ভাঙচুর এখন বেঘোর বর্ষাকাল, মহাশূন্যে। রেডিও ঢেউয়ের ঢল নেমেছে আকাশযমুনায়। ভরা প্লাবনে, প্রবাহে উজিয়ে চলেছে অগণিত জ্যোতির্ময় মাছ। এ মুহূর্তে রাতের আকাশ যেন এক স্ফুলিঙ্গখচিত তুঙ্গ তেজস্ক্রিয় উদয়তারার শাড়ি। হু-হু করে বইছে মহাজাগতিক বাউরি বাতাস আর হুতাশন একসঙ্গে, এলোমেলো। আগুনের জাততৃষ্ণা মেটাতে হাওয়ায় মুহুর্মুহু ঝাপটা মারছে ওই তেজস্ক্রিয় শাড়ির আঁচল আর আকাশের ঘন নিবিড় প্রচ্ছদে নৃত্যরতা দুজন জ্বলন্ত নগ্নিকার উগ্র অগ্নিমুদ্রা। এখনই প্রবল রশ্মিঢল, পরমুহূর্তেই মেঘবাষ্প, বাষ্প জমে গিয়ে বিন্দু-বিন্দু ঘনোপল... এখনই যা ধূলিধোঁয়া, পরক্ষণেই তা বিকিরণ। মনে হলো, চূর্ণ-অনুচূর্ণ হয়ে বিচ্ছুরিত হচ্ছে খোদ ওই অখণ্ড একক পরমাত্মা, পরম কৈবল্য, তাঁর দিব্য অভিপ্রায়সহ। প্লবতা সুইয়ের পুচ্ছে বাঁধা যে লম্বা সোনালি সুতাটি, তারই এক অনিঃশেষ আঁকাবাঁকা ভ্রমণকাহিনি সুরেলা হাতের সুরকুশলতায় রূপকথা হয়ে বেজে ওঠে নকশিকাঁথায়। আর সুইয়ের ডিএনএ-তেই আছে কারুশিল্প যেমন চেয়ারের মর্মে লীন হয়ে থাকে তার প্লবতাশক্তি। চেয়ারের ওই প্লবতাশক্তিই কেদারা-নশিনকে ভাসিয়ে রাখে ক্রমপদোন্নতির পথে। কোলাহল-বিষে দিগ্ধ দার্শনিক ওহে, দ্রুত হয়ে ওঠো অতিদহনে বিদগ্ধ। আবহমান হে সর্বজনীন ডোম, হে অনন্ত অন্তেষ্ট্যিক্রিয়ার কারক, সৎকার করবে আর কতটি শবের? বংশবেগে বেড়েই চলেছে পঙ্গপাল। পঞ্চত্ব পাবার পরেও দ্যাখো সবকিছু কেমন বহুগুণিত হয়ে ফিরে আসছে চক্রাকারে, কোনোরূপ অডিট বা স্ক্রিনিং ছাড়াই। অথচ ওম্ থেকে শুরু হয়ে ডোম অব্দি পৌঁছতে কত কী যে পার হয়ে আসতে হয় বাস্তবিক-- দজ্জাল ঝড়ের রুক্ষ রোমশ মেজাজ, মরীচিকার মিথ্যাচার, দুঃসহ বিয়োগব্যথা, সাধুর বকবৃত্তি, নিদারুণ আস্থা-ঘাটতি, সিঁথিবদ্ধ সিঁদুর থেকে জেগে-ওঠা আভা... মাঝখানে চন্দনের গাছে আগুন লেগেছে ওই সুগন্ধি আগুন। ফাঁকতালে ব্যক্তিত্বকে একা ফেলে ভেগে গেছে ব্যক্তি কখন যে ধরা পড়ে, সেই ভয়ে এবং অচেনা এক অস্বস্তিতে কুঁকড়ে থাকে অনাথ ব্যক্তিত্ব। আর এরই মাঝে ‘তুমি হইয়ো ফুল রে বন্ধু আমি হবো হাওয়া দেশ-বিদেশে ঘুরব আমি হইয়া মাতেলা।’ এরই মাঝে গো-বলয়ের গেরুয়ার সঙ্গে সমঝোতা পুবদেশের ‘অহিংস’ গেরুয়ার। বাঁকা কাস্তের সঙ্গে কী প্রকার বোঝাপড়া তবে কথিত ‘শান্তি’র বাঁকা তলোয়ারের? মাঝখান থেকে হবে রণক্ষেত্র স্থানান্তর, নিশ্চিত এশিয়া থেকে ক্রমশ ইউরোপে... ইতিহাস জুড়ে এইসব গন্ধকৃতি আর চির-পক্ষপ্রীতি... তবে আলো পড়বে যেই, সরে যাবে গন্ধ, মুছে যাবে পক্ষ, নেত্র, বাণ যদিও এ কথা সর্বগত-ঘটনামাত্রই নিত্য ক্ষুরধার, খরসান