পার্টি অফিস থেকে ভেসে আসা হৈ-হট্টগোল সন্ধ্যার নির্জনতাকে আছড়ে ভাঙে, যেন কোনো নিগূঢ় ষড়যন্ত্রকে ধূলিসাৎ করে দেয়। অফিসঘরটা সাল্লুর। ঠিক সাল্লুর না, ঘরটা সাল্লুর জায়গার ওপরে নির্মিত। দেড় শতাংশ জায়গাটা বেহাত হওয়ার পর দক্ষিণ বাওচন্ডির কেউ টুশব্দটি করেনি। সাল্লুও না। এই যে বাপ-মার রাখা নামটা বেহাত হতে হতে আবদুস সালামের অপ্রভংশ সাল্লু হয়ে গেছে তা নিয়েও কোনো মানুষকে ও নিজে বা গ্রামের কেউ কোনো দিন কিছু বলেনি।
বাপ-মায়ের রেখে যাওয়া জায়গাটুকু হাতছাড়া হওয়ার পরই বরং গোপনে গোপনে অনেকে সহানুভূতি দেখিয়েছে। এমনকি জিল্লুর পর্যন্ত কণ্ঠস্বর ভারি করে সাল্লুর পিঠে হাত রেখে বুঝিয়েছে; দেশের কাজে, দশের কাজে মাটি দেওয়া লাগে। প্রয়োজনে শরীরের রক্তও দিতে হয়।
দেওয়ার মতো এক-দুই ফোঁটা রক্তও নেই সাল্লুর শরীরে তাই ও ঐ মাটিটুকুই দিয়েছে। আসলে দেয়নি, ওরা নিয়েছে। প্রয়োজনে এই ঘরটাও নিবে। দল বড় হবে, অফিসও বড় হবে। সবিস্তারে কেউ বুঝিয়ে না বললেও ওর কিছুই করার নেই বিষয়টা বুঝেই পার্টি সদস্যদের হৈ-হুল্লোড়, মাইকের কর্কশ আওয়াজকে মেনে নিয়েছে সাল্লু। আজ অবশ্য মাথা গুঁজে মেনে নেওয়া নয়, ঘাড় উঁচু করে, কানের লতি প্রসারিত করে শোনার চেষ্টা করছে কী বলছে ‘তোমার আমার নেতা’ ‘জনগণের নেতা’ জিল্লুর।
বক্তার বেশিরভাগ বক্তব্যই ঘুরে ফিরে বহু বার শোনা হয়ে গেছে, আজ কেবল ‘জনশুমারি’ শব্দটা বুঝতে পারছে না বলে চালাঘর থেকে এক পা দু পা করে পার্টি অফিসের দিকে এগিয়ে যায় সাল্লু। ওর পায়েপায়ে হাঁটে ওর মতোই চিমসে দেহের একটা ছাগল। ছাগলটার নাম, বাদশা। সাল্লুর সর্বক্ষণের সঙ্গী সে। দেখেশুনে সঙ্গীর জন্য ওজনদার একটা নাম রেখেছে সাল্লু, নিজের নামটা লোকমুখে বিকৃত হয়েছে বলে ওর প্রতি অবিচার করেনি।
দুজনেই ভেতরে ঢোকার সাহস পায় না। মিটিং শেষ হয়ে গেছে। লোকজন অফিসের বাইরে দাঁড়িয়ে বিড়ি-সিগারেট ধরাচ্ছে। অফিসঘরটা পাকা হয়নি এখনো। টিন দিয়ে কোনোরকমে ঘর দাঁড় করানো হয়েছে। চাঁদা তোলার কাজ চলছে, অচিরেই পাকা দালানের কাজ শুরু হবে। মাঝেমধ্যে জিল্লুর সাল্লুর কাছেও চাঁদা চায়। ভাই রসিকতা করছে বুঝেও ড্যাবড্যাব করে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। ওর বিহ্বল ভাব দেখে জিল্লুর শরীর কাঁপিয়ে হাসে আর বলে, ‘যা, গায়ে-গতরে খাইটা দিস।’ ঐ কাজটা ভালোই পারে সাল্লু তাই ভাইয়ের কথা মেনে নিয়ে ঘাড় নিচু করে স্বস্তির হাসি হাসে। দৌড়ে গিয়ে পার্টি অফিসের লোকজনের বিড়ি-সিগারেট এনে দেয়। অফিস ঘর ঝাড়ু দিয়ে দেয়। গতকাল অফস ঘর সংলগ্ন কাঁচা পায়খানাও পরিষ্কার করে দিয়েছে। প্লাস্টিকের বোতলে করে নীল রঙের বিষ এনে দিয়েছিল জিল্লুর ভাই। ব্রাশের ডগায় লাগিয়ে ঘষে ঘষে ফেনা তুলে ঝকঝকা করেছে। কাজ শেষে প্লাস্টিকের থলেতে করে খানিকটা নিয়েও এসেছে। এই বিষ দিয়ে ঘরের কী পরিষ্কার করবে তা এখনো ভেবে ঠিক করতে পারেনি। নিজের প্রয়োজনে এখনো ঝোঁপ জঙ্গলেই যায় সাল্লু। পেটের ভেতরে গুম গুম করে ওঠে আচমকা। আজকের সকালের খাওয়াটা ভালো হয়নি। কী করা যায় ভাবতে ভাবতেই দেখে ওকে জিল্লুর ভাই হাতের ইশারায় ডাকছে।
‘কী রে কিছু বলবি?’
