পার্থকাকু আমার দেখা প্রথম বোকা লোক। বোকামি অবশ্য দেখার নয়, বোঝার। চালাক লোকেরা বোকামি বুঝতে পারে। বোকাদের বোকামির গল্প তারা রসিয়ে বলে। এইভাবে বোকামির গল্প দিশে দিশে রটে যায় আর খুব হাসাহাসি হয়। গল্প রটতে রটতে পার্থকাকু একটা মিথিকাল ক্যারেক্টার হয়ে উঠেছিল যাহোক। অথচ পার্থকাকু আমাদের বাড়ি এসে মায়ের হাতে মেরিগোল্ড বিস্কিট ডুবিয়ে চা খেত। তাকে বোকা বা চালাক কিছুই লাগত না তখন।
এই কথা আমি সুবিনয়কে বোঝাচ্ছিলাম। কারণ সুবিনয়কে দেখলে আমার পার্থকাকুর কথা মনে পড়ে। সুভাষগ্রাম থেকে সাউথ গড়িয়ার দিকে গাছের চাঁদোয়া-ছাওয়া যে অটো-রাস্তাটা পড়ে আছে চুপচাপ, সেই রাস্তা দিয়ে হেঁটে বাড়ি ফিরত পার্থকাকু। পয়সা বাঁচাত সে অটোয় না চড়ে, নাকি হাঁটতে তার ভাল লাগত— সে সব আমরা জানি না। গালগল্প বা গুজব বা চুটকিতে সে সব তথ্য নিষ্প্রয়োজন। তবে ওই রাস্তাটায় যদি সুবিনয় কখনও যায়, তবে দেখবে, রাস্তাটার ছিল অসীম সম্ভাবনা। ছায়া ছায়া, নিঝুম আর রহস্যময় রাস্তাটায় যা খুশি ঘটতে পারে বলে আমার মনে হত।
গল্পটা ছিল এরকম। পার্থকাকু একদিন ওই শুনশান রাস্তা দিয়ে আপন মনে বাড়ি ফিরছিল। এক ছিনতাইবাজ তাকে খপ্ করে ধরল। ঘড়ি চাইল, পার্স চাইল। পার্থকাকু সব দিল। তারপর বলল, ‘দু দণ্ড বসবে ভাই? এস তোমায় শ্রেণি সংগ্রাম বোঝাই।’ চালাক লোকেরা হা হা করে হাসত গল্পটা বলে। আরও চালাক যারা, তারা বলত, ‘তারপর জানিস, পার্থ চোরকে ইউনিয়নও বোঝাল। কারণ চোরেদেরও ইউনিয়ন থাকা উচিত।’ এই পর্যন্ত বলে তারা পার্টি অফিসের দিকে হাঁটা দিত। আমাদের তখন ব্যাকরণে পড়ানো হচ্ছিল ‘এককথায় প্রকাশ’ আর জানা গেছিল দু ধারে গাছওয়ালা পথকে বলে ‘বীথিকা।’ আদি-অন্তহীন বীথিকার ব্যাকড্রপে কিছুই অলীক বা অসম্ভব লাগত না। বীথিকায় মনে মনে পার্থকাকুকে দাঁড় করাতাম আর একটা হতশ্রী চোরকে। অমনি সব অংক গুলিয়ে যেত আর চুটকি রূপকথা হয়ে যেত। চোখেমুখে জলের ঝাপটা মারতাম। হাসতে চাইতাম হা হা কারণ হাসতে না পারলে নিজেকে বোকা বলে সন্দেহ হবে নিজেরই।
অবশ্য তখন চালাক মানুষও আদৌ তত চালাক-চতুর ছিল না, তাই না সুবিনয়? স্মার্ট ফোন ছিল না বলে গুগলিয়ে সবজান্তা হওয়ার উপায় নেই। এখন সবাই কত সপ্রতিভ, সংযত, প্রস্তুত। বোকামি করে ফেলার বিন্দুমাত্র ভয় কারও নেই। ঝকঝকে কথা, তকতকে শ্লেষ, জোক্, মিম্… তাতেও শান্তি নেই। সবাই সবাইকে সন্দেহের চোখে দেখছে আর বুঝে নিতে চাইছে সামনের জন আরও বেশি চালাক কিনা। এই যেমন, পার্থকাকুর বোকামি নিয়ে তখন যে একটা ঐক্যমত্য তৈরি হয়েছিল, এখনকার কাল হলে কিন্তু তা হত না। ভ্রু কুঁচকে ভাবতে বসা হত, মালটা কি সত্যি বোকা না ভান করে? যেমনটা সুবিনয় সম্পর্কে লোকে ভাবে। বোকা বললেই তো হল না, বুঝে নিতে হবে বোকামিতে তার লাভটা কী?
