সে এক উৎসব ছিল আমাদের। কার কোন উৎসবে কোন পশুর ছটফট, কোন আদিমন্ত্রের তীব্র শেষ উচ্চারণ – সেসব বোঝার বয়স কোথায়! আমাদের তখন চোখ, মুখ চিনে রাখার বয়স। একটা ঘরে কজন এখন? নয় আট সাত। গুনতে গুনতে সংখ্যাটা কমত ক্রমশ, কখনও কোনও সদস্য মরে গেলে আসর-আয়োজনে বেড়ে যেত হুহু করে। ওইসময়টা, বহুদিন পর্যন্ত, পুজোয় বৃষ্টি হত না। বৃষ্টি বয়সের দ্যোতক, মেঘ একটা ট্রানজিশন – আমরা ততদিন, জলবায়ু-সীমান্তের ওদিকে ছিলাম, ঝকঝকে রোদ, ছুটি, টেলিভিশন। ঘর অন্ধকার হলে চোখ ছোট ছোট করেও কটা মুখ দেখা যায়? কাকাদের না পাওয়া চাকরির অন্ধকার, পিতামহের বয়সের অন্ধকার, বাবার টানাটানির অন্ধকার, একটা টিমটিমে হলুদ আলোর ঘর, একটা গমক ঘরের ভাঙন, ভয়ের অন্ধকার – সেইসব ভয়ের ভেতর শুধুই উৎসব আর উৎসব। উৎসব ব্যক্তিগত হলে তার ভেতর জোর থাকে এতো। আমরা পুজোর চেয়ে বিবাহকে উৎসব ভাবতাম বেশি। ওই যে উঠোনের মাঝে তিরপল খাটানো হয়, ওই তিরপলের নিচের হালকা হলুদ আলো, তার ভেতর উৎসবের বিবর্তন। ওই হলুদ আলোর ক্রম – সে ক্রম ক্রমশ কমছে, কমছে, কমছে। তবু তো ছিল, তার ভেতর আমাদের বড়রা, আর তখনও ডেথ প্যানেলে গা জড়াজড়ি করে না এগোনো বরিষ্ঠ নাগরিক – সবাই ছিল, সবাই। একেবারে ছোটদের অতিরিক্ত কথায় আমরা বিরক্ত হতাম, বড়দের অকারণ মেজাজ হারানোয় আমাদের সমধিক রাগ হতো– কারণ আমরা দুটো দিক ব্যালেন্স করছি। আমরা দুদিকে দুঃখের ভারে নিমজ্জিত, সুখের ভার নেই, তা যারা পায়, যেটুকু পায়, অসম লভ্যাংশে একে ওকে দিয়ে শেষমেশ আর আমাদের ভাগ্যে কোথায়! আমরা তখন তিরপলটাকে সোজা করি। পড়ে যাচ্ছে না জেনেও করি। কারণ আমাদের অপশন নেই। আমরা অপশনগুলো সিলেবাসের বাইরের প্রশ্ন দেখে লিখতে চাইনি। ভেবেছি স্যার নম্বর দিয়ে দেবে। আর তাছাড়া, লিখলেও ভুল করতাম। লুস সিট নিতে নিতে ওই সময়টা আমাদের পিতামহেরা এক একটা মাস্টারস্ট্রোক রপ্ত করত, ঠিক করত কোথায় কতদূরে হোঁচট খেয়ে পড়লে ব্লাডজেট দীর্ঘতর হবে। আমরা রক্তচিন্তার আশঙ্কায় আর বেশিদূর এগোইনি। ইচ্ছে থাকলেও বলতে পারিনি, ‘তেরে খুন কি ধারা সে মসিহ, মুঝে জিন্দেগি মিলি …’
দুর্গার মুখ দেখিনি। ছুটকিদিকে দেখতাম। ছুটকিদির চুল। সেই থেকে দীর্ঘ চুলে লোভ। না, প্রতিমার চুলে না। ঠাকুর বেশিক্ষণ থাকে না, থাকলেও, যারা খুব বিশ্বাস করে, তাদের ঘরে আপ্যায়ন পায়। আমি কী জানি কী করি, পুরোপুরি অনিশ্চিত কি? নাহলে ছুটকিদির পায়ের কাছে রাখা লাল তরল আভায় কেন দেবীচিন্তা করেছিলাম, কেন জড়িয়ে ধরে বলিনি, বলো, আমায় বলো, গভীর দুপুরে বই না পড়ে, না ঘুমিয়ে, কাঁদছ কেন? হুহু কাঁদছ কেন? আমার দুর্গার