
যারা এসেছিল যারা এসেছিল ,একে একে চলেও গেল। এখনো তাদের জয়যাত্রার বিউগল বাজছে। রয়ে গেল অজানার অন্ধকার, বহুকালের কালো হ্রদের তমিশ্রা। আসর ভাঙলে যে যার গন্তব্যে যেতে চায়। একলা চল রে! একলা কোথায় যাব তা তো কেউ বলে দিচ্ছে না! তবু সুন্দর আজ সমুদ্র তেজস্ক্রিয়, আকাশ ক্ষমাহীন তবু সুন্দর এক প্রবালদ্বীপের মত আমার কবিতা থেকে যাবে, যে কোন খয়রাতি চায়নি, কারো কাছে কৃপাভিক্ষা করেনি কেবল আনন্দে নিজেকে নিজে সৃজন করেছে। আমি চাই,আমি হই ঠিক আমার কবিতাটির মত। আলো আমার দিনলিপি অস্পষ্টতায় ভরে উঠছে । ওই জানলা দিয়ে আসা বিদায়ী আলো অনেককিছু বলতে চায়, কিন্তু আমি আর কিছু শুনতে পাইনা। দেখিওনা কিছু। হে ক্ষীণ আলোকরশ্মি,আমি একটা জীবন চাই একদম আমার কবিতার মত, হয়ত ভঙ্গুর,ভীষন ভঙ্গুর তবু পরিণামে শৌর্যে উজ্বল। শীতের বিকেল শীতের বিকেল বড় তাড়াতাড়ি চলে যায়, যেন কোথাও যাবার তাড়া আছে। কৌতূহলী বালকের মত আকাশের রংগুলি পরীক্ষা করি। গেরুয়া,লাল কখনো মেঘের বেগুনিভাব শেষে কালো হয়ে আসে বিষাদের রেশটুকু রয়ে যায় আমার জন্য। আকাশের যবনিকা অলক্ষে নামিয়ে দিয়ে ফিরে আসি আমি। বাতাস হু হু এক বাতাস, আমাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। কোথাও থাকার জায়গা পাচ্ছিনা । দুটো অ্যাম্বুলেন্স চলে গেল, একটা শোভাযাত্রা। বৃষ্টি এলে আমাকে একাই ভিজে চুপসে যেতে হবে। আরেকবার কানে কানে নিষ্ঠুর হেসে, হু হু বাতাস দিগন্তের দিকে চলে গেল। গুড়ের গন্ধের মত গুড়ের গন্ধের মত এই রোদ স্নান করিয়ে দিচ্ছে উজ্জ্বল হলুদ পাতাবাহারে এসে বসছে দিনের পোকারা এই দৃশ্য দেখে আর কোথাও উঠে যেতে ইচ্ছা হয় না অনন্তের দিনলিপি একটু একটু করে লেখা হয় আর তুমি কাব্য পড়ে শোনাও আমাকে। কথা ছিল যে জীবনের মত নিষ্ঠুর হবে কিন্তু কোথা থেকে ভেসে আসে আবছায়া গান বুনো ঝোপে, টবে বসন্তের ফুল এসে জোটে অবারিত এক আকাশ ঝালর টাঙিয়ে দেয় প্রতিবেশী ছাদে ছেলেপুলেরা মেতে ওঠে নির্মমতা থেমে যায় একটা শীর্ণ হাত পিঠে এসে পড়ে বলে লেখ্ কিন্তু কই! কাউকে দেখা গেল না। বিড়াল ফ্ল্যাট হতে হতে আচমকা যে জায়গাটা এখনও ফাঁকা সেখানে এক আস্ত আস্তাকুঁড় আর আজগুবি বাগান। বুনো ঘাস, কচু এমনকি আস্ত একটা কলাঝাড় গজিয়ে উঠেছে। মরুব্বি এক বিড়ালের ঘর সেখানে। প্লাষ্টিকের জলট্যাঙ্কের ঘাড়ে বিকালের নিঃসঙ্গ বিড়াল বসে আছে। পিছনে এক পোড়ো নীলের পটভূমি। রিক্সার টুংটাং, ট্যাক্সির হর্ন আর মানুষের রোজনামচার মাঝে কান স্থির রাখে, কখন যে খচমচিয়ে