গত কয়েকদিন ধরে একটা পাগলা ভাবনা আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। হঠাৎ যদি আমি হাওয়া হয়ে যাই, তা’হলে কী হতে পারে ? কী কী হতে পারে ? ভাবছি, আর সব কিছু গুলিয়ে যাচ্ছে, থই পাচ্ছি না। কী কী কাজ এখনও বাকি, শেষ করে উঠতে পারি নি ? তার একটা পরিসংখ্যান তৈরি করতে গিয়ে অকুল পাথারে পড়লাম।
আমার অর্ধাঙ্গিনী—আমার কোন ব্যাঙ্কে, পোস্টাপিসে ক’টা আকাউন্ট আছে বা তাতে কত টাকা, ফিক্সড ডিপোজিট, সাংসারিক খরচাপাতি, দান-খয়রাতি কী বা আর কোনো পোষ্য আছে কিনা এই সমস্ত ব্যাপারে তার বিশেষ আগ্রহ নেই। ব্যাঙ্কের লকারের চাবি কোথায় রাখি তাও তিনি জানেন না। এমন কী, তাঁর নিজের ব্যাঙ্ক আকাউন্টের টাকা তোলা বা হিসেব রাখা আমাকেই করে দিতে হয়। সকালে উঠে তিনি আমাকে আমার দৈনিক কর্তব্যের ফিরিস্তি দিয়ে দেন, সে কাজগুলো হয়ে গেলেই আমার দায়িত্ব শেষ। তবে তাঁর একটা বিশেষ দায়িত্ব পালনের ভার আমার ওপর ন্যস্ত—তিনি অন্য কাউকে, এমনকি নিজেকেও এ ব্যাপারে বিশ্বাস করেন না। প্রতি সোম ও বৃহস্পতিবার ইষ্টদেবতার ফুলমালা আমাকেই এনে দিতে হয়, সোমবার বেলপাতা কম হলে বা বেস্পতিবারে জবাফুল নিতে ভুলে গেলে তিনি খড়্গহস্ত হয়ে ওঠেন।
আমি এক পুত্র ও এক কন্যার পিতা। চাকরিসুত্রে তারা দুজনেই অন্যত্র, বাংলার বাইরে। দূরে হলেও, আমার ওপর তাদের নির্ভরতা একটু বেশি মাত্রায়। তাদের ইনকাম টাক্স, ইনভেস্টমেন্ট, ইনসিওরেন্স সবকিছুই আমার হাতে। আমি কখন কোথায় থাকি, এই গরমে বা বৃষ্টির মধ্যে কেন বারবার গ্রামের বাড়ি যাচ্ছি, খাওয়া-দাওয়া সময়মতো বা ওষুধ নিয়মিত খাচ্ছি কিনা এই নিয়ে তাদের ভালোবাসার চোখরাঙানি প্রতিনিয়ত। কেউই এখনও বিয়ের গাঁটছড়া বাঁধেনি। কন্যা বড়, সে এতদিন পড়াশোনায় ব্যস্ত ছিল, সবেমাত্র সম্মতি দিয়েছে। কথাবার্তা, দেখাশোনাও চলছে অল্পবিস্তর, তার দায়ভার আমার, সমস্ত তথ্যও আমার কাছে। আমার স্ত্রী শুধু জানেন যে আমি এই ব্যাপারে উৎযোগ নিয়েছি।
আমাদের পারিবারিক পরিসরটি বেশ বড়। মূল ভিটেমাটি হুগলী জেলার প্রত্যন্ত গ্রামে। আমি সেখানেই জন্মেছিলাম। জীবিকার কারণে আমার বাবা-কাকারা শহরে চলে আসেন এবং থিতু হবার পর হাওড়ার শিবপুরে একটি স্থায়ী আস্তানা গড়ে তোলেন—যেটি আমাদের দ্বিতীয় পৈত্রিক নিবাস। আমরা অনেকগুলি ভাইবোন, এছাড়া কাকা-জেঠা-পিসি ও তাদের সন্তানসন্ততিদের সঙ্গে যৌথ-পরিবারে আমরা মানুষ (বা অমানুষ) হয়েছি। বাড়বাড়ন্ত সংসার— আমরাও কেউ কেউ আস্তে