================================================================

================================================================
ইদানীং আমাদের চারপাশের মানুষগুলো আর তাদের কাজকর্ম চিন্তা ভাবনা ইত্যাদি সবই বড় বেশি আলাদা লাগে না? মানে যারা নিজেরাই ইদানীং কালে জন্মে সদ্য যৌবনে পা দিয়েছে বা কয়েক বছর হল যাদের যৌবন শুরু হচ্ছে তাদের কথা বলছি না। তারা তো সমসময়ের মানুষ। তাদের পক্ষে দূর থেকে এই সময়কে দেখা সম্ভবই নয়। কিন্তু আমাদের মত বা আমাদের চেয়ে অগ্রজ যারা তারা কয়েকটি কাল অতিক্রম করে আসার সুবাদে তাদের কাছে বর্তমান কালকে নিরপেক্ষ ভাবে দেখবার সুযোগ অনেক বেশি। আমিও সে ভাবেই সময়টাকে দেখছি। আমরা যারা রেডিওয় জগন্নাথ শাঁওলি বা শ্রাবন্তী শুনে বড় হয়েছি তারাই আবার চ্যাটজিপিটি আসার পরের দুনিয়া দেখবার সুযোগ পাচ্ছি, তাদের কাছে ইদানীংকালের কাছের বিশ্ব বা বহির্বিশ্ব দুটোতেই সবকিছু কেমন বিহবল করা পরিবর্তন দেখাচ্ছে।
রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এ রাজ্যে বা কেন্দ্রে যে সরকার রয়েছে তাদের নেতাদের কিংবা অনুরাগীদের ভাবনা চিন্তায়ও ঢের বদল ঘটে গেছে। আর যাই হোক এদেশে এখনও তো ‘ভোট’ বলে একটা নির্বাচনী প্রক্রিয়া চালু। মানে যাকে মানুষ গণতন্ত্র বলে অভিহিত করে। অথচ প্রশাসন পরিচালনার সময়ে কোন গণতান্ত্রিকতা চোখেই পড়ে না। কোন নীতি নির্ধারণ করার সময় জনতাকেই তার সঙ্গে জোড়া হয় না। আমলা নির্ভর একটি কাঠামোয় গণতন্ত্রের প্রতিফলন আমলাদের তরফ থেকেই আশা করা যেত। কেননা স্রেফ একটি চিহ্নে ছাপ দিয়ে শাসক নির্বাচন করাটা ফলিত গণতন্ত্র হতে পারে না, যেখানে আমলারাই শাসকের মুঠোর ভিতরে নিয়ন্ত্রিত। তাহলে পাবলিকের কথা শাসকের কানে পৌঁছবে কে? সদ্য শেষ হওয়া পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময় পশ্চিমবঙ্গের গ্রামের মানুষ নিশ্চিত টের পেয়েছে জনগণের ‘মতামত’ নিয়ে নেতা প্রার্থীরা কেউ আগ্রহীই নয়। তাই অসংখ্য আসনেই প্রার্থীদের কোন প্রতিপক্ষই নির্বাচনে দাঁড়ায় নি। অতএব ‘বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়’ তারা বিজয়ী ঘোষিত হয়েছে। তাছাড়াও যে অসংখ্য হত্যার পরিসংখ্যান পাওয়া গেছে সেটাও ‘গণতন্ত্র’হীনতাকেই সূচিত করছে। যেটা সবচেয়ে দুঃখের তা হল এইবার আমলাদের সম্বন্ধে শোনা যাচ্ছে অনেকেই এই অন্যায় কাজের সাহায্যকারীর ভূমিকায় ছিল। একটি গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় এর চেয়ে হতাশাজনক পরিস্থিতি হয় না। কিংবা এই মুহূর্তে গত আড়াই মাস ধরে মণিপুরে দুটি সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে যে অশান্তির আগুন জ্বলছে সেটাকেও গণতন্ত্রের জয় বলা যাচ্ছে না। দেশে একটি গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত সরকার রয়েছে, সেই রাজ্যেও সে দলই রয়েছে, অথচ আগুন নেভানো যাচ্ছে না। কেন? এর উত্তর তো শাসকেরই দেবার কথা। সবচেয়ে বড় কথা বিনাবাধায় এমন খুনোখুনি কী করে চলতে পারে একটি স্বাধীন দেশের স্বাধীন রাজ্যে? মোদ্দা কথাটা হল দুটো তিনটে বিচ্ছিন্ন উদাহরণই নয়। ঠিকমত খবরাখবর নিলে জানা যাবে প্রত্যেকদিন প্রতিনিয়ত ক্ষমতাসীন দলগুলির নিজস্ব এজেন্ডা চালু করার দাপাদাপি কতটা বেড়েছে গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে।
