কঙ্কাবতীর মাঠ ভরে আছে জলে। কোথাও রাজপুত্র কোটালপুত্র নেই। তাদের ঘোড়াগুলো ভেসে গেছে কোথায় কে জানে! মাঠের ভেতর ওই যে একখানা সাঁইবাবলার গাছ, সেখানে ব্যঙ্গমা-ব্যাঙ্গমিরও সাড়া নেই। শুধু টলমল জলে ফুটে আছে নীল কমল। ফুলের হলুদ বুকে ঘুরে ঘুরে দোল খাচ্ছে মধুচোর কালো ভোমরা। নীল শালুকের ছোটো ছোটো পাতার ফাঁকে জলছায়া আশ্বিনের আকাশ। তাকে ভেঙেফুঁড়ে মাঝেমাঝেই বুজকুড়ি কাটছে রঙিন খলসে, রুপোপিঠ কাজলি পুঁটি। ঝলসে উঠছে একফালি ফিরোজা আয়না। আর তাতে মেঘ নয়, ললিতাপিসির বাগান থেকে বুনো কাপাস উড়ছে সাদা সাদা। বেলেপুকুরের জলে ছেলেপুলেহাঁস ডুব কাটছে দুপুরভর। যতক্ষণ-না তাদের নাকের নীচে মেটে গোঁফ গজাবে ততক্ষণ তারা বাড়ি যাবে না। বাবলাতলা থেকে ভয়েরা এখন পাততাড়ি গুটিয়ে নিয়েছে। ওখানে আর মরা গোরুর সাদা হাড় পড়ে নেই। শকুনেরা নেই। বড়োকাকারও আজ চিন্তা নেই আর। এ ক-দিন শরতের দেবীপক্ষ জ্যোৎস্নায় ব্রহ্মঠাকুর খড়ম পায়ে ঘুরবে না এখানে। দিব্যি মাছ নিয়ে ফেরা যাবে।
পুজো এসেছে এপাড়ায়। এখানে ঢাক-ঢোল নেই। আলো আছে। আকাশ আছে। শিউলিরা দু-বেলা ঝরেছে উঠোনে। নুনমাঠের ধারে দাসবাবুর বাগানের মাথায় পাড়া-বেপাড়ার পেটকাটি, ময়ূরপঙ্খি, মোমবাতি ঘুড়িদের সাথে পাগলা কাত্তিকের একশো পায়রার ওড়াউড়ি শুরু হয়েছে। ঘরে ঘরে চলছে ঝাড়পোঁছ, উঠোন গোবর দিয়ে তকতকে করে নিচ্ছে মেয়ে-বউয়েরা। পরামাণিক কাকা বগলে চামড়ার ঝোলা ব্যাগ নিয়ে ঘুরে ঘুরে বাড়ি বাড়ি চুল কেটে গেছে। শিউলিরা নারকেল গাছ ছাড়িয়ে দিয়েছে, পেড়ে দিয়েছে ঝুনো ফল এককাঁদি। উঠোনে এখন থইথই সোনারোদ। কেউ যেন আসছে। হাওয়ায়, হলুদ কলকে ফুলে, দুর্গাটুনটুনির চঞ্চল পায়ে তার ভীষণ গুঞ্জন।
এখন আর ঘুম আসতে চাইছে না কিছুতেই। ক-দিন আগেও হ্যারিকেনের সামনে আমার বদলে বই পড়ত শ্যামাপোকা, গঙ্গাফড়িং, ঘুরঘুরে আর গুবরেরা। কিন্তু ময়মনসিংহের রুপোচুল প্রিয় কালো রাজকন্যাটি যেই হাঁটুর জুজু থেকে ঠাকুমার ঝুলি খুলে ডালিমকুমারের গল্প বলতে শুরু করেছেন, তখন শত চেষ্টা সত্বেও আর ঘুমজাদুকরের হাত থেকে রেহাই মিলছে না আমার। কিন্তু ঘুমের দেশেও আবছা ভেসে আসছে মা আর ঠাকুমার গল্প। যাদুলাঠির গল্প থামিয়ে ঠাকুমা তখন চলে যাচ্ছেন নিজের গল্পে।
