৯ই ডিসেম্বর, ২০১০। দিনটা ছিল বৃহস্পতিবার। দিনটা মনে রাখুন, কিন্তু তারও আগে এই গল্পটা শুরু করতে আরেকটু পিছিয়ে যেতে হবে।
দীর্ঘকাল সভাপতি থাকার সময়ে প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সী জাতীয় ফুটবল লিগ চালু করে প্রথমে ওএনজিসিকে দিয়ে স্পনসর করালেন আর তারপর উপরের মোড়ক বদলে তাকে আই লিগ বানিয়ে হিরো মোটরসকে দিয়ে স্পনসর করালেন। এছাড়া পরপর দুটি এশিয়ান গেমসে দল পাঠাতে ব্যর্থতা, জাতীয় দলের ব্যর্থ হওয়া এসব ছেড়েই দিলাম। তবুও তিন মাসের জাতীয় লিগ/ আই লিগ ছাড়া এদিক ওদিক, ডুরান্ড, রোভার্স, বরদৈলুই, গভর্নর্স গোল্ড কাপ, ডিসিএম, সর্বোপরি ফেডারেশন কাপ ও স্থানীয় লিগ নিয়ে ছেলেপুলেগুলো ম্যাচ পেত বেশ কিছু।
২০০৮এ প্রিয়বাবু হঠাৎ অসুস্থ হয়ে কোমায় চলে গেলেন আর তাঁর স্থলাভিষিক্ত হলেন আরেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রফুল্ল প্যাটেল। তিনি এসে বুঝলেন যে অসুখটা অনেক গভীরে, এই ছুটকো ছাটকা আইলিগ-টাইলিগ দিয়ে হবে না। সে ক্ষেত্রে ঢাকের দায়ে মনসা বিক্রি হয়ে যাবে। তাহলে? আরে কর্পোরেট আনো হে!
কর্পোরেটদের সঙ্গে আলোচনায় বসা হল। বিশেষজ্ঞদের ডাকা হল। ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিলের মুখ্য আর্থিক অধিকর্তা কুশল দাস মহাশয়কে এআইএফএফএর রীতিমতো বেতনভোগী আধিকারিক হিসাবে সাধারণ সম্পাদক বানানো হল। মিটিং হলো। কর্পোরেটরা রায় দিলেন, ও সব ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান-মোহামেডান স্পোর্টিং-ডেম্পো-সালগাঁওকর-কেরল পুলিশ-বিএসএফ দিয়ে হবে না। কর্পোরেট ফ্র্যাঞ্চাইজি করতে হবে ন্যাশনাল বাস্কেটবল লিগ বা মেজর লিগ সকারের মতো। অথবা কিছুটা অস্ট্রেলিয়ার মডেলে।
এফএসডিএল অর্থাৎ ফুটবল স্পোর্টস ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড (নামটাই কেমন একটা ইয়ে না?) তৈরি হল ওই ৯ই ডিসেম্বর, ২০১০। নীতা আম্বানির নেতৃত্বে রিলায়েন্স ও ইন্টারন্যাশনাল ম্যানেজমেন্ট গ্রুপের সমন্বয়ে তৈরি আইএমজি-রিলায়েন্সের সঙ্গে এআইএফএফ-এর চুক্তি অনুযায়ী। চুক্তি অনুযায়ী ১৫ বছরের জন্য ৭০০ কোটি টাকার বরাতে ভারতীয় ফুটবলের ভবিষ্যত বেচে দেওয়া হল।
