================================================================

================================================================
আমাদের সমাজব্যবস্থা এবং তার পেছনে যে জীবনদর্শন সক্রিয় তা যে কত গভীরভাবে মনুষ্যত্ববিরোধী খুব অল্প বয়সেই শিবনারায়ণ রায় সে বিষয়ে সচেতন হয়েছিলেন। দারিদ্র্য শিক্ষাহীনতা অধিকাংশ মানুষকেই প্রত্যয়হীন যুক্তিবিমুখ করে রেখেছে আজও। কিন্তু আজকের পরিপ্রেক্ষিতে দেখলে, এই দুটির কোনোটিকেই চিন্তাশীল হয়ে ওঠা বা নৈতিকতা অর্জনের বাধা বলে মনে হয় না। মোটামুটি সচ্ছল ও আধাশিক্ষিত এই সমাজও সমান মনুষ্যত্ববিরোধী ও অনৈতিকতার আধার। তবে কি মানুষ আজও কথা বলতে ভয় পায়? তার সঙ্গে ঘটা অন্যায়, তার চোখের সামনে ঘটে যাওয়া অন্যের ওপর নেমে আসা নানাবিধ পীড়নের দিকে না তাকিয়ে সে কি শান্তিপূর্ণ একটা জীবনের কোণ খুঁজে পেতে পারে? এর পেছনে কি কেবলই ভয় কাজ করে? যে-ভয় কেবল ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা থেকে আসতে পারে? নাকি ধর্মনির্ভর সমাজব্যবস্থা থেকেও আসতে পারে? একটু অন্বেষণ করে দেখা দরকার।
একথা স্বীকারে আমাদের বাধা নেই, সারা পৃথিবীজুড়েই কথা বলা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হওয়া এখন অনেকখানি সহজ হয়ে এসেছে। ইতিহাস ঘেঁটে দেখলেই আমরা এর সমর্থন পাব। আমি বলতে চাইছি না যে, আজকের রাষ্ট্রব্যবস্থা কথা বলার অনুকূল ; বলতে চাইছি আজকে আমার কণ্ঠস্বর মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া অনেক সহজ। যে-কথা কয়েক দশক আগেও ভাবা যেত না। সমাজ আড় ভেঙে অনেকখানি এগিয়েছে, সোস্যাল মিডিয়াও বিশ্বকে চোখের সামনে এনে হাজির করেছে। দেশ-বিদেশের নানা অন্যায়ের ঘটনা এবং তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর উদাহরণ আমাদের মনে সাহস জুগিয়েছে। কিন্তু প্রকৃতই কি আমাদের সমাজ এখনো মনুষ্যত্ব বিকাশের উপযোগী ও অনৈতিকতার বিপক্ষে দাঁড়াবার যোগ্য হয়ে উঠেছে!
তবে কয়েকবছর আগেও যা দেখতে হয়নি, আজ তা দেখতে হচ্ছে কেন? এই ২০২৩-এও আমাদের বিদ্যালয়ে কয়েকজন মুসলিম ছাত্রীকে মাথা ঢেকে বোরকা পরে স্কুল আসতে দেখছি, এটা আমার শিক্ষকজীবনে কখনো দেখিনি। বুঝতে পারি, নতুন করে মুসলিম সমাজ অন্ধকারের দিকে আকৃষ্ট হচ্ছে। এই দৃশ্য দেখতে দেখতে মনে পড়ল আজ থেকে একশো বছর আগে ফজিলাতুন্নেসা কীভাবে অচলায়তনের বিরুদ্ধে একা দাঁড়াতে পেরেছিলেন সে-কথা। মেধা ও সাহসের ওপর ভিত্তি করে নিম্নবিত্ত পরিবারের এই নারী তৎকালীন রক্ষণশীল মুসলিম সমাজব্যবস্থার মধ্যেও সমাজের অনেক উঁচু স্তরে উঠে এসেছিলেন। ১৯২৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান পেয়ে এম.এ ডিগ্রি পেয়েছিলেন প্রথম ভারতীয় মুসলিম নারী হিসেবে। কিন্তু প্রসঙ্গ সেটা নয়, যা এখানে উল্লেখের দাবি রাখে তা হল তাঁর অনমনীয় চরিত্র। ওই অতদিন আগে তিনি বোরকা ছেড়ে কেবল শাড়ি পরেই বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতেন। “মাঝে মাঝে তাঁর প্রতি ঢিল-পাটকেল নিক্ষিপ্ত হতো কিন্তু তিনি বিচলিত না হয়ে নিজের সাধনায় অবিচল ছিলেন।” তবে এতদিন ধরে ফজিলাতুন্নেসার কাছে কী শিখল এ সমাজ? শুনতে পেলাম কি বিরুদ্ধতার স্বর? যদি পাই তবে আজ সমাজ আবার পেছনের দিকে হাঁটছে কেন?
