
এখানেও একুশ আসে, ভাষা স্মরণের সভা বসে, প্রাণের রণনে দোলা দিয়ে গাওয়া হয়,‘একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলতে পারি?’
বিশুর স্মৃতিরা এখন আর পূর্ববাংলাকে নিয়ে ভাবতে চায় না। তবুও ভাবনারা জড়ো হয়! ভয়ংকর স্মৃতিরা একদিন সব কিছু জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছে। কেমন ছিলো ওসব দিন? সুখের ছিলো, দুখেরও ছিলো।
কেমন আছে, এখনকার দিনগুলো? খু্ব কি মনে রাখার মতো। বিশু নিজের মাঝে চুপটি করে থাকে, লজ্জ্বায় মাথা নুয়ে আসে। এপার বাংলা-ওপার বাংলা কোত্থাও সুখের ঠিকানা মেলেনি। কেন মেলেনি? বিশুর কান্না আসে! ওর মতো যুবকের চোখে কান্না কতটা বেমানান তা সে জানে, তবু কাঁদতে ইচ্ছে করে। কেঁদে হাঁফ ছেড়ে বাঁচতে ইচ্ছে করে।
দূরের কাশবন যতটা ঘন মনে হয়, বাস্তবতা ততটা মধুর নয়, নিয়তি ও নির্মমতা বুকে পুষে রাখা আকাঙ্ক্ষা মেনে চলে না। এমনই রূঢ় পৃথিবী। অথচ, বাবার দেশত্যাগের ইচ্ছেকে সে এড়িয়ে যেতে পারেনি। ওসব পুরনো দাঙ্গার স্মৃতি বিশু শুনতে শুনতে ক্লান্ত। কবে কত সনে পুজোতে হামলা হয়েছে, প্রতিমা ভাঙচুর, দোলের মেলায় ডাকাতি হয়েছে এইসব। শুনতে না চাইলেও বাবা বলতেই থাকত।
অথচ বিশুকে কষ্ট দিতো স্কুলের বন্ধুরা। ওর মুখে ‘জল’ শব্দটা শুনতে ওরা ভীষণ নারাজ ছিলো। হাসি তামাশার জোয়ার জাগত। তখন ওর কাছে নিজেকে ভীষণ অসহায় প্রাণি বোধ হতো।
একবার ক্লাসে কয়েকদিন অনুপস্থিত ছিলো বিশু। মোড়ল স্যার কানে ধরিয়ে বেঞ্চের উপর দাঁড় করিয়ে রাখে। এক সময় জানতে চায়, কেন স্কুল কামাই করলিরে বিশু?
বিশু বলেছিল, মাসির বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিলাম।
-ও আচ্ছা মাসির বাড়ি!
-জ্বি স্যার। মেষো মশায় মারা গিয়েছেন, শ্রাদ্ধ ছিলো।
-ঠিক আছে, শাস্তি তো হলো, এবার বেঞ্চ থেকে নেমে আয়।
স্যার ক্লাস থেকে চলে যাবার পর, অনেকের মুখে বিশ্রী হাসি দেখা যায়। ওরা বলতে থাকে, মাসি কী রে? শ্রাদ্ধ ওটা কী জিনিস?
বিশু চুপচাপ থাকত। ওদের কোনো কথার উত্তর জানা ছিলো না তখন।
গাঁয়ের এই বালক বিদ্যালয়ে ক্লাস ফোরে একমাত্র হিন্দু ছাত্র সে। ওর জন্য আলাদা শিক্ষক বরাদ্দ করেনি স্কুল কর্তৃপক্ষ। বরং যিনি ইসলাম শিক্ষা ক্লাস নিতো সেই স্যারই হিন্দু ধর্ম শিক্ষা পড়াতেন। সেই স্যারের নাম সুফি মৌলবি মুহম্মদ চেরাগ শাহ। দুধ সাদা রঙের পাঞ্জাবি পরতেন, ধবধবে চুল-দাড়ি, এখনো স্যারকে ভুলতে পারেনি বিশু।
তিনি একদিন ক্লাসে জগ্ধাত্রী দেবীর পুজোর মন্ত্র জিজ্ঞেস করেন। বিশু সংস্কৃত মন্ত্র মুখস্থ বলতে থাকে, হঠাৎ ক্লাসে কয়েকটা দুষ্ট ছেলেরা হেসে ফেলে। সেদিন স্যার ভীষণ চটে যান, ক্লাসের সব ছেলেকে বেত্রাঘাত করেন। এতে ঘটনাটা এমন ঘটে, অনেকে বলতে থাকে একজনের দরুন সবাইকে মার খেতে হলো। এর জন্য দায়ী একমাত্র বিশু। ওর মন্ত্র পাঠের ধরন দায়ী। এসবের মুখোমুখি হওয়া বালক মন তখন ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে থাকত ক্লাসে। সহপাঠীদের যম মনে হত, ভয়ে ভেতরটা কাঁপতে থাকত। এমন অসহায়ত্ব জগতে যেন বিরল!
