=========================================================

=========================================================
‘Authentic human existence’ গ্রন্থে এরিখ ফ্রোম ও হার্বাট মার্কিউসের অনুসন্ধান এই সিদ্ধান্তে পৌঁছায়, ধনতন্ত্র শুধু একটা অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক সংকট নিয়ে আসে তাই নয়, ধনতন্ত্র বয়ে আনে মানবিক সত্তার এক গভীর সংকট। মার্ক্সবাদের সমীক্ষণী পর্যালোচনা দিয়ে ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের দ্বিতীয় প্রজন্মের গবেষকরা উপলব্ধি করেছিলেন, শুধুমাত্র অর্থনৈতিক উৎপাদন ব্যবস্থার বিশ্লেষণ দিয়ে পুঁজির চরিত্রকে সম্যক বোঝা অসম্ভব, এর জন্য সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনগুলোকে বিশ্লেষণ করা জরুরি। পুঁজির টিকে থাকার জন্য যা সর্বাগ্রে প্রয়োজন তা হলো চৈতন্যহীন একটা সমাজ ব্যবস্থা। মার্ক্সীয় ঐতিহাসিক বস্তুবাদ গড়ে উঠেছিল জ্ঞানদীপ্তির যুক্তিবাদের আলোকে। মার্ক্স মনে করতেন, পুঁজিবাদী সমাজে পণ্যের অবিরাম উৎপাদন বৃদ্ধির ঝোঁক তার সর্বনাশ ডেকে আনবে। কারণ ইতিহাস বলে, উৎপাদন পদ্ধতির সঙ্গে এবং উৎপাদন সম্পর্কের সংঘাতের ফলেই নতুন সমাজব্যবস্থার দরজা খুলে যায়। মার্ক্স মনে করতেন, উৎপাদন বাড়লেও তার বন্টনে সমতা আসবে না বলেই, শোষিত মানুষেরা একদিন না একদিন বিপ্লব করবেই। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে কি তা দেখা গেলো ? আমরা যদি সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর সমগ্র বিশ্বের দিকে তাকাই, মার্ক্স কথিত বিপ্লবের দেখা তো মিলেইনি, উপরন্তু সমস্ত প্রকার বৈষম্য ও শোষণ বেড়েই গেছে ! কেন হলো এমন ? এর একটা পর্যবেক্ষণ ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের গবেষকরা দিয়েছেন, যা মার্ক্সের দৃষ্টিভঙ্গির থেকে ভিন্নতর। তাঁরা দেখেছেন, উৎপাদনের পদ্ধতি এবং উৎপাদন কৌশলের অভূতপূর্ব উন্নতির ফলে বিপ্লবের সম্ভাবনা ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসছে। বুর্জোয়া সমাজ যুক্তিবাদী সমাজ গঠনের পক্ষে সর্বশ্রেষ্ঠ সাংগঠনিক ব্যবস্থা। উৎপাদনের ক্ষেত্রেও সাংগঠনিক এবং পরিচালনা-ব্যবস্থার ক্রমাগত উন্নতি ঘটছে এবং রাষ্ট্র বিভিন্ন কৌশলের মাধ্যমে শ্রমিক এবং অন্যান্য নিপীড়িত শ্রেণির অসন্তোষকে নিজের আয়ত্বের বাইরে যেতে দিচ্ছে না। আসলে পুঁজিবাদকে টিকিয়ে রাখার জন্য রাষ্ট্র তার শোষিত নাগরিকদের প্রতি যে হিসেবি নমনীয় (calculative flexibility) অবস্থান নেয়, সেটি ক্ষমতার বৈধীকরণ করে। সাম্প্রতিক ফ্যাসিবাদের প্রবণতাকে বোঝার জন্য রাষ্ট্রের এই নমনীয়তার স্বার্থ ও ক্ষমতার বৈধীকরণের স্বরূপটিকে বোঝা জরুরি।