দেখানো অবশ্য হল যে ভারতীয় ফুটবলের প্রভূত উন্নতি হবে। তারকা বিদেশী খেলোয়াড়রা আসবেন। প্রতিটি শহর থেকে একটা দল, ঠিক যেভাবে আইপিএল হয়। যেন কলকাতার মানুষ ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগান ভুলে এক সুরে কলকাতার দলকে সমর্থন করবেন। আসলে ওই বস্তাপচা সংকীর্ণমনা ঘটি-বাঙাল প্রতিদ্বন্দিতা দিয়ে আর চলবে না। এখনকার ছেলেপুলেরা নাকি রাত জেগে ইউরোপীয় ফুটবল দেখে। বাইচুং বিজয়ন নয়, তাদের মাথার মধ্যে ঘুরছে রবার্তো কার্লোস, মার্কো মাতেরাজ্জি, আলসান্দ্রো দেল পিয়েরো, আলসান্দ্রো নেস্তা, আসোমায়া গ্যান, রবার্তো পিরেস, নিকোলাস আনেলকা, দিমিত্রি বার্বাতভ, লুই গার্সিয়া, এডু ইত্যাদির মতো নাম। নাইজিরিয়া ক্যামেরুন সহ আফ্রিকা নয় অথবা ব্রাজিল আর্জেন্টিনার লাতিন আমেরিকা নয়, টাকা নিয়ে এসে ইউরোপে হানা দিতে হবে বিদেশী খেলোয়াড়দের জন্য, সে বয়স্ক হলেও ক্ষতি নেই, তাঁদের কাছ থেকে অনেক কিছু নাকি শিখবেন ভারতীয় ফুটবলাররা।
সেই মতে ঠিক হল যে ইন্ডিয়ান সুপার লিগ হবে, আটটি শহরের ফ্র্যাঞ্চাইজি বিক্রি হবে।
তো প্রতিবাদ হল। ডেম্পো, সালগাঁওকরের মতো ঐতিহ্যবাহী দল আই লীগ থেকে দল তুলে নিল। অবশ্য গোয়ার দলগুলি অধিকাংশই ছিল একক মালিকানাধীন। চার্চিল ভাইদের চার্চিল ব্রাদার্স, শ্রীনিবাস ডেম্পোর ডেম্পো, পিটার ভাজের স্পোর্টিং ক্লুব দে গোয়া অথবা পাণ্ডুরং সালগাঁওকরের সালগাঁওকর। ঠিক যেভাবে জেসিটি ছিল। এর আগে মাহিন্দ্রা দল তুলে নিয়েছে, কোচিন এফসিও।
তো প্রাইভেট লিগ আইএসএল শুরু হল ২০১৪য়। প্রথম দিকে মরসুমী লিগ হয়েই রয়ে গেল। প্রথম তিন বছর। তখন আইএসএলের চার মাস আর আই লিগের চার মাস রাখা হত। আই লিগ, ২০০৬এ জাতীয় লিগের আপাত খোলনলচে বদলে নতুন মুখোশ দিয়ে ঢাকঢোল পিটিয়ে আনা হয়েছিল, জিটিভিকে টেলিভিশন রাইটস বেচে। কিন্তু বছর তিনেকের মধ্যেই সেই গাঁটছড়া ছিঁড়ে গেল। আইএসএলের টিভি স্বত্ত্ব অবশ্য কিনল স্টার।
তারপর আর কি! প্রবল উৎসাহ উদ্দীপনার মাধ্যমে প্রতিটি ফ্র্যাঞ্চাইজির সঙ্গে এক একজন সেলিব্রিটিকে জুড়ে দিয়ে চালু হল আইএসএল। প্রথম দিকে সদ্য প্রাক্তন বিশ্ববরেণ্য খেলোয়াড়দেরও জুড়ে দেওয়া হল, যে নামগুলো উপরে করা হয়েছে আর কি! কিন্তু প্রায় প্রত্যেকেই শুধু মাত্র টাকা কামাতে এসেছিলেন, ভারতীয় ফুটবলের উন্নতির জন্য কে আর মাথা বিকিয়েছেন।
এর পরে শুরু হল দাদাগিরি। এএফসি-র এদ্দিন ধরে পরিষ্কার স্ট্যান্ড ছিল যে, যে লিগে ওঠা-নামা নেই এবং সারা বছর ধরে খেলা হয় না, সেই লিগকে মান্যতা দেওয়া যাবে না। আর মান্যতা না দিলে, এই লিগের এএফসি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ বা তার পরের মহাদেশীয় টুর্নামেন্টে কোনও গুরুত্ব নেই।