অথচ প্রতিবাদ করবার কথা কারো মনে হচ্ছে না। যারাই করছেন তাঁরা ব্যক্তি উদ্যোগে করছেন এবং রাষ্ট্র যন্ত্রের ক্ষমতার হাতে পিষে যাচ্ছেন। এখন সর্বক্ষণ সকলেই ভয়ের মধ্যে রয়েছে। মজার কথা হল ভয় বস্তুটি কোন বিপদ থেকে মানুষকে বাঁচায় নি কখনও। মানে ভয় মানুষের জীবনে সাহায্যকারী কোন অস্ত্র নয় একেবারেই। কিন্তু আমাদের সারাক্ষণ কী যেন হারানোর ভয় আমাদের মুখ বন্ধ করে রাখছে। আমরা যত অন্তর্জালে জড়াচ্ছি ততই একলা হয়ে যাচ্ছি। আর সেভাবেই আমরা ক্রমে সমাজ বিচ্ছিন্ন, তারপর পাড়া বিচ্ছিন্ন, অবশেষে পরিবার বিচ্ছিন্ন একটি অসহায় প্রাণীতে পর্যবসিত হয়ে দিন কাটাচ্ছি।
এই ব্যাধি যে শুধুই ভারতে চলছে তেমনটি তো নয়। আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলিতেও রাজনৈতিক পরিস্থিতি লন্ডভন্ড হয়ে থাকছে। কোন দেশে নির্বাচনে ৯৮ শতাংশ আসনে জয়ী দল ক্ষমতায় আসছে। সেই সঙ্গে প্রধান বিরোধীদলের নেতাদের সবাইকে গারদে পুরে রেখেছে। গণতন্ত্রে এমনটি হওয়াটাই আশ্চর্য! কোথাও সরকারের প্রধানকেই বিদেশি চ্যানেলকে সাক্ষাৎকার দিতে দেখা যাচ্ছে যে সেখানে মিলিটারি শক্তিই চায় না গণতান্ত্রিক নির্বাচন হোক।
নিকারাগুয়ার সান্দিনিস্তা বিপ্লবের কথা বাঙালিদের বিলক্ষণ জানা রয়েছে। এই বিপ্লবটি হয়েই ছিল সোমোসা বংশের অবলুপ্তি ঘটানোর জন্য। গত শতকের ৬০ এবং ৭০ এর দশক জুড়ে এই বামপন্থী দলটি সংক্ষেপে যাদের FSNL বা Frente Sandinista de Liberación Nacional বলে ডাকা হয় অত্যাচারী আনাস্তাসিও সোমোসার বিরুদ্ধে বহু লড়াইয়ের পরে অবশেষে ১৯৭৯ সালে ক্ষমতায় আসে। তার পর থেকে দশকের পর দশক কখনও মার্কিন হস্তক্ষেপে তৈরী মিলিটারি শক্তি Contra র ক্ষমতা দখল। তারপর ক্রমে গৃহযুদ্ধ আবার ক্ষমতা দখল ইত্যাদি ডামাডোল পেরিয়ে অবশেষে (২০১১, ২০১৬, ২০২১) গত তিনটি নির্বাচন ধরে এই সান্দিনিস্তা অর্থাৎ FSNL রাই জিতে আসছে। এবং এখন জয়ের নিদর্শন হিসাবে তারা তাদের বিরুদ্ধে যে লোকই কথা বলুক না কেন তাদের গ্রেফতার, অত্যাচার এমনকি নির্বাসন পর্যন্ত দিচ্ছে। ২০১৮ সাল থেকে প্রাণ বাঁচানোর জন্য এই দেশ ছেড়ে পালানোর হিড়িক পড়েছে। সরকারের অন্যায়ের বিরুদ্ধে যারাই মুখ খুলছে তাদের দশা সঙ্গীন। অতি বিখ্যাতদের নির্বাসন দেয়া হচ্ছে, আর সাধারণ অসন্তুষ্ট বিরোধীদের পালাতে হচ্ছে। প্রখ্যাত কবি খিওকোন্দা বেলি কিংবা প্রবাদপ্রতিম ঔপন্যাসিক সেরখিও রামিরেসকে কয়েক মাস আগেই নির্বাসন দিয়েছে সে দেশের সরকার। তাঁরা স্পেনের কাছে রাজনৈতিক আশ্রয় ও সম্মান পেয়েছেন। অর্থাৎ গণতন্ত্রের নামে যে নির্বাচন হচ্ছে তাতে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষই অসন্তুষ্ট থেকে যাচ্ছে। তাহলে কতটা গণতান্ত্রিক হচ্ছে নির্বাচনগুলো? অথচ এমনটা কী হবার কথা ছিল!
