আমাদের বোকামির কোনও ইয়ত্তা নেই। আমাদের বোকামি অনন্তে হাত ধরাধরি করে হাঁটে। আমাদের জন্ম হয়, ধ্যারধ্যারে নিম্নমধ্যবিত্তে। একটা বোকা ঘর, তার সবকটা দেওয়াল নিয়ে রামঠকা ঠকে গেছে বেশ কয়েকবছর হল, সেই বোকা খোদ আমাদেরই শেখাতে আসে, দেখো, এই দেখো, কী কী করেছি, এই আমার পাপ, পুণ্য, আমাদের অতিবুদ্ধির কায়ারোস্কিউরো। জন্মের স্মৃতি বলতে একটা নস্টালজিক আর্ট ছবির ঘর। চারপাঁচটা বাচ্চা, একটা ভিডিও ভাড়া করে দেখা আমির, সলমন, দিব্যা। টিভির পেছন থেকে সবার মুখের ওপর তোলা একটা স্লো ট্র্যাকিং শট। শটটা সবচেয়ে ছোট ছেলেটার সর্দি থেকে শুরু করে সবচেয়ে বড় পাশের পাড়ার তন্বী, শ্যামলা ছুটকিদির বুকের কাছে গিয়ে শেষ হয়। ছুটকিদি আঁচল ঠিক করে। আমাদের বোকামি ফ্রেম পায়। আমাদের জন্মের সমস্ত ছবিতে আমাদের চোখে মায়েদের মুখ ব্লার করা থাকে। যেন মায়েদের শরীরে, মনে অকাল সোনা ফলেছে, দেখে গেছে কোনও পুরুষ, আর পাড়াপড়শি যে যার আসন্ন ভয়্যারের আগ্রহে একটা বাড়তি চেয়ার রেখে বসে দেখছে সেই সার্কাস। যেন মা কোনও বোকামির চোটে বাড়ি থেকে দাদাটাদাদের সঙ্গে না নিয়েই বেরিয়ে গেছে রাতবিরেতে। সেই মা, মাতৃত্ব, প্রথম নারী – ব্লার। ফলে আমাদের অনেকেই মুখ চিনতে পারিনি বলে তেমনভাবে বন্ধু হতে পারলাম না মায়ের। মা-ও দুবেলা দুমুঠো জামা প্যান্ট শুকোতে শুকোতে তারের ওপার দিয়ে এমনিই চলে গেল একটুও না থেমে। আমাদের ডেঞ্জারাস রোপওয়াকিং-এ একবারের জন্যও বলল না, ‘সাবধানে’। আমাদের একরাশ মা-দূরত্বে তখন গলা পাল্টাচ্ছে পরিচিতিবোধ, পাল্টাচ্ছে এতদিনকার লালিত স্বর, গর্ব। আমরা একটু গলা খুসখুস করেই আবার পড়ে নিচ্ছি বাংলা কবিতা, দেখছি সবকিছু ঠিকঠাক মনে থাকছে কিনা, দেখছি দেওয়ালের স্যাঁতস্যাঁতের ভেতর মাইকের মতো দেখতে কী একটা দাগ। আমরা মাইকটাকে ঘষতে ঘষতে দেওয়াল-জীবন পেয়ে যাই। মাকড়সা-মানুষে, গড়িয়ে পড়া এক-একটা জলের অপেক্ষায় আমাদের সে কী নিশ্চুপ ব্যারিটোন! আমাদের বোকামির চোটে দর্শক, শ্রোতা হাততালির ভাষা খুঁজে পায় না। আসলে তো সবাই বোকা, সবাই ভাবছে কবিতাটা হচ্ছে নিশ্চয়, শুধুই তারাই শুনতে পাচ্ছে না। আমরা পড়ছি ভাস্কর। আমরা সেই চক্রবর্তীর ভেতর জেনারেশন ধরে ধরে শুয়ে পড়ছি। আমরা বলছি – ‘হে প্রিয়, অবসাদ একটা থলথলে জোঁক আমার সেরা সময়টাকে গিলে খেয়েছে …’