স্পনসরের আবদার, ঘোষিতভাবে আই লিগকে দ্বিতীয় শ্রেণির লিগ বানিয়ে দেওয়া হল। আই লিগের পারফরম্যান্সের জোরে কোনও খেলোয়াড়কে জাতীয় দলে সুযোগ দেওয়া হবে না, এমন একটি অঘোষিত নিয়ম বানিয়ে দেওয়া হল। আইএসএলকে সারা মরসুমের লিগ ঘোষণা করা হল। ফলে আই লিগে ভালো মানের খেলোয়াড়রা টাকার অভাবে খেলতে চাইলেন না। ২০১৭য় আবার নিলাম হল, এবারে আই লিগের অন্যতম সফল দল ব্যাঙ্গালুরু ফ্র্যাঞ্চাইজি কিনে আইএসএল-এ চলে গেল। সঙ্গে নতুন দল হিসাবে জামশেদপুর।
অথচ গোড়ায় যে মডেলটা নেওয়া হয়েছিল তাতে মেট্রো শহরগুলোতেই ফুটবল জনপ্রিয় করার চেষ্টা হয়, পুণে, দিল্লি, গৌহাটি বা চেন্নাই। পুণে-র তাও একটি আই লিগ দল ছিল একসময়। কিন্তু বর্তমানে যে আইজল, ইম্ফল বা শিলং-এ ফুটবল অত্যাধিক জনপ্রিয়, সেই সব ছোট কেন্দ্রকে গুরুত্ব দেওয়া হল না। আর এক সময়ের অন্যতম ভরকেন্দ্র পাঞ্জাবের কথা তো ছেড়েই দিলাম।
এর সঙ্গে যোগ হল রোভার্স, ডুরান্ড, বরদলৈ, আইএফএ শিল্ড প্রভৃতি ঐতিহ্যবাহী টুর্নামেন্টগুলিকে গুরুত্বহীন করে দেওয়া। প্রতিবছর নাকি এই টুর্নামেন্টগুলির আয়োজন করা যাবে না। গেলেও বড়দলগুলিকে পাওয়া যাবে না, কারণ এমন সময় ‘স্লট’ দেওয়া হবে যে সময় লিগ চলছে। আইএফএ শিল্ডকে করে দেওয়া হল অনূর্দ্ধ ১৯। ভাবা যায়! অন্যতম প্রাচীন টুর্নামেন্ট আইএফএ শিল্ড, ১৯১১ সালে ইস্ট ইয়র্ক রেজিমেন্টকে হারিয়ে মোহন বাগান যে ট্রফি জিতে প্রথম ফুটবল মাঠে জাতীয়তাবাদের জোয়ার আনে, যে ট্রফি ইস্ট বেঙ্গল সর্বাধিকবার জিতেছে। এই আইএফএ শিল্ডের ফাইনালেই ইস্টবেঙ্গলের ১৯৭৫ মোহনবাগানকে ৫ গোল দেওয়া, ‘৭০এ ইরানের পাস ক্লাবকে হারানো। ১৯৭৭এ ফাইনালে সোভিয়েত ইউনিয়নের এফসি আরাফতের সঙ্গে ২-২ অমিমাংসিত রেখে যুগ্ম জয় মোহনবাগানের। অথবা এই হালের বিজয়ন বাইচুং সমৃদ্ধ জেসিটির ইরাকের কর্খ ক্লাবকে হারিয়ে শিল্ড জয়। সে সব কালের গর্ভে হারিয়ে গেল। ইতিহাস তৈরির জন্য নাকি শুধু আইএসএল। ভারতীয় ক্লাব শক্তিশালী হবে, এএফসি চ্যাম্পিয়ন্স লিগে খেলবে, এএফসি কাপ জিতবে।
প্রাক্তন সভাপতি প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সী এবং বর্তমান সভাপতি প্রফুল্ল প্যাটেল রাজনীতির মঞ্চে অবশ্যই স্বীয় ঔজ্জল্যে দেদীপ্যমান (যদিও এয়ার ইন্ডিয়া নিয়ে মন্তব্য করছি না!)। কিন্তু ফুটবল মাঠে? শুধুমাত্র এএফসি এবং ফিফার বিভিন্ন কমিটিতে উপস্থিত থেকে শোভা বর্ধন ছাড়া ভারতীয় ফুটবলের জন্য কিছুই কি করেছেন এঁরা?
