=========================================================
=========================================================
অথচ সেটুকু বোধ নেই মনে। ক্রমেই কমে আসছে নিজের বাসভূমিতেই বাঁচা। এখানে কারোর যেনো কোনো বিষাদ নেই। অশ্রু শুকিয়ে গেছে চোখের কোনে। পিচুটি জমেছে। এ তো চোখেরই ক্লেদ, এরপর দৃষ্টিবিভ্রম স্বাভাবিক। এখানে আছে শুধু অমানুষিক এক বিকার। নাটুকে প্রলাপের মতো এক নাটুকে রাজনীতি।আর এই নাটুকে রাজনীতির কার্পেটের তলায় চাপা পড়ে থাকে এক অসম্ভব রকমের পলিটিক্যাল ভায়োলেন্স। রাজনৈতিক হিংসায় এই মুহুর্তে পশ্চিম বংলার স্থান ২৯ টি রাজ্যের মধ্যে ২৯ নম্বরে। তলিয়ে দেখলে দেখা যাবে, এই রাজনৈতিক হিংসার একটি ধারাবাহিক ইতিহাস আছে। যে ইতিহাসেও আছে অনেক পরত।
নির্বোধের নিষ্ঠুরতায় যা থাকে, তা হোলো ভয়াবহ লোভ। রাজনীতি মানুষের সহজাত লোভের শাখায় প্রশাখায় অর্থ সিঞ্চন করেছে এমনভাবেই যে আজ, মানুষের চৈতন্যের আকাশ জুড়ে কেবলই ক্লেদ, ময়লা। কে দেবে কাকে ধিক্কার? কে করবে কার সমালোচনা? কে করবে কাকে ঘৃণা? অমানুষিক চোখের আওতায় প্রতিটি জীবনের অনাচ কানাচ চলে এসেছে। মানতেই হয়, এ ভয় দুর্জয় নয়। এই অপঘাত দূর হবে কীভাবে…তা নিয়ে আলোচনাই বা কে করবে! কে দেবে আশার আলো…সেও তো প্রশ্ন! ক্ষতির খতিয়ান এতোই বড় হবার সম্ভবনা যে, তাকে বইবার মতো কাঁধ-ই বা কোথায়? মনে হয় যেনো চৈতন্যেই মড়ক লেগেছে।
দেশ স্বাধীন হলেই এই বাংলা রণক্ষেত্রের চেহারা নিলো। দেশ ভাগ, উদ্বাস্তু সমস্যা, খাদ্য সংকট, বেকারত্বের হাহাকার মানুষের সামনে পথে নামা ছাড়া কোনো বিকল্প রাখে নি। মানুষ গ্রাম থেকে শহরে এসেছে, শহর থেকে আবার গ্রামে ফিরেছে…চোখের জল সম্বল করে। তারপর শুরু হয়েছে অন্দোলন। কংগ্রেসের বিরুদ্ধে সেই অন্দোলন কমিউনিস্ট পার্টি ও অন্যান্য বাম দল্অগুলির সহযোগিতায় রাজপথ থেকে গলিপথে আছড়ে পড়েছিলো। ফলত, ত্রিশ, চল্লিশ, পঞ্চাশ ও ষাটের দশক জুড়ে ব্যপক আন্দোলন গড়ে উঠলে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস নেমে আসে। সেই সরকারী হিংসাও নিশ্চিতভাবেই ছিলো রাজনৈতিক। সত্তরের দশক জুড়ে সরকারি ও বেসরকারি তরফ থেকে নেমে আসা সন্ত্রাস সাধারণ মানুষের মধ্যে যে আতঙ্ক তৈরি করে তাতে সমস্ত রকমের বৈপ্লবিক চেতনা মানুষের মধ্যে থেকে অন্তর্হিত হয়। স্ট্যাটাসকুয়ো বজায় রাখার একটি সহজ পন্থা বাঙালি মধ্যবিত্ত আয়ত্ত্ব করে। আর এখান থেকেই শুরু হয় তার নিজের জন্য পথ চলা। একটা জাতি যে কষ্ট ভোগ করেছে, মৃত্যু শিকার করেছে,দু:খকে ব্যক্তিগত ভাবে কাছ থেকে চিনেও, এই সবের প্রতিরোধে সে যখন পথে নেমেছে, তখন কিন্তু সে শুধু নিজের কথা ভাবে নি। ভেবেছে সকলে কিকরে ভালো থাকবে তার কথা। ফলে মানুষ যখন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে তখন তার মাত্রা যাই হোক না কেনো তা হিংস্রতম হয়ে ওঠেনি। এই যে যেকোনো চাওয়া ব্যক্তিকেন্দ্রিকতাকে ছাপিয়ে ওঠা এটাই বামপন্থী আন্দোলনের ঔদার্যবোধ। তারা যখন জমিদার জোতদারদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে, এক