ওরহান পামুকও দেখিয়েছেন, মোস্তফা কামাল যে বৈপ্লবিক সংস্কার করেছিলেন তুর্কি সমাজব্যবস্থায়, তাঁর মৃত্যুর পরে আধুনিক তুরস্ক আবার পেছনে ফিরতে চাইছে। তবে তো ভেবে দেখতে হবে আমাদের— এটা কেন ঘটে, কীভাবে ঘটে!
আজ যে চোখের সামনে এমন পেছনে ফেরা দেখেও আমরা চুপ করে আছি, এই নিশ্চেষ্টতাই একটা কারণ।
দ্বিতীয় কারণ, শম্বুক গতিতে এগোতে থাকা একটা সমাজ যদি রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে তখন সে তার অতীত রূপের ভেতরে লুকোতে চায়। কর্ণাটকে হিজাব কাণ্ড নিয়ে যখন তোলপাড় সারা দেশ তখন অনেক শিক্ষিত মধ্যবিত্তকে দেখেছি, হিজাবের পক্ষে কথা বলতে।এ হল বিজেপিবিরোধিতার এমন এক স্বর, যা আমাদের অজান্তেই সমাজকে ভুল পথে নিয়ে যায়।
তার মানে মুসলমানদের ওপর হওয়া রাষ্ট্রের অত্যাচারগুলোর বিরুদ্ধে আমরা সরব হতে গিয়ে দেরিতে ঘুম ভাঙা একটা সমাজকে পুনরায় অন্ধকারে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করছি। একে বলা যেতে পারে যুক্তিহীন বিরুদ্ধতার স্বর। এটা তখনই আসতে পারে, যখন প্রতিবাদ করার লোকদেখানো ইচ্ছে আমাদের সঠিক যুক্তির থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়। অমর্ত্য সেন আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছিলেন এর বিপদের কথা —”অযুক্তি সব যুক্তিকেই বাতিল করে দেয়, কোনও যুক্তিকেই অবলম্বন করে না— এমন নয়। সে আসলে খুবই আদিম ও বিভ্রান্তিপূর্ণ যুক্তি ব্যবহার করে।”(মুখবন্ধ, ‘নীতি ও ন্যায্যতা’, অমর্ত্য সেন)
এই বক্তব্যের আলোকে আমাদের আচার-আচরণ ও দুঃসময়ে করা উক্তি-প্রত্যুক্তিকে বিচার করে দেখতে পারি। কোনো সংকট দূর করার সদিচ্ছাতেও আমরা কোনো অযুক্তি বা কুযুক্তির আশ্রয় নিচ্ছি কিনা ; ভেবে দেখতে হবে, অন্যায় থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্য কোন্ যুক্তি খাড়া করছি, ভাবতে হবে সেটাও।
যে অন্যায়গুলো চোখের সামনে ঘটে চলেছে, সে-বিষয়ে নীরব থেকে আমি কি আমার জীবন শান্তিপূর্ণ করে রাখতে পারি না? অনেক ক্ষেত্রেই এটাকে প্রশংসনীয় পন্থা বলে মনে করা হয়। পরিবার সমাজ আমাদের তেমন শিক্ষা দেয়ও। সমাজের অধিকাংশ শিক্ষিত মানুষকেই আমরা এই শ্রেণিতে রাখতে পারি। প্রকটভাবে একটা ভয়ানক সংকটের সময়ও একটি সংগীত, কোনো কবিতা বা শিল্পের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে ফেলতে পারি। অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলার চেয়েও একটা শিল্পসৃষ্টি বা সৃজনশীলতা গুরুত্বপূর্ণ কিনা এধরনের কূট তর্ক তো হামেশাই উঠতে দেখি আমরা। এ সবকিছুই কিন্তু সমস্যা থেকে সংকট থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেওয়ার এক-একটা অজুহাত ছাড়া কিছু নয় । এর দ্বারা এরকম এক সিদ্ধান্তে আসার প্রবণতা দেখা দিতে পারে যে—অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হওয়া, প্রতিবাদে সামিল হওয়া সৃষ্টিশীলতার থেকে দূরে অগভীর একটা চর্চা বা চেষ্টা মাত্র।