রাষ্ট্র তার ক্ষমতাকে নাগরিকের চোখে ‘বৈধ’ করে তোলার জন্য কতকগুলো সুপরিকল্পিত কৌশল অবলম্বন করে। আমরা তাকে সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক প্রভৃতি ভাগে বিভক্ত করে আলোচনা করবো। একটি পুঁজিবাদী বা ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রে সবচেয়ে যা অবহেলিত হয়, তা হলো বিকেন্দ্রীকরণের ধারণা। কি অর্থনীতি, কি সংস্কৃতি, কি সমাজনীতি সমস্ত ক্ষেত্রেই বিকেন্দ্রীকরণের বিপর্যয় ঘটে। অর্থনীতির ক্ষেত্রে ব্যক্তি মালিকানাধীন পুঁজির পরিমাণ দ্রুত বৃদ্ধি পায়, বাড়তে থাকে দরিদ্র শ্রেণির সংখ্যা। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের দারিদ্র্য যদি ‘সহ্যসীমা’র বাইরে চলে যায়, তাহলে সেই ক্ষোভ থেকে বিদ্রোহ, বিদ্রোহ থেকে বিপ্লবের সম্ভাবনা জেগে ওঠে। তাই একটি পুঁজিবাদী রাষ্ট্র দরিদ্র শ্রেণির দারিদ্র্যকে সহ্যসীমায় ধরে রাখার জন্য নানারকম পদ্ধতি অবলম্বন করে। ভাতা বা অনুদান প্রথা তার একটি। নানারকম সরকারি পরিষেবা, ফ্রি বা হাফ ফ্রি সিস্টেম দিয়ে জনগণের দারিদ্র্যের সীমা নিয়ন্ত্রণ করে রাখা হয়। এতে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বঞ্চনা বা শোষণের অবসান হয় না, কিন্তু তারা বিদ্রোহীও হয় না। এখানে একটা প্রশ্ন উঠতে পারে, মানুষ কেন এই ভাতা, অনুদান বা সরকারি জনমোহিনী পরিষেবাগুলির আসল সত্য উদঘাটন করতে পারে না ? এর উত্তর আছে, ক্ষমতাবান রাষ্ট্রের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক কৌশলে। ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের অন্যতম সদস্য অ্যাডোর্নো লিখছেন, “it is this lack of experience of the imagery of real art, partly substituted and perodied by the readymade stereotypes of the amusement industry, which is at least one of the formative elements of that cynicism that has finally transformed the Germans, Beethoven’s people into Hitler’s own people.” শিল্প-সাহিত্য থেকে চিন্তা ও ভাবনার বহুমুখী গভীরতাকে সরিয়ে শিল্প-সাহিত্যকে বিনোদনে পরিণত করা ফ্যাসিস্ট সমাজব্যবস্থার প্রধানতম একটি চিহ্ন। মধ্যবিত্ত সমাজের ভিতরে সংস্কৃতি বিমুখতা ফ্যাসিবাদের পথ পরিষ্কার করে। হিটলার এর কাল থেকে আজকের কালের ফ্যাসিবাদী সমাজে এটি সহজ লভ্য একটি উদাহরণ। পশ্চিমবঙ্গে নব্বইয়ের দশকের থেকে বাংলা, হিন্দি সিনেমা, গান, যাত্রা-নাটকে কিংবা সাহিত্যেও যে মধ্য থেকে নিম্ন মেধার চাষ হয়েছে, এবং তা জনপ্রিয় হয়েছে, তার চর্চা সাম্প্রতিক সময়ে একেবারে চূড়ান্ত আকার ধারণ করেছে। বিগত কয়েক বছর ধরে যে বাংলা সিরিয়ালগুলো রমরম করে চললো তা কী প্রমাণ করে ? কেন ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ বাংলা সিনেমার সবচেয়ে জনপ্রিয় একটি সিনেমা হয়ে দাঁড়ায় ? শিল্প সাহিত্যের যে অধঃপতন জার্মানের নাগরিকদের Beethoven’s people থেকে Hitler’s own people এ পরিণত করে, সেই এক অধঃপতন পশ্চিমবঙ্গে রবীন্দ্রনাথের জনগণকে নরেন্দ্র মোদীর জনগণে পরিণত করে। সারা বিশ্বেই এই ট্রান্সফরমেশন চোখে পড়বে। ঋত্বিক ঘটক কেন বললেন, ভাবো, ভাবা প্র্যাকটিশ করো ? কারণ না ভাবলে তুমি নিজের প্রকৃত অস্তিত্ব খুঁজে পাবে না। ক্রমাগত নিয়ন্ত্রিত হবে।
