একটু একটু করে ভোর হচ্ছে। বাইরে হেমন্তের শেষ শীত। বাতি নিভিয়ে ব্যালকনিতে পা দিয়ে দেখি সূর্যের চিকন আলো উঠে আসছে বনানী-গুলশান সেতুর পর্দা ছিঁড়ে। কুয়াশার মুখখানাও আবছা।যেখানেই থাকি না কেন এরকম ঘন কুয়াশা দেখলে গায়ে শীতশীত লাগলে স্মৃতি খুলে যায়, খেজুর গাছের তাজা রস খেতে ইচ্ছে করে।
ভেতরে এসে কফির জল গরম করতে করতে মনেপড়ল নড়াইলে দেখা মহান শিল্পী এস এম সুলতানের আঁকা বিশালাকৃতির বাংলাদেশ ক্যানভাসের কথা। আমাদের সম্পন্ন ও ঋজু গ্রাম বাংলার কথা। সর্ষে রঙা রোদ আর স্বাস্থ্যবতী বাঙালি রমনী পিড়িতে বসে বাঁকানো বটিদা’য়ে মাছ কাটছেন। আহা আমার ছোটবেলায় দেখা দাদির বাড়ি মুরূজপুর! অথবা নানীবাড়ী নলদাড়িয়া। গ্রামগুলো ছিল যেন হিন্দু-মুসলমানের মিলিত অরগ্যানিক আখ্যান। নানান আয়োজনের ফাঁকে আজান, কাঁসার ঘণ্টা, নাড়ু ও নামাজ আসা যাওয়া করতো পরম্পরায়।
স্মৃতি বড় ছোঁয়াচে ও দূর্বার। এক স্মৃতি মনে হওয়া মাত্র সে স্মৃতি দেশ-কাল-পাত্র টপকে আরেক স্মৃতিকে ছুঁয়ে দেয় বা টেনে ধরে। সেটি ধরে আরেক জায়গার আরেকটিকে। এদের কালের তকমায় আটকে ফেলতে চাওয়া এক মুর্খামি ছাড়া কিছু না। তাই জীবনবুড়ি ছোঁবো বলে বাংলাদেশের গ্রামীন বা লোক সংস্কৃতি সাহিত্যের কথা আমাকে ছুটিয়ে নিয়ে যায় সেখানে যেখানে আমার শৈশব এক থোকা রক্তবীজ হিসেবে সে মাটিতে গেঁথে আছে।
বাবা আবু আহমদ মাহমুদ তরফদার শুধু সরকারি চাকরিজীবী ছিলেন না, ছিলেন সংস্কৃতি ও শিল্পসেবী।বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা ও মহকুমা শহরে চাকরিসূত্রে ঘুরে বেড়াবার সময় আমি বিভিন্ন স্থানে বহুমাত্রিক চিত্তাকর্ষক সব আয়োজন উদযাপনের সুযোগ পেয়েছি। জাতিস্বত্ত্বা ও আত্মস্বত্ত্বার ভেতরে ধর্ম নিরপেক্ষতা গাঢ়ভাবে প্রোথিত হয়েছে। উপলব্ধি করেছি আমাদের লোক বা গ্রামীন সংস্কৃতি কতটা সার্বজনীন। শিল্প সাহিত্য, আহার আচরন, সঙ্গীত স্বাদ- সবই। বলি খেলা থেকে মোরগ লড়াই, পুঁথিপাঠ থেকে ধাঁধাঁ, ব্রতচারি নৃত্য থেকে ধামাইল। ভাটিয়ালী ভাওয়াইয়া, মুর্শিদী ও কীর্তন, জারি সারি সবই ধ্বনিত ও গীত হত, আর নৌকা বাইচ, পূজা, সিন্নি হত বিবাহ বা ধর্মীয় আয়োজনে। এক ধান থেকেই তৈরি হত চাল, চিড়া, খই, মুড়কি, করই, মুড়ি, পিঠা, খুঁদ, মোয়া, উড়কা। পিঠাও হত শত রকমের। মেলায় পাওয়া যেতো হাতে বানানো মাটির রবীন্দ্র ও নজরুল। একবার ছোট মামার সংগে চন্দ্রচড়িতে পুতুল কিনে নাগরদোলায় দোলা শেষে কিনতে গেছি বেতের বাঁশী। মুঠো খুলে দেখি হাত ঘেমে গলে গেছে মেলায় কেনা সোনালী বাতাসা ও শঙ্খের মত সাদা রস কদম। হাত চাটতে চাটতে নানী বাড়ি ফিরেছি।
