=========================================================

=========================================================
ঢালু রাস্তায় গড়িয়ে পড়া ফুটবলের মতো কয়েকটি ঘটনা বিরক্তিকর ভাবে দাঁত খিচিয়ে বকে যাচ্ছে দুই কানের ভেতর। সময়টা শীতের শেষ। গরম কড়াইয়ে কুরানো নারকেল আর গুড় মেশানো শেষে যেরকম আঠালো ভাব আসে বছরের শুরুতে সেরকম আঠালো গরম ভাব আছে এবার।
বিড়ি ফুঁকার মতো কেউ প্রকৃতির এমন আচরণ দেখে প্রাচীন প্রবাদ কিংবা হেয়ালি আওড়ানোর টান বোধ করলনা, তবে টাকা জমানোর আইডিয়া কষে খোঁজ নিতে লাগল সবচেয়ে ভাল ব্রান্ডের এয়ারকুলার বিজ্ঞাপনের।
এই গরমের ভেতর আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম মোহাম্মদপুরের বিহারি কলোনির একটা মোটর মেকানিকের দোকানের সামনে।
সেদিন জুমার দিন ছিল। মেরামতের জন্য দাঁড়িয়ে থাকা কারগুলোর শরীরে পেপার দিয়ে ব্যান্ডেজ লাগানো হয়েছে। দুইজন ছেলে উর্দুতে, বাংলাতে গোজামিল পাকিয়ে তামাশা করছে একজন মধ্যবয়সী লোকের সাথে।
সেই দুইজনের মধ্যে মেকানিকের দোকানের একজন ছেলে হাতে তেলের কালি নিয়ে কথা বলতে বলতে সেই লোককে দুঙ্গা সালে কুদরত আলি! বলে তেড়ে তেড়ে আসছে।
ছেলেটার তেড়ে আসা দেখে লোকটা মা তুলে কি একটা অশ্লীল তামাশা করতেই হাতের কালি নিয়ে দৌড়ে গিয়ে লোকটার হোলের বিচি চেপে ধরে।
গোঙানি শুরু হয়। জুমার মসজিদের মাইকে বেজে ওঠা খুদবার সাথে গোঙানি, মজে যায়৷
আমি বেশ কয়েকদিন থেকেই ছিচকে চোরের মতো মোহাম্মদপুরের গলিগুলোতে ঘুরে বেড়াচ্ছি ভালো কোন হোটেলের উদ্দেশ্যে। যখন আমার হাতে কোন টাকা ছিলনা তখন কুকুরের মতো চেয়ে চেয়ে দেখতাম গ্রিলের মুরগীগুলো টিপ টিপ আজাবের আগুনে কিভাবে পুড়ে সুস্বাদু হয়ে উঠছে। সাথে চমৎকার একটা রং ধারণ করছে । রাস্তা থেকে দেখি আর বলি থাম তোকে একদিন কোকাকোলার ঢোকে ঢোকে খাব। হিন্দি বিজ্ঞাপনে যেমন শব্দ করে ঢোক মারে তেমন। ব্যস্ত কর্মচারির ফাঁকে তাদের রেখেই ছবি তুলি। নান রুটির চুল্লিটা তখনো গমগম করছে৷ আর ওদিকে বিহারি ছেলেটা এখনো বোধহয় লোকটার হোলের বিচি চেপে ধরে আছে।
তো ছিচকে চোরের মতো যখন এ রোড ও রোড ঘুরে বেড়াচ্ছি তখন ভালো কিছু হোটেল দেখেছিলাম৷ ক্যাম্পের বাজার থেকে বেরিয়ে হাঁটা দি তখন সেই বাজারকে নাসার সদ্য দেখানো হাজার বছর আগের মহাকাশের ছবিটির মতো মনে হয়৷
কিন্তু সেগুলো ছাপিয়ে পেতে থাকি সাজানো তাজিয়ার পদতলে যাই যাই অবস্থায় পড়ে থাকা আগরবাতির গন্ধ।
এত ঝলক তার সারা গায়ে। আলোকসজ্জায় সজ্জিত সারা অঙ্গ যেন নববধূ।
উপবৃত্তির পাওয়া টাকা দিয়ে একটা সাইকেল কেনার ইচ্ছা আছে। সেটাতো হবেই তার আগে যেটার খোঁজে বেরিয়েছি সেটা তো খুঁজে বের করি!
আরে এই রোডেই তো দেখেছিলাম। দোকানগুলো কি সব গায়েব হয়ে গেল নাকি?