ঘাড় দুদিকে নাড়িয়ে হাতের মুঠোতে গুটিয়ে রাখা সাতফুটি দড়িটা ধীরে ধীরে ছাড়ে সাল্লু। দড়ি আলগা পেয়েও দূরে না গিয়ে সাল্লুর পায়ের কাছে মুখ রেখে মাটি থেকে কী একটা খুঁটে খেতে থাকে হাড়সর্বস্ব বাদশা।
মালিকের সঙ্গে পোষাপ্রাণীটার সাদৃশ্য দেখতে পেয়ে হাসিই পায় জিল্লুরের। জননেতাকে হাসতে দেখে সাল্লুও হাসে। ওর হাসিমাখা কিম্ভুত মুখশ্রী দেখে বাদশা কী বোঝে কে জানে, ম্যা ম্যা শব্দ করতে করতে চঞ্চল হয়ে ওঠে। দড়ি সামলাতে গিয়ে টালমাটাল হয়ে যায় সাল্লুর পা জোড়া। কতদিন ভাত খায়নি কে জানে। ছাগলটার তো দিনে তিনবেলা ভাত না হলেও চলে। মানুষের চলে না। সাল্লুর চলে। সাল্লু কচু, লতি, শাক-পাতা তুলে সেদ্ধ করে লবণ মরিচে চটকে ভাতের সঙ্গে খায়। চাল বাড়ন্ত বলে দুদিন ধরে ট্যালট্যালে জাউয়ের সঙ্গে লবণ গুলে খাচ্ছে। আজ ভাত খেতে পারবে, এক বাড়িতে রোজ খাটার ডাক পেয়েছে। বাদশাকে মাঠে দিয়ে ঐ বাড়ির পথেই হাঁটা ধরে সাল্লু।
সেখানে গিয়েই শোনে জনশুমারির বিত্তান্ত। শুনতে শুনতে সাল্লুর পলকা বুকের ছাতি স্ফীত হয়ে আসে। এতদিন গ্রামের কেউ ওকে গোনায় ধরেনি, এবার ধরবে; সেই ভাবনায় শুষ্ক চামড়ার নিচে ধুকপুক করতে থাকা হৃদপি-টা বারবার উল্লাসের সংকেত দিচ্ছে।
কাজ সেরে নগদ তিনশ টাকা পেয়েছে সাল্লু। উঠানজুড়ে সবজির আবাদ করবে জিল্লুরের বউ, তাই সাল্লুকে দিয়ে জংলি ঘাসলতা পরিষ্কার করিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করিয়ে নিয়েছে। আজকাল কামলারা কাজে ফাঁকি দেয়, ঢিলাঢালা কায়দায় কাজ করে বোঝায় এক রোজে হয় না। এদিক থেকে সাল্লুর ওপর ভরসা করা যায়। জীর্ণ শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে কোদাল দেয় মাটিতে, নিড়ানি দিয়ে ঘাসের শেকড় অব্দি উপড়ে ফেলে। কাজ শেষে যা দেওয়া হয় তা হাতে নিয়ে পরিতৃপ্ত ভঙ্গিতে হাসে।
কাজ থেকে ফিরে গৃহস্থালি কাজ সারছে সাল্লু। চুলায় ভাত ফুটছে। ভাত না ঠিক, হাঁড়ির গলা পর্যন্ত পানি দিয়ে তাতে দুই মুঠ চাল দিয়েছে। খাওয়ার আগে এতে খানিকটা লবণ দিয়ে দেবে। এরপর জুড়িয়ে এলে আঙুল দিয়ে নেড়ে চেড়ে এক চুমুকে খেয়ে নিবে সবটা। জাউয়ের চেয়েও পাতলা এই খাবারের উদ্ভাবক সে নিজে। এই জিনিস পেটে পড়লে পেট ভার হয়ে থাকার আরাম লাগে। সমস্যা একটাই, এটা খেলে পেট যেমন দ্রুত ভার হয়, তেমন তলপেটও দ্রুত ভার হয়। ঝোপের আড়ালে দাঁড়িয়ে একবার সেই ভার কমিয়ে এলে পুনরায় ফাঁকা হয়ে যায় পেট।