২
আমরা যখন দূরের কোনো সমাজকে বিশ্লেষণ করতে চেষ্টা করি, কিংবা আমি যে-রাষ্ট্রের বা সমাজের অন্তর্ভুক্ত নই, তার বিচার করতে বসি, তুলনায় অনেক সহজে আমরা অন্যায়গুলিকে চিহ্নিত করতে পারি। এবং সেই অন্যায়সমূহ কী করে সহ্য করতে পারছে/পেরেছে ওই সমাজের অন্তর্ভুক্ত লোকজনেরা তা ভেবে আশ্চর্যও হতে পারি। অথচ নিজে যে-সময়ে ও সমাজব্যবস্থায় অভ্যস্ত হয়ে জীবনযাপন করে চলেছি, অনেকক্ষেত্রেই সেখানে অন্যায়কে খুঁজে পাইনা আমরা, এমনকি অন্যের চোখে কিছু অন্যায় ধরা পড়লেও, আমরা সে-সবকে গুরুতর কিছু বলে মনেই করি না। হয়তো আমাদের সমাজব্যবস্থা যেসব পূর্বধারণা সহিষ্ণুতা ইত্যাদির ওপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছে, আমি তারই অংশ হয়ে পড়ি নিজের অজান্তেই। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই নিজের পরিবারের, চারপাশের সমাজের মধ্যে ন্যায়ের জন্য কথা বলা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে আমাদের পক্ষে । তাই সাধারণত আমরা নিকারাগুয়ার অন্যায় নিয়ে কথা বলি, ইউক্রেন-রাশিয়া নিয়ে কথা বলি, এমনকি রাষ্ট্রীয় নানা সংকট নিয়ে কথা বলি, প্রতিবাদে গর্জে উঠি, নিজের চারপাশ সম্পর্কে চোখ বুজে থেকেই। এর কারণ হিসেবে নিশ্চয়ই দারিদ্র্য বা শিক্ষাহীনতার কথা তুলব না আমরা, এ এক ধরনের অন্ধতাই।
মীর মশাররফ হোসেন তেমনই একজন, যিনি এক কঠিন সময়ে হিন্দুত্বের রাজনীতির বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে নিজেদের সমাজের দিকে নিজের ধর্মের দিকে তাকিয়ে ছিলেন এবং সেই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে গো-হত্যা নিবারণী আন্দোলনের প্রেক্ষিতে লিখেছিলেন, ‘গোকুল নির্মূল আশঙ্কা’র মতো প্রবন্ধ। মশাররফের যুক্তি ছিল মুসলমানত্ব বাঁচানোর জন্য গোমাংস খেতেই হবে এমন কোনো কথা শাস্ত্রে লেখা নেই, আরবে যেহেতু গরু ছিল না, তাই গরু কোরবানির কথাও নেই। গরু কোরবানি না দিলেই ধর্ম নষ্ট হবে এমন নয়। যা ঘটার তাই ঘটেছিল, এই লেখার জন্য তাঁকে নানাভাবে মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছিল সেদিন । তা সত্ত্বেও নিগ্রহের সম্ভাবনা মাথায় রেখেও মীর মশাররফ হোসেন যে-ধরনের যুক্তির অবতারণা করেছিলেন, যে সৎসাহস দেখাতে পেরেছিলেন — সেদিন তুলনায় এগিয়ে থাকা হিন্দুসমাজের ভেতর থেকে তেমনভাবে কাউকে সুযুক্তি ও সৎসাহস দেখিয়ে গো-রক্ষার নামে যে হিন্দুত্বের রাজনীতি তার বিরুদ্ধে সরব হতে দেখা যায়নি। দাঙ্গা বা দাঙ্গার মোকাবিলা অনেক পরের ব্যাপার কিন্তু তার অনেক আগেই সমাজের নানা আচার ধর্মীয় বিভেদকে যে আমরা এভাবে এড়িয়ে যাই বা প্রশ্রয় দিই সেখানেই আরো বড়ো অন্যায়ের বীজ প্রোথিত হয়ে যায়।
৩
