মাতাল প্রয়োজন যে ছেলেটা মদ খেয়ে ঘুমুচ্ছে, তাকে ডেকে দিন বলুন- সময় হয়েছে। ঘুমানোর মানুষ তো অনেকই আছে, শহরের এখন একজন মাতাল প্রয়োজন। হৃদয়ের ছোটপাখি হৃদয়ের ছোটপাখি আমি তোমাকে বুঝি কিন্তু বলো কীইবা করতে পারি আমি তোমার জন্য? আমি তো এক সামান্য মানুষ যে কীনা আবার একটা পাখি নিয়ে বিব্রত তারচেয়ে তুমি বরং চমৎকার শীতনিদ্রায় যেতে পারো- যখন বসন্ত আসবে, শহরের সব বরফ গলে গেলে, কথা দিচ্ছি, আমিই তোমাকে ডেকে দেবো। বসন্তকে কখনো অবিশ্বাস করো না ঠিক যেমন কোরো না বিশ্বাস- সবকিছু যা তুমি দেখতে পাও; শুনতে পাও; তোমাকে বলা হয় কেউ তোমাকে বলে- তুমি ঘুমাও, তোমাকে ঠিক ডেকে দিবো অথচ বসন্ত এসে চলেও গেলো, কিন্তু কেউ তোমাকে ডাকলো না- আর অপেক্ষা করতে করতে দীর্ঘ এক শীতঘুমের ভেতর কখন মারা গেলে তুমি ছোটপাখি, তুমি নিশ্চিন্তে ঘুমাও তোমার সৌভাগ্য- তুমি অন্তত প্রতারিত হতে পারো! কবিতা লেখা একজন জিজ্ঞেস করলো, আপনি কি কবিতা লিখেন? আমি তার চোখে তাকালাম। না, আমি কবিতা-টবিতা লিখতে পারি না। আমি শুধু মাঝে মাঝে শব্দগুলার ঠ্যাং ভেঙ্গে দিই। কারণ আমার মনে হয়- ওগুলা বোধহয় আমার ঐভাবে পড়তেই আরাম লাগবে বেশি। তারপর সেগুলা বাতাসে ছড়ায়ে দিই আমার বন্ধুদের জন্য যেন তারাও আরামটা পেতে পারে। আর যেহেতু না পেলেও ক্ষতি নাই। আর জানেন বোধহয়- আপনি যখন কিছু একটা কথা নিজের মন নিংড়ায়া বলতে পারলেন, আপনি মূলত একটা বায়বীয় আরাম তৈরী করলেন- আউট অব নোহয়ার অনেকটাই ম্যাজিকের মতো। আর এরপর সেইটা ছাদের ওপর দড়িতে শুকাতে দিলেন আর সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলেন আয়েশ করে বারান্দায় বসে নিজেকে এক কাপ দারুণ চা বানায়ে খাওয়ানোর জন্য। তাহলে আপনার প্রশ্নটা বরং এমন হইতে পারে- যে- মাঝে মাঝে আমি নিজেকে চা বানিয়ে খাওয়াই কিনা? নাগরিক দুপুর এইসব নাগরিক দুপুর আমার ভালো লাগে না যখন চিতই পিঠা থেকে তরল গুড় গড়িয়ে পড়ে নিকটবর্তী বইয়ের পৃষ্ঠায় কম্পিউটার অচল হয়ে যায় কিংবা তুমি থাকো বার্তাহীন আমাদের তখন বইয়ের কাগজ থেকে সোনালী গুড় মুছে ফেলতেও আলসেমি লাগে। ইচ্ছে করে শাহবাগ চলে যাই রমনায় গিয়ে বসে থাকি কাঠবেড়ালি দেখি সন্ধ্যে হোক, তারপরে ল্যাম্পপোস্ট জ্বলে গেলে আমরা না হয় আবার ভিজে ভিজে বাড়ি ফিরলাম। আমাকে অনুসরণ কোরো না আমাকে অনুসরণ কোরো না ফালতু সময় নষ্ট করবে আমার কোথাও যাবার তাড়া নেই ইচ্ছে হলে রাস্তার ফুটপাতে পা লটকে বসতে পারি আধুনিক শপিং মলের স্বয়ংক্রিয় সিড়ি দিয়ে উঠবো আর নামবো শুধু ইচ্ছে হলে মিছিলে যাবো, কিংবা যাবো না ইচ্ছে যদি হয় কোনো একটা গন্তব্যহীন রিকশায় কাটিয়ে দেবো সারা সন্ধ্যা, তারপর রাত নেমে এলে অন্ধকার জানি না কখন ঘরে ফিরবো, বা আদৌ ফিরবো কিনা ঘরে ঢুকে বাতি জ্বালাবো না হয়ত, হয়ত অন্ধকারে অন্ধকার জড়িয়ে মাতালের মতো পড়ে থাকবো কিংবা কে জানে হাতুড়ি দিয়ে থেঁতলে দেবো