আমার অভিজ্ঞতা তেতুলিয়া থেকে টেকনাফ না হলেও নেহায়েত নগণ্য কম না। সিলেট, মৌলভীবাজার, সন্দ্বীপ, চাটগাঁ, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, টাঙাইল, ময়মনসিংহ, রাজশাহী, জামালপুর, ফেনী!কথা হল বাংলাদেশের সেই হারিয়ে যাওয়া সময়ের কাহিনী বলার জন্য এ পরিসরও পর্যাপ্ত না। বাংলাদেশের লিংগুয়াফ্রাঙ্কা বাংলা ভাষা হলেও দেশের প্রতিটি স্থানে নিজস্ব উপভাষার বা ডায়লেক্টের একটা ব্যাপার ছিল। নিজেদের অনুষ্ঠান ও তার প্রদর্শনে লোকসংস্কৃতি থেকে উঠে আসা লোকনাট্য, লাঠি খেলার সঙ্গে লাঠি নাচ, খেমটা গানের সঙ্গে খেমটা নাচ এবং ঘাটু গানের সঙ্গে ঘাটুনাচ ছিল ওতপ্রোতভাবে জড়িত।ময়মনসিংহ গীতিকা, চাঁপাই নবাবগঞ্জের গম্ভিরা, ছড়া, ধাঁধা, মন্ত্র, প্রবাদ-প্রবচন, পালা, কবির লড়াই প্রভৃতি ছিল যে কোন আয়োজনেই। হোলি, গাজীর গীত, মাগনের গীত, বিবাহের গীত প্রভৃতি লোকসংস্কৃতির আনুষ্ঠানিক প্রকাশগুলো হত আয়োজন করে। হতো বলছি, কারণ এখন আর তা আগের মত হয় না, এখন বেশ কিছুদিন ধরে চলছে ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি নিধন। হচ্ছে কূপমন্ডুকতায়, স্বার্থচিন্তায়, আত্মপ্রেমে, রাজনৈতিক লিপ্সায়।
হস্তশিল্প হচ্ছে লোকসংস্কৃতির এক সমৃদ্ধ ভুবন। বেতশিল্প, বাঁশশিল্প, কাঠশিল্প, চামড়াশিল্প, বুননশিল্প প্রতিটির আলাদা ইতিহাস, মোটিফ ও মূল্য। মসলিনের যুগ পেরিয়ে আজকের জামদানি যে অবস্থানে এসেছে তা লোকশিল্পেরই অবদান। এতে প্রথিত মোটিফ, রঙ, রঙের বিন্যাসে যে শিল্পী মনের প্রকাশ লক্ষ্য করা যায় তাতে প্রতিটি দশক চিহ্নায়ন সম্ভব। এবং সেটাই হওয়া উচিত। অযাচিত ও অকস্মাৎ পরিবর্তনে বিবর্তনের স্বাভাবিক ধারা ব্যহত হয়।
নগর সংস্কৃতি ও সুবিধার জন্য মাটির জায়গায় প্লাস্টিক, চটের জায়গায় পলিথিন, বেলোয়ারি রেশমী চুড়ির স্থানে এসেছে অক্সিডাইজড গহনা। শাড়ি, ধুতি উবে গেছে। গামছার স্থানে তোয়ালে, নিমের মাজনের বদলে টুথব্রাশ আর মেয়েদের বেনীতে সুতির কালো ট্যাসেলের জায়গায় এসেছে প্লাস্টিকের চুল বা উইগ।
পাহাড়পুর-ময়নামতির পোড়ামাটির ফলকে হাজার বছর আগে আমাদের যে শাড়ির প্রচলন ছিল কয়েক দশকেই কর্মজীবী নারীদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় বিশেষ করে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে কাজ হওয়া পর প্রথমে এসেছিল সুতির ছাপা সালোয়ার কামিজ। সালোয়ার কামিজ ভেতরে পরলেও উপরে এই মহা গরমের দেশেই এখন এসেছে মরুর পোশাক। প্রতিপদক্ষেপে জড়িয়ে ধরছে মেয়েদের পা। শাড়ি হয়ে গেছে পার্টির