পয়সা ট্রাম ভাড়া বৃদ্ধির বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে তখন কিছু হিংসা মূলক কাজ তারাও করেছে। কিন্তু একে দমানোর জন্য রাষ্ট্র যে হিংসা নামিয়ে এনেছে তা একেবারেই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে। ১৯৭০ এর পর রাজনৈতিক হিংসার চরিত্রে বদল আসছিলোই। সেই বদল ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয়ে যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে তা তো দেখতেই পাওয়া যাচ্ছে অবিরাম । এই সব রাজনৈতিক হিংসা সংগঠিত হচ্ছে একেবারেই ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থে। সামাজিক বা রাজনৈতিক আদর্শের দায় নেই কোনো। তাই এইসব হিংসায় আক্রোশ ও আক্রমণ তীব্র, অমানবিক,। গনতন্ত্র একটি আপেক্ষিক ধারণা এবং আদর্শদত ধারণা । এটা ঠিক কেমন তা বোঝা দায়। এর পরিসর কতটা অথবা কোন হিংসায় এর পরিসর কমে যায়… এ নিয়ে সামগ্রিক ধারণায় পৌঁছানো যায় না। তবে ধারণাটি যে আক্রান্ত, তা বোঝা যায়। যা আমাদের ভাবায়, এই আক্রমণের সামনে আমরা হয় নীরব অথবা অসহায়। কেনো?
কোনো মৃত্যুর জন্যই কোনো সামাজিক হাহাকার নেই, নেই সামাজিক কান্না। অথচ এইসব মৃত্যু কোনোনা কোনোভাবে তো রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক। মানুষকে এইভাবে একা, নি:সংগ করে তুলেছে আজকের রাজনীতি। অথচ, মানুষ সমাজবদ্ধ জীব… একথা তো রাজনীতির সূত্রেই পাওয়া। অথচ আজ সবটাই যেনো ‘নরকের ব্যঙ্গচিত্র কিংবা মৃত্যুর বিকার….
এ দেশ আগেও দেখেছে যুদ্ধ, অনাহার, বাঁটোয়ারা, দাঙ্গা…দেখেছে তারোপরে নির্বাচন। গনের ভেতরেই যে আগামীর পথ… এটুকু বিশ্বাস নিয়ে চলতে শুরু করেছিল। বহু বাধা, বহু জটিল হিসেবে, বেহিসেবে,গড়েমিলে তবুও শেষচেষ্টা বলেও তো একটা কথা ছিলো। অন্তত হাল ছেড়ে দিতে চায়নি কেউই। আত্মগ্লানি তো নরকেই বসে আসে। সেই গ্লানি নরকের দাহ-জাত। গ্লানিবোধটুকু সৃষ্টি করেছিলো কিছু স্পষ্ট-বাক যা জীবনেরও… যা মরণেরও। অর্থাৎ, একটা বড় কলরব, হৈ হৈ,…সাম্যের সমতার অধিকারের দাবীতে মুখরিত, বিষ্ফোরিত। তখন মানুষ জনতো ঘৃণা করতে। জানতো কাকে ঘৃণা করতে হয়। এও জানতো কি তাকে ক্লান্ত করে। কর্ষণে মাটির যে ক্লান্তি তাতে খেদ থাকে না…তেমনি, মানুষ সেই ক্লান্তি কাটিয়ে নিতে জানতো দাওয়ায় মাদুর বিছিয়ে চাঁদ থেকে জ্যোৎস্নায় অবতরণ করে অথবা শ্যওলা ধরা স্নানঘরে মাকরসার জালে এক মগ জল ঢেলে দিয়ে বাকিটুকুতে নিজেকে ভিজিয়ে নিয়ে। আজ মানুষের এই দেউড়িতেই আগুণ….বগটুই, ভাঙড়,কেশপুর…ভোট আসে…ভোট যায়….আগুণ নেভেনা। থামে না হিংসা।
চোর, জুয়াচোর,বাটপার, নেতা মন্ত্রী, মন্ত্রণালয়, গন্যমান্য কবি, শিল্পী সাহিত্যিক, ডাক্তার, শিক্ষক, অধ্যাপক, আইনজীবী….গদিয়ান, পদে পদস্থ। ক্ষমতার ভিখারী এরা। সমাজের রাজপথ, গলিপথ, চোরাপথ…এদের দখলে। এরা দুস্থ … অর্থে নয়, ক্ষমতায় নয়… দুস্থ তারা মনে প্রাণে মগজে। এরা বিকল, তবুও সমস্ত কলের এরাই মালিক, এরাই নাট, এরাই বল্টু, ছেনি, হাতুড়ি, পেরেক। এদের ভূমিকা জলহস্তির মতো, কুমির, হায়েনা,শেয়াল বা গোখ্রোর মতো….কখনো মাড়িয়ে …কখনো কামড়িয়ে , কখনো ছোবল মেরে এরা টিকে থাকে। এদের মারেই মরে সমাজের আঁস্তাকুড়ের বিশু কালু কাটাহাতেরা।
