
গগণ ঠাকুর : গণিতজ্ঞ গগণ ঠাকুর গণিতজ্ঞ ছিলেন লিটল ম্যাগাজিনের দুর্মূল্য খাঁচায় তার নাম যাদুঘরের প্রহরী বেষ্টিত উজ্জ্বল হয়ে আছে জীবনে প্রথম তিনি ভাষাবিজ্ঞান থেকে নেমে লোকসংস্কৃতির দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন রিক্সার চাকা তারপর নাটক সরণির মুখোশের কেনাবেচায় গণিত বিষয়ে সবিশেষ আগ্রহী হয়ে ওঠেন এবং যে কোনো বাহাস কিংবা প্রথম প্রথম কবিতার খাতায় ব্যাকরণ থেকে জ ফলা (্য) কিংবা নৈতিকতা থেকে ঐ ফলাগুলো (ৈ) ছিঁড়ে বাতাসে উড়িয়ে দিতেন বলে একদা এ্যান্টি এশটাবলিশমেন্টের কয়েকজন তরুণ কর্মী তাকে গভীর উৎসাহে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় বলে, যে কোনো স্কুলিংয়ের নির্জনতায় জনসভার উত্তেজনা কিংবা কফি হাউসের ছায়ায় সরাইখানার পরাপাঠ রটিয়ে দিতে পারলেই তবে মুক্তি কোনোদিন মুক্তি নেননি গগণ ঠাকুর বরং দীর্ঘ কারাবাস কালে এ্যালজ্যাবরার প্লাসগুলো একদিকে এবং বন্দিজীবনের নিঃসঙ্গতা ও অপ্রাপ্তিগুলো একদিকে রেখে প্রতিদিন ঘুমোতে অভ্যস্ত ছিলেন একদিন যোগের সঙ্গে ভাগ এবং নিঃসঙ্গতা ও অপ্রাপ্তির সঙ্গে গুণীতকের গভীর সখ্যের দরুন তারা মধ্যরাতে হাত ধরে পালিয়ে চলে গেল অথচ তিনি প্লাসের সঙ্গে মরালিটি এবং মাইনাস ও একাকিত্বের সঙ্গে হিউম্যানিটির সমন্বয়গুলো গভীর কাছ থেকে ভেবে এসেছিলেন — গগণ ঠাকুর গণিতজ্ঞ ছিলেন। এ-মতো গাণিতিক সমস্যা জীবনে এটাই প্রথম বলে তার মীমাংসা হেতু নতুন কোনো লিটল ম্যাগাজিনের খাঁচার দিকে তাকিয়ে আছেন যে গাঁয়ে সবাই রাজা লাটিম নিয়ে খেলতে গিয়ে পরাজয় থেকে আঁকতে শিখেছি বাঘ অথচ কোনোদিন বাঘ বাঘ খেলিনি আমরা আমাদের প্রহরা থাকত সুলতানপুর ডালিমের মতো ভোর, মানুষে মানুষে মায়াবী প্রহর ময়রা পট্টির সন্দেশ বিকোবার ঠোঙায় সুদৃশ্য ভরাট শূন্য আঁকা ছিল — গারোয়ানের শৈশশের খাতায় শূন্য দেখে ঘরে ফিরে এঁকে ফেলি বিকল্প চাবুক অথচ ঘোড়া ও চাবুক কোনোদিন খেলিনি আমরা কত কী খেলে গেছি ‘প্রযত্নে : সুলতানপুর’ লিখে! অনর্গল ফুটফাট, নামে-ধর্মে কত কী কাটাকুটি ছিল! অথচ কাটাকুটিজুড়ে রক্তপাত ছিল না কোথাও কী ভীষণ রাজায় রাজায় যুদ্ধ করেছি অথচ সুলতানপুরের সিংহাসন কখনো রাজার প্রয়োজনে ছিল না প্রকৃতিপুত্র ভাবতে গেলে তুমিই একদিন আমাদের হারানো শেকড়, হারানো চুল, বয়সভেদে ছোট হয়ে আসা পরিত্যক্ত পোশাকের ধরন, ছায়াভিত্তিক ঘাসের আকৃতি, বুক চিতিয়ে শুয়ে থাকা মাঠ — আলের ওপর হাঁটতে হাঁটতে ধানক্ষেতে পড়ে যাবার স্মৃতি— একদিন ডেওয়া ফলের ঘ্রাণের মতো ফিরিয়ে দিতে পারো যখন সাঁকোর কম্পন দেখে বুঝে নিতাম মাছেদের হৃৎপি-ের