টিউবলাইট, যাতে আর কোনোদিন জ্বলতে না পারে। আমার খাওয়ার জরুরি নেই, ঘুমোতে যাবার সময় নেই, সকালে উঠতে হবে কথা নেই- কিংবা একদিন আর কেউ দরজা খুললো না, বের হলো না শহরের পথে, ঘরের ভেতর একা কখন মরে পড়ে আছে- যার কীনা মাঝে মাঝে কেবল বিদায় জানাতে ইচ্ছে করতো একটা সাবলীল মেয়ে একটা সাবলীল মেয়ে কুয়াশার মতো বৃষ্টিতে একহাতে ছাতা ধরা, হাঁটছে রাস্তার দুদিকে ভেজা আর আধখোলা দোকানগুলোর দিকে তাকাতে তাকাতে সে নিশ্চয়ই রাস্তা বরাবর দোতলার এই জানালার দিকে তাকাবে না- যেখানে তাকালে আমাকে যেখা যায় আর তাকে যে কেউ দেখছে তা বোঝা যায় স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা দ্রুতই হাঁটছে সে এবং আর কিছু মুহূর্তের মাঝে আমার জানালাটাকে অতিক্রম করে যাবে কিন্তু তার আগে সে চাইলে আমাকে দেখতে পারে আমার জানালার দিকে তাকিয়ে আমি সরে পড়বোনা আমি জানালার পর্দার আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে ফেলবোনা বরং তার সাথে চোখাচোখি হলে নিঃশব্দে বলবো- আজকে কি একটা ছুটির দিন, মাত্রই দিনের প্রথম চা শেষ করলাম আপনি কি উপরে এসে এক কাপ চা খাবেন? আর চাইলে ভেজা ছাতাটা শুকাতেও দিতে পারেন বারান্দায় যদিও কিছুক্ষণ পরই হয়ত ওকে আবার ভিজতে বের হতে হবে কিংবা কে জানে- হবে না মড়ক সারা শহরে যেন মড়ক লেগে গেছে। তিনদিনের বন্ধ পেয়ে ছুটছে। শহরটা। মানুষরা। গাড়িঘোড়া। রাজপথ। ফুটপাত। পিঁপড়া। কদম গাছ। এই ব্যস্ততার আঁচ যেন কোনো একটা ছোঁয়াচে রোগের মতো। যে মানুষটা অন্য সব দিনের মতোই অফিস করে ঘরে ফিরছেন। তার অপেক্ষায় তিন কামরার বাসাটা। এক স্ত্রী। ছেলে মেয়ে। মুখে পুরাতন ভাতের স্বাদ। আজকাল ভালো করে তাকালে যিনি দেখতে পান টেলিভিশনটার ওপর শ্যাওলা জমেছে। সেই তার মাঝেও এক ধরণের গোপন উত্তেজনা। কেন। কে জানে। অথচ তার কোথাও যাবার তাড়া নেই। তিনদিনের বন্ধে গ্রামে যাবার মতো বাড়ি নেই তার। আগে ছিলো। বৌয়ের অপারেশন আর ছেলেটার পড়াশোনা। বিক্রি করে দিয়েছেন। তাই তিনি গ্রামে যাচ্ছেন না। সকালে হয়ত বাজারে যেতে হবে। দরাদরি করে কিনতে হবে বাসি মাছ। তবু তার বুকের ভেতরও কেমন মৃদু অশান্তির আলোড়ন- যেন এক বোবা জরুরি অবস্থা। তাই না চাইতেও দ্রুত পা চালান তিনি। যেন এই শহুরে অস্থিরতাকে অতিক্রম করে যেতে চান। যদিও অত কিছু মাথায় নেই তার। তিনি শুধু জানেন- তাকে যেতে হবে। যে করে হোক- যত তাড়াতাড়ি। তিনিটা কে? জালালুদ্দিন। বয়স ৪৭। অনেকদিন তিনি কোথাও যাচ্ছেন না। স্বাধীনতা মিউজিয়াম এত ভোরে কে হবে? চোর-ডাকাত-পাগল? কিছুটা ভয় আর কিছুটা কৌতুহল নিয়ে আরেকটু এগোই। একটা লোক। দেখতে ভদ্র ঘরেরই মনে হয়। শুধু চুলটা উষ্কখুষ্ক। কি যেন কিছু অস্থির ভঙ্গিতে খুঁজছিলেন। এখন পাশের বেঞ্চে ক্লান্তভাবে বসে আছেন। কি ব্যাপার? কি খুঁজছিলেন ওখানে? পাননি? লোকটা আমার দিকে তাকায়। করুণ আর কাতর চোখের দৃষ্টি। না, পেলাম না তো। কি