
১) এই পঞ্চাশ বছর বয়সে এসে একাডেমি, নন্দন, বইমেলা আমাকে ঘিরে রাখলেও বা মাসের বেশ কয়েকদিন কলকাতাতে থাকলেও, আমার জন্ম শৈশব, কৈশোর ও এখনো স্থায়ী বাস কিন্তু রূপসী বাংলার প্রান্তিক জেলা কোচবিহারের সুটুঙ্গা মানসাই দিয়ে ঘেরা দ্বীপসম শহর মাথাভাঙাতে।ঐতিহ্যের শহর, সুশিক্ষার শহর, পারস্পারিক আত্মীয়তার শহর। (যদিও এখন সে তকমা ১০০ শতাংশ দিতে পারি না।) আক্ষরিক অর্থেই শরৎ আসতো পেজা মেঘের ভেলায় ভেসে, কাশফুলের মাথার ওপর দিয়ে,সঙ্গে থাকতো ভোর বেলার শরৎ সেফালি। হ্যাঁ, আমরা কিন্তু শিউলি ফুলকে সেফালি ই বলি, এমনকি এখনও। আর ছিল স্থলপদ্ম, গোলাপি রঙের। তখন তো জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এর বাড়বাড়ন্ত ছিল না। ফুলেরা তাদের অসবর্ণবিবাহ মেনে নিত না। আমাদের ছোট্ট শহরে প্রথম যেবার বন্ধুদের সাথে দিনের বেলায় বাবা-মাকে না বলে ঘুরে দেখবার অন্যায় সুযোগ হয়েছিল, গুনে গুনে এগারো খানা প্রতিমা দেখেছিলাম। সাকুল্যে, তাই ছিল ওই শহরের পুজোসংখ্যা তখন। আর কেন যেন পাশের বাড়ির শ্রীদামের মনে হয়েছিল ‘পূজার দিন, চ, মদনবাড়ি যাই’।শতবর্ষ প্রাচীন সেই মন্দির থেকে নামতে গিয়ে দেখি অনেক বায়নার পর বাবার পুজোতে কিনে দেওয়া জুতোটাই নেই। কেউ নিজের মনে করে নিয়ে গেছে। কী যে কান্না পাচ্ছিল! এখনো সেই নির্মল কষ্টটা আছে। রাতে বাবা মার সাথে পুরনো জুতো পরেই ঘুরেছিলাম। বললে তো উত্তম মধ্যম খেতে হতো। ফলে সেবারে পুজোয় পায়ে ফোসকা পড়েনি। শ্রীদাম এখন একটা গালামালের দোকানে ফাই ফরমাস খাটে। সরকারের শ্রী-যুক্ত প্রকল্পে কায়ক্লেশে বাঁচে। বছরে দু একদিন হয়তো কথা হয়। অথচ আগে তো সমস্ত শরৎকাল আর উৎসব মরশুম জুড়েই একাত্মতা ছিল আমাদের । আর এখন আমার–‘পাশের বাড়ি যেতেও বিমানবন্দর লাগে’। আমার উৎসবের বিবর্তনে সেটাও তো বিষয়। দোতলার বারান্দা থেকে শরতের সকালে গ্রিন টি খেতে খেতে দেখি টবের ফুলগুলো —
কতটা সৌন্দর্য বিস্তার করল! আর তখন শ্রীদাম ওর বাবার সত্তুর বৎসর আগের ভাঙাচোরা সাইকেলটা নিয়ে যেতে যেতে বলে,”কাঁচামরিচ যে নাই, আগে বলবা না বৌদি, পান্তা লঙ্কা ছাড়া খাওয়া যায় না। ” আগে হলে ও দৌড়ে আমার মার কাছ থেকেই নিয়ে যেত, এও বিবর্তন। হয়তো উৎসবের নয়, আবার উৎসবেরও। আমি তো চাইলেই ছেলেমেয়েকে দু-তিন চারটি জামাকাপড় কিনে দিতে পারি আর শ্রীদাম বিয়েই করলো না । বললে বলে,–” দ্যাখস তো, কয় টাকা পাই, নিজেই খামু কি আর বউ ছেলেমেয়েদেরই বা
কি খাওয়ামু! পূজা আসে, তগ ছেলেমেয়েদের দেখি আনন্দ করে, ব্যাস। “জিজ্ঞাসা করা হয় না কোনদিনই, ওর কি আছে কিছু ড্রিম চিল্ড্রেন!
We are not of thee; not of Alice, we are dream children. –এরকম আর কি!