তখন, মানে ওই প্রি-পোস্টট্রুথ যুগে কিন্তু কাকুর বোকামি নিয়ে কারও সন্দেহ ছিল না। বোকা কাকুই একবার এক চায়ের ঠেকে মাও-এর বোকা বুড়োর গল্পটা বলেছিল। চীন দেশে থাকত সেই বুড়ো। তার বাড়ির দুয়ার যেখানে শেষ, সেখানেই দৈত্যের মতো দুদিকে দাঁড়িয়ে আছে দুই পাহাড়, তাইহাং আর ওয়াংউ। বুড়োর বাড়িতে তাই আলো নেই, হাওয়া নেই। অতএব বুড়ো চলল গাঁইতি শাবল নিয়ে পাহাড় সরাতে। সাদা দাড়ির প্রজ্ঞাবানেরা বলল, ‘ কি বোকা হে তুমি! পাহাড় সরাবে একা হাতে?’ বুড়ো বলে, ‘তা পারব না বটে। কিন্তু আমি ম’লে আমার ছেলেরা সরাবে। তারপর নাতিরা। এইভাবে একদিন না একদিন পাহাড় তো সরবেই।’ গল্পে বোকা বুড়োর অধ্যবসায়ে মুগ্ধ হয়ে ঈশ্বর তাঁর দূতদের পাঠিয়েছিল কাঁধে করে পাহাড় সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। বোকা আমি প্রশ্ন করি:
-কাকু, মাও ঈশ্বরের কথা বললেন কোন্ আক্কেলে?
-বক্তৃতায় মাও আরও বলেছিলেন, জনগণই আমাদের ঈশ্বর।
-জনগণ তাহলে বোকা বুড়ো হবে, না ঈশ্বর?
-দুটোই। এটা একটা লোককথা যাকে মাও ব্যবহার করছেন।
– মানে লোককথায় যা যা আছে সব ভুল নয়? ধর্মের গল্প বিপ্লবের কাজে ব্যবহার করা যায়?
এই প্রশ্ন করতেই, পার্থকাকু হকচকায়। তারপর আচমকা চালাক হয়ে যায়। হুড়মুড়িয়ে সাংস্কৃতিক বিপ্লবে ঢুকে পড়ে। ধর্মকে নিয়ন্ত্রণ করবে পার্টি। পার্টিই ধর্ম, বা নেতা-ই ধর্ম। ইত্যাদি। নিজ নিজ ধর্মকে বাঁচাতেই কি সবাই চালাক হয়ে ওঠে?
এই সন্ধিক্ষণে এসে আমরা, আমি আর সুবিনয়, বোকামির মানে বুঝতে চেষ্টা করি। সবচেয়ে বোকা কি সে, যে অনেক প্রশ্ন করে বা নিজের ধর্মকেও প্রশ্ন করে? ব্যাপারটা কি কালিদাসের গাছের ডালে বসে সেই ডালই কাটার মতো নয়? অবশ্যম্ভাবী উত্তর হল, আলবাত। বোকা বলেই না এত প্রশ্ন করে! সমঝদারো কে লিয়ে ইশারা হি…ইত্যাদি।
এই সময় সুবিনয় বলে, গার্গীও অনেক প্রশ্ন করত। যাজ্ঞবল্ক্য বলেছিল মাথা খসে পড়বে।
এ যে কলেজের বা মহিলাসমিতির গার্গী নয় তা বুঝতে পারি কিন্তু লোকেট করতে পারি না। অন্য নামটা আরও কঠিন। জিজ্ঞাসা করি, ‘কে?’ কিন্তু সুবিনয় ততক্ষণে মাথা চেপে ধরেছে নিজের। বিড়বিড় করে বলছে,
-‘মাথা খসে পড়বে’ কি কোনো অলৌকিক অভিশাপ, না স্রেফ বুদ্ধিবিভ্রাট? কার মাথা খসে পড়ে? কোনো উত্তরে থিতু না হতে পারা প্রশ্নকারীর? নাকি প্রশ্নবাণে বিপন্ন উত্তরদাতার? নাকি সকলের? সব সময় তো উত্তরদাতা মেলে না। নিজেকে প্রশ্ন করতে করতে এগোতে হয়। মাথা ফেটে যাওয়ার জোগাড় হয় তখন।
আমি ঘাবড়ে যাই৷ সুবিনয়ের জন্য মায়া হয়। মনে মনে বলি, থিতু হও সুবিনয়, শান্ত হও। থিতু হলে তুমি আর তত বোকা নও। অসহায় নও। প্রশ্নকে আর বাড়তে না দেওয়ার ছোট্ট চালাকিটা আমি ধরতে পারছি, কিন্তু কাউকে বলব না। বোকারাই চকমকি পাথর ঠুকে আগুন জ্বালাতে যায়, নয় কি? যা কিছু অ-সাধারণ, তাকে অ-সম্ভব না ভাবতে পারার বোকামিই ইতিহাস বহতা রাখে। অথচ প্রশ্ন যদি থামতে না চায়? তবে বোকা লোকও অস্থির হয়। যেমন পার্থকাকু হয়েছিল। থিতু হয়েছিল বিশ্বাসে। নইলে গার্গী সিন্ড্রোমে মাথা খসে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। মতাদর্শও নিবিড় আশ্রয়। প্রশ্ন, প্রাপ্ত উত্তরকে আবারও প্রশ্ন— অন্তহীন জিজ্ঞাসার এই বিশুষ্ক পথে একা সুবিনয়কে বা পার্থকাকুকে আমি ছেড়ে দিতে চাই না। তাদের বীথিকার ছায়ায় স্থাপন করি।
