
১. আমার কু-প্রস্তাবটি বাকিমহাম প্যালেসে দ্বাররক্ষী বদল হওয়ার সময় কুচকাওয়াজের নীচে পিষ্ট হয়েছিল। বস্তুত , প্রস্তাবটি ঠিক কী ছিল এখনও ঠাওর করতে পারিনি। আমি তখন অ্যালুমিয়াম বাটিতে অ্যাটলির ছুঁড়ে দেওয়া ডমিনিয়ন স্টেটাস নাড়াচাড়া করছিলাম, দুমড়ে যাচ্ছিল আমাদের ছেলেবেলার তে-রঙা পতাকা। --' তুমি আজকাল বড্ড সিনিক হয়ে উঠেছ! এই তো ক'দিন আগে অমৃত মহোৎসব গেল । ' পিছন ফিরে দেখি কেউ কোত্থাও নেই, বিউগল বাজছে। ২. এই তো অ্যাভন নদী। শুনশান গোটা গাঁ। কে কার কবর দেয়! জাহাজের খোল থেকে পিলপিল ইঁদুরগুলি খুঁজে বেড়াচ্ছে জীবিতদের। ঘাড় কাৎ করে বললাম, জানো ---ঠিক সেইসময় স্ট্র্যাটফোর্ড -এর ছোট্ট এই ঘরে, এই যে আমরা ঢুকছি, জন্মেছিলেন লিয়ার । আর এই সেই টেবিল, দোয়াতদানি আর পালকের কলম। সব হারিয়ে এক ঝড়ো অন্ধকারে তাঁর চোখের কর্ণিকায় আলো জ্বলে উঠেছিল। ---হ্যাঁ,তুমি এই বুড়ো রাজাটির গল্প মেয়েকে প্রায়শই বলতে। চলো, আজ আমরা কান পেতে লন্ডন ব্রিজ-পতনের শব্দ শুনি। ৩. কাল যখন একটু শীত শীত করছিল, পেলিকান পাখিদের সঙ্গে হাইড পার্কে তুমি সারা গায়ে সূর্যাস্ত মেখে লবণ হ্রদের বনবিতান হয়ে উঠছিলে ; সামনে সার সার তেঁতুল। পিছনে প্যাগোডা। নৌকাসন শেষে তুমি তখন সবুজ ঘাসের ওপর এক ভুজঙ্গ। অবাক হয়ে দেখি --- ডানা-অলা এক সারস হয়ে উড়ে যাচ্ছ মেঘের ভিতর। গোবর ডাঙার রণজিতের হাতের মুঠোয় তখনও তোমার দেওয়া কমলালেবুর সেই ক'টি কোয়া । বিশ্বাস করো, নীরবতা কখনও কখনও সত্যিই দুঃসহ হয়ে ওঠে। কে যেন লিখেছিলেন আনবিয়ারেবল লাইটনেস অব্ সোলের কথা ! আমরা সেই শীত-সন্ধ্যায় বিয়ারের ক্যান খুলতে পারিনি। ৪. উড়ন্ত নোকার মতো হাওয়ায় ধাক্কা খেতে খেতে উড়ে যাচ্ছিল যে-প্রজাপতিরা আমি তাদের থেকে পাপড়ি নিয়ে বললাম, এই দ্যাখো অন্ধকারে দুধপথের দিকে উঠে যাওয়া আলোর মণিপাথর। তোমার আহ্লাদ হোক যেমন হয়েছিল সেন নদীর বুকে এক দঙ্গল নিষ্পাপ দেবদূতের লুটোপুটি দেখে। কী ঝলমলে এই টাওয়ার-নগরী! রক্তাক্ত দীর্ঘদেহী কান্তিমান এক কবি হয়ে উঠছেন লে মিজারেবল আর নারীরা এক একটি জলপ্রপাত। এই মাটি আর বাতাস থেকে আমি খুঁজে পেতে চেয়েছিলাম শব্দদের রহস্যময় পবিত্রতা। আমাকে রীতিমতো অবাক করে তুমি জিগ্যেস করলে, আর এইসব দ্রাক্ষাকুমারীরা ? --হাঃ, হাঃ , আবস্যাঁৎ ! আমি রাত্রিকে লিখেছি, কিন্তু নরককে তছনছ করে কে আমাকে স্বর্গের বাগানে নিয়ে যাবে! কবিদের রাজা, প্রথম দ্রষ্টা নয়, আমাদের মরে যেতে হবে, ক্রিস্তফ । নতুন করে বাঁচব বলে। হেঁটে যাচ্ছেন শীর্ণকায় দেবতা। আমার না-হয়ে ওঠা এক দেবদূত। এসো, নত্র-দাম