২) পুজো ঠিক কবে থেকে শুরু হতো? তীব্র বর্ষায় কোনো রাতে খিচুড়ি খাওয়ার পর, হঠাৎ বৃষ্টিতে বাবা বাবার সান্ধ্য আড্ডায় না গিয়ে যেদিন বাড়িতে থাকতো,সেই রকম কোন এক দিনে মা হারিকেনের আলোটা বাড়িয়ে দিয়ে পঞ্জিকা নিয়ে বসত আর খুঁজে খুঁজে বলতো ডেটগুলি। একেবারে এবারে মা কিসে আসছেন, কিসে যাবেন পর্যন্ত। আর মার যাতায়াত কোনোটা নৌকায় হলে আমার জন্মদাত্রী বলতো,–” ও এইজন্যই তো এত বৃষ্টি হইতেছে”।ব্যাস, হয়ে গেল, আমাদের পুজো শুরু। দিদি তো সঙ্গে সঙ্গে বলে বসলো, “আমার কিন্তু ববি প্রিন্টের জামা” বা “এবারে টিউনিক নেব”।আমি আবার খুব বেশি কিছু চাইতাম না, যা দিত তাতেই খুশি। বরং বৃষ্টি শেষ হলে ঘোরাঘুরি বেড়ে যাবে, বাবার স্কুল বন্ধ হলে সাইকেলটা বেশি করে পাবো। আর হাফপ্যাডেলে’ যথা ইচ্ছা তথা যা’ তাতেই আমার বেশি আনন্দ ।
তখনও আমার নিজের পাড়ায় পুজো চালু হয়নি, সম্ভবত আমি যখন থ্রিতে পড়ি সেই বছর চালু হল। আমরা সুভাষপল্লীর ঠাকুরকেই আমাদের বলে মনে করতাম। সেখানে বেশিরভাগই সাহা পদবীর ব্যবসায়ীর বাস। ফলে তথাকথিত চাকুরে এলিটদের একটা ভ্রু কোঁচকানো ভাব চিরকালই ছিল।যেন ব্যবসাটা খুব খারাপ জিনিস। সুভাষপল্লী কিন্তু তার ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। এখন ও ডাকের সাজের প্রতিমা। অর্থাৎ একটা চালাতেই সবাই –দুর্গা কার্তিক গণেশ লক্ষ্মী সরস্বতী এবং প্রতাপশালী মহিষাসুর। একান্নবর্তী পরিবারের মতো।তথাকথিত ‘ব্যবসায়ী’ পাড়াই কিন্তু নিষ্ঠা ভরে সেই ট্র্যাডিশন ধরে রেখেছে। অন্য অনেক পারাই যখন থিম পূজা শুরু করেছে সেখানে তারা একটা আটচালায় একসাথে সবারই সহবস্থানকেই মান্যতা দিয়ে চলেছে। ঠিক যেন তাদের অজান্তেই তাদের পূর্বজদের ‘দ্যাশের বাড়ি’র মতো। ঠিক পপঞ্চাশ মিটার দূরেই যেখানে ধানক্ষেত সেখানে একটা গ্রামের থিমকে পূজা প্যান্ডেলে বেছে নেওয়া আমার কেমন যেন নগরের অন্ধ অনুকরণ বলে মনে হয়। যেমন বেমানান লাগে আমার পাড়ার পূজায় বেশিরভাগ বাড়ি থেকেই চাঁদা না নেওয়া। কিছু লোক একটু বেশি পরিমাণ টাকা দিয়েই পূজো হয়ে যায়। (আমাকে অবশ্য বাদ দেয় না তার থেকে।) অথচ শৈশবে আমি আমার বাবাদের এক টাকাও চাঁদা কাটতে দেখেছি। ফলে যারা চাঁদা দেয় না,সাধ্যের মধ্যে বা তার বাইরে, যাই হোক না কেন, তারা কি আদৌ পুজোটাকে তাদের ভাবতে পারে? পুজোর সর্বজনীনতা কোথায় থাকলো?? আর নগরে তো দেখি প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে বা মন্ডপের পথে পথে বিরাট বিরাট ফ্লেক্স বা হোর্ডিং— মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে। পুজো হয়ে উঠল কর্পোরেট উৎসব, শুধুই আলো ঝলমলে। কৃত্রিমতার ছোঁয়া সর্বত্র। এমনকি গ্রামেও ধুনুচি নাচ নেই, তালে বেতালে ঢাকের শব্দ নেই, পংক্তিভোজন নেই, বদলে কোনো ক্যাটারার সংস্থার বাড়িতে প্যাকেট পাঠানো যা কখনোই মায়ের মন্দির ছুঁয়ে আসেনি। ফলে প্রায় প্রাণহীন, জৌলুষ ও আরম্বর সদৃশ্য কিছু আচার-আচরণ হয়ে উঠেছে দুর্গাপূজা।