জিনিস? বৌয়ের কানের দুল? হাত ফস্কে পড়ে গেছে? নারে ভাই। সে হতাশ গলায় বলে। যেন বৌয়ের সোনার দুল হারালে কত ভালোইনা হতো। তাহলে? আমার স্বাধীনতা। ঐখানের কাঠের তক্তাটার নিচে চাপা দিয়ে লুকিয়ে রেখেছিলাম। এখন আর পাচ্ছি না। কেউ বোধহয় চুরি করে নিয়ে গেছে। ও কি মশাই। এবার আমার অবাক হওয়ার পালা। কি বলছেন এগুলি। স্বাধীনতা একটা লুকিয়ে রাখার জিনিস হলো নাকি? কিন্তু আমি তো চিরতরে পরাধীন হয়ে গেলাম। লোকটা কাঁদো কাঁদো গলায় মিন মিন করে বলে। যেন নিজেকেই। একটু খারাপও লাগে। আপনি কি এই শহরে নতুন নাকি? জিজ্ঞেস না করে আর থাকতে পারলাম না। হ্যাঁ। এজন্যই এই অবস্থা। অতি চালাকি করলে এমনি হয়। কেন? আপনার স্বাধীনতা কোথায়? স্বাধীনতা কোথায়? প্রাণপণে তাকে ভেংচি কাটার চেষ্টা করি। এত স্বাধীনতার দরকারটাইবা কি? মানে আপনাদের স্বাধীনতা নেই? আহা কী জ্বালা। থাকবে না কেন? আমরা সবাই এই শহরের স্বাধীন নাগরিক। কেন আমাকে দেখে বুঝতে পারছেন না? ভালো করে দেখুন। আগাগোড়া স্বাধীন। লোকটা পা থেকে মাথা পর্যন্ত আমাকে দেখে। কোন জঙ্গল থেকে এসেছে এই গেঁয়ো ভূত কে জানে। কিন্তু আপনারা স্বাধীনতা রাখেন কোথায়? কেন, স্বাধীনতা মিউজিয়ামে। জাদুঘরে? হ্যাঁ। শিশুদের জন্মের সাথে সাথে আমরা তার স্বাধীনতাটুকু জমা দিয়ে দিই। তারপর শহরের সবচেয়ে সুরক্ষিত স্থানে সেগুলো সংরক্ষণ করা হয়। আমি পার্কের ময়লা কোণের দিকে তাকিয়ে হাসি। সেখানে চুরি হওয়ার ভয় নেই, ছিনতাইয়ের ভয় নেই। একেবারে নিশ্চিন্ত। সেটা ফেরত নেন কখন তাহলে? মৃত্যুর পর সবাইকেই তার স্বাধীনতাটুকু ফেরত দিয়ে দেয়া হয়। এই ব্যাপারে মহান মেয়রের বিশেষ নির্দেশ আছে যেন কারো কোনো ধরণের স্বাধীনতা খর্ব না হয়। কিন্তু বেঁচে থাকতে স্বাধীনতা লাগে না আপনাদের? প্লেন থেকে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলেও বোধহয় এত অবাক হতাম না। মহামক্কেল তো আপনি। স্বাধীনতা লাগবে কি জন্য? স্বাধীনতা কি টুথব্রাশ যে প্রতিদিন সকালে দাঁত মাজবেন! তাছাড়া এই যে আপনাকেই দেখুন- যদি হারিয়ে যায়, যদি চুরি হয়। কি দরকার বাপু এতো রিস্কের। তারচেয়ে নিরাপদে ভালোই তো আছে। কিন্তু... আবার কিন্তু কি! স্বাধীনতা ছাড়া কি সমস্যাটা হচ্ছে বলুন শুনি। দিব্যি খাচ্ছি-দাচ্ছি,দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অন্যের স্বাধীনতা চুরি যাওয়া দেখছি- ভালোই তো আছি। লোকটা কিছু একটা বলতে মুখ খুলতে চায়। আমি সরে পড়ি। লোকটা বোধহয় এখন কাঁদবে। কিন্তু কান্না করার মতো কিছু হয়নি। আমি খুব জানি তার স্বাধীনতা কে নিয়েছে। এই মুহূর্তে সেটা কোথায় আছে তাও জানি। এটা তার ভালোর জন্যই। এখন তার স্বাধীনতাও সুরক্ষিত। আর কোনো ভয় নেই তার।

গল্পকার
অনেকে ‘ইনি’ ডাকে। বেঁচে আছেন ঢাকায়। আপাতত একটা চাকরিবাকরি করতে হচ্ছে যেহেতু লিখে টাকা কামানো যায় না। স্বপ্ন দেখার পার্ট টাইম জব করেন।
Facebook Comments Box