ধ্বনি, স্রোতের প্রবাহ দেখে মনে হতো ভেসে যাচ্ছে সম্রাট দারায়ুস কিংবা স্কাইলাক্সের অধিকৃত রাজত্বের ধ্বংসাবশেষ আর যত্রতত্র অশ্বদৌড় দেখে মনে পড়ত সেই সকল ক্রীতদাস ব্যবস্থার প্রবর্তক, যাদের ঐসব দুরন্ত অশ্বের লেজে জুড়ে দিয়ে ঘোরানো হচ্ছে কাঁটাঝোপ, বনবাদাড়, তপ্ত মরুভূমি — একদিন আলোছায়ার নক্ষত্রের মতো তুমিই তার ভালমন্দ, উঁচুনিচু শিখিয়ে নিতে পারো যখন মাথার ওপর সুস্নিগ্ধ মেঘের পরিচ্ছদ দেখে মনে হতো প্রাগৈতিহাসিক কুশলীরাজ কিংবা প্রাচীন গ্রীসীয় স্থাপত্যপ্রেমিক কোনো রাজরাজড়ার মহান কীর্তির কথা — কিংবা মনে পড়ে যেত — গাছে গাছে বিবিধ কূজন আর বর্ণালি ফলের আস্ফালন দেখে ইবনে বতুতার চোখে অপ্সরী ও গন্ধর্বের পরম সংসার; আর অতল সুখের এই পলিধৌত সুশীল রাজ্যের মতো স্বর্গীয় মাতৃভূমির কথা ভাবতে গেলে একদিন তুমিই তার আগাপাছতলা দেখে ফেলেছিলে আজ আবার পুনরুদ্ধারিত গৌরবের মতো তারই কিছু গ্রহণ বর্জন সুখ স্মৃতি অনায়াসে তুলে ধরতে পারো জানি রক্তের ধারা মাছবাজারে যে মাছটির দরদাম নিয়ে কথা কাটাকাটি হাতাহাতির দিকে যাচ্ছিল — তার পাশের ডালা থেকে একটি কর্তিত কাতলের মাথা আমার ব্যাগের ভেতর লাফিয়ে ঢুকে গেল তখন মস্তকবিহীন কাতলের অবশিষ্ট দেহের দিকে তাকাতেই আমার সমস্ত শরীর রক্তে লাল হয়ে গেল কাতলের যিনি প্রকৃত ক্রেতা ছিলেন মানিব্যাগ থেকে মূল্য পরিশোধ করে বললেন — “এ নিয়ে কিছু ভাববেন না হে আজকাল মাছেরা যেভাবে রক্তপাত করতে শুরু করেছে এভাবে চললে আপনি-আমি সবাই এমন রক্তে নেয়ে যাবো” আর তৎক্ষণাৎ বাজারের সকল মৎস্যবিক্রেতা যার যার রক্তের ধারা আবিষ্কার করতে ব্যস্ত হয়ে গেল কেউ বলল: আমি সেন বংশজাত, আমি পাল বংশোদ্ভূত, আমি... এবং দেখা গেল, বাজারে যে ক’জন ক্রেতা ছিলেন শুধু তারাই ছিলেন মীনবংশজাত যারা নিজেরাই নিজেদের মাংস ভক্ষণ করতে বাজারে এসে কথা কাটাকাটি থেকে রক্তারক্তি পর্যন্ত চলে যেতে পারে ফুল ফোটার কোনো স্বগতোক্তি নেই বকুলফুল কুড়িয়ে এনে মঙ্গলবারের অপেক্ষায় সোমবারের উঠোনে এসে দাঁড়াতাম সোমবার ছিল আদরণীয় আর মঙ্গলবার ঘিরে প্রচলিত ছিল নানা অমঙ্গলের কথা শিশুমনে এই প্রথম অসামঞ্জস ঘটে যেতে দেখি— বিদ্যায়তনের পাঠ একদিন কৈশোরক আঙুল উঁচিয়ে বলে ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’ অথচ পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা উল্টিয়ে দেখি মানুষের কোনো জীবনী তাতে নেই পড়তে হয় সেন পাল মুঘল বাদশাহের প্রসিদ্ধ জীবনী পৃথিবীতে এত এত সুলতানের কথা শুনি অথচ সুলতানপুরে একজনও সুলতান মেলে না বুকের ভেতর বাদানুবাদ ঘটে যেতে দেখি — সুলতানপুরে