সবই তো দখল হয়ে যাচ্ছে। হিমযুগীয় বরফরাত নেমে আসছে। এমন হয় না, কোনো স্বপ্নের ভেতরে আরও অনেক স্বপ্নের কানাগলি খুলে যাচ্ছে?! কানাগলি। পথ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে অনিবার্য বিরতিহীন পথ থেমে যাচ্ছে। অথচ কানাগলির ভাঙা স্ট্রিটলাইট চুপ। স্ট্রিটলাইটে হিম মাখানো সময় চুপ। শুধু বরফের মতো শান্তি নেমে আসছে। স্বপ্নের ভিতরে চিৎকার করতে চেয়েও কোনও টুঁ-শব্দ নেই। ইউএপিএ-র মতো বরফমাখানো ফাঁস গলায় চেপে বসছে মুখে কালো কাপড় পরিয়ে দিচ্ছে কেউ। কানাগলি পেরোলেই দিগন্তপ্রসারী মাঠ। কানাগলির নির্বাক পাতলা দেওয়াল ভেঙে একবার ওদিকে গেলেই আরও স্বপ্নের আলো সব শৈত্য কাটিয়ে দেবে। কিন্তু সেই নিশ্চিত বসন্তে পৌঁছানোর আগেই অনিশ্চিত আলোগুলো নিকষ ধূসর বরফে ঢেকে যাচ্ছে। পালাবার নেই কোথাও। কিন্তু এতদূর ছুটিয়ে এনেছে এনআরসির মতো হাওয়া। সে হাওয়ার প্রতিটি সূঁচের অক্ষর বিঁধে যাচ্ছে অস্তিত্বের পরতে পরতে। খুবলে নিচ্ছে স্থিতি। দৌড়তে তো হবেই। কিন্তু, সেই দৌড়ের সময় হাততালি দিচ্ছিল কারা, সেই হাততালিতেও শব্দ নেই কোনও। ধূসর বরফের শান্তিতে সেই হাততালিতে মিশে যাচ্ছে হিংস্র উল্লাস। আশেপাশে ছুটছিল যারা, তারাও কখন যেন বরফ হয়ে যাচ্ছে। মাছের আড়তে বরফের ভেতরে শোয়ানো খোলা-চোখ মাছের মতো অভিব্যক্তি নিয়ে তারা শান্তিতে ছটফট করতে করতে বরফ হয়ে গেছে। শীত ও শান্তির যুগলবন্দি কবিতার সঙ্গে মালকোষের মতো খাপ খেয়ে গেছে। ওই যারা ছুটছিল, যারা বরফ হয়ে যাচ্ছে, তারাও এবার ঝরে পড়ছে আরও গাঢ় শান্তি বাড়াতে। কেউ কেউ ছন্দ পেয়েছিল, কেউ কেউ গদ্যকবিতা। সেসব দিয়ে বরফ বানিয়ে বানিয়ে এ-ওর গায়ে ছুঁড়ে মারছে। কী সতেজ হিংস্র খেলা! যারা দৌড়চ্ছিল ওই সংখ্যালঘুর বিপন্নতার মতো ঘনিয়ে আসা সন্ধ্যেজুড়ে, তাদের গায়ে ছুঁড়ে মারছে এইসব বরফকবিতা বরফগদ্য বরফগল্প উপন্যাস। শান্তির জন্যেই তো এত লেখা। এত এত লেখা রোজ লেখা হচ্ছে তারা বরফ হয়ে যাচ্ছে বিষণ্ণশবের মুখ ঢেকে দিচ্ছে- এই সব শান্তি আর নিরিবিলি দখল ক’রে নিচ্ছে সব পথ। কোনও চিৎকার নেই, আর্তনাদও না। এমন শান্তিই তো বহুযুগ আরও ঘুম পাড়িয়ে দেবে
#
“A single non-revolutionary weekend is infinitely bloodier than a month of permanent revolution”
এই তো সময়। এমন সময়ের জন্যেই তো এত স্তব আর প্রার্থনার উপচার জমা ছিল। কাগজে বিজ্ঞাপন ছিল, ‘শব্দ থাকুক কাগজের পাতায়, দেশ থাকুক শান্ত’। কফিশপের বিজ্ঞাপনে- ‘তুফান উঠুক চায়ের কাপে, শহর হোক শান্ত’। শান্তি সবচেয়ে আকাঙ্খিত ছিল। শান্ত থাকার চেয়ে বড় চরিত্রগুণ কীই বা হতে পারত আর। অথচ তার আগে প্রতিক্রিয়া ছিল। ক্রোধ, শোক, হাসি, ভয় সবকিছুর প্রকাশ ছিল। তাতে শব্দ হত। দৃশ্য তৈরি হত। দেশের সেনা প্রতিরক্ষার নামে ঝাঁ-ঝাঁ ক’রে বুলেট ছুঁড়ে নাগরিকদের মেরে দিলে শোকে পাথর হয়ে যেত প্রতিবেশীরা। সেই নৈঃশব্দের নাম ছিল দেশভক্তি। কোনও বামুন প্রকাশ্যে দলিতকে জ্বালিয়ে দিলে ক্রোধে টালমাটাল হয়ে উঠত অনেকে। সেই পোড়া গন্ধকে সনাতন নামে ডাকা হত। কর্পোরেট আর শাসকের যুগলবন্দী জল-জমি-নারী-শিশুদের বেঁধে হিঁচড়ে টেনে নিয়ে গেলে বাধা দিতে ছুটে আসত অনেকে। সেই দৃশ্যের নাম ছিল গণতন্ত্র। সেই যেবার দ্রোহী হওয়ার অপরাধে ছাব্বিশ জনকে সার বেঁধে দাঁড় করিয়ে গুলি ক’রে দিল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আর তাকে অখণ্ডরাষ্ট্র নাম দিল, সেবারও ছুটতে শুরু করেছিল অনেকে। তাদের পায়ের শব্দ কিংবা আরও অনেকের পায়ের শব্দ এত বেড়ে গেছিল বলেই ‘শান্তি চাই’ বয়ানে রচনা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছিল কর্তৃপক্ষের তরফে। শান্তি নামানোর শান্তি ঝরানোর যত ভাল উপায় যে লিখবে সে তত নম্বর পাবে, দশের মধ্যে সাত, আট, সাড়ে আট, নয় পঁচিশ। নয় পঁচাত্তর যে পেয়েছিল, বরফঝরা শান্তির কথা সেইই লিখেছিল। “ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ ব্যতিরেকে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সময় যেমন শান্তি বিরাজ করে, তেমন শান্তিই কাম্য। প্রবল শৈত্য আর ভীষণ বরফে ঢেকে থাকা দিনরাতে অবর্ণনীয় নৈসর্গিক শান্তি ফোটোজেনিক হয়…” এমন শান্তির বিকল্প এসেছিল ভার্চুয়ালে। প্রিয়জন মরলে স্যাড রিয়াক্ট, শত্রুর অঙ্গহানিতে হাহা রিয়াক্ট, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার উস্কানিতে অ্যাংরি রিয়াক্ট কিংবা কাউকে ল্যাং মেরে খাদে ফেলে দেওয়ার আগে কেয়ার রিয়াক্ট। না, এইসব রিয়াক্টে শব্দ ছিলনা কোনও। শান্তির সহজপাঠ। সত্যি সত্যি রেগে ক্যালোরি খরচ নেই, সত্যি শোকের শরীরখারাপ নেই, এমনকি সত্যি হাসির উত্তেজনাও নেই। শান্ত থেকে খুব শান্তির ভেতর ডুবে থেকেও রিয়াক্ট ক’রে দেওয়া যায়। সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়েছিল লাভ রিয়াক্ট। হ্যাঁ, ভালবাসার শব্দও অসহ্য হয়ে উঠছিল তখন। দু’জন মানুষের আদরে সামাজিক শান্তি বিঘ্নিত হচ্ছিল। চুমুর উত্তেজনা সহ্য করতে পারছিল না রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ। তাতেও কেমন যেন দ্রোহের গন্ধ লেগে থাকত। লাভ রিয়াক্টে সেসব বালাই নেই। তারপর এল নিরপেক্ষতা। কী আশ্চর্য প্রশান্তি তাতে! নিরপেক্ষতা মাপার দাঁড়িপাল্লা পৌঁছে দেওয়া হল ঘরে ঘরে। প্রাক-হিমযুগীয় ঘনদিনে নিরপেক্ষতাই হয়ে উঠল নির্বিকল্প সিডেটিভ। এমন আরও আশ্চর্য সব উপায় বেরোল। তাতে কারোর আর জেগে ওঠা থাকল না। শান্তির জলের মতো পবিত্র হয়ে গেল শাসক। তুলসীপাতার মতো স্নিগ্ধ পূত হয়ে গেল আদেশনামা।