প্রিয় তবু সেটআপ নষ্ট করেননি, কনস্টানটাইনের মতো কোচকে এনে ছোটখাটো টুর্নামেন্ট জিতে, নেহেরু কাপ আবার আয়োজন করে, চেষ্টা করেছিলেন। এমন কি ২০০৮এর এএফসি চ্যালেঞ্জ ট্রফিও জেতেন যখন তখনও তিনি সুস্থ। হোক না তুর্কমেনিস্তান, তাজিকিস্তান, প্যালেস্টাইন, আফগানিস্তানের মতো দল। উত্তর কোরিয়াও তো ছিল সেখানে। প্রফুল্ল প্যাটেল এসে কী করলেন? এফএসডিএল-এর কাছে ভারতীয় ফুটবলকে বিক্রি করে আইএসএলের মতো একটা পার্ট টাইম সার্কাস শুরু করলেন।
সারা পৃথিবী জুড়ে ক্লাব ফুটবলে মাঠে ৪জন বিদেশী নামতে পারে, আইএসএল-এ ৫। তাহলে আটটা দলে ভারতীয় হিসাবে ৪৮ জন কম বেশী তথাকথিত সর্বোচ্চ পর্যায়ের ফুটবল খেলতে পারবে। তাও কটা ম্যাচ? হোম অ্যাওয়ে সেমি ফাইনাল ফাইনাল মিলিয়ে সর্বাধিক ১৬। অন্যান্য টুর্নামেন্ট তো নেই। তাহলে ম্যাচ প্র্যাকটিসের কী হবে?
এই যে ক’দিন আগে এএফসি কাপ সেমি ফাইনালে এটিকে ও মোহনবাগানের জগাখিচুড়ি দলটি উজবেকিস্তানের নাসাফের কাছে ৬ গোল খেল। তা আইএসএল ছাড়া মোহনবাগান তার আগের তিন চার মাসে কটা ম্যাচ খেলেছে? গুনে গুনে ৬টি। কোয়ালিফাইং টুর্নামেন্টের। উজবেকিস্তানের দলটি সেখানে খান ২৫এক দেশীয় লিগ এবং কোয়ালিফাইং টুর্নামেন্টের ম্যাচ খেলে নিজের দেশের মাটিতে খেলতে নেমেছিল। ভারতীয় ফুটবলের উন্নতি হচ্ছে! আইএসএল হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক খেলাগুলোতেও দেখুন! ভারত শেষ মুহূর্তে গোল খেয়ে হয় হারছে, না হলে ড্র করছে। আসলে ম্যাচ প্র্যাকটিস কম হওয়ায়, ম্যাচ সিচুয়েশনে কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাতে হয় এই অভিজ্ঞতাটাই তৈরি হয়নি।
ইগর স্টিম্যাককে একবার দেখি আসুন। ইগর স্টিম্যাক, ১৯৯৮ সালে আবির্ভাবেই চমকে দেওয়া ক্রোয়েশিয়া দলের সদস্য, কোচ হিসাবে এনকে জাগ্রেব ক্লাব এবং ক্রোয়েশিয়ার জাতীয় দলের দায়িত্ব সামলানো কোচ যখন ইংরেজ স্টিফেন কনস্টানটাইনের স্থলাভিষিক্ত হলেন তখন অনেক আশা ছিল। কনস্টানটাইন প্রথমে ২০০২ থেকে নিয়ে ২০০৫এ কোচিং করেছিলেন, যখন বাইচুং ভুটিয়া তাঁর নেতা এবং অধিনায়ক। পরে বব হাউটনের আমলে সাফল্য আরও এল, কিন্তু বব হাউটন ২০১১য় যাবার পর যখন আর্মান্দো কোলাসো, স্যাভিও মেদেরা বা ডাচ উইম কোভারমান্সের কোচিং-এ ভারতের সাফল্যের গ্রাফ নিম্নগামী তখন আবার চেনা বৈদ্যের ডাক পড়ে। খেলার উন্নতি না হলেও কনস্টানটাইন ফলাফল দিচ্ছিলেন। কিন্তু ভারত তখন খেলছে মূলত সুনীল ছেত্রীর ব্যক্তিগত ক্যারিসমার উপর ভর করে। লং বল, আঁটোসাটো ডিফেন্স আর জোড়া স্ট্রাইকার। এতে তো ফুটবলের উন্নতি হচ্ছিল না।