যেমন বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ হলে ছিঁড়ে দু-ভাগ হয়ে যায় সন্তান। চারুশিল্প তোমার সহিংসতাটুকু আমিই তোমার হয়ে সেরে আসি বাইরে গিয়ে। তবেই-না তুমি সম্পূর্ণ অহিংসরূপে দিবানিদ্রা যাও। সন্ধ্যাবেলা জেগে উঠে বলো-- বাহ্! করেছ কী কাণ্ড! বাইরে কী অপরূপ রক্তবিকিরণ! স্প্রাং রিদমের তালে-তালে জম্বি ছন্দে চলছে যজ্ঞ মনুমেধ-- ওই যে থ্যাঁতলানো দেহ-- প্রতীকপ্রতিম, ছিটকে-পড়া ঘিলু-- রূপকসমান, পোড়ানো হাত-পা মুখ-মাথা-- উপমেয়হারা উপমান, কাটা মুণ্ড, ফাটা জিভ, বিমূর্ত চিত্রের মতো নাড়িভুঁড়ি, অনুপ্রাস, থকথকে কূটাভাস, চকচকে চিৎকার, সত্রশিখা, উগ্র আগ্নেয় তুফান... থেকে-থেকে যজ্ঞপটে জেগে ওঠে ভৌতিক জবান। যোজনগন্ধার গন্ধকাহিনির মতো চমৎকার রক্তের সুবাস ভেসে আসছে জানালায়। সেইসঙ্গে এও বলো-- জীবাণুনাশক দিয়ে মুছে ফেলো সব আর্ট, তাড়াতাড়ি। বিমূর্ত চিত্রের রূপ-- মূর্ত তো থাকে না বেশিক্ষণ। পচে। গলতে থাকে। চণ্ড গন্ধ হয়। জীবাণু ছড়ায়... আন্তর্জাগতিক ভিন গ্যালাক্সির মেয়ে তুমি, ভিন্ন গ্রহের মেয়ে তোমায় আমি ফুটিয়ে তুলি ইচ্ছাশক্তি দিয়ে। দেখতে কেমন, ভাষা কী তার,কেমন অবয়ব- জড়বুদ্ধি জাহিল আমি, জানি না ওসব। তার মন তৈরি রূপ তৈরি কেমন উপাদানে কল্পভীরু এই কবি আর কীই-বা তার জানে! জানি না তার অনুভূতি, আবেগ, স্বভাবগতি স্রেফ অনুমানেই ফুটিয়ে তুলি, এমন প্রাণবতী! ছায়াপথ ছাড়িয়ে, দূরের ওই সুরগঙ্গা, তারও ওইপারে, বহির্গোলকে, শঙ্কু-আকৃতির এক মিটিমিটি আলো-জ্বলা ঘরে ব’সে ভিন্ন ভুবনের মেয়ে তুমি নির্নিমেষ চেয়ে আছ হে আমারই জানালার দিকে। হৃদয়ের নেশা, এক আন্তর্জাগতিক নেশা... একদিন ঘনিয়ে আসব ঠিকই দুইজনে, পরস্পরে। তোমার আমার ঘনীভূত অভিকর্ষ দিয়ে আস্তে-আস্তে বাঁকিয়ে ফেলব দেশকাল দূর দুই জগতের মাঝখানে যে ব্যাকুল মহাশূন্য, বেঁকে যাবে তা টানটান অশ্বক্ষুরাকার চুম্বকের মতো। আলোকবর্ষের ওই মহাদূর দূরত্বই হয়ে যাবে তুড়ি-মেরে-উড়িয়ে-দেওয়া ঘণ্টা কয়েকের পথ। আর আমি ঠিকই সাঁতরে পাড়ি দেবো ওইটুকু মহাকাশ। জ্যামিতির ছুড়ে-দেওয়া এক জেদি অথচ লাজুক স্পর্শকের মতো তোমাকেই ছুঁয়ে ছুঁয়ে বয়ে যাব আমি পৃথিবী নামের গ্রহ থেকে ছোটা হেমন্তদিনের হাওয়া। তৃষ্ণা তেতে-ওঠা বালুর ওপর দিয়ে হাহাকার করে ধেয়ে আসে এক মরুসরীসৃপ, মুসাফিরের দিকে। ‘বিষ ঢালব না, ছিঁড়ে খাব না মাংস, শুধু একটু গলা ভেজাব রক্তরসে, এমন ছাতিফাটা কহর তৃষ্ণায় প্রাণ যায়-যায়, এটুকু রহম করো হে বেদুইন’ ব’লে সেই গনগনে সরীসৃপ ঝাঁপ দিয়ে পড়ে বিদ্যুৎ গতিতে, গোড়ালি কামড়ে