থোকা থোকা হাড়জিরজিরে অনাহারী, অর্ধাহারী মানুষের মুখ দেখে ভাবি বৈপরীত্য লেখা থাকে যে কোনো স্বখ্যাত নামে বাগানে ফুল ফোটার কোনো স্বগতোক্তি নেই অথচ ঝরে পড়ার আছে করুণ মর্মর ধ্বনি মেটামরফসিস : মনিরুজ্জামান ছিপি খুলে ঘুমের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো মনিরুজ্জামান কারা যেন দীর্ঘ ঘুম মুড়ি দিয়ে পড়েছিল চিলেকোঠার খাটে এবং প্রস্থান কালে ঘুমের মুখে ছিপি এঁটে পেরিয়ে গেছে প্রমোদ সরণি আমাদের মনিরুজ্জামান তাতে আটকা পড়ে কতগুলো পুকুরের চারা এবং অরণ্যের ডিম সফল প্রজনন হেতু ফেলে এসেছে; এবং পুকুরের গায়ে জলপাই শ্যাওলার এক প্রকা- চাদর প্রান্ত ধরে টেনে শরীরে মুড়িয়ে লোকালয়ে ফিরে এসেছে আজকাল তার সন্তানের প্রতি সিংহের মতো স্নেহ এবং স্ত্রীর প্রতি ইঁদুরের মতো নিষ্কণ্টক ভালবাসা দেখে কেউ কেউ তার নাম পাল্টে ফেরারি রেখেছে গাঁগঞ্জের ফেরারি-মন মানুষেরা উঠতে-বসতে ঘুরতে-ফিরতে সারাক্ষণ তাকে বন্দি করে রাখে এবং ব্যক্তি মানুষেরা তার মতো আকস্মিক বদলে যেতে কেউ বাঘের মতো কেউ ছারপোকার মতো অভিনয় করে তার মনোযোগ খুঁজতে থাকে শুধু মনে মনে ভাবে মনিরুজ্জামান: এক জীবনে আর কতবার হারালে একদিন শীতল বৃষ্টির মতো আকাশের করুণা কুড়নো যাবে! অভিনেতা তীর্থঙ্কর তীর্থঙ্কর মজুমদার আমাদের বাড়ির ছেলে তার ব্যাকগ্রাউন্ড চেহারাটা দর্জিখানায় সেলাই হচ্ছে চিবুকের প্রশ্রয় থেকে একগুচ্ছ চুল নাভির ওপর দোল খাচ্ছে সকাল থেকে একটি কাঠকয়লার বাস এসে দাঁড়িয়ে রয়েছে আঙিনায় তাতে বসন্তকাল, কোকিলের ডাক সারাদিন চড়ে বেড়াচ্ছে এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত তীর্থঙ্কর, অভিনয়ের প্রাক-ভূমিকায় তার গোফের ওপর বসিয়ে দিল নার্সারি। তাতে যা লাভ হলো : ফুটে থাকা দুচারটি ফুলে আবশ্যক পারফিউমের কাজটি অন্তত হয়ে গেল আর এখন তাতে ফল ধরবে — যা পেড়ে খেতে তীর্থঙ্করের সস্নেহ আশীর্বাদ প্রয়োজন পড়বে তোমাদের কবি জীবনানন্দ দাশ প্রতিরাতে ঘুমানোর আগে ট্রামের লাইনে চমৎকার চিত্র নির্মাণ করতে পারতেন কলকাতার প্রেক্ষাগৃহ ঘুরে মধ্যরাতে স্ত্রী লাবণ্য দাশের তৎকালীন নারী জীবনের স্বাধীনতা বিষয়ে অনেক গল্প শোনা যায়। শোনা যায় : বিদূষী লাবণ্য দাশ উনুনের পাশে শুয়েবসে কী করে শীতরাত্রির গল্প ফেঁদে কাঁচামাটির পাত্রের মতো আগুনে পুড়িয়ে নিতে পারতেন। আর পুরোটা জীবনের এ দীর্ঘ অবসরে জীবনানন্দ দাশ অভাবিত সোনার ডিম উনুনে তুলে কিছু তাঁর জীবদ্দশায় আর বাকিগুলো তাঁর মৃত্যুর পর আপামর পাঠকের জন্য পরিবেশন করে যান। আমরা তাঁর কাছে বনলতা সেনের অনেক গল্প শুনি। তবু, কোনো এক