মা বলেছিল—তুই একটা বোকা! দিদিও বলেছিল–এই বোকামিটা কেন করলি ভাই? বাবা শুধু রাস্তায় জনে জনে ডেকে ডেকে বলে—জানো, আমার ছেলে আমায় কী বলেছে? তোমার তো এবার টাকাপয়সার খুব টানাটানি, তাই আমায় এবার পুজোয় জামাপ্যান্ট দিতে হবে না। শুধু একবাক্স জলরং, দু-তিনটে তুলি, আর একটা ড্রইং খাতা কিনে দিও। বাবার কী যে আনন্দ! বাবার এই অপার্থিব আনন্দে ছেলেও আনন্দিত। বাবা কেন এত আহ্লাদিত সে তা সেদিন তেমন করে বুঝতেই পারেনি। বরং বাবা জনে জনে ডেকে ডেকে বলায় লজ্জায় রাঙা হয়ে যাচ্ছিল। আজ এত বছরের ব্যবধানে, নতুন সহস্রাব্দের দ্বিতীয় দশকে দাঁড়িয়ে, নিজে বাবা হয়ে বুঝতে পারে কার্যকারণ। বুঝতে পারে সেদিন নিজের অজান্তেই কতখানি আহ্লাদ সে চারিয়ে দিতে পেরেছিল তার পিতৃদেবের হৃদয়ে। বাবার চোখেমুখে সেদিন এক স্বর্গীয় মায়া, মমতা, প্রেম, বাৎসল্য, স্নেহ মিলেমিশে অপূর্ব আলোর আভা তৈরি হয়েছিল। চোখে জল আসে, আজ ভাবতে বসলে শুধুই চোখে জল আসে। বাবা আজ নেই। মাও চলে গেছে বাবারই কাছে।
আমাদের দুর্গা পুজো ক্যাপবন্দুক, বেলুন, রায়দার টেলারিং-এর দোকান থেকে ক্যাটালগ দেখে ডিজাইন দিয়ে জামাপ্যান্ট কাটানোর পুজো। প্যান্টের পকেটের কতরকম বাহার, জামার হাতা, পকেট—তারও রয়েছে নানান বাহারি ডিজাইন। পুজোর বোনাসে বাবাকে বিগত কয়েক মাসের বেশ কিছু ধারদেনা শোধ করতে হত বলে, রায়দাকে অল্পকিছু টাকা দিয়ে বাকি টাকা বাকি রেখে নতুন জামাপ্যান্ট আনতে হত প্রায়শই। মুখ ভার হলেও রায়দা কোনোদিন না করেনি। রায়দা ছোটো বাচ্চার মুখ চেয়ে সামান্য টাকা জমা নিয়েও জামাপ্যান্ট দিয়েছে। পুজোর জামা তো আর পুজোর পর পরা যায় না। নতুন জামাপ্যান্ট না হলে কীভাবে এই উৎসবে শামিল হবে ছোটো ছেলে। না জানি এরকম কত ছোটো ছেলের মুখ চেয়ে রায়দাকে টাকা বাকি রাখতে হত। তার নিজের বাড়ির ছোটো ছেলেমেয়েরা পুজোয় নতুন জামাকাপড় পেত কিনা জানা নেই।
আমাদের দুর্গা পুজো ছিল প্রকৃতই শিউলিফুলের। বন্ধু কল্যানের বাড়ির উঠোন ছেয়ে থাকত শিউলি ফুলে। আহা! সাদা পাপড়ি, কমলা বৃন্ত।
এই শিউলি গাছের পাতাও খাওয়া যেত বড়া ভেজে। আর শুয়োপাকা! বাপরে বাপ! গাছের গায়ে সে এক রোমশ প্রদেশ। মশাল জ্বেলে সেসব শুয়োপোকা মারা হত।