কদিন আগেই সুদীপ্ত কবিরাজের একটি সাক্ষাৎকার পড়ছিলাম, তিনি বলছেন —আমরা দেশের স্বৈরতন্ত্র নিয়ে সরব হই কিন্তু পার্টির ভেতর, কোম্পানি বা স্কুল-কলেজে কিংবা পরিবারের ভেতর যে স্বৈরতন্ত্র চলছে, তাকে চিহ্নিত করতে পারি না। কথাটা ভেবে দেখার মতো। কেন? ধরুন, সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের বিশাল মূর্তি , রাম মন্দির, বা দীঘায় জগন্নাথ মন্দির নির্মাণ বা মন্দির মসজিদকে সরকারের অর্থ সাহায্য ইত্যাদির মতো কর্মকাণ্ড — এসব কি সেই ব্যক্তি বা সংশ্লিষ্ট ধর্ম সম্পর্কে বিশুদ্ধ শ্রদ্ধা বা ভক্তির প্রকাশ! নাকি এখানেও আছে একটা সর্বগ্রাসী ফ্যাসীবাদী চরিত্র, নিজেকে বিজ্ঞাপিত করা, সবচেয়ে আগে নিজের মূর্তিটাকে বড়ো করে তোলার নির্লজ্জ প্রয়াস! বাংলাদেশে স্বৈরশাসক এরশাদের কথা মনে পড়বে আমাদের, মসজিদে মসজিদে তাঁর নামাজ পড়ার দৃশ্য সে-দেশের মানুষের কাছে চমৎকার অভিনয় হিসেবে স্মরণীয় হয়ে আছে। নিজেকে তুলে ধরার এমন নির্লজ্জ প্রতিযোগিতা যতদিন যাচ্ছে, সারা পৃথিবীতেই তা বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে ধর্মনির্ভর রাজনীতি ও রাজনীতিতে ধর্মের অপব্যবহার। রাষ্ট্রের কাজ নিশ্চয়ই প্রচুর অর্থ ব্যয় করে মন্দির মসজিদ নির্মাণ করা নয় কিংবা কোনো বিশেষ ধর্মের বিশ্বাসকে তোল্লাই দিয়ে অন্য ধর্মগুলিকে সন্ত্রস্ত করে তোলা নয়! কিন্তু এসবই ঘটতে দেখছি সাম্প্রতিক ভারতে। দেশের মানুষ যদি যুক্তিবোধহীন সংকীর্ণ চেতনার দ্বারা চালিত হয় শাসকের পক্ষে ধর্মকে ব্যবহার করার সহজ প্রবণতা তৈরি হয়। শাসককে আক্রমণ করে এ সমস্যা থেকে বেরোনো সম্ভব নয়, যদি ধর্মবিযুক্ত চিন্তাভাবনা করার চর্চা থেকেই দূরে সরে আসে আমাদের সমাজ।
একথা মানা হয়তো কঠিন কিন্তু ভেবে দেখতে হবে যে, ধর্মনির্ভর সমাজব্যবস্থায় ফ্যাসিবাদ সহজে গেড়ে বসতে পারে। এমনকি পরধর্মসহিষ্ণু সমাজেও সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতি করা অনেকসময় সহজ হয়ে যায়। আমরা দেখতে পাব, যাঁরা সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কথা বলছেন, তাঁদের অনেকেই ধর্মনিষ্ঠতার পক্ষেও বলছেন। এটা তখনই ঘটে যখন আমাদের চেতনা কোনো সঙ্কীর্ণতা ও অপরিচ্ছন্ন চিন্তা দ্বারা চালিত হয়। চিন্তাভাবনাকে স্বচ্ছ করে তোলার সহজ কোনো পথ নেই, নিরন্তর পাঠ, চর্চা ও বিবেকবুদ্ধি থেকেই তা গড়ে উঠতে পারে। অসম্পূর্ণ চেতনা আমাদের ভুল প্রতিবাদ বা খণ্ডিত প্রতিবাদে অভ্যস্ত করে তোলে, এটা মনে রাখা উচিত। যেমন রাষ্ট্রীয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব একজন ব্যক্তি তার সমাজ ও পরিবারের নানা অন্যায় নিয়ে নীরব থাকতে পারে আবার প্রতিবাদের স্রোতে গা ভাসিয়ে দেওয়ার প্রবণতায়, প্রতিবাদের বিষয়গুলোকে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার করে নাও দেখতে পারে। তাই প্রতিবাদ করার চেয়ে জরুরি হল অন্যায়কে যথাযথভাবে চিহ্নিত করা।