গীর্জার সামনে হাঁটু মুড়ে এক দণ্ড নীরব হই--- কবিতা, আমার গথিক স্থাপত্য, এক একটি ক্যাথিড্রাল। ৫. পিছনে পড়ে রইল রদ্যাঁ ও তাঁর নারীদের সুবর্তুল স্তন। তোমার ঠোঁটের কোণে এক ঝলক ঈর্ষা। হয়ত তোমার মনে পড়ল সেদিনটিও ছিল অক্টোবর মাসের এমন এক সন্ধ্যা আর হাসনুহানার মতো মেয়েটি। লুভ্ র্ মিউজিয়ামে গিয়োম আপোলিনের যখন আমার আর এক উঁচু-বুক সুন্দরীর ঘনিষ্ট শট নিচ্ছিল, পাশে মিটমিট করে হাসছিল য়্যাজেন গিলভিক, কারণ তার নারীদের নিতম্ব থেকে জন্ম নিত অরণ্য, তুমি বুঝলে বল্গা হরিণের বাঁকানো শিং-এর মতো রাত্রি এখন মাত্র দ্বিপ্রহর, যদিও সূর্য তখন সাইপ্রেস গাছের মাথার ওপর এক তরুণ যুবক। চার দিকে পাহাড় আর পাহাড়। হানড্রেড ইয়ার্স অব্ সলিটিউড। বরফ টানেল পেরোলেই জংফ্রো, মাউন্ট টিটলিস । টাল খেয়ে পিছলে যেতেই তুমি হাঁ হাঁ করে উঠে হাত বাড়িয়ে দিলে, আঙুল ছুঁতে গিয়ে দেখি আইস-ফ্লায়ার থেকে খোলা চুলে তুমি পা দোলাচ্ছ আর শিমুল আঁশের মতো গুঁড়ো গুঁড়ো তুষার উড়ে যাচ্ছে অনন্ত কুয়াশার দিকে----- ৬. দ্রুত সরে যাচ্ছে ভেড়া, পাল পাল, বিস্তীর্ণ ঘাসের গালিচা, তুমি সবিস্ময়ে হাত ধরে আছ। ---ওই তো টুংটাং ঘন্টা। গাভী কি এঁদেরও মাতা? হ্যাঁ, না , বলা হয় না, মার্সিডিজ বেঞ্চের দু-ধারে হু হু অপস্রিয়মাণ আপেল বাগান আর দ্রাক্ষালতা, চিনার গাছ , ক্যারাভ্যান, গার্হপত্য ও মগ্ন টানেল। এই তো জুরিখ হ্রদ, আল্পসের পায়ের নীচে শান্ত, স্থির ; মেঘের মুকুট পরে মাছশিকারিরা চোখ জ্বেলে বসে আছে খটাসের মতো । মাঝরাতে চাঁদ ওঠে, হিম জ্যোৎস্না বাঙলোর মাথায়। নাম-না জানা বৃক্ষসারি এবং অদূরে কোথাও কি গির্জা আছে? টেরেস থেকে অকারণ পুলকের মতো জেগে আছে চরাচর, অন্ধকারে সমুজ্জল, মুখোমুখি আমরা দু-জন ৭. গুড বাই, গুড বাই টেরেস, ছটপটে মিস বেলমন্ট । আবার রুকস্যাক পীঠে, ইনসব্রাক, লিচেনস্টাইন চকোলেট টুকরোর মতো বয়ে নিয়ে যাচ্ছি , দাও , ট্রলি ব্যাগ সারাটা জীবন বহন করেছ, আজ আমি। ক্রমশ ধুসর হয় হেমন্তের খড়, খেত, সম্পর্কগুলি। দুধপথ থেকে তুমি কুয়াশার মতো নেমে ভাসমান কাঠের শহর দেখছো, ওক ও লার্চের মতো ধরে আছ, বুক পেতে খুঁটি ও পাটাতন ; কোনও পচন নেই, কত যুদ্ধ হয়ে গেল, স্বাস্থ্যবান পায়রাদের দল, যাদের সকালবেলা জানালায় খুদ দিতে তারা এখানে কীভাবে এল ? সমুদ্র পেরিয়ে, এত দূর? হঠাৎ কেঁপে উঠলে কেন? ---জমাট-বাঁধা দীর্ঘশ্বাসগুলি ঘুলঘুলির ফোকর দিয়ে তোমাকেও ছুঁয়েছিল সেতুর ওপর.! ওরা আর দেখবে না এই শহর , গন্ডোলায় চেপে কাটাবে না হেমন্ত-দুপুর। শ্বাসপতনের শব্দে এই দ্যাখো তলিয়ে যাচ্ছে , একটু, একটু স্থাপত্য ও নৌবহর, অ্যাড্রিয়াটিক, ভূমধ্যসাগরে ৮. তুমি আছ । পক্ষকাল, ঋতু, বর্ষ ঘুরে যায়, ফিরে আসে ; অবিনশ্বরতা আমাদের মেধি কাঠ, দেখতে থাকে থাকা ও না-থাকা জুড়ে একটি প্রবাহ ক্রমাগত বয়ে যায় , এবং নারীরা অশ্বত্থের তলে আসে, জল ঢালে, ঊর্বরতা, মাটি। প্রতিটি সুজাতা ভিন্ন, তবু তারা ভিন্ন নয়, রূপান্তরিত রেখে যায় থালাভর্তি আপেলের টুকরো, পেঁপে, পঞ্চস্কন্দ, বেদানাসমেত ৯. হেলে পড়া বেল টাওয়ার, ঐ যে গির্জাটির চূড়া, লণ্ঠনের আলো তুমি সবিস্ময়ে দেখছ। অমিতাভ তত্ত্বদর্শী, ঘর ছেড়েছিলেন। আর আমি দণ্ড ও বাকল ছেড়ে, ভাগ্যিস, অগ্নিকেই আমাদের গৃহপতি স্থাপন করেছিলাম। পাপে তাপে সে ছিল নিকটতম, ডিসেম্বরের শীতেও শ্মশান-চুল্লিতে ছিল, আজও প্রেমের নরম রোদ , আর্নো নদীর পারে পারাপার, হৃদয়ের সেতু, বিশ্বস্ত থাকেনি যারা, তারাও তো চাবি এঁটে ওখানেই ঝুলিয়েছে তালা। কেননা নরক নয়, জান্নাতের দরজা খুলে বারবার দাঁড়িয়েছে নারী। প্রাজ্ঞ ভার্জিল, তাদের প্রেরিত দূত হাত ধরে নিয়ে যায় পতনের শেষ সীমা থেকে। ১০. ---এই সেই টাইবার নদী! দগদগে ঘায়ের মতো, চোখে ঘোর, তুমিও সেদিন বলেছিল , ডুবে যাক গোটা রোম টাইবারের জলে , আসলে প্রেমিক তুমি। সামান্য স্ত্রীলোক এই , হয়ত বা আত্মকেন্দ্রিক। # # হাঁটু ভাঙবার মতো চেয়েছিলে এক আকাশ তারা। --- এহ বাহ্য । ভাসতে ভাসতে দুটি কাঠ। আকস্মিকতাও একটি সম্ভাবনা ; সত্য এই , ছিলে, আছ, শাশ্বত, পুরাণ । আগে বাড়ো, ঈষৎ বাঁ-দিকে , পাহাড়-সংলগ্ন ভ্যাটিকান। মাত্র শহর নয় এটি ; সেন্ট পিটারস্ ব্যাসিলিকা, এখানেই সিস্টিন চ্যাপেল। এই যে দেখছ সূর্য-স্তম্ভ,পিটারের রক্ত লেগে পবিত্র হয়েছে। কষ্ট হচ্ছে ? হাঁটু! এই আমার ডান হাত, আস্তে আস্তে, পা তোলো, বাঁ পাশে রেলিং --- ----ভাগ্যিস, ডোবেনি রোম ! তাই ফ্রেস্কো, টেপেস্ট্রি নরম উলে বোনা। তোমার দক্ষিণ পাণি, মধুমান সূর্য, এই অপরাহ্ণকাল। ----উপরে তাকিয়ে দ্যাখো , সিলিংয়েই ঝুলে ঝুলে মিকেল এঞ্জেলো আদি পাপ, প্লাবন ও ঈশ্বরপুত্রের জন্ম পাথরে লিখেছেন। ----পাথরে কবিতা ! ----শব্দও তো এক একটা নিরেট পাথর। যখন শব্দ কুঁদত কবি, তুমি কখন যে নিঃশব্দে এসে রেখে যেত টি-পট, বোন-চায়নার কাপ, থিন অ্যারারুট। ছেঁড়া কাগজের টুকরো অধিকাংশ দিন মেঝেতে ছড়ানো থাকত,কুটিকুটি, কাঁধে তোমার নিঃশব্দ হাত, অবাচ্যতার অধিক ১১. বেহালা বাজাতেন নিরো, এখানেই, এই তাঁর গোল্ডেন প্যালেস, নীল হ্রদ ; সমবেত কী উল্লাস ! যেদিন ভাঙা হল রাজভবন ,নদীগর্ভ শুষে নিল জল আর উপবৃত্তাকার মাথা তুলে দাঁড়াল বিস্ময় --- অ্যাম্পিথিয়েটার। এক