এর সাথে না আছে ধর্মীয় যোগাযোগ, না আছে নির্মল আনন্দের প্রতিশ্রুতি। অথচ একসময় ‘বাজলো তোমার আলোর বেণু’ শুনলেই ‘মালদা দানা’র গুড় জ্বালের গন্ধ ভেসে আসতো।নারকেল নাড়ু, তিলের তক্তি, পদ্মচিনি, ছাতুর নাড়ুর জন্য মন উদগ্রিব হত। নারকেল মালাইয়ের টর্চ বানিয়ে তাতে মোমবাতির অবশিষ্ট টুকরো জ্বালিয়ে যে আলো হত, আজ তীব্র এলইডি বা সোডিয়াম ভেপারেও তা হয় না। যত আলো আজ দেখি তার বিপরীতে ঠিক ততটাই ম্যারমেরে একটা কিছু– যা ঠিক অন্ধকারও নয়, তবে অন্ধকারেরও অধিক।
৩)বিজয়া পর্বের কথা তো বলাই হলো না, যা ছিল আমাদের আরেক আকর্ষণ। আমরা ভাসানে যেতাম, প্রতিমার সঙ্গে সঙ্গে। ট্রাকে থাকতো প্রতিমা। পাড়ার ছেলেরা তুমুল নাঁচতো সামনে। আর বাজি পটকা –বুড়িমার চকলেট বোম, বাক্স বোম ইত্যাদি । শুধুই শব্দ, তখন তো আকাশে উঠে ফেটে যাওয়া ও বিভিন্ন রকমে তা ছড়িয়ে পড়ার আলো তুবড়িদের আসতে ঢের বাকি। আমি নাঁচতেও পারিনা আর আমার বাবা চানও না সেই তথাকথিত ‘কুসঙ্গে’ আমি যাই। তাই ট্রাকের ভিতরে। ভালো ছেলে হয়ে গুটি সুটি ড্রাইভারের পাশে।পরে একটু বড় হয়ে অবশ্য মাইক্রোফোনে সবাইকে বিজয়ার শুভেচ্ছা জানাতে জানাতে যেতাম।
ইচ্ছামতি নদীর মতো মাথাভাঙ্গা শহরের সুটুঙ্গা নদীর উপরের ‘দশমী’ও খুব নান্দনিক। দুই তীরে প্রায় মেলার মতো বসে যেত। প্রতিমা আসতো শহর এবং শহরতলী থেকেও। অনেক প্রতিমাকেই নৌকায় বা বড় হলে জোড়া নৌকায় উঠানো হতো। আর সেদিন যেন কোত্থেকে হাজির হতো শতাধিক মিডিয়াম সাইজের যাত্রীবাহী নৌকা। ব্যাস, দরদাম করে উঠে গেলেই হল।কোনো কোনো নৌকা বেলুন দিয়ে, ফুল দিয়ে সাজানো। দুই পারে আর কাঠের ব্রিজের উপর হাজার হাজার (বা লক্ষও হতে পারে) মানুষের ভিড়। নৌকা গুলি ৩০০/ ৪০০ মিটার ধরে যাচ্ছে আবার চক্রাকারে ফিরে আসছে। যাত্রীরা সেজেগুজে বসে আছে, মজা করছে। এক নৌকা থেকে আরেক নৌকায় ছুড়ে দিচ্ছে চকলেট বেলুন- এইসব। আর যেগুলিতে প্রতিমা উঠেছে সেগুলো তো যেন অসম্পাদিত, এক পরিকল্পিত ও ও অপরিকল্পিত বিশৃঙ্খলা– যা মনমুগ্ধকর। আর সে যে কি নাচ! এখন প্রাকৃতিক দূষণের দোহাই দিয়ে সেই নির্ভেজাল আনন্দকে প্রশাসনিক তৎপরতায় সম্পূর্ণ নিঃশেষ করে দেওয়া হয়েছে। সেই নৌকাগুলো আর আসে না প্রতিমা উঠাতে। ফলে জৌলুসহীন আকর্ষণ হীন মাথাভাঙ্গার বিজয়া দশমী এখন। আমরাও ক্রমশ ব্যস্ত। কাকিমা মাসিমারা নিজেরাও নাড়ু মোয়া বানায় না আর। আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম তো ম্যাগী পাস্তা বার্গারে এত ডুবে গেল যে সেই কর্দমাক্ত অতল থেকে তাদের তুলে আনা দেবী দুর্গারও সাধ্যাতিত।
তবু পূজা আসে।চরখেকো, নদীখেকো, বিল খেকো মানুষের লোভ ও গ্রাস বাঁচিয়েও কিছু কিছু কাশফুল এখনও ফোটে । তমাল নিজেও হাসপাতালে থেকে ‘উৎসবের বিবর্তন’ নিয়ে কাজ করার কথা ভাবে –আমি মেয়েকে নিয়ে উডল্যান্ড নার্সিংহোমের কিডনি সিটি স্ক্যানের সামনের ওয়েটিং রুমে বসে এইসব পুরনো সময় আর ফুরনো সময় যাপন করি।
তমাল দা, আমাদের গেছে যে দিন একেবারেই কি গেছে?