ওঠে সেই অনন্য শিকার। নীলের পটভূমি মুছে আসে স্ট্রিট বাল্ব জ্বলে, মানুষের বিড়ালীকে ফুসলায়, তীব্র পরুষগন্ধে ডাকে। কান, চোখ, লুকানো থাবার সেই নীচু কবোষ্ণ পৃথিবীতে দীপ্ত সবুজ চোখ জ্বলে ওঠে রাতে। কালচে চাঁদের টুটি ধরে এনে লুকায় আবার গেরস্থের আঁতিপাঁতি, দুধকাঁটার প্রেম ছিঁড়ে একলা পাঁচিল দিয়ে হাঁটে, কিছুতেই পোষ মানবে না। মেলা কেনাকাটার সময় মেয়েদের মুখ আরও নিষ্ঠুর ও উজ্জ্বল দেখায়। এখানে কৃত্রিম আলোয় তাদের মুখের ঘাম ঝলমল করছে। যতই গভীরে যাই দেখি ছোট ছোট চিনা টয়, মুখোশ, নাগরদোলার ভিড়। এক নকল জ্যোৎস্না সব মনোযোগ শুষে নিচ্ছে, হিন্দি ছবির অপ্সরার মতো। তবু এই নকলই কি আসলের মর্মদেশ নয়? শহরের প্রেত আমি মেলায় এসেছি স্রেফ হারিয়ে যাব বলে কিন্তু দেখছি এখন অচেনা মানুষের খোল ছেড়ে বেরিয়ে আসছে তীব্র স্ফূর্তি, আর জীবন দপ্দপ্ করছে। আমি জুয়া খেলিনা, ওই সস্তার গয়না কিনব না, মুখোশ, বেলুনে বীতরাগ তবু হারিয়ে যেতে যেতে এই অন্য আমির সোয়াদ নিচ্ছি। মেলা কাউকে ফেরায় না। ভিনগ্রহের লোক এখানে আমি কেউ নই, তবু আমার প্রেত এই পাড়া ছেড়ে বেরোতে পারেনা এখানে পানের দোকানে আমি উঁকি দিই, এটা ওটা কিনি। গরম হাতরুটির উত্তাপ আমি এখনও কবিতায় আনতে পারিনি। এই রাত্রি-উপনিবেশে নিভু তারাদের শেষ বার্তা এসে পৌঁছতে চেষ্টা করে, তাও লক্ষ্য করেছি। তবু অলক্ষ্যে মিশে গেছি গুঞ্জনে, ভিড়ে। বাদামি কুকুর হয়ে বিস্কুটের প্রতীক্ষা করেছি। হনুমান মন্দিরে ঢোল নিয়ে গান হয়, জুতো সেলাই করে আটা মাখে মুচি। তার হাতের ময়লা হয়ে, মায়া হয়ে বেঁচে আছি আজও, এক রহস্যকে বহুবর্ণ রঙে তালাশ করেছি একা পাড়া ঘুরে ঘুরে পৃথিবীর খুব কাছে, তবু পৃথিবীর সে নয়, কিছু সুদূরের ছিল তার ভালবাসা। যমগুরু আমি লেখা শেষ করছি কিন্তু সময়ের কাব্য আদৌ থেমে থাকছে না ভালো লেখা বিরলই ছিল, বিরলই থাকবে। কিন্তু মাঝে মাঝে ছোটপত্রিকার এক একটা লেখায় চোখ আটকে যায়, অদ্ভুত সুবাস রাস্তা-পাশের স্টোভে যেন রুটি ফুলে উঠছে শীত ভেদ করে আমি থামছি আর বেঁটে মোটা পেন দিয়ে খসখস করে লিখে যাচ্ছে কাল।

ইমন ভট্টাচার্য
জন্ম- ১৪ মার্চ, ১৯৮৩। শূন্য দশকের কবি, কবিতার বই- অন্তর্জলি (২০০৮), জীবাশ্মের ভাষা (২০১৪), জীবনখণ্ড (২০২২); প্রবন্ধের বই- কয়েকটি প্রবন্ধ (২০১৪)। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা বিভাগে গবেষণা শেষে কলকাতার একটি কলেজে অতিথি- অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত।
Facebook Comments Box