ভাবতে শেখাতে যে পারে সেই পাঠশালার হাল কীরকম ? হীরকের রাজা উচ্চারণ করলেন, জানার কোনো শেষ নেই, জানার ইচ্ছা বৃথা তাই। জনগণ উল্লসিত, সত্যিই তো যদি শেষই না হবে, তাহলে চেষ্টা করে কী লাভ ? রবীন্দ্রনাথের ‘কর্তার ভূত’ ভূতগ্রস্থ দেশের মানুষ সম্ভবত তাই ভাবলো, অদৃষ্টের চালে চলাই জগতের শ্রেষ্ঠ চলা। চোখ খুলে চলার বাধা অনেক, প্রতি পদে প্রশ্ন এসে পড়ে। তাই প্রশ্নকর্তাকেই সন্দেহ করো, অস্বীকার করো। হীরকের প্রজা আর ‘কর্তার ভূত’ এর জনগণ এর মধ্যে চোখ বুজে মেনে নেওয়ার প্রবণতায় ভীষণ রকম মিল। কিন্তু কেন তারা এমন অন্ধত্বের জীবন বেছে নিয়েছে ? কারণ, আলো কী তাদের জানতে দেওয়া হয়নি, বরং এব্যাপারে চেষ্টা করতেও তারা ভয় পায়। ফ্যাসিবাদে প্রজাদের ভয় পাওয়া শাসকের জন্য জরুরি। তাই শাসকেরা তাদের ভয় দেখায়। উল্টে শাসক কি ভয় পায় না ? প্রজার প্রশ্নকে তাদের ভয়, সে কারণেই প্রশ্ন উত্থাপনকারী শিক্ষাকে পুরো বাতিল করা হয়। যদিও এই বাতিলের প্রক্রিয়াটি সময়ের সাথে সাথে বিবর্তিত হয়। বর্তমান উদারনৈতিক গণতন্ত্রের ছদ্মবেশে যে পুঁজি ও ফ্যাসিস্ট শক্তির উত্থান সেখানে হয়তো হীরক রাজার রক্তচক্ষু সবসময় প্রত্যক্ষ করা যায় না, এখানে ছাত্রদরদী শিক্ষাব্যবস্থার নামে শিক্ষা থেকে চিন্তাকে তুলে দেওয়ার উদাহরণ দেওয়া যায়। বোধমূলক প্রশ্ন, রচনাধর্মী উত্তর লেখা তুলে দিয়ে মাল্টিপল চয়েস সিস্টেম পরীক্ষা, অতিসংক্ষিপ্ত প্রশ্ন-উত্তর সিলেবাসে এনে, ছাত্রছাত্রীদের সৃজনশীলতাকে শেষ করে ফেলা হয়। ছাত্রছাত্রীদেরকে কাছে মুখস্থ করা ছাড়া পড়াশোনার অন্য কোনো অর্থ থাকে না। ফলত দেখা যায় প্রচুর নাম্বার পেয়ে পাশ করে ছাত্র থেকে অভিভাবক খুশি কিন্তু দিন শেষে তার জ্ঞান কোথায় গেলো ? আইয়াপ্পা পানিক্কর কবিতায় উত্তর দিচ্ছেন, জ্ঞান যেখানে গেল, সেটি একটি ধোঁকা। শুধু কি সৃজনশীলতা নষ্ট করা হচ্ছে, শাসক তার ইচ্ছামত ছাত্রছাত্রীদের ভুল বা বিকৃত শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টাও করেছেন। যেকোনো ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রের অন্যতম চরিত্র হলো, বিকৃত ইতিহাস রচনা, নিজের চরমপন্থী মতাদর্শ অনুযায়ী পাঠ্যতালিকা তৈরি। হিটলারের কাল থেকে আজকের ভারত তার ব্যতিক্রম নয়। একটা মিথ্যাকে ক্রমাগত বলে যেতে যেতে তাকেই জনগণের কাছে সত্য করে তোলার ফ্যাসিবাদী প্রক্রিয়ার অন্যতম হাতিয়ার হলো, ইতিহাসের বিকৃতি, শিক্ষাব্যবস্থায় ফ্যাসিবাদী আদর্শের অংশগ্রহণ ও মিডিয়ার ব্যবহার।