স্টিম্যাকের কোচিং-এর ধরণ অনেক আধুনিক। তিনি জোর দিলেন মাঝমাঠের কাঠামো এবং ছোট ছোট পাসে খেলা এগিয়ে নিয়ে যাবার উপর। উইং দুটো ব্যবহার করে খেলা ছড়াতে হবে, ডিফেন্সিভ থার্ডে, কাঠামো হারানো চলবে না, মাঝখান দিয়ে আক্রমণ করতে দেওয়া যাবে না বিপক্ষকে। কিন্তু এগুলো থিওরিই। বস্তুত স্টিম্যাকের কোচিং-এ ভারতের র্যাঙ্কিং এবং পারফরম্যান্স উভয়ই খারাপ থেকে আরও খারাপ হচ্ছে। কারণ? কোচ তো তিনি খারাপ নন? মানসিকতাও বেশ উন্নত।
আসলে আইএসএলের ক্লাবগুলিতে মেরুদণ্ডের জায়গায় কোনও ভারতীয় গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় নতুন, উঠে আসে না। সুযোগই পায় না। মেরুদণ্ড অর্থাৎ, স্টপার ব্যাক, সেন্ট্রাল মিডফিল্ড এবং সেন্টার ফরোয়ার্ড। সুনীল ছেত্রী বয়সের কারণে নিজের ক্লাবেই দ্বিতীয় স্ট্রাইকার হিসাবে খেলেন। তাঁকে মূল স্ট্রাইকার বানিয়ে আর কতটা হবে?
খেলা হোল্ড করে পাসিং গেম, আবাসদের মতো কোচরা সেটা ডেভেলপ করাতে পারেন না ভারতীয় খেলোয়াড়দের মধ্যে। বল ধরেই ছেড়ে দাও, কোনওরকমে বিদেশীদের পায়ে দাও, আর তারা উপরে উঠে হয় দূরপাল্লার শটে, না হলে এক স্ট্রাইকারে গোল করবে। গোয়া, কেরালা ছাড়া আকর্ষণীয় ফুটবল নয়, ফলাফলের উপরই বাকি দলগুলি নজর দেয়। এটিকে একবছর হোসে মোলিনাকে নিয়ে পাসিং গেম খেলল বটে, কিন্তু বারবার করে অ্যান্তোনিও আবাসের উপরই ছাড়া হল দল।
এমতবস্থায়, স্টিম্যাক কেন? ইয়ুরগেন ক্লপ বা পেপ গুয়ার্দিওলা এলেও যে কিছু হত না সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।
মাঝখান থেকে ফেডারেশন কাপও উঠে গেল। স্থানীয় লিগগুলির কথা তো ছেড়েই দিলাম। গোয়া, কেরালা বা কলকাতা, আগে স্থানীয় লিগগুলি খেলোয়াড় তোলার আঁতুরঘর হিসাবে ব্যবহৃত হত। এখন সেগুলোও হেলাফেলা করা হচ্ছে।
আইলিগের কথায় আসি। আইএসএলের প্রারম্ভিক উচ্ছ্বাস থেমে গেলে দেখা গেল আইলিগের খেলাগুলি অনেক বেশি প্রতিদ্বন্দিতাপূর্ণ হচ্ছে। একে ভারতের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে খেলা, তার উপর মাটির কাছাকাছি দলগুলির উঠে আসা। বেঙ্গালুরু, ইস্ট বেঙ্গল, মোহন বাগানের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আইজল, চেন্নাই, নারোকা, লাজং বা মিনার্ভা পাঞ্জাবের দলগুলি হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করছে। শেষ দিন পর্যন্ত বোঝা যাচ্ছে না কে চ্যাম্পিয়ন হবে। তাহলে? এই যে কর্পোরেটরা এতো ঝুড়িঝুড়ি টাকা দিয়ে ফ্র্যাঞ্চাইজি কিনল তাদের কী হবে?