পার্থকাকুকে নিয়ে ততদিন ভাবিনি যতদিন না সুবিনয়ের সঙ্গে সাক্ষাত হয়েছে। বস্তুত সেদিন জলের ধারে বসেই অন্ধকারে প্রথম এসব ভাবনা এল। অথচ সুবিনয়ের সঙ্গে পার্থকাকুর আপাতভাবে তুলনা হয় না। সুবিনয় আমাকে বলেছিল, আমার মধ্যে আনন্দ নেই কেন? আমি যেমন পৃথিবীর সবেতেই অনাচার দেখতে পাই, সে নাকি দেখতে পায় আনন্দ। আকাশ, আলো, তনু, মন, প্রাণ…না চাহিতে তুমি যা করেছ দান…অধুনা রবীন্দ্রনাথের আনন্দযজ্ঞ দেখে আমি তো মনে মনে খুব হাসলাম। সেও হাসল। নিথর জলের ধারে বসে আমরা স্থির করলাম লেট আস এগ্রি টু ডিসএগ্রি। আমরা নিজের নিজের মতো করে অন্ধকার, চাঁদ, জল সব কিছুকে বুঝতে চাইলাম কেউ কারও সাথে কথাটি না বলে। ঠিক যেমন অনতিদূরে চুম্বনক্লান্ত দুটো তরুণ-তরুণী বেঞ্চিতে বসে যে যার মোবাইল ঘাঁটছিল। অথচ সত্যি বলতে আমার আনন্দের জন্য লোভ হতে লাগল৷ অন্ধকারে সুবিনয় দেখতে পেল না আমার চোখ লোভে চকচক করছিল। এ লোভ আমি চিনি। পার্থকাকুর কথা শুনেও লোভ হত। রূপকথার লোভ। লোভের হাত থেকে বাঁচতে আমি সুবিনয়কে বিদায় জানিয়ে ট্রেনে উঠে পড়লাম।
এই ট্রেনগুলোয় আজকাল খুব ভিড় হচ্ছে। ডায়মণ্ড হারবার। নামখানা। গঙ্গাসাগর এসে গেল কি? এই সব লাইনে এসময় ভারতবর্ষের ঢল নামে। প্রতি বছর। অ্যালডাস হাক্সলে যেমন কুম্ভে আসা গরীব, নোংরা, অশিক্ষিতদের বর্ণনা দিতেন, ঠিক তেমন। গোটা আবহে কোনো জিজ্ঞাসা নেই, শুধু সমর্পণ।
-এলে কী করে? ফেরার রাস্তা চেনো?
-গঙ্গাজি লায়েঁ হ্যায়, ওহি ওয়াপস লে জায়েঙ্গে।
আচ্ছা তো! ঠোঁট বেঁকিয়ে সরে আসি। এদের চিন্তা নেই? ধরা যাক, এনআরসির? এদের কাগজ আছে? ওদের ঈর্ষণীয় প্রত্যয় ভেঙে দিতে চাই। তোমাদের কাগজ আছে? জমি জায়গা? বাপের সঙ্গে লিঙ্কেজ প্রুফ? ওরা হাসে।
-গঙ্গা মাইয়া জানতি হ্যায়।
আমার কেমন মায়া মায়া লাগে। একটু আগে সুবিনয়ের জন্যও যেমন হচ্ছিল। দুহাত দিয়ে ঠেলে ঠেলে মায়ার পলি সরাই। মায়ায় বাঁধা পড়লে প্রশ্ন মরে যায়। নোংরা লোকগুলো বোকা/ চালাক কিছুই না হতে পেরে গ্রিক নাটকের কোরাসের মতো আমার চৈতন্যে ঝুলে থাকে। পার্থকাকু বা সুবিনয় বা গঙ্গাসাগরগামী লোকগুলো— কারও থেকেই স্থিতি ছিনিয়ে নেওয়া বড় নিষ্ঠুর হবে বলে মনে হয়। অনেকদিন কাকুকে দেখিনি। এই ট্রেন কি কাকুর বাড়ির দিকে যায়?
চালাকি আর বোকামির স্পষ্ট সংজ্ঞা গুলিয়ে যেতেই ক্রমে আমার মাথায় তাপ্পি দেওয়া টুপি গজিয়ে ওঠে আর গায়ে দেখা যায় চকরাবকরা কোট। কোথাও কোনো ঈশ্বর এল না বলে আমার হাতে পড়ে থাকে কেরানির কীপ্যাড। আমি খচমচ শব্দে কীপ্যাড টিপি আর কালো অক্ষর দিয়ে যেমন তেমন একটা গল্প গাঁথতে চাই, বা একটা ব্যাখ্যা, বা একটা অর্থ, একটা ন্যারেটিভ। নাহলে অস্থির লাগে, শিকড়হীন। ট্রেনের লোকগুলো ভাবে, আমি কি যে বোকা বোকা!