যেমন ফ্যাসিবাদ আমাদের নানাবিধ বিপদের সম্মুখীন করে দেয়, এমনভাবে যে, পুরোপুরি বুঝে উঠতে উঠতেই অন্যায় পীড়নগুলো নানারূপ ধরে দেশের নানা শ্রেণির মানুষকে একেবারে অসহায় ও বিচ্ছিন্ন করে দেয়। ভারতের মতো দেশে ফ্যাসিবাদী শাসক একইসঙ্গে ধর্ম ও দেশপ্রেমের আড়ালে নানাভাবে নির্যাতন করতে থাকে — জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দেওয়া, দুই ধর্মের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে তাদের পরস্পরের প্রতি হিংস্র করে তোলা, বেকারত্ব সৃষ্টি করে দরিদ্রকে হতদরিদ্র দুর্বল করে ফেলা, চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতির নামে তাকে সাধারণ মানুষের আয়ত্তের বাইরে নিয়ে চলে যাওয়া, শিক্ষাক্ষেত্রকে বেসরকারি সংস্থার হাতে তুলে দেওয়া, সিলেবাসকে মনুষ্যত্ব বিকাশের অন্তরায় করে তোলা, দলিতদের ওপর উচ্চবর্ণের কর্তৃত্ববাদকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা বা তাদের ওপর ঘটা হিংস্র অত্যাচারকে নীরবে প্রশ্রয় দেওয়া ইত্যাদি। কিন্তু এই প্রক্রিয়াগুলি এমনভাবে একসাথে ঘটতে থাকে যে মানুষ দিশাহারা হয়ে পড়ে এবং দুরবস্থার এক গোলকধাঁধায় ঘুরপাক খেতে থাকে। আর এইসবের পাশাপাশিই নতুন নতুন মোড়কে শাসকের মহত্ত্বকে তুলে ধরা হয় এমনভাবে যে হতাশাগ্রস্ত দেশবাসীও তাতে অভিভূত হয়ে পড়ে।
৪
ফ্যাসিবাদ এমন এক একরৈখিক দর্শন, যা বিদ্বেষ ও অসহিষ্ণুতাকে মান্যতা দেয়। একটা দেশে ফ্যাসিবাদ তখনই সফল হতে পারে, যখন সাধারণ মানুষের মন বিনাপ্রশ্নে সবকিছু মেনে নিতে প্রস্তুত থাকে।
ভারতের মতো দেশে পুরুষতান্ত্রিক ধর্মীয় ব্যবস্থা বা উন্মাদনা ফ্যাসিবাদের ভিত্তি তৈরিই করে রেখেছে, কেননা স্বাভাবিক ভাবেই এখানে প্রতিবাদী সত্তা গড়ে ওঠার পরিবেশ তৈরি হয়ে নেই। যুক্তিবিমুখ মনুষ্যত্ববিরোধী এবং সহিষ্ণুতার নামে অন্যায়কে মেনে চলার প্রবণতা দীর্ঘকাল ধরে। তাই এখানে একশো বছর আগেও আবুল হুসেনের মতো যুক্তিবাদী প্রথাবিরোধী চিন্তাবিদকে তাঁরই সমাজের একাংশের কাছে মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়ে ঢাকা ত্যাগ করতে হয়, ২০২৩-এও অবস্থাটা খুব বেশি বদলায়নি। কেন? এখন গণতন্ত্রের নামে যে-সাধারণ মানুষের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়, তা আসলে অধিকাংশের সমর্থন নিয়ে সমাজে অন্যায় প্রতিষ্ঠার একটা সুচতুর প্রচেষ্টা। যতদিন যাচ্ছে, জনগণের সমর্থন নিয়েই রাষ্ট্র যতই ভয়ানক ও শক্তিশালী হয়ে উঠছে, ততই সমাজে বিরোধী কণ্ঠস্বর অসহায় হয়ে উঠছে। শাসকরা অন্যায়কারী ও অন্যায়ের সরব ও নীরব সমর্থকদের সংখ্যার ভয় দেখিয়েই প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে সফল হচ্ছেন। ফলে একজন প্রতিবাদী যিনি রাষ্ট্রের যেকোনো অত্যাচারের বিরুদ্ধে সমাজের যেকোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে সজাগ ও সরব, তিনি সমাজের একাংশের হাতে শারীরিক নিগ্রহের শিকার হলে কিংবা রাষ্ট্র তাঁকে গ্রেপ্তার করলে তথাকথিত শিক্ষিত মহলের সমর্থনও তিনি পাচ্ছেন না। এমনভাবে তাঁর প্রতিবাদকে উপস্থাপন করা হচ্ছে, যেন তিনি সুশৃঙ্খল সুশাসিত একটা দেশ ও সমাজের ক্ষেত্রে বিপজ্জনক ও ক্ষতিকারক।