ধরে রক্ত শুষে ভিজিয়ে নেয় জিহ্বা ও গলা, তারপর নিমেষে উধাও, এক ক্ষমাহীন বিষুবীয় ক্রুদ্ধ মরীচিকার ভেতর। জ্বরের ঋতুতে তখন আমাদের ঋতুবদলের দিন। খোলসত্যাগের কাল। সুস্পষ্ট কোনো সর্বনাশের ভেতর ঢুকে পড়তে চেয়েছিলাম আমরা দুজন। তার আগেই তোমার জ্বর এল। ধস-নামানো জ্বর। তুমি থার্মোমিটারের পারদস্তম্ভ খিমচে ধরে ধরে উঠে যাচ্ছ সরসর করে একশো পাঁচ ছয় সাত আট...ডিগ্রির পর ডিগ্রি পেরিয়ে...সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী তাপের সহগ হয়ে উতরে উঠছ তরতরিয়ে সেইখানে, যেখানে আর কোনো ডিগ্রি নেই, তাপাঙ্ক নেই...তাপের চূড়ান্ত লাস্যমাত্রায় উঠে ঠাস করে ফারেনহাইট ফাটিয়ে বেরিয়ে আসছে থার্মোমিটারের ফুটন্তঘন ফেনিল আগুন। তীব্র, ধসনামানো জ্বরেও নারীরা ধসে না। হয়তো কিছুটা কদাকার দেখায়, এবং কিছুটা করালী দেবীর মতো। যত রূপসী তত করালিনী, জ্বরে। একসময় মাথা-ফেটে-যাওয়া থার্মোমিটারকে ব্রুমস্টিক বানিয়ে তাতে চড়ে উধাও উড়ালে অস্পষ্ট অঘটনের দিকে হারিয়ে যাচ্ছ হে তুমি, প্রিয়তরা পিশাচী আমার। জীবনে প্রথম মুখোমুখি এরকম সরাসরি স্পষ্ট বিপর্যাস... থার্মোমিটারের জ্বালাখোঁড়ল থেকে ঝরছে তখনো টগবগ-করে-ফোটা ফোঁটা-ফোঁটা লাভানির্যাস। অ-বশ্য পাশ দিয়ে দ্রুত ছুটে যাবার সময় কেশর খামচে ধরে কোনোক্রমে উঠে পড়েছে দুর্ধর্ষ সিংহের পিঠে আরোহণশাস্ত্রে অজ্ঞ অধিকারহীন এক অশিষ্ট বালক। এখন সে না-পারছে নামতে, না-পারছে থাকতে সওয়ার। উঠে পড়া যতটা সহজ, নেমে যাওয়া ততটা নয় আর। অর্বাচীনে চেনে না সুইচ, ব্রেক, ব্যাটারি, গিয়ার সিলেক্টর... জানে না সিংহ-চালানোর কায়দাকানুন। অনুমানে, স্রেফ অনুমানে, একটার বদলে অন্যটা অপারেট করে যাচ্ছে বেদিশার মতো একে-একে। একে তো ভুল বশীকরণের ছুরা, তা আবার উল্টা করে পড়ে ফুঁ দিচ্ছে সিংহের কেশরে, একনাগাড়ে। যেখানেই গিয়ে লাগছে সেই ফুৎকার, সেখানেই অঙ্কুরিত হচ্ছে আহ্লাদিনী অনূঢ়া আগুন। বিন্দু-বিন্দু বহ্নিচিহ্ন, গোঁফ আর কেশরের আগায় ডগায়। জ্বালানি জ্বলছে খুব অন্তর্দাহ সিংহের ইঞ্জিনে পিস্টনের আজগবি ওঠানামা সিলিন্ডারে গহ্বরে সুড়ঙ্গপথে সরাসরি অস্বীকার গূঢ় অটো চক্রের অনুজ্ঞা... একমুখী ভালভের ভৌতিক কেরামতি ঘনঘন বাতকর্মে বায়ুদোষে মিথেনে মনোক্সাইডে মুহুর্মুহু মিসফায়ারে এলোমেলো লুব্রিকেশনে, থেকে-থেকে ফুয়েলের নিবাত দহনে দুঃশব্দ ও দুর্গন্ধদূষণে প্রাণ-জেরবার আরোহী ও আরোহবাহন। বেদম নাকাল চারপাশ, নাজেহাল লোকালয় আরোহণ যতটা সহজ, অবরোহণ ততটা নয়। রসমঞ্জরি শান্ত সমুদ্রে ভেসে চলেছে একা এক রণতরি। দূর থেকে মনে হচ্ছে