মার্ক্স দেখিয়েছিলেন, শ্রমিকের উৎপাদিত শ্রমের বিচ্ছিন্নকরণ কীভাবে শ্রমিকের জীবনের উপর মালিকানার শোষণ সৃষ্টি করে। ঠিক একইভাবে একটি পুঁজিবাদী সমাজে সামাজিক বিচ্ছিন্নকরণ মানুষের সামাজিক জীবনের উপর প্রভুত্ব নিশ্চিত করে। ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের দ্বিতীয় প্রজন্মের গবেষক হাবারমাস তাঁর ‘Structural Transformation of the public Sphere’ গ্রন্থে ইউরোপে মধ্যযুগে কীভাবে একটি শক্তিশালী পাবলিক স্ফিয়ারের সৃষ্টি হয়েছিল এবং পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার বিবর্তনের ফলে তা কীভাবে সংকুচিত হলো দেখিয়েছেন। হাবারমাস মনে করতেন, এই পাবলিক স্ফিয়ারে আমাদের বাস্তব জীবনের নৈতিকতার প্রশ্নটি অবিরাম আলোচিত হয়ে এক নীতিবোধে পরিণত হয় যা সমাজজীবনে ধরে রাখে। কিন্তু পুঁজিবাদী সমাজে মানুষের একান্নবর্তিতা ক্রমে ভেঙে পড়ে, এবং তার জায়গা নেই প্রচার মাধ্যম। যে পাবলিক স্ফিয়ারে এক একটি আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক ঘটনার পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ হতে হতে একটা নৈতিক অবস্থান তৈরি হতো, সেটা তখন সম্পূর্ণত মিডিয়ার নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। বলা বাহুল্য মিডিয়া ক্যাপিটালিজমের আদর্শ অনুযায়ী জনমত গঠনে বড়ো ভূমিকা নেয়, কোথাও স্বেচ্ছায়, কোথাও বাধ্যত। ভারতের সাম্প্রতিক ইতিহাসে একটি সংবাদ সংস্থার অংশীদারত্ব কেনার জন্য একটি কর্পোরেট সংস্থা যেভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, তা এই বক্তব্যের সত্যতা প্রমাণ করে। তাছাড়া যে সমস্ত মিডিয়া হাউস কর্পোরেটের কাছে মাথা নোয়াতে চায় না, তাদের উপর কর্পোরেট রাষ্ট্রকে দিয়ে যে নিপীড়ন ও হেনস্থা চালায় তার ইতিহাস আমাদের ভোলার নয়। বাকি থাকলো কর্পোরেট বা পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের নিজস্ব বশংবদ মিডিয়া, বর্তমানে ঠিক যে প্রসঙ্গে ভারতে ‘গোদী মিডিয়া’ নামটি বহুল প্রচারিত হয়েছে। মানুষকে সামাজিক ভাবে বিচ্ছিন্ন করার জন্য, এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, নানারকম সোস্যাল মিডিয়া, ইউটিউব, টেলিগ্রাম, টুইটার, ফেসবুক ইত্যাদি। মানুষের সঙ্গে মানুষের সামাজিক বিচ্ছিন্নতা মানুষের নৈতিক জাগরণের বা সংঘবদ্ধতার সম্ভাবনাটি সম্পূর্ণ বিপন্ন করেছে। সামাজিক বিচ্ছিন্নকরণের প্রসঙ্গে আঞ্চলিকতার উৎপাটনের বিষয়টিকেও আলোচনা করা দরকার। একটি নির্দিষ্ট সমাজে ভাষা, জাতি ও সংস্কৃতিগত যে আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য তার শক্তি বহুত্ববাদ ও সমাজতন্ত্রের একটা শক্তিশালী চরিত্র। পুঁজিবাদ ও বিশ্বায়নের হাত ধরে এই আঞ্চলিকতা হুমকির মুখে পড়ে, এবং তার বিকেন্দ্রীকরণের ক্ষমতা ধীরে ধীরে কমে যায়। মানুষ নিজের ভাষা, জাতি ও সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