পরিকল্পিতভাবে, আই লিগকে দ্বিতীয় সারির লিগ বানিয়ে দেবার চক্রান্ত শুরু হল। আইএসএল যখন স্টার স্পোর্টসে দেখানো হয়, আই লিগের জন্য টেলিভিশন স্পনসর পাওয়া যায় না, সময় দেওয়া হয় দুপুরে বা সপ্তাহের মাঝখানে, টিভির প্রাইম টাইম থেকে আইলিগকে সরিয়ে দেওয়া হতে শুরু হল।
কিন্তু এতো করেও তো মাঠে লোক হয় না। কেরলা বা গুয়াহাটির মাঠ ছেড়ে দিলে কলকাতা বা দিল্লিতে বা মুম্বই মাঠে তো দর্শককে ‘বিরিয়ানি’-র লোভ দেখিয়ে মাঠে আনতে হয়। দিল্লির মাঠে একবার খেলা দেখতে গিয়ে দেখি কলকাতা ফ্রিকিক পেলেও লোকে উল্লাস করছে, দিল্লি গোল করলেও। ফুটবল ভালোবাসে? দল নয়? হাহাহাহা। না না, এসব ভুল ধারণা করবেন না। আসলে মাঠে সান্ধ্যকালীন পিকনিক হচ্ছে। সিরিয়াস ফুটবল দর্শকরা তো রাত জেগে ফুটবল দেখে ইউরোপের মাঠে, তাদের এভাবে কি টেনে আনা যায়? আর যারা তৃণমূল স্তরের ফুটবল পাগল? তারা লাইন দিয়ে টিকিট কেটে খেলা দেখতে যায়, সে সপ্তাহের মাঝেই হোক বা দুপুর বেলা। তারা বাসে করে লুধিয়ানা যায়, ট্রেনে করে শ্রীনগর। প্রচণ্ড গরমে অথবা শ্রীনগরের বরফ জমা শীতে মাঠে বসে কাঁপতে কাঁপতে খেলা দেখে।
কিন্তু এদেরকে লালনপালন করলে তো এআইএফএফ-এর পেট ভরবে না! তাই মাঠগুলোয় দর্শকদের তুলনায় ফ্যামিলি সার্কাসকে গুরুত্ব দেওয়া হয় বেশি।
কিন্তু পাঁচ বছর পেরিয়ে গেছে, পুনে এবং দিল্লির ফ্র্যাঞ্চাইজির মালিকরা হাত গুটিয়ে নিয়েছে, জামশেদপুর এবং হায়দ্রাবাদকে তার জায়গায় ঢোকাতে হয়েছে, তবু কিচ্ছু হচ্ছে না। তাহলে? এই যে এতো দিনের ব্রাত্য ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান। তাদেরকে কিছু করে ভাঙা যায়? ১৫ কোটি টাকা ফ্র্যাঞ্চাইজি ফি দিয়ে কেউই আসবে না এদের মধ্যে। তাহলে? প্রথমে চেষ্টা হচ্ছিল যে যদি এদের এমনি এমনিই ঢোকানো যায়। সারা ভারত জুড়ে এদের সমর্থকরা ছড়িয়ে তাদেরকেও টানা যাবে। কিন্তু হোমগ্রাউন্ড কোনটা হবে? প্রথমে কর্পোরেটদের পাল্লায় পড়ে এই চুক্তি হয় যে এক শহর থেকে একটাই দল হবে। কলকাতার ফ্র্যাঞ্চাইজি বেঁকে বসল। কলকাতা থেকে ইস্ট বেঙ্গল বা মোহনবাগান কাউকেই খেলতে দেওয়া যাবে না। উপায়? কথা চলল ইস্টবেঙ্গল যদি শিলিগুড়ি বা ভুবনেশ্বর বা রাঁচি থেকে খেলে অথবা মোহনবাগান দুর্গাপুর। কিন্তু তা হয় নাকি! এই দুটি ঐতিহ্যবাহী দল নিজের ফ্যানবেস, নিজের ভিত ছেড়ে বাইরে যাবে! এভাবে হয় নাকি?