যেন অনন্ত ময়রার গোল গামলাভরা রসের ওপর ভাসছে এক আয়তাকার রাঘব রসমঞ্জরি-- উপরিভাগে একটি একটি করে বসানো সব বুন্দিয়া আর কুড়মুড়ে পেস্তা বাদাম। মিঠাইয়ের দিকে চঞ্চু ব্যাদান করে এক শ তেইশ ডিগ্রি কোণে তেড়ে নেমে আসছে এক মহাকায় খেচর। ওই হা-করা ধেয়ে-আসা চঞ্চু তাক করে সমরজাহাজ থেকে ছুটল মিসাইল মুহুর্মুহু। অবিশ্বাস্য বেগে ছুটে-আসা সেইসব জ্যান্ত মিসাইল, পেছনে লঞ্চার, তারও পেছনে ডেকের ওপরে পেস্তা বাদাম বুন্দিয়ার মতো ছড়ানো-ছিটানো সব কামান ও জঙ্গি বিমান আর জলযোদ্ধাদের কৃত্য ও কম্যান্ড আর এই সবকিছু ধারণ করে আছে যে বহুতল রণতরি... সুড়ুত করে সমস্তটাই টেনে নিল পাখি এক টানে, দ্রুত চঞ্চুক্ষেপে। পাখির ঠোঁট আর কশ বেয়ে তখনো ঝরছে রসমঞ্জরির রস। চিত্রকল্প কেরোসিন খেয়ে মাতাল হয়েছে মাঝি গলা ছেড়ে গান ধরেছে মাঝনদীতে দাহ্য তরলে গোসল সেরেছে বউও মেতেছে দুজনে নেশায়, নৈশ গীতে। দুটি প্রাণী এই ঘোর অমাবস্যায় জড়িয়ে ধরেছে যেই-না আশ্লেষায়, উগ্র দাহ্য তরলের মৌতাতে ঘর্ষ-আতশ জ্বলে ওঠে সাথে সাথে। জ্বলে ওঠা ওই মাঝি-মাঝিনীর মিথুনমূর্তি দেখে ভীতবিহ্বল নৌকাখানিও নিজেকে পোড়াতে শেখে। জ্বলছে মাঝিটি, সেই সাথে মাঝিনীও মধ্যনদীতে জ্বলছে নৌকাটিও। নৌকা জ্বলছে, নদীও জ্বলছে, জ্বলছে প্রতিমাযুগ পালক পুড়ছে, খোলস পুড়ছে আর যা পোড়ে পুড়ুক। মাঝি ও মাঝিনী আর ডিঙাখানি এই তিন বাহু আর নদী ঢেউ স্রোত এই তিনে মিলে চিতা ছয় মাত্রার। জ্বলন্ত ওই যুগল মূর্তি দাঁড়ানো লম্বাকার ষড়ভুজ চিতা জ্বলছে নদীতে হু-হু হাওয়া, হাহাকার। বহুদূর থেকে কূটাগারে বসে দৃশ্য দেখছি এই অন্ধ ক্ষুব্ধ নদীকে হয়তো মানায় এই রূপেই। জ্বলন্ত ফুলে ফুটে-থাকা দুই জ্বলন্ত মৌমাছি বিস্ফোরিত এ চিত্রকল্পে স্তম্ভিত হয়ে আছি।
মাসুদ খান
জন্ম ২৯ মে ১৯৫৯, বাংলাদেশের জয়পুরহাট জেলার ক্ষেতলালে। পৈতৃক নিবাস সিরাজগঞ্জ। প্রকৌশলবিদ্যায় স্নাতক, ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর। তড়িৎ ও ইলেকট্রন প্রকৌশলী। বর্তমানে ক্যানাডায় বসবাস। শিক্ষকতা করেন টরন্টোর একটি কলেজে।
প্রকাশিত গ্রন্থঃ
পাখিতীর্থদিনে (১৯৯৩), নদীকূলে করি বাস (২০০১), সরাইখানা ও হারানো মানুষ (২০০৬), আঁধারতমা আলোকরূপে তোমায় আমি জানি (২০১১), এই ধীর কমলাপ্রবণ সন্ধ্যায় (২০১৪), প্রসন্ন দ্বীপদেশ (২০১৮), দেহ-অতিরিক্ত জ্বর (২০১৫), প্রজাপতি ও জংলি ফুলের উপাখ্যান (২০১৬), গদ্যগুচ্ছ (২০১৮), শ্রেষ্ঠ কবিতা (২০১৮), পাখপাখালির গান পাগলাঝোরার তান (২০১৯), ঊর্মিকুমার ঘাটে (২০২০), দুঃস্বপ্নের মধ্যপর্ব (২০২২)।
Facebook Comments Box