বিজ্ঞান বিষয়ে আমাদের স্বপ্ন ও বিশ্বাসের সীমাটি অসীম। কিন্তু নোয়া হারারি তাঁর ‘সেপিয়েন্স’ গ্রন্থে আমাদের সাবধান করে বলেছেন, “বিজ্ঞান নামক প্রতিষ্ঠানটি মানুষের চেয়ে বড় কোনো নৈতিক বা আধ্যাত্মিক সত্তার উপর ভর করে গড়ে ওঠেনি। সংস্কৃতির অন্যান্য উপাদানগুলোর মতোই সমাজের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় পরিস্থিতিগুলোই এর প্রকৃতি গড়ে তুলেছে।” তিনি দেখিয়েছেন বিজ্ঞানের সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদের গাঁটছড়ার ফলে কীভাবে প্রযুক্তি বিজ্ঞান পুঁজিবাদের শ্রেষ্ঠ হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। ইউরোপের জ্ঞানদীপ্তির ফসল যে মানবতাবাদ তা যে আধুনিক বিজ্ঞানের হাত ধরে একটি নিষ্ঠুর সাম্রাজ্যবাদের সূচনা করেছে, এবং যে মানবতাবাদে মানুষ বাদ দিয়ে অন্য কোনো প্রাণীর স্থান নেই, তা তিনি আলোচনা করেছেন। ‘ডাইলেকটিক অব এনলাইটমেন্ট’ গ্রন্থে হর্কহাইমার ও অ্যাডোর্নোর অনুসন্ধানের মূল বিষয় ছিল, যথার্থ মানবিক পরিস্থিতির মধ্যে প্রবেশ করার পরেও মানবতা কী কী কারণে এক নতুন ধরনের বর্বরতার মধ্যে ডুবে যাচ্ছে। তাঁরা লক্ষ করেছিলেন, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ও চিন্তাগুলো ক্রমাগত বেশি বেশি করে প্রকরণবাদী, যান্ত্রিক ও বশ্য হয়ে উঠেছে। তাঁরা উপলব্ধি করেছিলেন, জ্ঞানদীপ্তির ধারণা মানুষকে যুক্তির অতীত রহস্যময়তার বোধ থেকে মুক্ত করে, যান্ত্রিক যুক্তির উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল করে তুলতে চেয়েছিল। ফলস্বরূপ তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠার পদ্ধতি বিষয়ক ধারণা, সারবত্তা, গুণ ও আকস্মিকতা বিষয়ক ধারণা উপেক্ষিত হয়, এবং নিজের স্বার্থে কাজে লাগানো যায় না এমন সমস্ত কিছু মূল্যহীন হয়ে পড়ে। বেঞ্জামিন মনে করতেন, সমকালীন সংকটের মূলে রয়েছে কৃৎকৌশলের ওপর ভ্রান্ত নির্ভরতার বিধ্বংসী প্রতিক্রিয়া। উনবিংশ শতাব্দী থেকে বিংশ শতাব্দীর ৩০ দশক কেটে যাওয়ার পরেও মানুষ এ ব্যাপারে সচেতন হয়নি যে কৃৎকৌশলের পণ্য উৎপাদন ছাড়া সমাজকে আর কিছু দেবার নেই। তিনি এও মনে করতেন যে অভিজ্ঞতাবাদ কৃৎকৌশলের মধ্যে বিজ্ঞানের প্রগতিই দেখে, সমাজের অধোগতি দেখে না। ফুকো, দেরিদা বা লিওতার মতো পোস্ট মর্ডানিজমের প্রবক্তারাও ১৮ শতকের ইউরোপীয় এনলাইটমেন্টের বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদের থেকে মানুষকে মুক্ত করতে চেয়েছেন। প্রদীপ বসু তাঁর ‘ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুল ও উত্তর আধুনিকতাবাদ’ প্রবন্ধে উত্তর আধুনিকতাবাদীদের পর্যালোচনাকে ব্যাখ্যা করে লিখেছেন, “এনলাইটেনমেন্টের বৌদ্ধিক আন্দোলনের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো যুক্তিকে সমস্ত সমাজ দর্শনের কেন্দ্রে নিয়ে আসা। যুক্তির মানদন্ডে সবকিছু বিচার করা। যুক্তির রাজদরবারে, যুক্তির কাঠগড়ায় সবকিছুকেই দাঁড়াতে হবে। যুক্তির সর্বগ্রাসী, চরম দাম্ভিক, উদ্ধত প্রভুত্বকে উত্তর আধুনিক তাত্ত্বিকরা তীব্রভাবে আক্রমণ করেছেন। যুক্তি তো সমাজে আগেও ছিল। কিন্তু তার এই সর্বগ্রাসী আধিপত্যের আসন তাকে দিয়েছে আলোকপ্রাপ্তি। ফলে যুক্তির বাইরে যে জীবনের বহু কিছু রয়ে যায়, সেগুলি হয় চরম উপেক্ষিত, অবদমিত। স্বপ্ন, আবেগ, অনুভূতি, যৌনতা, মনস্তত্ত্ব, হৃদয়বৃত্তি, বিশ্বাস, সংস্কৃতি, ক্ষমতা ইত্যাদিকে ঠেলে দেওয়া হয় প্রান্তে।