পোশাক। বৈশাখী, বসন্ত গানের ও রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তী, একুশের অনুষ্ঠান ছাড়া শাড়িপরা নারী দেখা যায় না। নবীন প্রবীন অনেক নারী বিউটি পার্লারে গিয়ে অন্যের হাতে শাড়ি পরে তবে অনুষ্ঠানে যান। কনের গায়ে উঠেছে আধামন ওজনের লাহেঙ্গা, বরের গলায় মুক্তা ও স্বর্ণ মালিকা, পাগড়ীর সঙ্গে কোমরে খাপে ঢাকা বাঁকা তলোয়ার। বর্তমান বাংলাদেশে ধর্মীয়, বাংলা ও ইংরাজি এই ত্রিধারা শিক্ষা ব্যবস্থার অনুরূপ সর্বত্র চলছে তিনটি ধারা। তবে তাতে ক্ষতি নেই। যেমন ছিলনা ক্ষতি আমাদের শৈশবে। সমস্যা হল বর্তমানে এই ধারাগুলোর পাঠ্যবিষয়ের মধ্যে নেই কোন সমন্বয় বা সরকারী নিয়ন্ত্রণ।
মহা শক্তিশালী ঐ এক ও তিন নম্বরের চাপে দ্বিতীয় এখন হয়ে যাচ্ছে চিড়ে চ্যাপ্টা! অথচ তারই সারবস্তুতে সনাক্ত করা যেত দেশের স্বাদ। তাই আজকাল শোনা যায় না পুঁথিপাঠ, কিন্তু অনবরত শোনা যায় অনলাইন অফলাইন কবিতা পাঠ, বৃন্দ কবিতা, নাচে কবিতা, বাজনায় কবিতা। কিনতু তার সবই শুদ্ধ উচ্চারণে নয়। বেতারে উপস্থাপক বলেন বেংলিশ। কিছু ষ্টেশনে বাংলা গানের সঞে চলছে উর্দু ও হিন্দি গান। সে বাংলা গান হোক তা লালন হাসন বা রবীন্দ্র নজরুল। কোন ঘোষণা ছাড়াই তা চলতে থাকে একটার পর একটা। বই পড়া উঠে যাচ্ছে। এখন গাড়ি চালাতে চালাতে বা ট্রেনে বাসে চলতে চলতে কানে শোনা যায় হুমায়ুন আহমেদের দেবী বা বেঞ্জামিন জাফানায়ার কবিতা। এখন জন্মদিনে হায়ার করা হয় স্টোরিটেলার, ক্লাউন ও ম্যাজেশিয়ান, ফিল্মী পান্ডিলিপি ও ক্যামেরা হাতে পরিচালক। আশ্নগকা করি একদিন পুঁথিপাঠ,কবির লড়াই এগুলোর ঐতিহাসিক গুরুত্ব ছাড়া আর কোন কিছু থাকবে না।
আচ্ছা ধরে নিলাম বৈশ্বায়নের কারণে আমাদের সংস্কৃতির এ পরিবর্তন, সাহিত্যের এ পরিবেশনা নবায়ন অপরিহার্য। বিবর্তন না হলে এগুনো ব্যহত হবে। তবু আমার যে বুকটা চিন চিন করে। সে কি আমার নিজের ব্যাক্তিগত স্মৃতির উপমা হারিয়ে যাচ্ছে বলে নাকি আমাদের সমষ্ঠিগত আত্মবিক্ষনের অনুপান হারিয়ে ফেলছি বলে। তা জানি না।
একটা কথা মনে রাখা দরকার। নিটোল বর্তমান বলে কিছু নেই। মুহূর্তে মুহূর্তে সবই অতীত হয়ে যাচছে। তাই বর্তমান নিয়ে ভাবলে বাঙালি জাতি হিসেবে আমাদের আত্ম পরিচয় একদিন লুপ্তও হয়ে যেতে পারে। এখন সেটাও যে কেউ কেউ আশংকা করছেন না তাও কিন্ত নয়। দেশে নতুন ক্ষমতাধারী আগের ক্ষমতাবানের দেয়া প্রতিষ্ঠানের, সেতুর, স্কুলের, সড়কের, সেবা সংগঠনের নাম বদলে ফেলে কি অর্জন করেন বুঝি না। তবে সাধারন মানুষের কথা বুঝি ও জানি। তারা উপলব্ধি করেন এ হচ্ছে কৃতঘ্নতা, এ হচ্ছে অশিক্ষা, এ হচ্ছে যাঁদের অবদানে অবদানে এই ক্ষমতাবান তার বর্তমান অবস্থান অর্জন করেছেন তাঁদের অবদান মুছে ফেলা।