আস্তে সমর্থ হলাম, স্থান সংকুলানের জন্য কালক্রমে কাছেপিঠে আস্তানা গেড়ে আমাদের বিচ্ছিন্ন হতে হল। কিন্তু আমাদের পারিবারিক বন্ধন তাতে কিছুমাত্রায় ক্ষুণ্ণ হয় নি। এই মুহূর্তে আমি পরিবারের জ্যেষ্ঠজন, পরিবারের কোনকিছু সিদ্ধান্তে আমার মতামত অনেকাংশে গ্রাহ্য—এই বৃহৎ পরিবারের অধিকাংশ পরিজন আমাকে সেই আসনটি দিয়েছে।
চাকুরিজীবন থেকে অবসরগ্রহণের পরে, আর একটি বন্ধনে আমি আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেছি—সে আমার জন্মভিটে, আমার গ্রাম। আটাত্তরের বন্যায় ভেসে যায় আমাদের বাস্তুভিটে, সেই ভগ্নস্তূপ সাফ করে উত্তর প্রজন্মের আমরা গড়ে তুলেছি একটি আশ্রয়—পিতৃপুরুষের স্মরণসৌধ, ফুল ও ফলের বাগান। যখন কিছুই ভাল লাগে না, ছুটে চলে যাই সেই প্রত্যন্ত নিবিড় ছায়ায়। সেই জনপদের প্রতিটি মানুষ আমার প্রিয়জন, পরম আত্মীয়—তাদের সুখেদুখে সঙ্গী হয়ে আমি তৃপ্ত হই, তাদের ছোট ছোট প্রত্যাশাপূরণের শরিক হওয়ার আনন্দ উপভোগ করি।
আমার আত্মজন, আমার বৃহত্তর পরিবার, আমার গ্রামের পরিজন—এদের প্রত্যাশা আর আমার ওপর নির্ভরতাই আমার ওপেন এন্ট্রিজ্—আমার জীবনের উদ্বর্তপত্র, বেঁচে থাকার রসদ।
২
ওপেন এন্ট্রি হিসাবশাস্ত্রের একটি পরিভাষা। ব্যবসায়ের দায় ও সম্পদের সময়ান্তিক স্থিতিপত্রের এক-একটি উপাদানকে ওপেন এন্ট্রি বলা হয়—বাংলায় অসমাপ্ত লেনদেন বলা যেতে পারে। তথ্যপ্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে এই পরিভাষার ব্যবহারিক বিবর্তন লক্ষণীয়।
বিংশ শতাব্দীর আশির দশকের শেষভাগ থেকে অর্থনীতিতে বেশ কিছু ওলটপালট শুরু হয়ে যায়। বিশালাকৃতির মেনফ্রেমগুলো সংগঠনের রসুইঘর থেকে বেরিয়ে ঠেলাগাড়ি চেপে চলে গেল পুরোনো লোহালক্করের দোকানে—তার জায়গায় শিল্পিত মডিউলার কিচেনের মতো ছোট্ট কামরার ডেস্কে এসে বসে পড়ল ক্ষমতাসম্পন্ন সার্ভার। এ-দিকে টাইপ-রাইটারের দিন শেষ—পার্সোনাল কম্পিউটার অনেক কম সময়ে তার চারগুণ কাজ করে দিচ্ছে। শেষ দশকে বিশ্বায়নের শুরু আর এই সময় থেকেই ব্যবসাবাণিজ্যের চরিত্রও বদলাতে শুরু করল। যে সমস্ত সংগঠনগুলো এতদিন ছিল বরাত-নির্ভর একচেটিয়া কারবারী, বছর-শেষের খাতায় চলমান সম্পদ প্রায় থাকতই না, তাদের এবার নড়েচড়ে বসতে হল। এতদিনের ‘ফ্যালো কড়ি মাখো তেল’-এর সুবিধে লোপাট—মাল ছাড়ো কম রেটে, কড়ি পাবে পরে, কারণ বিশ্ববাজারের প্রতিযোগী দরজাগোড়ায় দাঁড়িয়ে। এই সময় থেকেই দক্ষ কার্যকরী মূলধন সঞ্চালনা ব্যবসা