পেটে তো চলে গেলাম, তারপর তরল বমিভর্তি সেই অন্য এক শরীরের ভেতর আমাদের অন্যের জীবন, কেমন লাগল দেখতে? আমাদের হাঁটা চলায় হাত নেই, চাকরিতে হাত নেই, প্রেমে হাত নেই, কথা বলায় হাত নেই, শুধু অপরাধস্বীকারে তীব্র হাত আছে। আমরা সেই হাতের আঙুলে আঙুল জড়াই। আবার ভুল করি। বোকামি করি। হয়তো চোখ বন্ধ করে দিয়েছি পলকে। হয়তো ঠিক আঙুল ধরতে বলে ডেস্টিনি চকিতে ঘুরিয়ে নিয়েছে হাতটা, কাপটা। আমরা বিষ না কফি, কফি না বিষ – করতে করতে নিজেই নিজের টেবিলটা ঘোরাচ্ছি আর বিচ্ছিরি একটা হাসছি। আমাদের সন্তান, আমাদের বন্ধু, আমাদের প্রেমিকারা আমাদের চারপাশে কিলবিল করছে জীবননষ্টের মোক্ষে – আমরা বলছি, আর একটা সুযোগ দাও, আর একটা। ঘরটা ভরে যাচ্ছে অন্য লোকে, সেই অন্য লোক আমাদের মতো পোশাকে অন্যের ঘরে। একটা চেইন রিয়্যাকশনে আমরা কেউ নিজের ঘরে থাকছি না। ঢুকতে গেলে ভয়ে ভয়ে স্ত্রীকে বলছি, আসব এখন? অসুবিধে নেই তো। আর তখনই ভাস্করবাবু আস্ত একটা বোকামি হয়ে পেছন থেকে দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়াচ্ছেন। আমরা হাসছি। মেয়েটি পেছনে ঘুরে অবাক হয়ে যাচ্ছে, বলছে, কার সঙ্গে কথা বলছ তুমি? আমরা বলছি, দৈব গো দৈব, ডেস্টিনি, আর কে! আমরা মেঝের দিকে তাকাতে তাকাতে ঘরে ঢুকছি আর বলছি, ‘এখানে-সেখানে এই যে এত পেচ্ছাপ, ভাবি হাঁটাচলা করবো কোথায়, কোথায় ঘুমোবো!’ আর তখনই স্ত্রীর মুখের ভাষা বন্ধুর মতো হয়ে যাচ্ছে। বাসের খালাসির মতো হয়ে যাচ্ছে। প্রত্যাখ্যানের আনন্দে আমরা ঘর থেকে বেরোনোর আগে শুনতে পাচ্ছি – ‘বোকাচো …’
ইন দ্য মিনটাইম, আমাদের বন্ধুদের এক এক করে একজিট। চিত্রনাট্য তেমনভাবে জমানোর আগেই পার্ট ভুল, সংলাপ ভুল, ভুল একজিট। আর এখানেই আমাদেরও ভুলটা হয়ে যায়। বোকামিটা আসলে যে সারভাইভারদের করতে হয় আর অনন্ত এক ফুর্তির ভেতর সিগারেট ধরিয়ে পায়ের ওপর পা তুলে হাসে মৃত বন্ধু – সেসব আমরা বেমালুম ভুলে যাই। আর তখনই যাবতীয় উপসর্গ। আমাদের কথা আটকে যায়। আমাদের জিভ যেন চল্লিশ ছোঁয়া ভেটেরান ফুটবলারের পা। নড়ছে না, নড়ছে না। আমাদের জুতোয় পেরেক, সিঁদুরে পেরেক, প্রতিশ্রুতিতে পেরেক। সেখানে আটকে, গেঁথে, ছিঁড়েফুঁড়ে আমাদের ফরিস্তা বোকার মতো হাসতে তো হাসছেই। বলছে, ওরে, বাঁচাতে চাস তো সিগারেট দে একটা, সিগারেট দে। এখন, এইসব মুখের থেকে আমাদের বরাবর বিতৃষ্ণা। আমরা এদের রামবোকা ধরে নিয়ে এড়িয়ে চলি। এরা আমাদের কাছে কাচের গাড়ির বাইরে তৃতীয় মানুষের হাত। এরা বেলুনওয়ালি কালো মেয়ে। এরা কুকুরের পর কুকুরকে খাইয়ে ঘরে ফিরে তাচ্ছিল্য খেয়ে পেট ভরা বোকা বুড়ি। এদের প্রতি আমাদের ভয়। আমাদের জন্য আমরা নিজেরা আছি। নিজেরাই নিজেদের পকেটের রাজা। নিজেদের গলার আলোয়ান, জিন-শেরি-শ্যাম্পেন, অহঙ্কার, লাম্পট্য, অসীম বন্ধুত্ব ভেবে গোঁত্তা খাওয়া এক্সট্রাম্যারিটাল। প্রিয় বান্ধবীকে