মানবীর মনে তাঁর ঠাঁই না হবার অপার বেদনার কথায় এতোটুকু বিচলিত কেউ নই; কারণ, একবার সুরঞ্জনা অন্য যুবকের প্রতি আসক্তি বাড়িয়ে বনলতা বিষয়ে এক গভীর জটিলতা তৈরি করে বসেন। আর তাতে আমরা নিশ্চিত হতে পারি যে, ভাবনার পূর্ব থেকেই তিনি কখনো বনলতাকে একক মানবীর মর্যাদা দিতে পারেননি। কলকে পাড় শাড়িতে জড়িয়ে যে কিশোরী সন্ধে হলে ঘরে ধূপ দিতে যায় প্রতিদিন; অথবা যে অনিবার্য মানবী এক শোভনা, সুদূর দিল্লিতে বসে উজানের স্রোতের তীব্রতায় টানেন সর্বদা নিমগ্ন খুব পুরুষ হৃদয়— বরং তাকে ঘিরেই তাঁর জীবনে নারীপ্রেম সম্পর্কে কিঞ্চিৎ ধারণা করা যায়। এবং ধারণা করা যায় যে, এরই পরিণতিতে তিনি হায় চিল নামের কবিতাটি লিখে থাকতে পারেন, এবং আমার সকল গান তবু তোমারেই লক্ষ্য করে— বলে তাঁর ভালোবাসার চূড়ান্ত অভিব্যক্তি ঘটান। আশৈশব তিনি জলসিড়ি, বিশালাক্ষীর তীরে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করেন — আমার মতন আর নাই কেহ! আমার পায়ের শব্দ শোনো— নতুন এ— আর সব হারানো— পুরনো। যেহেতু তিনিই কেবল ঘাইহরিণীর প্রতি অপার মমতা হেতু একদিন ক্যাম্পে লিখে গভীর সমালোচিত হন; নির্জন খড়ের মাঠে পৌষ সন্ধ্যায় হেঁটে হেঁটে রচনা করেন বাঙালির পরিভাষা— রূপসী বাংলার প্রগাঢ়তা আর তুমুল হেমন্ত ভাষা। সেই হেতু এই মহাপৃথিবীতে যার যেখানে সাধ চলে গেলেও তিনি এই বাংলার ’পরেই আমৃত্যু থেকে যেতে অভিলাষী হন। আবার বছর কুড়ি পরে— হারানো মানুষীর সাথে দেখা হয়ে গেলে— এই কাশ-হোগলার মাঠের ভেতরেই যেন দেখা যায় তারে— অথবা হাওয়ার রাতে— যেন দেখা হয় এশিরিয়ায়, মিশরে-বিদিশায় মরে যাওয়া রূপসীরা যখন এই বাংলার আকাশে কাতারে কাতারে নক্ষত্রের সমুজ্জ্বল সংসার রচনা করে— তেমনি তারার তিমিরে। আবার আট বছর আগের একদিন— কল্পনার নক্ষত্রচূড়ায় এক মৃতের গল্প রচনা করে বলেন— তবু জানি— নারীর হৃদয়-প্রেম-শিশু-গৃহ— নয় সবখানি; — অর্থ নয় কীর্তি নয় সচ্ছলতা নয়— আরো এক বিপন্ন বিস্ময়— আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে— খেলা করে;— আমাদের ক্লান্ত করে— ক্লান্ত— ক্লান্ত করে। জীবনানন্দ দাশ নিশিথের অন্ধকারে সিংহল সমুদ্র থেকে মালয় সাগরে ঘুরে ঘুরে জীবনের প্রতিটি ক্ষণ বিবেচনা করে বলেন— ভালোবেসে দেখিয়াছি মেয়েমানুষেরে... ঘৃণা করে দেখিয়াছি মেয়েমানুষেরে... উপেক্ষা সে করেছে আমারে— অথবা জীবনানন্দ দাশ তাঁর সমগ্র অধ্যাপনা ও সম্পাদনা জীবনের প্রগাঢ় বেদনাময় মুহূর্তে নিতান্ত দুঃখভারাক্রান্ত মনে তাঁর কিছু উৎকৃষ্ট রচনার নামকরণ ধূসর পাণ্ডুলিপি করে অনায়াসে পাড়ি দেন বাংলা কবিতার ঊষর