তাই এখানে নরেন্দ্র মোদী বা মমতা ব্যানার্জি যখনই মানুষের কথা বলছেন তখনই আরেক শ্রেণির মানুষকে প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছেন ; যেন একটা লড়াইয়ের প্রস্তুতি। তাঁরা নিজেদেরকে যখন প্রতিষ্ঠিত করতে চান জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে, তখন আসলে নির্বিবাদী অন্যায় মেনে চলা ধর্মভীরু মানুষের কথাই বলেন তাঁরা আর প্রতিপক্ষ হিসেবে চিহ্নিত করেন প্রতিবাদী মননশীল বিবেকী মানুষজনকে। ব্যাপারটা এত সহজে ঘটে না, এমনভাবে ঘটানো হয়, যাতে সাধারণ মানুষ বোঝে যে সাহিত্যিক শিল্পী বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই তাঁদের সরকারের অনুগত এবং সেভাবে একটা অনুগত সাহিত্যিক গোষ্ঠী বা বুদ্ধিজীবী মহল আগে থেকেই তৈরি করে ফেলে সরকার, যাঁদের কাজ সময়মতো সরকারের যেকোনো কর্মকাণ্ডের প্রশংসা করা ও অন্যায়কে যুক্তি দিয়ে প্রতিষ্ঠা করা। এতে করে সমাজে একটা জটিল ভুলভুলাইয়া তৈরি হয়— প্রতিবাদী বুদ্ধিজীবী শিল্পীরা হয়ে পড়েন দেশের শান্তির ক্ষেত্রে বিপজ্জনক আর সরকারি শিল্পী বুদ্ধিজীবীরা হন সেই বিপদ থেকে উদ্ধার করা শাসকের জয়গানে মুখর। সাধারণ ভোটার বা অনুগত সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে এই আধিপত্য কায়েমের মায়াজাল থেকে বেরোনো কঠিন হয়ে পড়ে। হয়তো পিঠ পুড়তে থাকা অবস্থায় একদিন বাধ্য হয়ে আরেকটা ফ্যাসিস্ট শক্তিকেই উদ্ধারকারী হিসেবে চিহ্নিত করে সাধারণ মানুষ —এই পরিস্থিতি কিন্তু আরো বিপজ্জনক। অর্থাৎ ফ্যাসিবাদ এমনভাবে অধিকাংশ মানুষের মনে স্থান করে নেয় যে, সে ফ্যাসিস্ট শক্তি থেকে বাঁচার জন্য আরেকটা ফ্যাসিস্ট শক্তিকেই সমর্থন করতে চায়। কিংবা ঘুরিয়ে এভাবে বলা যেতে পারে, বিরোধী দলগুলো ফ্যাসিস্ট শাসককে পরাজিত করার প্রাণপণ চেষ্টায় সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়ার তাড়নায় ফ্যাসিস্ট শাসকেরই কিছু বৈশিষ্ট্যকে আত্মসাৎ করে ফেলে। এবং বেদনার বিষয় যে, ন্যায়ের পক্ষে কথা বলা বিবেকী সত্তা নিরুপায় হয়ে ফ্যাসিবাদের সম্ভাবনা থাকা বিরোধী দলগুলোকে সমর্থন করে বসে। এমনকি পরবর্তীতে যখন ফ্যাসিস্ট শাসককে সরিয়ে আসা নতুন শাসকের ফ্যাসিবাদী চরিত্র প্রকাশ পেতে থাকে, তখনও সেই প্রতিবাদী সত্তা আত্মগোপন করে থাকে, নিজেকে লুকোনোর চেষ্টা করে এবং নতুন শাসকের অন্যায়গুলোকে পুরোনো শাসকের তুলনায় লঘু করার চেষ্টা করে। ফলে প্রতিবাদ তার দিশা হারায় এবং সাধারণ জনমানসের মধ্যে চিন্তাশীল লেখক বুদ্ধিজীবীরা গ্রহণযোগ্যতা হারায়।
৫