ভাসান হয়ে গেছিল। ছুটকিদি মোটা হয়ে যাচ্ছিল। দেখা করলে শেষের দিকে একটা অদৃশ্য, বিশ্রী হাতে চুলে বিলি কেটে দিত। আমি বিরক্ত হয়ে চুল ঠিক করে দিতাম পরে। ঘরে ঢুকে আঁচড়ে দিতাম। দুর্গা বড় হতে হতে মঞ্চের উচ্চতা ছাড়াল, টাউনশিপ ছাড়াল, দেখা করল না যাওয়ার সময়। ‘জিসম মুঝে দে কে মিট্টি কা, সিসে সা দিল কিউ বানায়া’। আমার ঈশ্বরী আমার সঙ্গে দেখা করে যায়নি। আমার ঈশ্বরীকে প্রশ্ন করা হয়নি কিছুই। মাটির শরীর, কাচের বুক – পরেরবারের পুজোর থিমের মতো – অব্যক্ত, অব্যক্ত। আমরা টাউনশিপ পাল্টেছি। ছোট টাউনশিপে পুজোয় অন্ধকার বেশি হতো। বেড়ালগুলো আওয়াজে ভয় পেত। দুটো প্যান্ডেলের ভেতরের রাস্তায় স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি অন্ধকার। বয়স বাড়ায় মাঝে মাঝেই বৃষ্টির কোপ। সেই অন্ধকার ভিজে ভিজে পড়ত আমাদের রেনকোটে। তারপর থেকেই রেনকোট পরা বন্ধ করলাম। যা কিছু নামত, চুল দিয়ে, ছাতা দিয়ে নামত। শুকিয়ে যেত। জ্বর বাঁধাতাম। পুজোয় জ্বর হলে বন্ধুবৃত্তহীন আমাদের যায় আসত না কিছুই। আমাদের একা ঘরে স্বমেহন, ঈশ্বরী, উত্তাপ – একটা খসখসে ক্যালেন্ডার হয়ে, হিন্দি ছবির চিঠি হয়ে প্রিয় মানুষীর ফর্সা মুখ হয়ে, রিডিং পড়ছে গো, রিডিং পড়ছে – ‘তেরা চ্যাহেরা নজর আয়ে …’
আমাদের কালো মেয়েদের সঙ্গে যে প্রেম হতো না তা নয়। বরং কালো মেয়েদের আমরা এড়িয়ে চলতাম। ওরা একটু বেশিই ভেতরটা দেখে ফেলত। আমরা ঈষৎ শ্যামলা দেখলে ভয় পেতাম। খুব বাজি ফাটাতে গিয়ে হাতের চামড়া পুড়ে গিয়ে আর দেখা যাচ্ছে না। আমাদের রোয়াকে চকলেট বোমের দাপটে এত বড় একটা গর্ত হয়ে আছে। মূর্তির বীভৎসতাকে ভয় পাই বলে, বেশি রাতে উৎসবের প্রলাপ চলে আসে বলে প্রতিমার সামনে যাওয়া বারণ, আমরা বাইরে বাইরে ঘুরি। আমাদের শুধু এটুকু বলা হয়েছিল, দেবীর রং কালো। একটা সাপবাজি বাড়তে বাড়তে অনেক দূর। সামনে ঝুঁকে গন্ধ নিই। কালো টাউনশিপের গন্ধ। সামনে হাত আনি, বলি দাঁত বসা, দাঁত। সে সাপ গুঁড়ো-গুঁড়ো হয়ে পড়ে যায়। অনন্ত আশিকিয়ানা, অনন্ত ভবিষ্যৎ, ‘ও দুশমন জামানা’, ধূলিসাৎ। আমরা আমাদের নিজস্ব অনু আগরওয়ালদের সঙ্গে ফ্যান্টাসি আশ্লেষে মত্ত রইলাম দিনভর। একটা পার্টির রাতে আমাদের হাত চেপে, ঠোঁটে ঠোঁট চেপে, দাঁত বসিয়ে, জিভ বসিয়ে কে যেন বলল, চলো, এখনও সময় আছে। আমরা দেখতে পেলাম, একটা অস্ত্র, একটা কোদাল আমাদের পায়ের কাছে। আমরা তুললাম, ওপরে তুললাম, মারলাম পায়ে, পা আধখানা হয়ে বেরিয়ে গেল, পাশ থেকে চলে যাওয়া ট্রাক থেকে কোনও একটা ‘মাই কি, জয়’ কোরাসে আমরা গলা মেলালাম, জানলামও না কোন দেবীর আরাধনায় কোন প্রসাদ দিয়েছি আমরা। তারপর থেকে অদৃশ্য দেহাংশের শোকে, একটা মরচে ধরা ক্রাচ নিয়ে বসে রইলাম জীবনভর। ‘সাঁসো কি জরুরত হ্যায় জায়সে’, তেমন প্রয়োজন, তেমন শ্বাসের প্রয়োজন আর কোনও উৎসবের কাছ থেকে আমরা পাওয়া বন্ধ করে দিলাম, একদিন …