কলকাতার ফ্র্যাঞ্চাইজিও বেশ অদ্ভূত পরিস্থিতিতে। শুরুতে অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে দলের নাম রাখা হল অ্যাটলেটিকো দে কলকাতা, সংক্ষেপে এটিকে। কিন্তু সে বিবাহ তিন বছরের মাথায়ই বিচ্ছেদ। তাহলে? নাম তো সবাই জানে এটিকে, জার্সিও লাল সাদা স্ট্রাইপ। কিন্তু অ্যাটেলেটিকো নামও ব্যবহার করা যাবে না। তাই একটা জগাখিচুড়ি তৈরি হল, ‘আমার তোমার কলকাতা’। এফ এম চ্যানেল নয়, ফুটবল দল। কিন্তু তা করেও কলকাতার ফুটবল পাগলদের মন পাওয়া যায় না। রাজ্য সরকারকে ধরেও না। শেষে প্রস্তাব এল, হয় মোহনবাগান অথবা ইস্টবেঙ্গল কোনও এক দলের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া।
এই দুটি দলের কর্তৃপক্ষ আবার মাশাল্লাহ! তহবিল, হিসাব কোনওকিছুই পরিষ্কার নয়। আধুনিকতার ধার ধারে না, আর তার উপর আবার ক্ষমতাও ছাড়বে না। বাঙ্গালুরুর স্পোর্টস ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি কোয়েস এল ইস্টবেঙ্গলে কিন্তু অব্যবস্থায় দু বছরের মধ্যেই পালিয়ে যেতে বাধ্য হল। আর মোহনবাগানের অবস্থা তো আরও দারুণ। এই শোনা যায় এমিরেটস, এই শোনা যায় লাগার্দে। আরও কত কী! স্পনসরের কুমিরছানা আসে, স্পনসর আসে না। শেষমেশ এফএসডিএল-এর মধ্যস্থতায় এটিকের সঙ্গে একটা সমঝোতায় এলো মোহনবাগান। শুধু ফুটবল দলের মালিকানা ৮০-২০ হবে। ৮০ শতাংশ এটিকে-র মালিক গোয়েঙ্কাদের হাতে আর ২০ শতাংশ মোহনবাগান কোম্পানির প্রকৃত অংশীদার যাঁরা ছিলেন। অনেক জল্পনা কল্পনার পরে ঠিক হল, প্রথম জার্সি সবুজ মেরুনই হবে, লোগো পালতোলা নৌকাই হবে। কিন্তু এটিকে নামটা মাথার মুকুটের মতো পরতে হবে। অ্যাওয়ে জার্সিতে সবুজ মেরুন থাকবে বটে সাদার পাশে স্ট্রাইপ হিসাবে কিন্তু তৃতীয় জার্সি আটক-র পুরনো থার্ড জার্সির অনুকরণে কালো হবে। ২০১৯-২০তে মোহনবাগান আই লিগ চ্যাম্পিয়ন হল, এটিকে আইএসএল। কিন্তু আইলিগ চ্যাম্পিয়ন মোহনবাগান থেকে মাত্র দুজনকে নেওয়া হল। অবশ্য এগুলো তো আমাদের আলোচ্য বিষয় নয়। কিন্তু সূত্রপাত থেকেই যে সম্পর্ক সমস্যার মধ্যে এবং দিন প্রতিদিন যা আরও বাড়ছে সেই সম্পর্ক কতটা সুদূরপ্রসারী হবে তা আপনারা সহজেই অনুমান করতে পারেন।
আসি ইস্টবেঙ্গলের কথায়। কোয়েস ইস্টবেঙ্গল ছেড়ে চলে গেছে, মোহনবাগান এটিকে-র সঙ্গে মিলে আইএসএল খেলবে। ইস্টবেঙ্গল? মোহনবাগান আর ইস্টবেঙ্গল তো এই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ, কর্মকর্তারা একই চিট ফান্ডের তহবিল তছরূপের কেসে জেলে যান, ফিরে আসেন। তাহলে মোহনবাগান আইএসএল খেললে ইস্টবেঙ্গল কী করবে? কেন? গৌরী সেন হয়ে নবান্ন দাঁড়িয়ে। মুখ্যমন্ত্রীর চাপে শ্রী সিমেন্ট কর্তৃপক্ষকে ইস্টবেঙ্গলের