কিন্তু কিছুটা আশার ছবি দেখছি নিকারাগুয়া ছাড়া অন্যান্য সেন্ট্রাল আমেরিকান দেশগুলির মধ্যে। তাকান হন্ডুরাসের দিকে। সেই ২০০৯ সাল থেকে সে দেশের রাজনৈতিক অবস্থা টালমাটাল। সেই সালে লিবারেল রাজনৈতিক দলের প্রার্থী হিসাবে নির্বাচিত তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মানুয়েল সেলায়াকে মিলিটারি ক্যু এর মাধ্যমে কোস্তারিকায় সরিয়ে দেয়া হয়। হন্ডুরাস দেশটির মূল সমস্যাও কিন্তু ড্রাগ পাচার সংক্রান্ত। এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীর সংখ্যা যুক্তরাষ্ট্রের মাথা ব্যাথার কারণ বরাবর। রাজনৈতিক খুঁটিনাটিতে এখানে যাবার সুযোগ কম, কিন্তু তথ্য হিসাবে বলা যাক যে এই ক’বছরে বহুবার রাজনৈতিক পালাবদল হতে হতে গত ২০২১ সাল থেকে সে দেশের প্রথম মহিলা রাষ্ট্রপতি এবং বামপন্থী জিওমারা কাস্ত্রো। যিনি এই সেলায়ারই পত্নী। অর্থাৎ এই মুহূর্তে সেলায়া দেশের ফার্স্ট জেন্টেলম্যান। কিন্তু এতদসত্ত্বেও সমস্যা কী কমেছে? হ্যাঁ জিওমারার নেতৃত্বে রাজনৈতিক অস্থিরতা কিছুটা সামাল দেওয়া গেছে কিন্তু নিরন্তর মার্কিন হস্তক্ষেপ কিছুতেই অন্যান্য সমস্যাগুলির সুষ্ঠু সমাধান করতে দিচ্ছে না।
কলম্বিয়ার চিত্র ওই একই ছিল গত চারটে দশক ধরে। ড্রাগ পাচার সমস্যায় জর্জরিত। ২০১৮ সাল থেকেই চিত্র বদলাতে শুরু করছিল। এই মুহূর্তে ২০২২ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন রিপাবলিক দলের গুস্তাভো পেত্রো যিনি অর্থনীতিবিদও বটে। এখন রাজনৈতিক স্থিরতা আসলেও, অর্থনৈতিকভাবে এই টালমাটাল সে দেশ। কেননা তাদের অর্থনীতিও অনেকখানি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নির্ভর। এক জটিল অর্থনীতির চ্যালেঞ্জের সামনে পেত্রো সরকার। তবু দমন পীড়ন আপাতত কিছুটা থমকে।
এল সালভাদোর দেশটি সবচেয়ে ঘন বসতিপূর্ণ সেন্ট্রাল আমেরিকান দেশ। সেখানকার চিত্র কেমন? নানা দশকের পর দশক টালমাটালের পরে এখন রাজনৈতিক ভাবে থিতু, ১৯৮১ র গৃহযুদ্ধে সে দেশে হাজার হাজার দেশবাসীকে হারিয়েছিল নিজেদের দেশবাসীর হাতেই। সেই রক্ত ধুতে প্রায় চল্লিশ বছর লাগল। ২০১৪ থেকে সে দেশে ক্ষমতায় ছিল বাম দল। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রমুখী অভিবাসন বন্ধ করা যায় নি। এখন প্রেসিডেন্ট নায়িব বুকেলে যিনি আবার বাম বা দক্ষিণ কোনপন্থীই নন। তিনি নির্দল প্রেসিডেন্ট। আর তার আমলেই রক্তপাত ঐতিহাসিক ভাবে কমে এসেছে। প্রায় ৪৮ শতাংশ কম হানাহানি হয়েছে তার সময়কালে।
এরকম বেশ কিছু স্প্যানিশভাষী দেশগ বরাবর কুখ্যাত ছিল টালমাটাল রাজনৈতিক পরিস্থিতির জন্য। কিন্তু এখন তাদের দিকে তাকালে একটি ছবি পরিষ্কার। সরকার বিরোধী মুখ যারা বন্ধ করতে চেয়েছে তাদের রাজত্বকালও স্থায়ী হয়নি অধিকাংশ দেশে। মরীয়া হয়ে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলেই মানুষ প্রতিবাদ করে। দেশের মানুষের একমাত্র সঠিক প্রতিবাদই একপেশে এই ক্ষমতার আস্ফালন বন্ধ করতে বা অন্তত কিছুটা হলেও কমাতে পারে। দেশের অন্যান্য পিছিয়ে পড়া বিষয়গুলিতে মনোযোগ দিতে পারে। কিন্তু প্রতিবাদ কী নেতারা করবেন? কবিরা করবেন? আমার মনে হয় যে কবি সাহিত্যিকদের দিকে তাকানোর বোকামি না করাই ভাল। কেননা অন্যের হয়ে কেউ লড়াই করতে পারে না যদি না সেটা তার নিজের সমস্যা বলে বিবেচিত হয়। কষ্ট যে পাচ্ছে, কোণঠাসা যে হচ্ছে প্রতিবাদ সেই করবে। আসল সমস্যা হল কতখানি সহ্য করার পরে আমি নয়, ভাবব আমরা কোণঠাসা হয়েছি- সেটা ঠিক করে বোঝা। স্বামীজি বলেছিলেন আমরা অন্ধকার থেকে আলোর দিকে যাই না, আমরা কম আলো থেকে অধিক আলোর দিকে যাই। অর্থাৎ ভাবনায় নঞর্থকতা রাখা চলে না। অন্ধকারকে শেষ না ভেবে তাকে কম আলো ভাবলেই আশা জাগে। তার থেকে জাগে শক্তি যা আমাদের সবার ভিতর জন্ম থেকেই নিহিত। আলোর দিকে পরিবর্তন শুরু হবে তখনই।