অতঃপর কী করণীয় আমাদের? আজ থেকে একশো বছর আগে খেদের সঙ্গে বুদ্ধিজীবী শ্রেণিকে সুবিধাভোগী শ্রেণি হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন রম্যাঁ রলাঁ। স্বাভাবিক যে, ফ্যাসিস্ট শক্তি তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদেরও কিছু সুবিধার বিনিময়ে কিনে ফেলতে পারে। পুরস্কার প্রদানের মধ্যে দিয়ে উচ্চকণ্ঠ প্রতিবাদী সাহিত্যিককে চুপ করিয়ে রাখা সম্ভব। ঠিক একারণেই বদরুদ্দীন উমর পুরস্কার সম্পর্কে তাঁর কঠোর মতামত জানিয়েছিলেন, নিজের বিবেক ও সত্তাকে বাঁচিয়ে রাখতে গেলে রাষ্ট্রের দেওয়া পুরস্কার সম্মাননা প্রত্যাখ্যান করতে হবে। আমরা দেশকালের নানা সংকটে দেখেছি, শিল্পী সাহিত্যিকদের কাছে মানুষের কত প্রত্যাশা! দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে, যেকোনো অত্যাচার অন্যায় মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে শিল্পী ছাড়া কে জেগে থাকবে? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, নাৎসিদের অত্যাচার দেখার পর প্রশ্ন উঠেছিল কী হবে কবিতা? কেন? তারমানে কি কবির কাছে মানুষের প্রত্যাশা আরো অনেক বেশি? মনে পড়ছে টমাস ট্রান্সট্রোমারের মতো কবিরও সামাজিক দায়বদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। দাবিটা হয়তো এমন যে, প্রত্যক্ষ রাজনীতিকে এড়িয়ে চললেও কোনো না কোনো ভাবে যাকিছু অবিচার অন্যায় তার রূপায়ণে কবিকে দায়বদ্ধ হতেই হবে। আজকের পৃথিবীতে দাবিটা অসঙ্গত নয়ও।
কীভাবেই-বা একজন সংবেদনশীল মানুষ বিলকিস বানোর ওপর ঘটা রাষ্ট্রীয় অত্যাচারকে এড়িয়ে যাবেন; ভুলবেন কী করে, কামদুনির নারী নির্যাতনের কোনো বিচার হয় না; মনিপুরের ভয়াবহতা থেকে কতদূরে একজন সাহিত্যিক তাঁর লেখার টেবিলকে নিয়ে যাবেন! আদনান আল-শায়েখের কথা ক’জনই বা মনে রেখেছেন? স্বৈরাচারী শাসকের কথা বলতে বলতে দেশ থেকে নির্বাসিত হয়ে, মৃত্যুদণ্ড থেকে বাঁচতে এক দেশ থেকে অন্য দেশে পালাতে পালাতে আজ তিনি বিস্মৃতপ্রায়। এই পরিণাম যেকোনো ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রে যেকোনো ধর্মনির্ভর সমাজব্যবস্থায় একজন প্রকৃত বিবেকবান সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবীর হতে পারে। হয়তো আমরা কেউই শারীরিক নিগ্রহের শিকার হতে চাই না, নির্বোধ ধার্মিক কিংবা ফ্যাসিবাদের অন্ধ সমর্থকদের হাতে প্রাণ হারাতে চাই না! ফ্যাসিস্ট শাসকের জেলে বন্দি হয়ে নির্বিচারে নিজের প্রাণ বিসর্জন দিতে কেই-বা চায় !
কিন্তু এসব কোনোকিছুই শাসকের অন্যায় অত্যাচার দেখেও চুপ করে থাকার যুক্তি হতে পারে না।
যখন কবি শিল্পী ফ্যাসিবাদের স্বৈরাচারী শাসকের সমর্থক হয়ে ওঠে, কিংবা নীরব থেকে তাঁর শিল্পচর্চা চালিয়ে নিয়ে যেতে থাকে —তখন সেই কবিতাকে শিল্পকে আক্রমণের মুখে পড়তেই হবে। কিংবা চুপ করে সয়ে সয়ে টিকে থাকার মতো ন্যাক্কারজনক ব্যাপার! মনিপুর, হাঁসখালি, বগটুই, নন্দীগ্রাম, গুজরাট, ভাগলপুর — নির্যাতন দাঙ্গা দমন-পীড়ন দেখতে দেখতেও সহিষ্ণুতার পরিচয় দিয়ে যাব কি! কিংবা ভেবেচিন্তে কখনো সরব কখনো নীরব থাকব অথবা দীর্ঘ নীরবতার পর কিছু অনুশোচনামূলক কবিতা লিখে নিজের দোষস্খালনের চেষ্টা করব সময়ের কাছে?