বড়ো তালুকদারের মেয়ে প্রমদাসুন্দরী তিন-চার বছর অন্তর পুজোর সময় বাপের বাড়ি নাইওর যেতেন। উমার কৈলাশে যাওয়ার মতো বাপের বাড়ি যাওয়ার সে এক মস্ত আয়োজন। পালতোলা নৌকায় ভেসে ভেসে রঙ্গিলা নাওয়ের মাঝির সঙ্গে শেরপুর থেকে কিশোরগঞ্জ।
ঠাকুমার বাবার বাড়িতে দুর্গা পুজো হত। একেবারে হইহই রইরই ব্যাপার। আত্মীয় পরিজন, লোকলস্কর, দানধ্যান, খাওয়াদাওয়া ক-দিন বিরামহীন চলত। লোকজন ভিড় করত বাড়িতে। মাটির প্রতিমা দেখার অছিলায় অবশ্য জ্যান্ত দেবীকে দেখবার আগ্রহটাই থাকত বেশি।
ঠাকুমার জ্যাঠামশাই দুটি বিবাহ করেছিলেন। তাঁর দুই স্ত্রীর মধ্যে একজন ছিলেন পরমাসুন্দরী। কিন্তু তিনি দৈহিকভাবে পূর্ণাঙ্গ নারী ছিলেন না। ছিলেন একজন অর্ধনারীশ্বর। সেই বৃহন্নলা সুন্দরীর মুখই ছিল খাসনবিশ বাড়ির শারদোৎসবের প্রধান আকর্ষণ। এ এক আশ্চর্য রূপকথা।
ঘুম কিছুতেই গাঢ় হচ্ছে না আমার। কান দরজায় লেগে থাকছে। মা মাস্টার স্টোর্স থেকে ধার-বাকিতে টেরিকটের খয়েরি বেগুনি চেকজামা আর ইলাস্টিক দেওয়া কালো রঙের প্যান্ট কিনে দিয়েছে বটে তবে ছোটোকাকার কিনে দেওয়া জামা-প্যান্টের জন্য অপেক্ষাটা বড়ো লম্বা। ওটা পাওয়া হয়ে গেলে তারপর আবার বাবার দেওয়া চামড়ার চটির জন্য অপেক্ষা। এগুলোর সবই আসবে রাত করে। আজ আসতে পারে অথবা কাল, তা না হলে পরশু। অপেক্ষা কিছুতেই ফুরোতে চায় না!
পাড়ার মেটে রাস্তার কাদা একটু কমেছে এখন। চাঁদা নিয়ে গেছে এ তল্লাটের প্রথম পুজোর উদ্যোক্তারা। এ বাড়িতে পুজোর চাঁদা একমাত্র ওখানেই দেওয়া হয়। সবাই জেনে গেছে এ বাড়িতে অন্য চাঁদা মিললেও, পুজোর চাঁদা মেলে না। একবার এক হঠাৎ সংঘ চাঁদা চাইতে এসে না-পেয়ে হুমকি দিতে দিতে চলে যায়। তাদের বক্তব্য, পুজোর বোনাস দেওয়া হয় চাঁদা দেবার জন্য। কথাগুলো ছোটোকাকার কানে যেতেই, তিনি প্রচণ্ড রেগে গিয়ে ছুটে গিয়ে ‘হঠাতিদের’ পাকড়াও করেন, তারপর কান ধরে ওঠবোস করান। সে এক কান্ড বটে।
প্রতিবছর মহালয়ার ভোর বেলা কারা যেন মাইকে বাজিয়ে দেয় ‘আশ্বিনের শারদপ্রাতে..’। তাই শুনে মনের ভেতর এক আশ্চর্য আনন্দ গান গেয়ে ওঠে। সকালে উঠে দেখি নসকরদের পুকুরে সরস্বতীর হাঁসেরা ডানা ঝটপটিয়ে আলো ছিটকে দিচ্ছে আমাদের ভাঙা জানালায়। সেই আলো কলকে ফুলের সবুজ পুতুলফলে লেগে মধুর মতো গড়াচ্ছে। আমি পুকুড়পাড়ে গিয়ে কুড়িয়ে আনছি কচুরিপানা আর কাঁকড়াঢিলের মাটি। দু-একটা শাপলাও। মাটি দিয়ে ঠাকুর গড়তে হবে। কচুরি পানার গুচ্ছমূল দিয়ে চুল হবে