হারানো বেসামাল আমরা, হদ্দ বোকা আমরা ওদের হারিয়ে পরের মুহূর্তেই আবার তুমুল প্লেটোনিকে ফ্যান্টাসাইজ করছি, পাগলের মতো খুঁজছি শরীরের অনন্ত তিল, একটা, দুটো, তিনটে। একটা করে খুঁজে পাচ্ছি আর ছড়িয়ে দিচ্ছি মোহর, বলছি, এই নাও জান, কত নেবে নাও। তারপর কপর্দকশূন্য হয়ে গেলে শুনতে পাচ্ছি ‘তুমি বলছ বাজারে যাও, আমি বলছি, নেই, একটা ফুটোকড়িও নেই …’
এর পরের গল্পেই আসল ম্যাজিক। রুমাল, খরগোশ, তলোয়ার, করাত, টেবিল, কাঠের বাক্স, ছিপছিপে সুন্দরী তন্বী, রংচঙে আলোয়ান, স্টেজ, লাইট – সব প্রস্তুত, শুধু প্রোটাগোনিস্ট দেরিতে ঢুকছে বলে কিছু শুরু করা যাচ্ছে না। আর শেষ মুহূর্তে সেই নায়ক আবার ভুল করে বসছে। পৃথিবীকে তীব্রভাবে ভালোবাসার লোভ। যা তার মধ্যচল্লিশে বোকার মতো জাপ্টে ধরছে। বলছে, ছাড়ো প্লিজ, লাগছে। সে ততোই জড়িয়ে ধরছে লোভে, আশ্লেষে। দর্শক এসব থার্ড পার্সনে ভুলবে কেন? তার তো সময় বাঁধা! সে ঘড়ি দেখছে, স্টেজে উঠে ছিনিয়ে আনছে রুমাল। বলছে, আর দুমিনিট দেখব, তিন মিনিট দেখব, শুরু না হলেই উঁচু করব রুমাল। ফেলে দেবো হাত থেকে। এরপর একটা বোকা শরীর শূন্যের অসীম আনন্দে ঝুলতে থাকবে একা। রক্ত শেষ হলে, ঘাম শেষ হলে, অপরাধবোধ শেষ হলে আশপাশের আর-পাঁচটা বোকা তাকে নামিয়ে আনবে সিলিং থেকে। তারপর নিজেরা জায়গা বদল করবে। এই অনন্ত শাফলে, প্রিয় দর্শক, আপনাদের একফোঁটাও বিরক্ত লাগলে, আপনারা নিজেদের মধ্যে কথা বলতে পারেন। বাইরে একটু বেরিয়ে এসে সিগারেট ধরাতে পারেন, দুতিনটে সবুজ বই এনে উল্টেপাল্টে দেখতে পারেন পাতা। চিঠি। আর তখনই আপনারা মোক্ষম বোকামিটা করে ফেলবেন। ঠিক এখানেই জিতে যাচ্ছেন প্রোটাগোনিস্ট। নায়ক। ম্যাজিশিয়ান। তার স্টেজে আসার আর প্রয়োজন হয় না। হি হ্যাজ কাস্ট হিজ স্পেল। তার অনন্ত অনুপস্থিতিতে, তার অট্টহাসে সে দেখবে, হিপনোটাইজড আপনি, আপনার মধ্যবয়সী অন্যান্য বন্ধু, অন্যান্য পোকামাকড় একসঙ্গে সেইসমস্ত বোকা মানুষের চিঠি পড়ছে। পড়তে পড়তে উঠে জড়িয়ে ধরছে মাকে, বাবাকে, সন্তানকে। স্ত্রীকে ছোট্ট একটি চুমু খেয়ে বলছে, চা করি একটু? সেইসমস্ত চিঠি। সুব্রত চক্রবর্তীকে লিখছেন ভাস্কর। কবে, কোন মাসে, কে জানে –
‘দুপুরবেলায় — যখন কারুর সঙ্গে সামান্যতম যোগাযোগও আর নেই — যখন আকাশ দিয়ে সবেগে চলে যায় প্লেন — অথবা, ছাদে শুকোতে-দেওয়া কাপড় যখন হাওয়ায় শুধুই উড়তে থাকে, আর থেকে থেকে ঝাপটা মারে দেয়ালে — বিছানায় শুয়ে শুয়ে এই অদ্ভুত শব্দ শুনতে শুনতে তখন শুধুই মনে হয়, এই তো চেয়েছিলাম আমি, এই তো চেয়েছিলাম। আরো শাস্তি হোক আমার। আরো শাস্তি হোক …’