ভাবতে ভাবতে দৌড়ে রাস্তাটা পার হলাম। জেনেভা ক্যাম্পের দিকে যে ভীড় সেই লাইন ধরে আবার একটা গ্রিল আর কাবারের দোকান খুঁজতে থাকি। না কোথাও কোন দোকান খুঁজে পাচ্ছিনা।
কিন্তু দিব্যি মানুষ বাজার করছে খাবার কিনছে, বৃষ্টি থেকে বাঁচতে রিক্সায় উঠে পেঁচিয়ে নিচ্ছে নিল পলিথিন।
যা হবার হবে। এই ভ্রম গায়েব হয়ে যাওয়া থেকে পরিত্রাণ আগে জরুরি। বরং আগে একটা ঘুম দেই।
বিকেলের দিকে মুসকানদের চিৎকারে ঘুমটার মাঁজা ভেঙে গেল। আমি এখানে নতুন বলতে যে ঘরে থাকছি সেখানে নতুন। বড় একটা ঘর, আসবাবপত্র নাই। মেঝেতেই বিছানা ব্যাচেলর রুম আরকি৷
ঝগড়াঝাটি চলছিল। থামল, গান শুরু হয়েছে বৃষ্টি আসার মতো।
– এই মুসকান সাউন্ড কমা। ঘরে দুম দুম করে বেজে চলেছে টিভি। আমি জানালার পরদা সড়িয়ে দেখলাম। তারা উপস্থিত দুইজন মহিলা আমার দিকে পিঠ করে কি যেন করছে।
দুইজন মহিলার মধ্যে একজন মুসকানের মা অন্যজন বৃদ্ধা, তার দাদি।
মুসকানের দাদি তার মাকে তার বিরুদ্ধে শাসাচ্ছিল। মেয়েকে এই বয়সে কেউ ফোন দেয়!
মুসকানের মা নরম হয়ে বলল করোনার জন্যই তো, তখন স্কুল বন্ধ ছিল , স্যারেরা বলসে মোবাইলে ক্লাস সেই থেকেই হাতে।
বৃদ্ধা বলল করোনা তো এখন নাই। কাইড়া নিতে পারোনা!
মুসকানের মা চুপ হয়ে যায় । তার চোখ দিয়ে পানি পড়তে থাকে সে আমার দিকে মুখ ঘুরিয়ে চোখ মুছছিল। আমি ভাবলাম এই কথায় কান্নার কি আছে?
সে উঠে দাঁড়ালো। তারপর মুসকানের মায়ের কান্নার কারণ বুঝতে পারলাম। আসলে তারা দুইজন মিলে পেঁয়াজ কাটছিল। অনেকেই বলে তারা বিহারি। কথা কতটা সত্য এই নিয়ে এখন সন্ত্রাসী বাকবিতন্ডায় জড়িয়ে পড়া উচিত না। প্রতিদিন সকালে তাদের চিৎকারে আশপাশের মানুষের ঘুম ভেঙে যায় কথাটা বললে ভুল হবে। কারণ এদের মতোই কয়েকঘর একইরকম ভাবে অভিন্ন কালচারের মধ্যে বসবাস করছে।
তার নাম যে কি এটাও মনে পড়ে না। যতদুর শোনা লোকটা বাবুর্চিগিরি করে ৷ জামাই পেটানোর কলঙ্ক তার ঘাড়ে চেপে আছে। লোকটা জাত বাবুর্চি বড় বড় ডেকে খুন্তি খেলানো যার কাজ, আর এটাতো সামান্য জামাই পেটা। এই কাহিনি করোনার সময়ে ঘটিয়েছিল সে। চারিদিকে হাহাকার তখন কার মাথা ঠিক থাকে মেয়ে নিয়ে বারোমাসি ক্যাঁচাল চুকিয়ে দিল জামাই পিটিয়ে। অবশ্য এখন সব মিটমাট। বিহারিরা খাওয়াতে জোর। জামাইকে খাইয়ে পেটানোর শেষে পটিয়ে নিয়েছে। যাকগে সেসব কথা। ছয়তলা বিল্ডিংটায় তারা চিলেকোঠার তিনটি ঘর নিয়ে থাকে। মোহাম্মদপুরের কানাগলিতে তাদের খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন, তাদের বাড়িটার নম্বর থাকলেও তারা যেখানে বাস করছে সেটা সম্পুর্ণ অবৈধ । বাড়ির মালিক সেটা লুকিয়ে করেছে এতে তার ফায়দা, ঢাকা শহরের মতো এরকম জায়গায় মাথায় পানি, রোদ আটকানোর মতো ব্যবস্থা করলেই লাভ।
পাশের আরেকটা বিল্ডিংয়ে অন্য একটি পরিবার এই বাবুর্চি পরিবারটির মতোই থাকে। আর তাদের ঠিক পেছনে মেথর প্যাসেজ। ঝগড়া লাগলে বুঝতে পারি সে পরিবারটিও বিহারি।
২.
কাহানি আর কেসসার দেখা মেলে মেথর প্যাসেজের পাশে একটা পাইকারি ডিমের ভ্যানের কাছে। তারা ডিম নিয়ে তর্ক করছিল। রিক্সাটা ধরে রেখে মোটা গলায় বলল এই মামা যাবেনা কিন্তু! দাঁড়িয়ে থাকবা নইলে… বুঝছ!
রিক্সাওলা দাঁড়িয়ে থাকে। কাহানি আর কেসসা ডিম দেখতে দেখতে দাম জিজ্ঞাসা করে।
ডিমওলা বলে তোমরা ডিম খাও?
ক্যানরে তোর মনে হয়না আমরা ডিম খাই কি খাইনা!