অসুর আর দুর্গার। শাপলার নল ভেঙে মালা হবে। নারকেল পাতার কাঠি দিয়ে প্রস্তুত হবে যাবতীয় অস্ত্র। কিন্তু মনমতো গড়া তো কিছুতেই হবে না। তাই প্রতিমার ভাঙাগড়া চলতেই থাকবে। যেহেতু ভেতরে খড়ের কাঠামো নেই তাই রোদে ফেটে যাবে মাটি। শুকিয়ে যাবে শাপলার চাঁদমালা। মন খারাপ হবে। ‘ভেতরে খড়ের বোঝা উপরে ন্যাপাপোছা’র মহিমা জানতে আরও কয়েক বছর কেটে যাবে।
এ পাড়ার ত্রিসীমানায় যদিও কোনো পুজো নেই, যদিও আমাদের বাড়ির সঙ্গে পুজোর কোনো সরাসরি যোগাযোগ নেই, তবুও আশ্বিনের আগন্তুক আকাশ থেকে গন্ধ নেমে আসে। নারকেল পাতা ফুঁড়ে আসা রোদ বাজনা বাজায়। আমাদের রুগ্ন ক্ষয়াটে যক্ষারোগীর মতো বারান্দার থামের ইটগুলো হেসে ওঠে আলোর সোনা ছুঁয়ে।
বাবার হাত ধরে যেতে যেতে আমাদের পাড়া ফেলে ইঁটপাতা রাস্তায় উঠে শুনি মাঠের প্যান্ডেলের ছোটো থ্যাবড়া তোবড়ানো মাইকে বাজছে ‘ইয়াদ আ রহি হ্যায়’। কে গাইছে জানি না, কী কথা বলছে জানি না, কিন্তু মনের ভেতর বাসা বাঁধছে অজান্তেই আমার চিরদিনের পুজোর ভাবসংগীত।
মাঠের ভেতরে গিয়ে বাবার সঙ্গে দাঁড়িয়ে দেখি বাঁশের প্যান্ডেলের চারপাশে ত্রিপল দিয়ে ঘিরে শুধু সামনের দিকটায় লাল হলুদ নীল কাপড়ের কুঁচি দিয়ে সাজানো হয়েছে মণ্ডপ। তার ভেতরে তক্তার মঞ্চে ইয়া পেশিওয়ালা সবুজ রঙের লাল টকটকে মখমলের কাপড় পরা অসুর মরা মোষের পেট ফুঁড়ে বেরিয়ে এসেছে। হাতে টিনের ঢাল আর তলোয়ার। শরীরের তুলনায় তার মাথাটা কেমন যেন ছোটো লাগে। তবে বিরাট চোখদুটো টকটকে জবাফুলের মতো লাল। তার গায়ে পা দিয়ে দুর্গা ঠাকুর অন্যদিকে আনমনে চেয়ে আছেন। তাঁর নাচের মুদ্রার মতো কোমল হাত একটা টিনের ত্রিশূল অসুরের বুকের ওপর আলগাভাবে ধরে আছে। এত অল্প আঘাতে যে কী করে এত রক্ত বের হচ্ছে ভেবে অবাক লাগছে আমার। পাশে গোলাপি রঙের গায়ের উপর সাদা হাতির মুন্ডু নিয়ে পেট উঁচু গণেশ বাচ্চাদের চুষিকাঠির মতো সরু একটা গদা হাতে দাঁড়িয়ে। তার পাশে কলা বউ। কার্তিক, লক্ষ্মী আর সরস্বতীকে ততটা চোখে পড়ছে না। মণ্ডপের সামনে ধুনো জ্বালিয়েছে পুরোহিত। নীচে ড্যাং ড্যাডাং করে ঢাক বাজাচ্ছে দু-জন ঢাকি। ঠাকুর, অসুর সবার গা কী সুন্দর চকচকে। মূর্তির তলায় কাগজ সেঁটে লাল কালি দিয়ে কে যেন লিখে দিয়েছে, ‘প্রতিমাশিল্পী কানাই পাত্র’। কী করে বানায় এমন ঠাকুর কানাই পাত্র? আমি যে কবে এমন বানাতে পারব!