তবু কিন্তু উৎসব থামল না। আমাদের বনেদিয়ানা উঠে গেছে অনেকদিন। নিজস্ব চারদেওয়ালে সাপের মতো ফোঁসফোঁস, অথচ লড়াইয়ের ইতিউতি সম্মানবোধ। আমরা হোর্ডিং-এ আর শহর চিনতে পারি না। কারণ শহর তো আমার নয়। আমাদের সাইকেল নেই, রোয়াক নেই, গাছ নেই, এ গলিতে গেলে ও গলি দিয়ে ফিরে আসার নিশ্চয়তা নেই – এ শহরে আমি জন্মাইনি, এ শহর আমার নয়। আমার সময়ে প্রথমা থেকে পঞ্চমী অবধি টেলিভিশন – ভাসানের দিন কী অদ্ভুত ঝিরঝির – গোটা টাউনশিপে বিসর্জনের জন্য কেবল টিভি অফ, আমাদের আশাহনন, আমাদের খুটখুট চ্যানেল শিফট, আমাদের বয়ঃসন্ধি ক্রমশ পাহাড়ের রাস্তায় খোঁড়াতে খোঁড়াতে একটা ম্যাজিক রিয়েলিজমে মাধুরী, টুইঙ্কল, রবীনা, ময়ূরী কঙ্গো হয়ে বড় হচ্ছে – আমাদের ঘুমোতে দিচ্ছে না – ‘হর পল মুঝকো তড়পাতা হ্যায়, মুঝে সারি রাত জাগাতা হ্যায়’ – একটা খাদের ধারে ভেনেশীয় জানলার শিকে পুজোর লাইটিং, রাত, ক্ল্যান্ডেস্টাইন আলো, রাত্রির আঙিনা, খোলা জানলা, ‘একবার, একবার যদি সে দাঁড়ায়’। আমাদের জগজিৎ সিং মরে যায়, আমাদের শানুদার গলা ভেঙে যায়, শ্রাবণের আগে নাদিম বসাতে গেলে বুঝতে পারি বৃষ্টি অনেকদূর নিয়ে গেছে, এই শ্রাবণে ধুয়ে যাবে না, মিলবে না কিছুই, ললিতের সঙ্গে যতীন মিলবে না, আনন্দের সঙ্গে মিলিন্দ মিলবে না, সুমনের সঙ্গে নচি মিলবে না। আমরা বুঝতে পারবো, উৎসব শেষ হয়ে আসছে, শেষ হয়ে আসছে দ্রুত। একটা ক্যাপ ফাটাতে ফাটাতে, দাঁতের ভেতর তামাটে গোল তাপ্পিটা জোরসে চেবাতে চেবাতে আমাদের সামনে মৃদুমন্দ শব্দে থেমে যাচ্ছে সময়। ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়ের চিত্রনাট্যে আজাদির জায়গায় বসিয়ে দিচ্ছে উৎসব। আমরা বলছি, মিথ্যে হয় না, পাল্টে গেলেও, উৎসব কোনওদিন মিথ্যে হয় না। সময় বলছে, পালিয়ে যাও, এই শরীর, এই যৌবন থাকতে থাকতে পালিয়ে যাও, বুকের বাঁদিকের ওই সোনার তাবিজটা বেচে পালাও আর লোকে বলুক, ঠিক সময়, ঠিক বয়সে, দ্যাখো, কী সহজ সুন্দর প্রস্থান।
আমরা একটা সস্তা শেরওয়ানি চাপিয়ে দুর্গাদালানে ভিড় করে ডাকছি সবাইকে। মৃদু হেসে প্রত্যুত্তরে বলছি – ‘শো চলাকালীন কোনও অভিনেতা তার মেক-আপের জিনিস বিক্রি করে না, তা সে যতই দামি হোক। এ আমার রাজপুত্রের মেক-আপ … ’
উৎসব থাকুক, না থাকুক, আমাদের মেক-আপ খুললে চলবে কেন?