আজ পরিশ্রম গেছে বেশি, পেটের তাগিদও বেশি। অথচ খাবারের জন্য বেশি আয়োজন করতে পারেনি। জিল্লুরের বাড়িতে কামলা দিয়ে ফেরার পথে সাল্লু হেফজখানা থেকেও ঘুরে এসেছে। ফাঁক পেলে দক্ষিণ বাওচন্ডি প্রামানিকপাড়া হেফজখানাতেও কাজ করে ও। এই ঝাঁড়মোছ দেয়, বাজার করে আনে। বাজারে গিয়ে আজ নিজের জন্য কয়েকটা জিনিস কিনতে গিয়েই খাবারের খরচায় হাত দিতে হয়েছে।
বহু অবাস্তবতার ভেতর দিয়ে আজ বহু পথ হেঁটেছে সাল্লু। চাল-ডাল-তেল-নুন কম কিনে একটা শার্ট, এক শিশি নারিকেল তেল আর চিরুনি কিনে ঘরে ফিরেছে। ঘরে ঘরে সরকারি লোক যাচ্ছে। আদব-লেহাজের সঙ্গে নিজের সব তথ্য দিতে হবে। ওর ঘরেও সরকারি লোক আসবে। সাল্লুর মাথা গুনবে, ওর কী আছে না আছে সব বিত্তান্ত নিবে, এ সময় যদি ও ঘরে না থাকে তবে তো মুশকিল। সাল্লু তাই নতুন শার্ট পরে চুলে তেল দিয়ে পরিপাটি হয়ে জনশুমারির দায়িত্বে থাকা সরকারি লোকের জন্য অপেক্ষায় থাকে।
সেই শৈশবের মতো অপেক্ষায় থাকে। পনেরো বছর আগে মা ওকে ছেড়ে চলে যাওয়ার পরও বছরের পর বছর ধরে সাল্লু মায়ের জন্য অপেক্ষায় থেকেছে। মা ভাত বসিয়ে বলেছিল অন্ধকার নামার আগেই আসবে, আসেনি। পরে শুনেছে কোন এক লোকের সঙ্গে বেগে গেছে।
পরের দিন আবদুস সালাম ওরফে সাল্লু কাজে যায় না। চুলে আধাশিশি তেল দিয়ে ঘরের দরজার সামনে বসে থাকে। পার্টি অফিস থেকে আনা নীল রঙা বিষটুকু পানির সঙ্গে গুলে ঘরের সামনের ফাঁকা জায়গাটা ভালো করে ঝাঁট দিয়ে জীবাণুমুক্ত করে। আর অপেক্ষায় থেকে থেকে রাঁধে, বাড়ে, খায়। মাগরিবের পর থেকে দক্ষিণ বাওচন্ডি গ্রাম নিথর হয়ে যায়। সাল্লুর দেহও নিথর হয়। ও মৃতের মতো ঘুমায়। পরের দিন সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে আবার সজীবতা পায় সাল্লুর পলকা দেহ। ও হাতের তালুতে তেলের শিশি উপুড় করে অবশিষ্ট তেলটুকু ঢেলে নিয়ে উসকোখুসকো চুলে মাখে। কচি পাতা রঙা শার্টটা পরে বুক পেট সমান করে হাত বুলিয়ে নেয় কয়েকবার। তারপর ফের অপেক্ষা করে।
পরের দিনও সাল্লু কাজে যায় না। ঘরের দরজার সামনে বসে সেই শৈশবের মতো অপেক্ষায় থাকে।