আমার ঠাকুর গোনা শুরু হত এই মাঠের ঠাকুর দিয়েই। বাড়ি ফিরলে ছোটোকাকাকে বলতে হবে ক-টা ঠাকুর দেখলাম। নইলে আর পরের বছর জামা পাওয়া যাবে না। এবার বাজারের ঠাকুর দেখা শেষ করে ট্রেনে চেপে ঢাকুরিয়া চলেছি। ওখানে আছে বাবুবাগানের ঠাকুর, যোধপুরের ঠাকুর, গোলপার্কের ঠাকুর। দেশপ্রিয় পার্কও আছে। দিনেদিনে সব দেখে নিয়ে ভিড়কে ফাঁকি দিয়ে ফিরব বিকেল বিকেল।
প্রতিটা প্যান্ডেলেই দেখতাম প্রতিমার সামনে সবাই দু-হাত জড়ো করে আছে। বোকার মতো কিছু না-বুঝেই একবার বাবাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, সব জায়গায় ঠাকুরকে লোকেরা প্রণাম করছে কেন বাবা, একই তো ঠাকুর? বাবা বলেছিলেন, ঠাকুরকে নয়, এই সুন্দর ঠাকুর যে বানিয়েছে সেই শিল্পীকে প্রণাম করছে ওরা। উত্তরটা সেদিন মনের অনেক গভীরে সেঁধিয়েছিল, পরে তা বুঝেছি।
সময় আমাকে হাত ধরে হাইস্কুলে পাঠিয়েছে। এখন আর বাবার হাত ধরে ঠাকুর দেখার দিন নেই। মনের ডালপালা এখন কিছুটা বড়ো। যে স্কুলে পড়ি তার কম্পাউন্ডে পুজো হয়। স্কুলের পুজো না-হলেও, স্কুল চত্বরে পুজোর আয়োজন আমাদের অস্থির করে দেয়। ক্লাসে এখন মন বসে না। ইস্কুলের জানালার গরাদ ধরে ঝুঁকে পড়ে কাঠচাঁপা ফুল, গাছে আটকে থাকা ছেঁড়াফাটা ঘুড়ি দোল খায়, কিন্তু কেউ দেখে না সেসব। ইস্কুলের মাঠজুড়ে বিরাট প্যান্ডেল হচ্ছে। ঠাকুর এসে গেছে আগেই। এটাই রীতি। নইলে বিশাল বিশাল ঠাকুরের প্যান্ডেলপ্রবেশ অসম্ভব। ঠাকুর এলেও তা দেখার উপায় নেই। ঠাকুরের শুধু নয়, অসুরের মুখও কাপড় দিয়ে ঢাকা। কিন্তু এইসব আমাদের মনে মনে ছুটি দিয়ে দিয়েছে।
অনেকদিন আগে সে কোন ছোটোবেলায় এই ইস্কুলেই দেখতে এসেছিলাম নবদুর্গা। সেই প্রথম রাতের বেলায় ঠাকুর দেখতে যাওয়া মা-বাবার সঙ্গে। কয়েক কিলোমিটার অন্ধকার পেরিয়ে, ঝিঁঝিঁর ডাক শোনাতে শোনাতে বাসটা ইস্কুলের পাঁচিলের পাশে উঁচু কৃষ্ণচূড়া গাছের নীচে এসে দাঁড়িয়েছিল। ঘোর কালোর ভেতর গাছের মাথায় সবুজ সেলোফেন পেপারে জড়ানো টিউবলাইটগুলো ছিল সেদিনের সবেধন লাইটিং। সেই দিগধাঁধানো অন্ধকারে নবদুর্গার এক রূপ করালী-কালী দেখে উড়ে গিয়েছিল প্রাণ। নিকষ রাতের চেয়েও ভয়াল সেই দিগম্বরী দেবীর মুখের শ্বদন্ত আর গলার সাদা করোটিমালা আরও বীভৎস করে তুলেছিল দৃশ্যকে। বাবা আর মা দু-জনের হাতই সজোরে জাপটে ধরে বলেছিলাম, ফিরে চলো! তারপর মণ্ডপ থেকে বেরিয়ে এসে দেখি বাস নেই। আমরা কয়েক জন পুজো পর্যটক সেই ভীতিপ্রদ আঁধারে দাঁড়িয়েছিলাম বেশ কিছুক্ষণ। তারপর আমাদের আশ্বস্ত করে হাঁফাতে হাঁফাতে এলো মুড়ির টিনের সেই ‘সাতচল্লিশ’ রুটের বাস।