খাও যদি তো এত বাছাবাছি করছ ক্যান?
এই তুই জানিস শিল্পা শেঠি কয়টা ডিম খায়? ওর ফিগার দেখসোস?
এই দামড়া শরীর লইয়া শিল্পা শেঠি হইবা? (মিচকা হাসি)
এই পোলা হাসে ক্যা, কাহানি?
ওরে ধরে জিজ্ঞেস কর, কেসসা।
এই নিয়ে শুরু হয় তর্ক এবং তালিয়া। কেসসা, কাহিনি আর ডিমওলার মধ্যে।
তর্কাতর্কি দেখার খাতিরে আমি ঠিক দাঁড়িয়ে ছিলাম মেথর প্যাসেজের সাইনবোর্ডটির সামনে। বিশাল প্যাসেজ যেটি ঘেরা আছে গ্রিল দিয়ে। প্যাসেজ বরাবর বিল্ডিংয়ের দুইপক্ষ ময়লা ফেলে। একবেলা ময়লা না ফেললে তাদের কোষ্ঠকাঠিন্য হয়।
প্যান্ট শার্ট পড়া মেথরেরা ভ্যান নিয়ে এসে দাঁড়িয়ে থাকে, ময়লা দেখে, তারপর বিড়বিড় করতে করতে তাদের অভিযানে নেমে পড়ে।
আমি তাজমহল রোডের ম্যাথর প্যাসেজের কথা বলছি। সাইনবোর্ডটি পোস্টারের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পায়নি। যদিও কিছু লেখা পড়া যায়। পড়লে বোঝা যাবে এখানে লেখা আছে –
পরিবেশ পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অঙ্গ ( সবুজ রঙ দিয়ে লেখা )
এ মেথর প্যাসেজ ( বড় বড় অক্ষরে লেখা )
ময়লা আবর্জনা বর্জ্য ফেলা
সরকারিভাবে নিষেধ। ( লাল রঙ দিয়ে লেখা )
নির্মল সুন্দর পরিবেশ রক্ষায়
সকলকে এগিয়ে আসার বিনীত
অনুরোধ করা হচ্ছে। ( সবুজ রঙ দিয়ে লেখা )
সৌজন্যে : ‘ সুখ স্বপ্ন ‘ ( পরিবেশ সুরক্ষা কমিটি )
৩.
ঢাকাতে আসার আগেই জানতাম আমার এক আত্মীয় এই শহরেই থাকে। আমার কলেজ থেকে সামান্য দূরে তার বাসা। শিয়া মসজিদের কাছে বাসে নেমে হেঁটে চলে যাওয়া যায়।
মোবাইলটা থেকে একটা শব্দ এল। কিন্তু এই শিয়া মসজিদের কাছে এত গ্যাঞ্জাম যে বলার কথা নয়। বাস থেকে নেমে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম আমার আত্মীয়ের বাসায়। আত্মীয় বলতে তিনি আমার আব্বুর চাচাতো ভাই। আমরা ছোট থেকেই কাক্কু বলে ডাকি। এবং তার স্ত্রীকে কাকি। আমার কাকি বেটে কালো। কালো হলেও অনেকের কালো রঙটা মসৃণ হয় কিন্তু তার চেহারায় সেই মসৃণতা নাই৷
সারাটাদিন মেকাপের উপর থাকে। তিনি সাংবাদিকতা করেন একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে।
আমার কাক্কু বছরে একবার বিদেশ থেকে দেশে আসেন। তারপর ঢাকা আর গ্রামের বাড়ি মিলিয়ে সময় কাটিয়ে আবার চলে যান। আমি মাঝে মাঝে তাদের বাড়ি যাই। তারা বেশ আদর করেন। বিশেষ করে আমার কাকির মা। তার আদর যেন উথলে পড়ছে। জগতে কত ধরনের যে আদর আছে তা বলা শক্ত। তবে তার কথার স্টাইল দেখে মনে হয়না সে বিধবা।
আমিতো এমনি এসে পড়ে থাকিনা। আমাকে কল করে ডাকা হয়। প্রথম ঢাকায় এসেছি মন খারাপ হচ্ছে কিনা, নানা প্রশ্নের উত্তর তাদের কাছে দিতে হয়।
যতদূর মনে পড়ছে সেটা গোলমেলে বিকেলের ঘটনা। ঘটনাটি হল –
সে বলতে কাকির মা আমার ট্রাউজার টেনে খুলতে চাইলে আমি চমকে উঠি। সে বলে আফ্রিকার মানচিত্রের ভেতর ওটা নড়ছে ! আর এত বিশ্রী গন্ধ কোত্থেকে আসছে, এই তোর শরীরে এত কাঁচা মাছের মতো গন্ধ কেন?
আমি বলি মেথর প্যাসেজের কাছেই আমি থাকি।
সওয়াল জবাব দিতে দিতে আমার ভ্রমঘুম ভেঙে যায়। মুসকানদের চেঁচামেচি শুরু হয়েছে আবার…
আমি জেগে ওঠার চেষ্টা করছি, আসলে ভ্রম – চেষ্টার জগতে আশীর্বাদস্বরুপ।