…. এই যুক্তিবাদের প্রকৃতি বিজ্ঞান ধর্মী প্রযুক্তি সর্বস্ব। …এ হলো আধুনিক ব্যক্তি মানুষের ভোগলালসাকে তৃপ্ত করার উপকরণ বা উপায় স্বরূপ।” পুঁজিবাদ প্রযুক্তি বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে মানুষকে ভোগবাসনার দিকে ঠেলে দিয়েছে, এবং এই ভোগবাসনাই যে জীবনের সারসত্য মানুষকে এই বোধ দিয়েছে জ্ঞানদীপ্তি বা বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদ। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতাকেই একমাত্র সত্য বলে বিশ্বাস করা এই যুক্তি ক্রমে যুক্তির অতীত সমস্ত কিছুকে নস্যাৎ করে একটি মৌলবাদী চিন্তায় পরিণত হচ্ছে। যার ফলে মানুষের নৈতিক সত্যের চরম সংকটের মুখে পড়েছে। পুঁজিবাদ বা ফ্যাসিবাদ টিকে থাকার জন্য যে ‘প্রফিটেবল মানুষ’ জরুরি, এই যান্ত্রিক যুক্তি তেমন মানুষের জোগানদাতা। প্রফিটেবল বলতে যার দ্বারা পুঁজি নিজের উদ্বৃত্ত বাড়াতে পারে। কে বাড়ায় মালিকের উদ্বৃত্ত ? যার নিজের ভোগবাসনা প্রবল, এবং যা পূরণের জন্য যে মালিকের উৎপাদন ব্যবস্থায় কলুর বলদের মতো খেটে যেতে বদ্ধপরিকর। রবীন্দ্রনাথের ‘কর্তার ভূত’ এর ভূতগ্রস্থ মানুষের অদৃষ্টের চালে চলার বুদ্ধি থেকে আজকের যান্ত্রিক যুক্তিতে চলা মানুষের মধ্যে মৌলিক ফারাক কিছু নেই, ফারাক কেবল বাইরের মোড়কে। প্রথমজনের কাছে কোনো যুক্তি নেই এটাই যুক্তি, দ্বিতীয়জনের কাছে যুক্তির অতিরিক্ততাই তার যুক্তিহীনতা। দুজনের তাই মুক্তি নেই। এরা কোনো কালে ভক্তি বা ধর্মের অতিরিক্ততাকে জীবনের কেন্দ্রে রেখে শোষিত হয়, কোনোকালে বিজ্ঞান বা যুক্তির অতিরিক্ততাকে জীবনের কেন্দ্রে রেখে শাসিত হয়।
তাহলে ‘শিক্ষা আনে চেতনা, চেতনা আনে বিপ্লব, বিপ্লব আনে মুক্তি’ এই ঘোষণার কী হবে ? ক্রমশ পরিস্থিতি এত জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে যে খুব একটা আশা কি দেখা বা দেখিনো যায় ? মার্ক্স কথিত সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার পূর্ণ বিকাশ (যা সমাজ বিবর্তনের শেষ ধাপ) সারা বিশ্বেই ক্রমাগত হুমকির মুখে পড়ছে। একনায়কতান্ত্রিক, পুঁজিবাদী, ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থার স্বর্গরাজ্যে পরিণত হচ্ছে মানুষের পৃথিবী। সাধারণ মানুষ থেকে শিল্পী, চিন্তক, গবেষক, রাজনীতিবিদ সবার মধ্যে যেন একটা অদ্ভুত সাধারণীকরণ ঘটে যাচ্ছে। সুভাষ মুখোপাধ্যায় এর ‘মিছিলের মুখ’টা কোথায় ? কোথায় তলস্তয়ের সেই শিশুটি ? না, এক দুজন মানুষ এই পৃথিবীকে বদলাতে পারবে না, তবু একটা প্রদীপ থেকে হাজার প্রদীপ জ্বলে ওঠার সম্ভাবনা তো তৈরি হয়। ফরাসি বিপ্লবের