এখন এই ইস্কুলেই পড়ি। প্রতিবছর দুর্গার নবরূপ দেখি, কিন্তু সেদিনের মতো আর লাগে কই! তবে মনের ভেতর ছুটির আনন্দ ওড়ে। নীল আকাশে ঘুড়ির মতো লাট খায়।
মহালয়ার পরে এমনিতেই পড়াশুনো গা ছেড়ে দিয়েছে। ক্লাসঘরে ক্লাসঘরে ব্যাগেরা গল্প করছে। ছেলেরা বাইরে। কেউ দোল খাচ্ছে প্যান্ডেলে, কেউ খেলছে ক্রিকেট, কেউ কমলা রঙের কাঠি আইসক্রিম আর কালো রঙের অ্যাসিড বিটনুনে মজে আছে। হাফছুটি এখন রোজের বিষয়।
ছুটি পড়ার দিন সবাই নতুন জামাকাপড় পড়ে ইস্কুলে আসার রীতি। ছোটোকাকার দেওয়া সাদাকালো চেক জামা পড়ে স্কুলে গেছি সেবার। ছোটোকাকা নিজে দাঁড়িয়ে আমার জামা আর প্যান্ট মাপিয়ে কাটিয়ে নিয়েছেন দর্জিকে দিয়ে। মনে সামান্য স্টাইলের ইচ্ছে থাকলেও তা তো আর বলার উপায় নেই! তাহলেই জুলপিতে পড়বে টান। চুলের টেরিটাও তো কাটতে হয় বুঝেশুনে। তো সেই জামা আর প্যান্ট দেখে সেবার আমাদের ইংরাজি স্যার শৈলেন মুখোপাধ্যায়ের সে কী প্রশংসা। সদারসিক তিনি আমাকে বললেন তোর মাপে আমাকেও একজোড়া বানিয়ে দিস তো বাপ। কী সুন্দর যে হয়েছে! তুই এবার হিট।
পুজোর ছুটির অবকাশ এলেই দেখি বন্ধুরা প্রেম করে। চিঠি বিনিময় করে। গোপনে পুজোর মন্ডপে দেখা করে, ফুচকা খায়, অভিসারে যায়। স্বভাবলাজুক আমার কোনো প্রেমিকা নেই, অবাকপটু আমি নচিকেতার গান হয়ে ইউনিফর্ম নীলাঞ্জনাদের বাসে চড়ে চলে যাওয়া দেখি।
মেয়েদের দেখি, ভালো লাগে, কিন্তু তাদের কানের সামনে কাগজের ভেঁপু বাজানোয় আমার সায় নেই। তাই পাড়ার বন্ধুদের সঙ্গে হোলনাইট পুজোপর্যটনে যাই না। বরং বারুইপুরের একান্নদুর্গা থেকে গড়িয়া-কামডহরির নব আর পঞ্চদুর্গা, পাটুলি থেকে যাদবপুর, বাবুবাগান থেকে গোলপার্কে একলা আগন্তুকের মতো বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়াই পুরোনো জামা-জুতো পরে। পকেটে টিউশানির সামান্য পয়সা আমাকে উসকিয়ে বইয়ের স্টলের দিকে নিয়ে যায়। হাতড়িয়ে খুঁজে দেখি, দু-মলাটের গোপন খামারে কিছু ভালোবাসার আলো পড়ে আছে কিনা।
এসব কি দিগন্তপারের গল্প? কেমন যেন খোয়াবের মতো লাগে। এখন তো মাঠের গা ফুঁড়ে টিউমারের মতো ঘরবাড়ি উঠে গেছে। সামাজিক দুরত্ব নেই বাড়িদের গায়ে। ঘাড়ে-পিঠে ইটের নিশ্বাস। পুজোর একমাস আগে থেকেই পরিত্রাহি চোঙের চিৎকার আকাশকে ফর্দাফাই করে দেয়। আশ্বিনে ভাদ্রের গুমোট, নিম্নচাপের বৃষ্টি কোনো শরতের কথা মনে করায় না। আলো আর বুলবুলির দিন খেলা করে না অন্ধ গলিতে। তবু পুজো আসে, থিম ভাসে আকাশে বাতাসে। ছোটো থিম বড়ো থিম দাদা থিম নেতা থিম শাড়ি জামা জুতো থিম। এ বড়ো থিমের সময়। সম্মোহিত বিজ্ঞাপনে অবিরাম দর্শনার্থীর ভিড়ে মণ্ডপেরা ক্লান্ত হয়। আলোকমালায় দিগন্ত ধাঁধিয়ে ওঠে। আশ্বিন আগন্তুকের মতো আসে, চলে যায়। কেউ টের পায় না।