মনে পড়ছে কবি হানস মাগনুস এনৎসেনসবেরগারকে ; যাঁরা গত শতকের প্রায় দ্বিতীয়ার্ধ জুড়ে কবিতার ভিতরে পুরে দিয়েছিলেন গনগনে ক্ষোভ, ছুঁড়ে দিতে চেয়েছিলেন তুমুল ঠাট্টা, তাঁদের অন্যতম প্রতিনিধি তিনি। তাঁর একটি কবিতার অংশ পড়তে পড়তে এ গদ্য শেষ করব।
“…
Oh we know
we know that we’re really rather well off
and that we’ll go on like this
and that it’s much use anyway
oh we know
we know that we are to blame
and that it’s not our fault if we are to blame
and that we’re to blame for the fact that it’s not
our fault
and that we’re fed up with it
oh we know
and that maybe it would be a good idea to keep
our mouths shut
and that we won’t keep our mouths shut all the
same
oh we know
oh we know
and we also know that we can’t help anybody
really
and that nobody really can help us
oh we know… “
(‘A Song For Those Who Know’/ Hans Magnus Enzensberger)
“…
আর আমরা যে দায়ী
আর আমরা যে এই নিয়ে কিছুই করতে পারি না যে আমরা দায়ী
আর আমরা যে সেই কারণে দায়ী যে আমরা এই নিয়ে কিছুই করতে পারি না
আর আমাদের পক্ষে যে ঢের হয়েছে
তা আমরা এমনিতেই জানি
আর মুখে কুলুপ দিলে যে হয়তো আরও ভালো হত
আর আমরা যে মুখে কুলুপ দেব না
তা আমরা এমনিতেই জানি
আর আমরা যে কারোরই পাশে দাঁড়াতে পারি না
আর আমাদের পাশে যে কেউই দাঁড়াতে পারে না
তা আমরা এমনিতেই জানি… “
(অনুবাদ : সুব্রত সাহা)
সত্যিই তো মনিপুরের নির্যাতিতারা জেনে গেছে, তাদের পাশে আমরা কেউ দাঁড়াতে পারি না, আমরাও জেনে গেছি আমাদের দুএক টুকরো লিখন তাদের পাশে দাঁড়াতে পারে না। আমরা ইতিহাসের এমন একটা স্তরে পৌঁছে গেছি, জেনে ফেলেছি প্রতিবাদ কতদূর পৌঁছাতে পারে, আর কত নির্যাতন বয়ে আনতে পারে। আমরা অনেক কিছুই জেনে ফেলেছি, জেনেছি যে ফ্যাসিস্টরা মুখে কুলুপ না আঁটা মানুষগুলোকে পরোয়া না করেই তার অত্যাচার নামিয়ে আনবে দিনের পর দিন ; তারপরও যে আমরা মুখে কুলুপ দেব না এও আমরা জানি।
হানস মাগনুস এনৎসেনসবেরগারের মতো এইভাবে আমরা স্বগতোক্তি নির্মাণ করে যাব তবু একের পর আরেক স্বৈরাচারী শাসক আসতেই থাকবে। হাততালি দিতে দিতে হাত লাল হয়ে যাবে কারো, কেউ-বা ক্ষোভে লজ্জায় কেঁদে ককিয়ে উঠবে। কেউ নিভৃতে শিল্পচর্চা করে যাবে যেন কোথাও কিছু ঘটেনি কিংবা ঘটলেও শিল্পের পক্ষে তা জরুরি নয়, কেউ রূপকের আড়ালে রূপ দিয়ে যাবে শাসকের হিংস্র দমন-পীড়নকে, কেউ সরাসরি আঘাত করতে চাইবে এই অপশাসনকে।
আমরা ইতিহাস থেকেই মুখে কুলুপ এঁটে থাকার শিক্ষা পেতে পারি, আবার সেই শিক্ষাও —যা আমার হৃৎপিণ্ডটাকে হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করতে বলে; সহিষ্ণুতার বিপরীতে আমাকে বিক্ষুব্ধ করে তোলে; বলে, এটাই তো আর্তনাদ করে ওঠার প্রকৃত সময়। শাসককে চুপ করিয়ে দিতে গেলে আমাদের এখন একসঙ্গে কথা বলে উঠতে হবে।