উদ্যান। একবার খুঁজতে খুঁজতে নক্ষত্রতিমিরে— জানি না সে এইখানে শুয়ে আছে কিনা— বলে যখন সরোজিনীর অবস্থান নির্ণয়ে একপ্রকার ধোঁয়াশায় পতিত হন— আত্মাভিমানে নিজেও ঝরা পালকের মতো ঝরে যেতে চান শুকনো পাতা ছাওয়া ঘাসে— জামরুল হিজলের বনে— কিংবা নক্ষত্র সকাশে। এই তাঁর ঝরে যাবার অভিলাষ হয় আমগ্ন কাব্য জীবনের এক অনিবার্য টান। যেহেতু তাঁর ট্রামের নিচের জীবন এমনই ইশতেহার রচনা করেছে যে, যে জীবন দোয়েলের শালিখের— মানুষের সাথে তার হয় নাকো দেখা— ফলে, কার্তিকের নরম নরম রোদে— এক পায়ে দাঁড়িয়ে এক সাদা বক— এই দৃশ্য দেখে ফেলে যে, আমাদের গহন গভীরের কবি জীবনানন্দ দাশ— এবার মানুষ নয়, ভোরের ফড়িং তারে দেখা যায়— উড়ে উড়ে খেলা করে বাংলার মুখর আঙিনায়— গৃহবন্দি মধ্যরাতে কে যেন এসে আমাদের বাড়ির ঘরগুলো হাত-পা মুড়ে বেঁধে রেখে গেছে এবং বারান্দাগুলো লুকিয়ে রেখেছে অদৃশ্য ছায়ায় ভোর হতে না হতেই লোকজন আসছে, চেনাজানা আত্মীয়-পরিজন তারা চোরের মতো বাড়িটাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কেউ ফিরে যায় কেউবা বিস্মিত হয়ে অদৃশ্য ছায়ায় দাঁড়িয়ে পড়লে পায়ের নিচ থেকে কঁকিয়ে ওঠে লুকানো বারান্দাগুলো যখন ঘরের দিকে এগিয়ে এসে শক্ত করে বাঁধা রশিগুলো খুলতে যাচ্ছে, ভেতর থেকে হৈ হৈ করে হাসছে গৃহবন্দি পরিবারের বাপ-মা, শিশু-যুবা— তাবত মানুষ তারা ফিঙের মতো ঘর থেকে লাফিয়ে বেরুচ্ছে আনন্দে এবং ঘরগুলোর যত্রতত্র যেসব ক্ষতে রক্ত ঝরছে জলে ধুয়ে লাগিয়ে দিচ্ছে কবরেজের দেয়া আরোগ্য-মলম ব্যক্তিগত ব্যবহৃত ঘরে টেনে তুলে জুড়ে নিচ্ছে শায়িত অলিন্দমালা আমি শুধু একমাত্র জন ইঁদুরের গর্তে পা আটকে যাওয়ায় শত চেষ্টাতেও ঘর থেকে বেরুতে পারছি না বাড়ির মানুষ যে যার কাজে ব্যস্ত হয়েছে, খাচ্ছেদাচ্ছে ঘুমাচ্ছে-জাগছে— শুধু একই ঘরে থেকে আমার গগনবিদারি চিৎকার কেউ শুনতে পাচ্ছে না এ-সংসারের রক্তমাংসের একজন মানুষ আছে কি নেই কতকাল হলো কারও কিছু মনেই পড়ছে না সাদা মেঘজুড়ে সাদা সাদা হাঁসের পালক আজকাল প্রায়ই দুপুরের ভাত বিকেল গড়িয়ে খাই আর সকালের নাশতা একপ্রকার না খেয়েই সময় গড়িয়ে যায় অথচ প্রতিদিন নিয়ম করে স্বাস্থ্য-আপারা আসেন আর আমার তুমুল নিঃসঙ্গতা থেকে কলহপ্রিয়তা যৌনতা থেকে স্মৃতিকাতরতাÑ একে একে টেনে শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে আবার শরীরে জোড়া দিয়ে যান দেখি, তারাও এতোটা নির্জনতাপ্রিয় যে আমার স্বাস্থ্যসংক্রান্ত একটি বাক্যও কেউ মুখে তুলছে না! এই দেহের ভালোমন্দ ঘিরে যাবতীয় অসামঞ্জস শুধু তাদের চোখেমুখেই ভেসে উঠতে