এই তেইশ এক নারকীয় নির্বাচনের স্বাক্ষী হলো। মৃত্যু যে কতো তুচ্ছ, হত্যা যে কতো লজ্জাহীন, সমাজ যে কতো মানবতাহীন তার বেশরম খতিয়ান লেখা হলো। এইসকল কেষ্টরা, বিষ্টুরা , জলে থাক, ডাঙা য় থাক, জংগলেই থাক…তাদের কল্পিত পরিকল্পনা জ্যন্ত থাকে। যে কোনো মুল্যেই জিততে হবে। নির্বাচন কমিশন, রাজ্য প্রশাসন ( পুলিশ, সিভিক), কেন্দ্রীয় বাহিনী…একদিকে। অন্যদিকে বুথে বসা “শিক্ষিত”, “অতিশিক্ষিত”, “অর্ধ্বশিক্ষিত” ট্র্যেনিংপ্রাপ্ত পোলিং অফিসার সহ তাঁদের টিম, এবং পোলিং এজেন্টগন…যেনো নারায়নী সেনা! বাইরে আরেকপক্ষ …অসহায় “বিক্রিত” “অবিক্রিত” কাজ নয়, অনুদান প্রাপ্ত সাধারণ পাবলিক!
আশ্চর্য এই যে যুদ্ধ শেষে পরাজয় নিশ্চিত জেনেও এই বিপুল জনতা ভোট দেয়। তার মতের কি বা মুল্য… কার কাছে? যাকে সে জেতাতে চায়, সেও জিতে বদলে নেয় পক্ষ। কি নিদারুণ পরিহাস! তবুও, যে পক্ষের পরাজয় সেই পক্ষ ছাড়ে না কেউ কেউ। এতো বিকিকিনির হাটে কেউ কেউ এখনো বিকোতে চায় না। না চেয়ে মরে। কোতোল হয় হায়নার হানায়। আরো কিছু শেষপর্যন্ত মাথা নামায়। নামাতে বাধ্য হয়। যাঁদের কাছে মাথা নীচু করতে বাধ্য হন, বাধ্য হলেন ….তাঁরা কারা? কাজ ও শিক্ষা না পাওয়া সহজলভ্য এক শ্রেনির লুম্পেন। অনাবশ্যক ভাবে নয়, অভাবে, ফেরে, কপালে তারা বয়ে যায়। কেটে নেয় কপালে তীলক, গুঁজে নেয় কোমোরে ড্যাগার…বন্দুক।আদর্শহীন, লজ্জাহীন, বিবেকহীন প্রতারক রাজনৈতিক দলগুলির কাছে এরা বিপুল টাকায় বিক্রি হয়েছে স্বভাবে অভাবে। কিছু মানুষ লাঠি, ঝাঁটা হাতে প্রতিরোধ করতে চেয়ে রক্তাক্ত হন।
এসব তো নতুন কিছু নয়।
মনোনয়নপর্ব থেকে শুরু করে এঅবধি ৫০ জনের বেশি প্রাণ চলে গেলো! মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে প্রতিযোগিতা হয়, হবে….
৩৪ বছরে কতো মৃত্যু? ২০০৮ এ কতো???
এইসব আরকি! খবর হলো, হবে, মুর্শিদাবাদের ভাঙরের….লুঙ্গিবাহিনীর, কাটাদের!দোষ, দোষারোপ চলেছে।
তথ্য বলে ভোট পর্ব শুরুর আগেই আবগারি বিভাগের অফিসিয়াল রেকর্ড দেখলে চমকে যেতে হয়। জুন মাসেই এই রাজ্যে নাকি লক্ষ লক্ষ লিটার মদ বিকিয়েছে। গ্রামে গ্রামে মদ, মাংস সহ পিকনিক হয়ে গেছে প্রথা মেনে।
এখানে স্বর নেই বিরোধিতার…. এই হলো সার কথা।
আইন, আদালত, প্রশাসন, কেন্দ্র রাজ্য ….সাধারণ মানুষের, অথবা শাসকের বিরুদ্ধে যারা বিরোধিতা করবে, তাদের সকলেরই বিরোধীপক্ষ। বিরোধী শূন্য, বিরোধিতা শূন্য পরিসর। তাই তৃণমূল জেতে…বিজেপি জেতে…জেতে রাম, জেতে মন্দির। অযোধ্যায় হলে দীঘায়ও মন্দির হয় সরকারী অর্থে। এরপরও জেতেন সায়নী বা মিমি নুসরতরাও। হয়তো কেষ্ট জেল থেকে এলেও পাবেন বীরের সম্মান। হয়তো জিতবেন… আবারো। কেউকেউ দল বদলে সৎ হয়ে যাবেন! বাইরন বিশ্বাসদের বিশ্বাসঘাতকতা আর মনে থাকবে না…প্রমানিত হবে সাগরদিঘিই পথ… ও পথের শেষ! চাকরি লুট , ভোট লুট, ডি এ লুট, তোলা, চুরি, ডাকাতি…. হয়েই চলবে নিয়মিত ও প্রথামত….