একবার স্কুল মাঠে ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন করা হয়, সেখানে বক্তা হিন্দু ধর্মের অবতার শ্রী কৃষ্ণকে নিয়ে অনেক বিষোদগার করে। পরদিন ক্লাসে সেই বিষোদগারের প্রভাব আছড়ে পড়ে বিশুর উপর। বিশুর নামকে অপদস্ত করা হয়ে উঠে সবার আনন্দ উৎসব। বিশুর পুরোনাম শ্রী বিশ্বজিৎ পাল। ওর নামের শুরুতে থাকা শ্রী শব্দটা নিয়ে অনেকে ভেংচি কাটে, সেই মানসিক যন্ত্রণা এখনো বিশুর মনে পড়ে। সেই দুঃসহ দিনে তার চোখে পানি নেমে এসেছিল, ভীষণ রকম কেঁদেছিল। ওকে কাছে টেনে নিয়েছিল সুফি মৌলবি স্যার। সবাইকে ক্লাসে ডেকে বুঝানোর চেষ্টা করেন শ্রী শব্দের অর্থ সৌন্দর্য বাচক। তিনি সবার উদ্দেশ্যে বলেন, এই শ্রী শব্দটি সনাতন ধর্মের কিছু না, এই দেশের এই উপমহাদেশের সবার নামেই শ্রী ব্যবহার হইতো। তোরা তোদের পূর্ব পুরুষদের নাম খুঁজে দেখিস, তবেই বুঝবি। শোন, আমার মায়ের নাম শ্রীমতি মেহেরুন্নেসা, আর পিতার নাম হইল শ্রীযুক্ত ইদ্রিস মৌলবি। শ্রী হিন্দু মুসলমান সবার নামেই ছিলো। পরে, মানুষে মানুষে ষড়যন্ত্রকারীরা মুসলমানদের নাম পরিবর্তন করে। উদ্দেশ্য ফ্যাসাদ তৈরি করা। তাই তোমরা এসব নিয়ে কোনো সময় কাউকে কটু কথা বলবা না। সবাই সুফি মওলানা রুমির মতো মানুষ হইবা।’
শৈশবের এইসব দিনেও একুশে ফেব্রুয়ারি আসত। হাত ভরে ফুল নিয়ে যেত সে শহীদ মিনারে। মন ভরে শিক্ষকদের আলোচনা শুনত, তারপর কোরআন পাঠ, মোনাজাত হতো।
সুফি স্যার বলত, জগতের সকল ভাষা দিয়েছেন আল্লাহ, সকল জাতির কাছে নিজ নিজ ভাষায় নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন। তাই সকল ভাষাকে শ্রদ্ধা করতে হবে।
অন্যদিকে শীতকাল এলে গাঁয়ে গঞ্জে ওয়াজ মাহফিলের হিড়িক পড়ত। সেখানে মোটা অঙ্কের টাকা খরচ করে বক্তা আনা হতো। তারা ধর্মের কাহিনী শোনাতো যেমন, তেমনি বিধর্মীদের নিয়ে বিদ্রুপ, ঠাট্টা করতে ছাড় দিতো না, আবার হিন্দুয়ানি শব্দের বিরুদ্ধে ঘৃণা দেখাতো, স্কুল-কলেজের বইতে দেয়া হিন্দুদের লেখা গল্প-কবিতা বাদ দেবার দাবি জানাতো। এদেশে পশ্চিমবঙ্গের সিনেমা আমদানি, টিভি চ্যানেল বন্ধ করার দাবি তুলতো।
ওসব মনে মনে ভেবে বিশু নিশ্বাস ফেলে। পূর্ববাংলার ঐ সব সহপাঠীরা ওর কথা বলা, কিছু শব্দকে হিন্দুয়ানি তকমা দিয়ে ঘৃণা করত, চরম শত্রু বোধ করত। তাই তো সব ছেড়ে একদিন বিশুরা পশ্চিমবঙ্গে চলে এলো।
এখানে সে স্কুলে ভর্তি পরম আশা নিয়ে। পুরনো স্মৃতিদের বিদায় জানানোর ইচ্ছায়। অথচ, সে আশায় গুঁড়ে বালি। ওর পূর্ববঙ্গীয় কথা বলাকে সহপাঠীরা আঁড়চোখে দেখত। খেলার মাঠে ‘বাঙ্গাল’ বলে গালি শুনতে হতো।
শৈশব থেকে বেড়ে উঠতে উঠতে শোনা শব্দগুচ্ছগুলো যেন ওর পথের কাঁটা হতে থাকে। আসমান-জমিন, জেওর, মজবা, জলসা, ইদ, রোজা থেকে শুরু করে কতশত শব্দ রয়েছে, সেগুলো অনেকে শুনলে চোখের ধরন পাল্টে যায়। বলেই ফেলে, মুসলমানি শব্দের আমদানি করতে এসছিস?
একটা সময় সে স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজ, অতঃপর ভার্সিটিতে ভর্তি হয়। এতদূর এসেও ওর জীবনের বিপত্তী কাটেনি। কারণ, পশ্চিমবাংলাতেও তো একুশে ফেব্রুয়ারি আসে, আয়োজন হয় আলোচনা সভার। হিন্দুত্ববাদি নেতার বক্তৃতায় কেঁপে উঠে ময়দান। বলতে থাকে, আমাদের বাংলা ভাষাকে রক্ষা করতে হবে। বাংলা ভাষার উপর আরবি-ফারসি শব্দের আধিপত্য দূর করতে হবে, মুসলমানি শব্দকে চিরতরে দূর করতে হবে, বাংলাদেশি বাংলা ভাষার প্রভাব দূর করতে হবে।
এসব শুনতে শুনতে বিশু আর নিশ্বাস নিতে পারে না।
চারপাশটাকে ভীষণ একা বোধ হয়।