থাকে— দৃশ্যত, তারা কখনো হাসছে কখনো কাঁদছে আবার কখনো ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে হয়ে উঠছে আমূল সাংসারিক! আবার যখন রাত্রি গড়িয়ে দুপুরের খাবারের প্রসঙ্গ আসে ওইসব স্বাস্থ্য-সেবিকা আমার অস্তিত্ব আছে কি নাই, এ জাতীয় সন্দেহ ধরে হ্যাঁচকা টান মেরে দেখে— আসলে আমি অনস্তিত্বময় এক বিপুল দোদুল্যমানতা, গৃহমাত্র বসবাস করি আর নিঃসঙ্গতা— আমার প্রত্যন্ত অলঙ্কার পরিবার থেকে পরিবারতন্ত্রে আমার অভ্রান্ত প্রতাপ ঘর থেকে ঘরে আমি অভিন্ন বিচরণকারী আর এই স্বাস্থ্যসেবিকাগণ তারা প্রত্যেকে জ্ঞানত গৃহবহির্ভূতা, সম্ভ্রান্ত অনুপ্রবেশকারী নিঃসঙ্গ থেকে নিঃসঙ্গতায় অবাধ অগণন

ওবায়েদ আকাশ
জন্ম ১৯৭৩ সালের ১৩ জুন, বাংলাদেশের রাজবাড়ী জেলার সুলতানপুর গ্রামে। একাডেমিক পড়াশোনা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর। ধ্যানজ্ঞানে সর্বক্ষণ কবিতা আর পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন সাংবাদিকতাকে। তাঁর সাংবাদিকতার বয়স প্রায় তিন দশক। বর্তমানে দেশের ঐতিহ্যবাহী পত্রিকা ‘দৈনিক সংবাদ’-এ সাহিত্য-সাংবাদিক হিসেবে কর্মরত আছেন। লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনাকে কবিতার পরেই আত্মক্ষুধা নিবৃত্তির অন্যতম আশ্রয় বলে মনে করেন। ১৯৯৯ সাল থেকে সম্পাদনা করছেন অধুনাবাদী চিন্তার লিটল ম্যাগাজিন ‘শালুক’। তারুণ্যপ্রধান এই পত্রিকাটির এযাবৎ ২৬টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে— যার সর্বশেষ সংখ্যাটি প্রকাশিত হয়েছে দূরের কাছের জীবনানন্দ দাশ এবং আবুল হাসান সংখ্যাটি পুনর্মুদ্রিত হয়েছে সম্প্রতি।
বাংলা সাহিত্য ও লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে সম্প্রতি ওবায়েদ আকাশ ও শালুকের শুভাকাক্সক্ষীগণ ‘শালুক আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মিলন’ নামে একটি আন্দোলন শুরু করেছেন। বিভিন্ন দেশের কবি-লেখকগণকে সেখানে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে। গত মার্চে অনুষ্ঠিত হলো উদ্বোধনী আয়োজন। এখন থেকে প্রতি দুই বছর পর পর ‘শালুক আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মিলন’ অনুষ্ঠিত হবে।
ওবায়েদ আকাশের প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা : কবিতা, অনুবাদ, গল্প, প্রবন্ধ, সম্পাদনা মিলিয়ে ৪৬টি। এর মধ্যে মৌলিক কাব্যগ্রন্থ ২৭টি।
প্রকাশিত গ্রন্থ:
কাব্যগ্রন্থ: পতন গুঞ্জনে ভাসে খরস্রোতা চাঁদ (২০০১), নাশতার টেবিলে প্রজাপতিগণ (২০০৩), দুরারোগ্য বাড়ি (২০০৪), কুয়াশা উড়ালো যারা (২০০৫), পাতাল নির্মাণের প্রণালী (২০০৬), তারপরে, তারকার হাসি (২০০৭), শীতের প্রকার (২০০৮), বিড়ালনৃত্য, প্রেতের মস্করা (২০০৯), যা কিছু সবুজ, সঙ্কেতময় (২০১০), প্রিয় কবিদের রন্ধনশালায় (২০১১), শুশ্রƒষার বিপরীতে (২০১১), রঙ করা দুঃখের তাঁবু (২০১২), বিবিধ জন্মের মাছরাঙা (একটি দীর্ঘ কবিতা, ২০১৩), তৃতীয় লিঙ্গ (কয়েকটি দীর্ঘ কবিতা, ২০১৩), হাসপাতাল থেকে ফিরে (২০১৪, কলকাতা), ৯৯ নতুন কবিতা (২০১৪), পাতাগুলি আলো (২০১৬), তথ্যসূত্র পেরুলেই সরোবর (২০১৮), সর্বনামের সুখদুঃখ (২০১৯), পৃষ্ঠাজুড়ে সুলতানপুর (২০২০), নির্জনতা শুয়ে আছে সমুদ্র প্রহরায় (২০২১) কাগুজে দিন কাগুজে রাত (২০২২), কোনো বাক্যে থাকতে পারত দেয়াল লিখন (২০২৩) এবং নকশিকাঁথায় তুলেছিলে জাতকের মুখ (২০২৩)।
কাব্য সংকলন: ঋতুভেদে, পালকের মনোবৃত্তিগুলি (কাব্য সংকলন, ২০০৯), স্বতন্ত্র ৬০টি কবিতা (কাব্য সংকলন, ২০১০), ওবায়েদ আকাশের কবিতা ॥ আদি পর্ব (কাব্য সংকলন, ২০১১), উদ্ধারকৃত মুখম-ল (বাংলা একাডেমি প্রকাশিত নির্বাচিত কাব্য সংকলন, ২০১৩), মৌলিক পৃষ্ঠায় হেঁয়ালি (কাব্য সংকলন, ২০১৭, কলকাতা), শ্রেষ্ঠ কবিতা (কাব্য সংকলন, কলকাতা, ২০১৯) বাছাই কবিতা (২০১১-২০১৮ পর্যন্ত নির্বাচিত কাব্য সংকলন, ২০১৮), স্বতন্ত্র কবিতা (স্বতন্ত্র কাব্যসংকলন, ২০১৮) এবং নির্বাচিত ২০০ কবিতা (কাব্য সংকলন ২০২৩)।
Translated Book (Poetry Collection): Faux Assassin, Translated by : Ashoke Kar, Haikal Hashmi, Mahfuz Al-Hossain, Razia Sultana and Kamrul Hasan. (2019)
শিশুতোষ গ্রন্থ : ভূতের বাপের শ্রাদ্ধ (২০১৯)।
অনুবাদ: ‘ফরাসি কবিতার একাল/কথারা কোনোই প্রতিশ্রুতি বহন করে না’ (২০০৯) ‘জাপানি প্রেমের কবিতা/এমন কাউকে ভালোবাসো যে তোমাকে বাসে না’ (২০১৪)।
গদ্যগ্রন্থ: ‘ঘাসের রেস্তরাঁ’ (২০০৮), ‘লতাপাতার শৃঙ্খলা’ (২০১২)।
সম্পাদনা গ্রন্থ: ‘দুই বাংলার নব্বইয়ের দশকের নির্বাচিত কবিতা’ (২০১২), পাঁচ দশকে বাংলাদেশ : সাহিত্য সংস্কৃতি সমাজভাবনা (বিশিষ্ট কবি লেখক-বুদ্ধিজীবীর সাক্ষাৎকার সংকলন, ২০১৮)।
সম্পাদিত লিটল ম্যাগাজিন : শালুক (১৯৯৯—)
পুরস্কার : এইচএসবিসি-কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার ২০০৮। কলকাতা লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণা কেন্দ্র পুরস্কার ২০০৯। লন্ডন থেকে প্রাপ্ত সংহতি লিটারারি সোসাইটি বিশেষ সম্মাননা ২০১২। কলকাতা থেকে ঐহিক মৈত্রী সম্মাননা পদক ২০১৬। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি লিটল ম্যাগাজিন পুরস্কার ২০২২। নর্দার্ন বিশ্ববিদ্যালয় সম্মাননা স্মারক (২০২৩)।