বিশাল বিনোদন, সদ্য খাঁচা খুলে দেওয়া ক্ষুধার্ত সিংহটি যখন কড়মড় দাঁতে গুঁড়ো করছে একটা মানুষ, কিংবা, মুক্তির আশায় সবচেয়ে উত্তেজক ---- কারও হাতে বিষ-অস্ত্র, হাতে ঢাল, কারও হাতে বর্শাদণ্ড, মাছ-ধরার জাল, ক্রীতদাসরা এখানেই, এই সেই কলোসিয়াম,পরস্পরের দিকে ক্রুদ্ধ চোখ, সন্দিহান, মরণপণ লড়াই করেছে। এই দ্যাখো গ্যালারি-শীর্ষ, ডান দিকে। দেখতে পাচ্ছ? রাজা-রানি, সেনেটর ও সম্ভ্রান্তরা এখানে বসতেন। রক্ত দেখে রোমাঞ্চিত, হাততালিতে ফেটে পড়ত, সারি সারি মুণ্ডহীন ধড় । -----বিনোদন ! ----- অন্নময় মানুষের পেটে জ্বলা প্রান্তিক আগুন, তারও তো প্রশম চাই , না হলে আগুন ওঠে মুষ্টিবদ্ধ, সমবেত বিধ্বংসী আগুন, ভেসপাসিয়ান তো গেছিলেন জেরুজালেম, যখন উত্তুরে হাওয়ারা বাড়ছে, নিরো হ্রদের কিনারে বসে শ্বেতহংসীদের মতো নারীদের জলক্রীড়া দেখছিলেন। আগুন নেভাতে এই সুব্যবস্থা, রাজোচিত ; ইহুদিদের প্রাচীন মন্দির লুণ্ঠন করতে হয়, এবং মানবপণ্য চড়া দরে, দাসবাজার, এইসব হত্যাদৃশ্য নান্দনিক, বারো মাস মেলা খেলা ও তেরো পার্বণ। স্তব্ধতা প্রগাঢ় হল। এবং প্রগাঢ় হল। মৃত্যুপুরী থেকে অবান্ধব প্রেতগণ, যাদের কেউ নেই কূলে, পারলোকিক অন্ন ও জলের জন্য হাত বাড়ালেন। ১২. এই তবে ভূর্জ গাছ, ওঁ স্বাহা , তিল ও তণ্ডুল লিখি, দধি ঘৃত, টাটকা ছেঁচা সোম। দুঃখের সরাইখানা, মৃত গাছ, পাথর বইছে বুকে এইখানে ছায়ামানুষেরা। অসংখ্য বরফখণ্ড, ধ্বসস্তূপ ,শনির বলয় জুড়ে ধুলো। পাথর-নির্মিত চত্বর ও গলিপথ, এই যে আমরা হেঁটে যাচ্ছি , গুয়েলফিরা এখানেই যুদ্ধ করেছিল। ----আলিগিয়েরি কোথায় থাকতেন? ----- তিনি আর মানুষ নন, শব্দসেতু, ইনফের্নো থেকে ক্রমে অন্তরিক্ষে নিয়ে চলেছেন। ----তাড়িত কবির মতো মথের ডানায় , কখনও বা হরিণবাহিত চন্দ্ররথে মিথুন-পুরুষ তুমি তাঁর প্রতিবেশি, গিলে খাচ্ছ রাঙা মেঘ, ররফ ও আগুন। ---আজও চোখের কাম, ঘোর তনহা, বারোটি নিদান বেঁধে রাখে--- ফ্লোরেন্সের রাজপথ, উদ্দাম ভেনিস, রাত্রি, নীল নয়নারা। সামনে নদী অ্যাকেরণ, মরুঝড়, অগ্ন্যুৎপাত, নেকড়ে ও চিতা। তবুও সান্ত্বনা এই, শব্দরা অনশ্বর, তাদের তৈজস খুলে দেয় দুধপথ , ষাণ্মাসা উত্তরায়ন

সুধীর দত্ত
সুধীর দত্ত। জন্ম ১২এপ্রিল,১৯৫১ পশ্চিম মেদিনীপুরে। বাংলা সাহিত্যের এক ছক ভাঙা কবি তিনি। ঐতিহ্য আর ইতিহাসবোধের ওপর দাঁড়িয়ে রচিত হয়েছে তার নিজস্ব ভাষামুদ্রা। আত্মখনন ও তার স্পন্দনই যে তার কবিতা,তা তার শব্দ প্রয়োগ ও চিত্রকল্প নির্মাণে স্বতঃপ্রকাশিত। তার কবিতায় পাওয়া যায় ঈশ্বরের প্রতিস্পর্ধী এক স্রষ্টাকে।
Facebook Comments Box