পরিচালনার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠল। উপভোক্তার থেকে পাওনা আর বিক্রেতার কাছে দেনার মধ্যে সামঞ্জস্য-সাধন, পাওনা, উৎপাদিত সম্ভার ও কাঁচামালের বয়স-বিশ্লেষণ সংগঠনের আর্থিক অবস্থা নিরূপণে বিশেষ ভূমিকা নিল। বয়োবৃদ্ধ বকেয়াকে অপরিশোধ্য ঘোষণা, অতি পুরোনো অব্যবহার্য সম্ভারকে আবর্জনীকরণ, সবকিছুই ওপেন-এন্ট্রির এক-একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে সংজ্ঞায়িত হল।
তারপর বেশ কিছু মাল্টি-ন্যাশনাল ব্যবসায়ীর হাত ধরে এসে গেল এন্টারপ্রাইজ রিসোর্স প্ল্যানিং বা ইয়ারপি প্যাকেজ—তথ্যপ্রযুক্তির নবতম সংযোজন। উন্নততর নেটওয়ার্ক, রিয়েল-টাইম কমপিউটিং, উৎপাদন, ক্রয়-বিক্রয়ের লেনদেনে প্রতি মুহূর্তে অপস্রিয়মান উৎপাদিত ও ক্রীত সম্ভার, সেলস, পারচেজ ও প্রোডাকশন অর্ডার ব্যালেন্স আর সেই সঙ্গে বদলে যাওয়া ওপেন এন্ট্রির সদ্যতম অবস্থান।
এই মুহূর্তে আরও অনেকটা এগিয়ে এসেছি আমরা। সেই মডিউলার কিচেনের সার্ভারটিকে এতদিনে পাঠাতে পারা গেছে এক তৃতীয়-পক্ষের মেঘ-বাড়িতে। সেই ওর দেখভাল করবে। আর মডিউলার কিচেনটিকে আর একটু ছোট করে প্যান্ট্রি রুম বানানো হয়েছে। এখন সত্যিসত্যিই সেখানে চা-কফি হয়, রোজ নয়, মাঝেমধ্যে—কেউ এলে রাজু বানায়। এখন সবাইতো বাড়ি থেকে ল্যাপটপে কাজ করে, পৃথিবীর যে কোনো প্রান্ত থেকে মেঘবালিকার সঙ্গে কথা বলা যায়।
আবার সেই ভাবনাটাই অন্যভাবে কুরেকুরে খেতে লাগল আমায়। মেঘ-বাড়িতে এখন যদি ক্লাউডবার্স্ট হয় ! সার্ভার যদি হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে যায় ! সেলস, পারচেজ, প্রোডাকশন, ইনভেন্টরিজ, অর্ডার ব্যালেন্স—লাখ লাখ ওপেন এন্ট্রিজ এক রাশ চাক-ভাঙ্গা মৌমাছির মতো কোথায় মাথা কুটে মরবে কে জানে !
৩
শুরু করেছিলাম চুয়াত্তর সালে। প্রথম জন্মের শেষ ১৯৮৯-এ। ডায়েরির পাতায় কত অসম্পূর্ণ শব্দবন্ধ, কত অসমাপ্ত লাইন ষোলো বছরে লেখা হয়েছিল—তার মধ্যে মাত্র পঞ্চাশ/ষাটটি কবিতা আমার নিজের কাছে সেই সময়ে পাঠযোগ্য বলে মনে হয়েছিল। সেই ডায়েরি, তার পাতাগুলো—আমার হারিয়ে যাওয়া ওপেন এন্ট্রিজ, মাথার চুল ছিঁড়ে তন্নতন্ন করে খুঁজেছি পরে। কোথাও পাই নি তার খোঁজ।
২০২০ সালে করোনার মৃত্যুমিছিলকে পাশ কাটিয়ে আবার উঠে দাঁড়িয়েছি। মাঝখানে সুদীর্ঘ ৩১ বছরের অন্ধকার অজ্ঞাতবাস। হাঁটতে শুরু করেছি, সামনে একরাশ স্বপ্ন—আমার নতুন ওপেন এন্ট্রিজ, ভবিষ্যতের রসদ…

কবি
সম্পাদক পিলসুজ