এরপরও একবারের জন্যেও আলোচনা হবে না আমাদের পিছিয়ে থাকার কারণ…এই পিছিয়ে থাকা রাজনীতি নিয়ে।মানুষকে পিছিয়ে দিয়ে কেউ কেউ এগিয়ে যেতে চাইলো… জয়ীর পাশে ছবি হয়ে, গদিয়ান হয়ে, পদস্থ হয়ে, পুরস্কৃত হয়ে… নিজের মাপের থেকে আরো বড়, আরো চটকদার হয়ে। যাদের উচিৎ ছিলো বলা, এই নিত্য অপঘাত দূর করো, তারাই চৈতন্যে মড়ক লাগিয়ে রাখলো বহু ছলে, কৌশলে ।
ডরাইলা কুবির? তুমি না মাঝি?
যে মাঝি যে চাষা যে কামার – তেলী — তাঁতি মানুষ একদা বিকল্প স্বদেশ গড়ে তুলেছিল বাংলায়, জমিতে লকলক করত ধান, তেভাগার নবান্নে– আমুনে মানুষ– দর কষতে বসত লাঙলের ও কাস্তের সাথে,আজ তারা শুধুই পরিযানে পর্যবশিত।মানবেতর কোলাহলে সন্তানের শেষকৃত্যে দিশেহারা!
ধর্মখোর কসাই আজ সার্বজনীন গণসৌধের ডিজিটাল মেরুদন্ড…!
মানুষ, এই ব্যথা বুকে নিয়ে পিছিয়ে গেল। বাধ্যত!
যারে পিছে ফেলা হলো সে যে আরো পিছনে টানলো… সেটুকু বোঝার মেধাবপু– অস্বীকৃত হলো একাডেমিতেও।
মানুষের অভিমান নাৎসিদের ক্ষমতায় বসিয়েছিলো। সেই মানুষকেই তো নির্বাসিত হতে হয়েছিলো তাদের হাতে। তাই, নরকের প্রলোভনকে ঘৃণা দিয়ে বদলে দিতে না পারলে এ বিপন্নতা কাটার নয়। তবে, এও মনে রাখার প্রয়োজন, নাগ-এর পাশ কাটাতে বিছেকে আহ্বান যেনো না করে ফেলি! নো ভোট টু… – এর প্রচারে মানুষকে বিভ্রান্ত না করলে, মানুষকে কাহিল না করলে, সেইই খুঁজে নেবে মাঠ থেকে, গঞ্জ থেকে, বস্তি থেকে তার নিজের এক ভূশন্ডির প্রান্ত্রর। মানুষের এই নীরবতা ভাঙার জন্যও অপেক্ষা করতে হবে। এছাড়া উপায় নেই কোনো। একটা সময় ছিলো মানুষ দিন বদলের আশায় রাজনৈতিক হিংসার আশ্রয় নিতো। তার যে কোনো নীল নক্সা থাকতো তা নয়, তা যে খুব সংগঠিত হতো তাও নয়। আজ সিন্ডিকেট , তোলাবাজি, পাচার, চাকরি বিক্রি, বখরার কারনে যে সংগঠিত রাজনৈতিক হিংসা হয় তার মোকাবিলা গনজাগরণ ছাড়া সম্ভব নয়। গনতন্ত্র কাঠামোর মধ্যে থাকে না। কোনো দেশে কতোটা গনতন্ত্রের পরিসর আছে, তা নির্ভর করে সেই দেশের মানুষ কথা বলতে পারে কিনা, গান গাইতে পারে কিনা, তার ওপর। কারণ মানুষ সুখে ও দু:খেই কথা বলে, গান গায়। আমাদের রাজ্যে, দেশে মানুষের সেই পরিসর কমে যাচ্ছে। এইটিই আশঙ্কার।