#
“Politics is war without bloodshed while War is politics with bloodshed”
স্থিতাবস্থা। নিরবচ্ছিন্ন স্থিতাবস্থায় বরফ পড়ে শুধুই। মেঘ-মেঘ আকাশ। এত শৈত্যপ্রবাহ যে, পাশের মানুষটির দিকে হাত বাড়ানো যায় না। প্রতিবেশী নিজেকে কুঁকড়ে মুড়ে নিয়েছে শীতঘুমে যাবে বলে। অথবা ঘন কুয়াশার মতো নেমে আসা নির্জন নৈঃশব্দের শান্তিতে তাকে আর খোঁজা যায় না। খোঁজার তাগিদও কি খুব? সে হয়তো ফিরে আসেনি আর দূরে কোথাও কাজ করতে গিয়ে, কিংবা কোনও সংকটে ম্লান হতে হতে মিলিয়ে গেছে কবেই। বরফ হয়ে গিয়ে ঝরে পড়ার অপেক্ষা করছে। অনেক দূরে আবারও কোনও ব্রাশ-ফায়ারিং। হয়তো ঘরের পাশেই। ‘গড়চিরৌলিতে চল্লিশ জন কমিউনিস্ট খতম’- এনকাউন্টারের মতো স্তব্ধ দুপুরে কর্ডাইটে ঝলসানো হাওয়া জানিয়ে গেল। স্থিতাবস্থার শান্তি বেড়ে গেল আরও। কোনও এনআরসি মাখানো বিকেলে প্রাণভয়ে দৌড়ানো মানুষের পায়ের আওয়াজে হাতড়িয়ে দেখে নেওয়া গেল নিজেদের রাষ্ট্রভক্তির পরিচয়পত্র যথাযথ কিনা। তারপর বিরক্ত অবসরে কিছু শিল্প বরফ মাখিয়ে ছিটিয়ে দেওয়া গেল দোরের বাইরে। শান্তিকে নিষ্কণ্টক করা গেল। তুমুল হিমযুগীয় বরফদিনে দরজায় ‘নিরপেক্ষ’ বোর্ড টাঙিয়ে নিয়ে ধ্রুপদী আমেজ আনা গেল। সাত দুনিয়ার যাবতীয় ভোগ্যপণ্য ঘরের মধ্যে আদর্শ শান্তির আবহ নির্মাণ ক’রে নিয়েছে। প্রশান্তি ছেয়ে আছে ঘরদোর ব্যেপে। কোথাও আর উত্তেজনা নেই, প্রতিক্রিয়ারা শান্ত, ‘জেগে ওঠা’ অভিধানে থিতু শুধু। আর, প্রতিবাদ শব্দটা শব্দাশ্ম হয়ে সেই সব গাছে গাছে লেগে আছে যেগুলোতে রাজনৈতিক লেখাগুলোকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে পুরু বরফ মাখিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আর মাত্র কয়েকদিন বা কয়েকবছর পরে সেই সব গাছগুলোতেও পুরু বরফ ঢেকে দেবে সমস্ত সম্ভাব্য-জাগরূক ইতিহাস। যুদ্ধের সব সম্ভাবনা মুছে ফেলে স্থিতাবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। উষ্ণতা নেই কোনও। স্যাঁৎস্যাঁতে বরফ-বরফ দিন দখল হয়ে গেছে। হিমযুগীয় বরফরাত বিকেল-সন্ধ্যে-দিন-ভোর আলাদা ক’রে বুঝতে দিচ্ছে না আর। ঘুম। ঘুমের ভিতরে স্বপ্ন মাখো মাখো সোহাগে দিল্লগি করতে করতে আরও খোয়াবের পথে ঢুকে যাচ্ছে। হঠাৎ ছোটার শুরু। হঠাৎ কোনও বিপন্ন হাওয়া বয়ে আসছে উচ্ছেদযন্ত্রণার মতো লুকোনো ব্যথাপাঁজর খুলে। আরও অনেক স্বপ্নের কানাগলি খুলে যাচ্ছে?! কানাগলি। পথ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে অনিবার্য বিরতিহীন পথ থেমে যাচ্ছে। অথচ কানাগলির ভাঙা স্ট্রিটলাইট চুপ। স্ট্রিটলাইটে হিম মাখানো সময় চুপ। শুধু বরফের মতো শান্তি…