স্পন্সর হতেই হল। কিন্তু চুক্তি সই করলেন না ইস্টবেঙ্গল কর্তারা। ত্রিশঙ্কু হয়ে এক মাসের মধ্যে রবি ফাউলারের কোচিং-এ এদিক ওদিক দিয়ে দল গঠন করা হল। ফলাফল খুবই খারাপ হল। তারপর শ্রী সিমেন্ট কর্তৃপক্ষ চুক্তি সই না করার কারণে স্পনসরশিপ থেকে সরে যেতে চাইলেন, প্রচুর নাটক, মান-অভিমানের পর আবার নবান্নের হস্তক্ষেপে শ্রীসিমেন্টের সঙ্গে সম্পর্ক ঝুলে রইল। দল গঠন আবার হাওয়ায়। আইএসএল এসেই গেল, ইস্টবেঙ্গলের কী হবে সে ভগাই জানেন।
আরও একটা আইএসএল। বারবার আটবার। শুরুর দিন থেকে খোল নলচে অনেক পাল্টেছে। নামকরা খেলোয়াড়রা যেমন আসছেন, তেমনই খেলোয়াড় জীবনের সায়াহ্নে পৌঁছে যাওয়া টু পাইস কামাতে চাওয়া সুপারস্টাররাও আসছেন। জমজমাট লিগ হচ্ছে। মোচ্ছব হচ্ছে, কিন্তু ভারতীয় ফুটবলের উন্নতি, দিল্লির শীতকালীন আবহাওয়ার মতোই ধোঁয়াশাচ্ছন্ন। নতুন ছেলেরা সে ভাবে ম্যাচ পাচ্ছে না, সারা বছর ফুটবল হচ্ছে না, জাতীয় দলের খেলার মান বাড়ছে না। তবু আইএসএল হচ্ছে। প্রফুল্ল প্যাটেল এবং আম্বানিদের ব্যক্তিগত মোচ্ছব। আর নিভৃতে ভারতীয় ফুটবলের আত্মা শুধুমাত্র অতীতমোচনে অশ্রুপাত করছে। ষাটের দশকে যে সমস্ত এশীয় দলগুলির সঙ্গে ভারত পাল্লা দিত, তাদের সঙ্গে এখন ভারত খেলতে ভয় পায়। এমন কি ঘরের পাশের বাংলাদেশ, আফগানিস্তানকে হারাতে ল্যাজে গোবরে হতে হয়। নেপালকে হারিয়ে সাফ ফুটবল জিতে স্টিম্যাকের মতো কোচকে উদ্দাম নৃত্য করতে দেখা যায়। আর ফুটবল সমর্থকরা ধীরে ধীরে তাদের রেটোরিকে ‘জয় মোহনবাগান’ বা ‘আমাগো ইস্টবেঙ্গল’-এর জায়গায় ‘হালা মাদ্রিদ’ বা ‘ফোর্জা জুভে’ নিয়ে চলে আসে।
খেলাটা সার্বিকভাবে অনেকটা বদলেছে। গত শতাব্দীর শেষাশেষি তদানিন্তন এএফসি-র কর্তা পিটার ভেলাপ্পান, ভারত আর চিনকে বিশ্বফুটবলের ঘুমন্ত দৈত্য বলেছিলেন। চিন তাও একবার বিশ্বকাপ ঘুরে এসেছে। আর ভারত? কুম্ভকর্ণের ঘুম ভাঙার বদলে আরও অতলে তলিয়ে যাচ্ছে সে। কবে যে এর থেকে মুক্তি হবে, এআইএফএফ-ও বলতে পারবে না।
সর্বোচ্চ আদালতের চাপে লোধা কমিটি গঠিত হয়ে ভারতীয় ক্রিকেটের প্রশাসনে প্রচুর পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু ফুটবলের লোধা কমিটি কবে গঠিত হবে, ভারতীয় ফুটবলের নিয়ামক সংস্থার প্রশাসন কবে স্বচ্ছ হবে আর এই অতল থেকে কবে উঠে আসবে জনগণের খেলা ফুটবল, সেই আশাতেই দিন গুনছি।
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ
১) সৌভাগ্য চ্যাটার্জী
২) কিক অফ- আনটোল্ড স্টোরিস অব ইন্ডিয়ান ফুটবলঃ শ্যামসুন্দর ঘোষ
৩) এছাড়া, ন্যাশনাল হেরাল্ড, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, খেল নাও, ফুটবল এক্সপ্রেস পোর্টালের বিভিন্ন আর্টিকেলসমূহ।