পেছনে হোক, কি সোভিয়েত বিপ্লবের পেছনে কয়েকটি জ্বলন্ত ফসফরাসের মুখ তো ছিল ! আমরা কি তাঁদের হারিয়ে ফেলেছি ? হেগেল বলছেন, ইতিহাস থেকে আমরা কিছু শিখি না। মার্ক্সের ঐতিহাসিক বস্তুবাদের ত্রুটিও ক্রিটিক্যাল থিওরির গবেষকরা দেখিয়েছেন। সোজা কথায়, হিস্ট্রি ডাজ নট রিপিট এগেইন। ভবিষ্যত বড়ো আকস্মিক ও অপ্রত্যাশিত, তাকে ইতিহাস দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। আমরা কেউই বলতে পারবো না, ভবিষ্যতে সমাজ পরিবর্তন কোন দিকে মোড় নেবে। মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিকদের মতো আরো অনেকেই ‘বিপ্লব’ বা আমুল পরিবর্তনের নতুন উপায় খোঁজ করে চলেছেন। আবার মার্ক্স যেমন ভাবতেন, এখনও মানুষের চূড়ান্ত বিকাশ ঘটেনি (যা ঘটলে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠা ত্বরাণ্বিত হয়), ঋষি অরবিন্দ তাঁর অতিমানসের যে কল্পনা ( মানুষের কনসেপ্ট ব্যর্থ হয়েছে বলে) করেছিলেন, তাও এখনও রূপায়িত হয়নি। আবার প্রযুক্তি বিজ্ঞান আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের যে সম্ভাবনা দেখাচ্ছে, তাতে কি মার্ক্সের পূর্ণ মানব, অরবিন্দের অতিমানস এর কল্পনাকে ভুল প্রমাণিত করে, মানুষের বিকল্প হিসেবে ভবিষ্যতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মানবের হাতে পৃথিবীর ব্যাটন চলে যাবে ? কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নিজের জীবন অভিজ্ঞতার আকস্মিকতা নেই বলে, সৃজনশীল কাজে তার চূড়ান্ত সাফল্য নিয়ে এখনও পর্যন্ত ধোঁয়াশা আছেই। কিন্তু অন্যান্য অর্থনৈতিক উৎপাদন ক্ষেত্র থেকে শুরু করে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক জীবনকে সে কতটা বদলে দেবে কে বলতে পারে ? এ কি ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের বাস্তব রূপ হতে যাচ্ছে, নাকি মানুষের সহায়ক ? যদি কোনোদিন সে কল্পনাও করতে পারে ? নোয়া হারারি দেখিয়েছেন, পৃথিবীতে অন্যান্য প্রাণিকে হারিয়ে মানুষের ‘শ্রেষ্ঠ’ হয়ে ওঠার মূল কারণ ছিল তার কল্পিত বাস্তবের ধারণা। যে বাস্তবতা দিয়ে একটি মানুষ তার চেয়ে লক্ষ মাইল দূরের একটি মানুষের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে পারে। যদি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সেই কল্পিত বাস্তবের বোধ তৈরি করা সম্ভব হয়, আর তা যদি হয় মানুষের চেয়ে আরও শক্তিশালী ? ভবিষ্যত সম্পর্কে আমরা কেবল জিজ্ঞাসা ও কৌতূহল দেখাতে পারি, উত্তর জানতে অপেক্ষা ছাড়া উপায় নেই।
_____________________________
তথ্যসূত্র :
সেপিয়েন্স : নোয়া হারারি
ঐতিহাসিক বস্তুবাদ : কার্ল মার্কস
ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুল ও উত্তর আধুনিকতাবাদ : প্রদীপ বসু
ম্যাক্স হর্কহাইমার : প্রশাসক ও গবেষক : সত্যজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুল : ইতিহাস ও দর্শন : শৈল ঘোষ