বহুদিন পর পুরনো বাড়ির উঠোনে ফিরে এসেছে সেই এক পায়ের শালিক। সারা দুপুর উঠোনের দক্ষিণ কোণে চুপটি করে বসে, যেন ধ্যানমগ্ন। বেলা পড়ে এলে গা-ঝাড়া দিয়ে সে উঠে বসে। ঘাড় বেঁকিয়ে শূন্য দৃষ্টিতে তাকায়। আমার চোখের কোণে জমে থাকা ধূসর পলকগুলো তখন একে একে উড়ে যেতে থাকে। দেখি উঠোনময় বৃত্ত এঁকে চলেছে এক কিশোরী মেয়ে। তার শরীরভর্তি সূর্যাস্তের লাল. বনের সবুজ মায়া আর নদীর সতেজ ঢেউ। তার হাতে ধরা এক টুকরো কাঠকয়লা। ও মেয়ে তুই কে গো? শরীরভর্তি প্রকৃতি মেখেছিস কী করে! আমার কথা শুনতে পায়না ও। আগাম বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা থেকে বৃত্তগুলোকে দু’হাতে আগলে কেবল চেয়ে থাকে আকাশের দিকে। তাকিয়ে দেখি সত্যি তো, আকাশ কেমন থম মেরে আছে। থমকে দাঁড়ায় সেই এক পায়ের শালিকও। এপাশ-ওপাশ ঘাড় নাড়ে। ডানা ঝাপটে ওঠে কিন্তু উড়ে যায় না। একসময় উঠোনে একলা পড়ে থাকা এক বৃত্তের মাঝে মুখ ডুবিয়ে দেয়।
সময় বাড়তে বাড়তে সে উঠোনে রাত নামে। স্নিগ্ধতার জালে আটকে পড়ে উঠোনের এক ধারে চুপ করে বসি। মেয়েটাকে দেখি উবু হয়ে বৃত্তর বদলে উঠোনে আবার কিছু একটা আঁকছে। আঁকতে আঁকতে সে কখন যেন সম্পূর্ণা হয়ে ওঠে। উঠোনে নরম জ্যোৎস্নায় তার দীর্ঘ চুল ভিজে উঠলে সে মেয়ে করুণ সুরে গান গায় আর উঠোনময় হাঁটে। সেই শালিকটা, মুখ ডুবিয়ে উঠোন থেকে খুঁটে খুঁটে জ্যোৎস্না কুড়ায়। হয়ত, জ্যোৎস্নার ফুটফুটে রঙের মাঝে যে ফিলোজিনি আছে তা সে ছড়িয়ে দিতে চায় মেয়েটার চারপাশে।
ঘুরে বেড়ানো শালিক আর ওই মেয়েটা চুম্বকের মতো টানতে থাকে অতীতের দিকে, স্মৃতির কাছে, শৈশবের কাছে। চৌকো কাচের বাক্সে গোলাপি হাওয়াই মিঠাই, স্কুল গেটে স্যাকারিন মেশানো জলপাইয়ের আচার অথবা চড়া গোলাপি রং-এর কচকচে বরফের আইসক্রিমের ছবিগুলো উড়ে উড়ে আসে.. সহসা সহস্র পাখি ডেকে ওঠে বুকের মাঝে। মনে পড়ে, একটা ফলসা গাছের প্রেমে একবার হাবুডুবু খেয়েছিলাম। গ্রামের বাড়িতে কুপির আলোয় আপেলের ছবি বসানো এনামেল প্লেটে মেজ মামীর হাতে ভাত খেতে ভালোবাসতাম। গ্রীষ্মের রাতে খোলা আকাশের নিচে পাটি পেতে বাবার সাথে কত যে ঘুমিয়েছি। আর হেসে ফেলি যখন মনে পড়ে যায়, ঘন সবুজ পুরনো জ্যাকেট পরা যে রিক্সাচালক আমাকে স্কুলো পৌঁছে দিত, তাকে মনে হত শেরউড জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসা রবিন হুড।
বাড়ির বাইরে কেমন যেন কথার গোল কানে আসে। বেরিয়ে দেখি, বড় রাস্তার আলোগুলোর নীচে হঠাৎ অজানা-অচেনা মানুষের জটলা। ভিড়ের মাঝে এ ওর হাত ধরে, জামার আস্তিনে টান দিয়ে চোখে-মুখে উৎকন্ঠা ফুটিয়ে কীসব বলে যার কিছুই আমি বুঝতে পারি না। কে আমার নাম ধরে ডাকে। বারবার ডাকে। মনে হয় কোথাও যেন একটা মহা সর্বনাশ ঘটেছে। আমার সাড়া দিতে ইচ্ছে করে না। চুপচাপ ফিরে আসি উঠোনে। ভোর হয় হয়।. মেয়েটাকে কোথাও আর দেখতে পাই না। শালিকটাও উধাও। স্মৃতির উল্টোপিঠে সময়ঘড়ি বাজে ঢং ঢং ঢং…
আর তখনই হঠাৎ এক ঝুল বারান্দা নেমে আসে মাথার ওপর। সময় সেখানে তার কাঠিন্য নিয়ে সটান দাঁড়িয়ে। দু’পাশে তার দু’হাত ধরে মারী আর মন্দা, সম্পর্কে তারা ভাই-বোন। তাদের ঠিক পিছনে চলছে যুদ্ধের মহড়া আর হননের বলী খেলা, মিসোজিনিস্টের ঠা ঠা হাসিতে কেঁপে উঠে দেখি, লালে ভাসছে পথ,ঘাট.. এ কোন দুঃসময়! এর থেকে উত্তরণের পথ কি জানি না। কেবল বিচলন। কেবল ক্ষরণ। শৈশবের সহজতা, অখণ্ডতা কোথায় হারিয়ে যায়, জেগে থাকে কেবল বিচ্ছেদ। অনেক পুরনো একটা জানলা যা আমি গতকাল খুলেছিলাম তা সশব্দে বন্ধ হয়ে যায়। ডিটারমিনিজমের ছড়িয়ে রাখা ফাঁদ আমায় জড়িয়ে ধরে। নিয়তি, সকলই নিয়তি বলে মূল্যস্ফীতির পেটের ওপর নাচতে থাকে শূন্য ভাতের থালা। আধিপত্য আর দখলের কাঠগড়ায় আমি এখন দণ্ডপ্রাপ্ত এক আসামী যাকে প্রজাপতির ভাঙা ডানায় দাঁড়িয়ে চোখ রাঙাচ্ছে স্বয়ং সময়।
উত্তাল ঢেউ জাগছে পুবে। পশ্চিমে।
চারদিক ছেয়ে যাচ্ছে পাতাল অন্ধকারে…

জন্ম ৪ মে, জামালপুর
বসবাস: ঢাকায়
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের স্নাতকোত্তর