়…
না, এসব শুনতে সেই সকাল থেকে সমবেত জনতা অপেক্ষা করে নেই। কেউ কেউ আইজু মিয়ার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে পানি ট্যাংকির উচ্চতা পরিমাপ করতে লাগলো আর কেউ কেউ বিরক্তি থেকে চেঁচিয়ে উঠলো,
আইজু মিয়া পয়েন্টে আসো, ক্যান উঁচুত উইঠ্যা ঝুলতাছিলা?
তবে এসবের ভেতর থেকে আমরা আবার বাধ্য হই আইজু মিয়ার দিকে দৃষ্টি নিবন্ধ করতে। সে আবার বলা শুরু করলো,
আমার জন্ম হইছিলো সেই গন্ডগোলের পর। বাপ রে দেখি নাই, হুনছি শহরের দিকে গেছিলো কাজ খুঁজতি আর ফেরে নাই। ক্যামনে খাইয়া না খাইয়া বড় হইছি সেসবও মনে করতি পারি না…
কথা থামিয়ে আইজু মিয়া নিজের অদ্ভুত গড়নের ঘাড়ে হাত বুলায়। আর এই সময়েই আমরা দেখতে পাই তার অবিশ্বস্ত সেই চোখদুটো খানিক সময়ের জন্য এদিক ওদিক তাকানো বন্ধ করে দিলো। স্হির হয়ে থাকা মণি দুটোয় কেমন একটা দুঃখ ঝলক দিলো। আর এর ঠিক পর পরই আইজু মিয়া স্বরূপে, এদিক ওদিক অনবরত তাকাতে তাকাতে বলা শুরু করলো,
তয় একখান কথা মনে পড়ে, হুঁশ হওয়নের পর থ্যাইকা সবাই আমারে দেইখ্যা হাসে, কেউ ঘাড় ব্যাঁকা আইজু বইল্যা ঢিল মারে…
ঠিক এই জায়গাতে আমাদের মনে হলো আইজু মিয়া কাঁদতে শুরু করবে। না, তা হলো না। বরং নিজের অসহায়ত্বের কথা বলতে বলতে আইজু মিয়ার চোখমুখে আচমকা ক্রোধ ফুটে উঠলো,
রাগ হইতো, জিদ হইতো, হ্যাগো কিছু না কইয়্যা বাড়িত গিয়া নিজের ছায়ায় ঢিল মারতাম, মনে হইতো ওইটা আমি না, ওইটা আমি না…
আহারে! আইজু মিয়ার চেহারায় যতই ক্রোধ থাকুক আমাদের চোখ জলে ভাসে। নিজের অবয়বের প্রতি এত ঘৃণা মানুষটার! কিন্তু কেন এমন গড়ন হলো আইজু মিয়ার?
প্রশ্নটি আমাদের মনে আসতেই সমবেত জনতার ভেতর থেকেও তা প্রতিধ্বনিত হলো,
তুমি কি জন্ম থেকেই এমন আইজু মিয়া?
আইজু মিয়ার চোখ দু’টো ধক্ করে জ্বলে উঠলো যেন,
না, হেইটাই তো দুঃখু, আল্লাহ এমুন কইরা বানাইলে শোক ছিল না, কিন্তুক নিজের মায়ে যদি এমুন বানাইয়্যা দেয় তো কারে কই সেই শোকের কথা?
আমাদের ভ্রু কুঁচকে যায়। কোন মা নিজ ইচ্ছায় তার সন্তানকে এমন আকৃতি দেবে? মাতৃস্নেহের কাছে তো স্বয়ং ঈশ্বর হেরে যায়। না, না আইজু মিয়া ভুল বলছে। নিশ্চয় কঠিন কোনো অসুখে এমন হয়ে গেছে সে। কি অসুখ করেছিলো তোমার আইজু মিয়া?