আমাদের ক্লাবের একটি ব্যান্ডের দল ছিল। বেশ নামী। তাতে ভর্তি হবার সুযোগ পাওয়া যথেষ্ট দুষ্কর ছিল। বড় দাদা দিদিরা সেই দলে ছড়ি ঘোরায়। ছোটো বাচ্চাদের চান্স হয় না। একটু বড় হতেই হত্যে দিলাম। ব্যান্ডের দলে ঢুকবই। নিজের পয়সায় ড্রেস বানাতে হল। নীল প্যান্ট, আকাশি জামা। প্রথমে মিলল পিকলু বাঁশি। বছর দুয়েক বাদে চেইন্টার। কতরকম গান শিখেছিলাম বাঁশিতে—আকাশ কেন মেঘলা, ওঠো গো ভারত লক্ষ্মী, চল চল চল আরও কত কী! লম্বা,চওড়া সঞ্জয়দা বাজাত বিগ ড্রাম। কী দাপট তার! পাড়ার দিদিরা সবাই পছন্দ করতো সঞ্জয়দাকে। বর্ধিঞ্চু সকল ক্লাবগুলোরই তখন ছিল একটা করে ব্যান্ডের দল। মিছিলের শুরুতে একজন ক্লাবের নাম লেখা ব্যানার হাতে নিয়ে এগিয়ে যেত। তার পিছনে পিকলু বাঁশি,তারপর চেইন্টার, সাইড ড্রাম আর সবশেষে বিগ ড্রাম। এই ব্যান্ডের দল থেকে ক্লাবের কিছু আয় হত।আর আমরা পেতাম একটা মিষ্টির প্যাকেট। কী যে আনন্দ হতো সেই প্যাকেট পেয়ে। কোনো কোনো বছরে দুর্গা পুজো, কালী পুজো মিলিয়ে দশ/বারোটা পুজোর বিসর্জনে ব্যান্ডের দলের একজন হয়ে হেঁটেছি,বাজিয়েছি। আরও যখন ছোটো ছিলাম বিসর্জনের মিছিলে লড়িতে সব বাচ্চাদের সঙ্গে বসে যাওয়া কী মজাই যে ছিল!
পুজো এলেই নিম্নমধ্যবিত্ত বাড়ির একটু বড় ছেলেরা নানারকম ব্যবসা সাজিয়ে রোজগার করত। বন্ধুরা মিলে সে আরেক মজা। বেলুনের দোকান, ক্যাপ-বন্দুকের দোকান, ঘুগনি-আলুরদমের দোকান, এয়ার-গান দিয়ে বেলুন ফাটানোর দোকান, যারা বেশ করিৎকর্মা কোথা কোথা থেকে জোগাড় করে ফেলত তাওয়া, পাম্প-স্টোভ। জমে উঠত এগরোল, চাউমিনের দোকান। পাঁচবন্ধু মিলে এরকম একটা দোকান করেছিল মুন্নাদা ক্লাবের পুজোপ্যান্ডেলের পাশে। পাঁচদিন খেটে প্রচুর মুনাফা হয়। সব খরচ-খরচা বাদ দিয়ে প্রত্যেকের পকেটে এলো পাঁচশ করে। অবাক হয়েছিলাম অত খাটুনির বিনিময়ে অর্জিত ওই পাঁচশ টাকা দিয়ে মুন্নাদা কিনেছিল বিরাট বড় সাইজের একটা লটারি টিকিট। প্রথম পুরস্কার এক কোটি টাকা। চমকে গিয়েছিলাম এই দুঃসাহস দেখে। সাতদিন বাদে খেলার ফল বেরলে দেখা গেল কোনো স্বান্তনা পুরস্কারও মুন্নাদার ভাগ্যে জোটেনি। তখন ওর মনে বীর না করুণ, অদ্ভুত না শান্ত কোন রসের উদয় হয়েছিল তা জানার খুব ইচ্ছে ছিল বহুদিন। কিন্তু কোনোদিনই তা জানতে পারিনি।