এক মানুষ থেকে আরেক মানুষের ছায়া আলাদা করে দেখবার দরকার আছে। কিন্তু নতুন নির্মানে হবে পুরাতন মুছে নয়।জীব বৈচিত্র্য যেমন জীবের টিকে থাকার জন্য জরুরী। তেমনি মানুষের নৈতিকতা সংস্কৃতি ও সাহিত্যের বৈচিত্র্যও তাদের মনের স্থিতিশীলতার জন্য অত্যন্ত জরুরী। পৃথিবীর সব জাতি, সব গোষ্ঠীর শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতিরই বিবর্তন ঘটে। বাঙালি সংস্কৃতিও সেই পথ ধরে চলছে। শত বছর আগের বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে আজকের বাঙালি সংস্কৃতির পুরো মিল থাকবে না সেটাই স্বাভাবিক। তবে ধারাবাহিকতা না থাকলে সেটাই এক সময় বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে।
প্রায় ৫০ বছর ধরে মুক্তিযুদ্ধের স্মারক হিসেবে যুক্ত হয়েছে বিশাল বিশাল অপরূপ ভাষ্কর্য, বলাকা, বাউল, বাঘ। নির্মিত হয়েছে সুলতানের ছবির অনুপ্রেরণায় ছবি, ও রশীদ চৌধুরীর ট্যাপেস্ট্রির অনুপ্রেরণায় ট্যাপেস্ট্রি। রফিকুন্নবীর টোকাইর অনুপ্রেরণায় আর চরিত্র। এতে শিল্পীগন তাঁর সৃষ্টিতে আমাদেরই ঐতিহ্যকে প্রত্যক্ষ রাখার একটা সূক্ষ্ম ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। তাদের দাম কমেনি – বরং বেড়েছে। রাষ্ট্রও পাশে ছিল বলেই তার বিস্তার হয়েছে। এটাই হওয়া উচিত।
শেষবার আমরা দু’জন যখন শান্তি নিকেতনে বেড়াতে গিয়েছিলাম তখন হেমন্ত ছিল। সকালটা ছিল এমনি কুয়াশাময়। কিন্তু দুপুরটা হয়ে উঠেছিল একদম নিরাকপরা।গরম।শিল্পকলা বিদ্যালয়ে ঘুরে ঘুরে মাঠে ছড়িয়ে থাকা যে শিল্পকর্মগুলো দেখছিলাম তার পরতে পরতে ছিল সে দেশের অতীতের দাগ। চারিদিক সুমসাম। যেন উড়ন্ত বালিকণার ও কথা শোনা যাচ্ছে। এসময় সব সকল ছাপিয়ে দূর থেকে রোদের গায়ে ভর করে ভেসে এল গানঃ
‘তোমায় হৃদ মাজারে রাখিবো
ছেড়ে দেবো না
ওরে ছেড়ে দিলে সোনার গৌড়
আর তো পাবো না।’
একটি বৃক্ষের নিচে দেহাতি এক গায়ক দেশী বাদ্যযন্ত্র সহযোগে আপন মনে চোখ বুঁজে গাইছেন। আমার মনে হচ্ছিল কলিজার থোড় ছিঁড়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, বাংলা গান, লোক শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিই আমাদের ঠিকুজী, আমাদের কলিজা। এরই ধারাবাহিকতায় যা সৃষ্ট হবে তাই আমাদের সোনার পঙ্খী। ছেড়ে দিলে কিছুতেই আর পাবো না সোনার গৌড়। সুতরাং তাকে ছাড়া যাবে না। অপশক্তিকে কিছুতেই ছাড় দেয়া যাবে না। লাগে লাগুক আরো পঞ্চাশ বছর। সেটা বিষয় না।