হো, সেইখান অসুখই আছিলো, তয় আমার নয়। অসুখখান ছিল আপনাগো সকলের।
না, আর এসব আবোলতাবোল কথা শোনার ধৈর্য্য নেই আমাদের। সমবেত জনতার কেউ বিরক্ত হয়ে উঠে দাঁড়াচ্ছে, কেউবা চিৎকার করে আইজু মিয়াকে থামিয়ে দিচ্ছে।
তবে আইজু মিয়া থামলো না। বলে চললো,
হেই সময় আপনারা সবাই তো নিজেরটুকু বুইঝ্যা নিতেই ব্যস্ত হইয়া পড়লেন, অন্যের থিইক্যা ছিনাইয়্যা নিতে লাগলেন হকলকিছু, এমুনকি পাতের ভাতটাও…
আরেহ্, কী বলছে আইজু মিয়া? আমরা কবে কার পাতের ভাত ছিনিয়ে নিলাম?
আমাদের অব্যক্ত প্রশ্নের উত্তর এলো আইজু মিয়ার কাছ থেকে,
না, আমার তখন ভাত খাওনের বয়স হয় নাই, তয় সারাদিন মায়ের শুকনা মাইয়ের লগে লাইগ্যা থাকতাম, দুধ না পাইয়া ট্যাঁট্যাঁ কইরা কাঁনতাম। দিনের পর দিন ভাত না পাইয়্যা ত্যক্ত শরীরের মায়ে আমারে লোঙ্গরখানার পুকুরে ফেলাইয়া দিছিলো…
সমবেত জনতার ভেতর থেকে ভেসে এলো ‘আহা’ ‘আহা’। আইজু মিয়ার গল্পের এই অংশটি আমাদের মনকেও আর্দ্র করলো।
তবে পুকুরের জলে ডুবে শিশু আইজু মিয়ার মরে যাবার কথা। ঘাড় এমন বাঁকা হবার কথা তো নয়।
আইজু মিয়া বলে চলেছে,
হেইদিন ডুইবা মরলিই ভালো আছিলো। কিন্তুক কপালের ফের, শেয়ালে ঘাড় কামরাইয়্যা তুইলা আনলো ডাঙায়, শেয়ালে খাইলেও ভালা আছিলো, তা না হক্কলতি মিইল্যা শেয়াল খেদাইয়া আমারে বাঁচাইলো। তয় সেই বাঁচনে কুনুদিন শান্তি আছিলো না, শেয়ালের কামড়ে ঘাড়ের হাড় ভাইঙা হইয়া গেলাম ঘাড় ব্যাঁকা আইজু।
আমাদের চোখের কোণে আইজু মিয়ার জন্য সমবেদনা জমতে শুরু করলো, আহারে কত খারাপ মানুষটার কপাল।
আইচ্ছা আমার মায়ে ক্যান আমারে পুকুরে ফেলাইলো? ক্যান আমার শ্বাসখান থামাইয়্যা দিলো না পুকুরে ফেলার আগে? ক্যান ঘাড় ব্যাঁকা আমারে আবার ভাতের ফ্যান খাওয়াইয়্যা বড় বানাইলো?
আমাদের প্রতি রাখা প্রশ্নগুলোতে আইজু মিয়ার দুঃখকে এবার আমরা ঠিকঠাক ধরতে পারি। সারাজীবনের বঞ্চনা থেকেই আইজু মিয়া আজ আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলো, আমরা বুঝে যাই।
সবাই ঔৎসুক্য মিটিয়ে চলে যাবার প্রস্তুতি নিলো।
আইজু মিয়া এবার হুট করে বলে উঠলো,
আমি আত্মহত্যা করতি ট্যাংকিত না উঠলি আপনেরা কেউ আইতেন আমার কথা শুনতি? আপনেরা তো নিজে গো নিইয়্যাই ব্যস্ত থাকেন।
কথাগুলো বলতে বলতে আইজু মিয়া কেন যেন আমাদের চোখের দিকে তাকালো। স্হির সেই চোখ আমাদের ইতস্তত বোধ জাগালো।
আইজু মিয়া স্হির চোখ নিয়েই বলে উঠলো,
মরিয়মরে বিইয়্যা কইরা সংসার বানতি চাইছিলাম, ঘাড় ব্যাঁকার জইন্য সেই মরিয়মও চইল্যা গেলো। নিজের ঘাড়ে তো আর কোপ বসাইতি পারি না, তাই মায়ের মাথাখান ইট দিয়া থেঁতলাইয়া দিছি…
আমাদের হুট করেই মনে পড়লো সুখপুরের দিন শুরু হয়েছিলো আজ নৃশংসভাবে।