
হিন্দুর ছেলেকে ধরে নিয়ে গেছে, তাতে ওদের কী? বোঝে না আইজুদ্দিন। মায়ের বিলাপ শুনে তার মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে যায়।
এদিকে ছেলের মেজাজের তাপ পরিমাপের কোনো দায় নেই দয়া মাইয়ের। তিনি কাঠ কাঠ হাতে ছেলের হাত চেপে ধরে বলছেন, ‘হাট, যাই।’
‘তোমার মাথাটা গেইচে মা। তোমরা গেইলেই অক ছাড়ি দিবে?’
‘দিবে। দিবে।’
‘মগা তালুকদার পাচোত নাইগচে। ভিটা ছাড়া না করি কি আর রেহাই দিবে?’
‘মোক নিয়া যা বাপ। পবনোক নিয়া আইসো।’
দয়া মাই কথাটা এমনভাবে বলে যেন সে থানায় গেলেই পুলিশ পবনকে ছেড়ে দেবে। এমনিতে তো নিজের পায়ে শক্তভাবে দাঁড়ানোর ক্ষমতাও নেই, তার ওপরে বুড়ি আবার চোখেও দেখে না।
দয়া মাই যে চোখে দেখে না সে কথা সে স্বীকারও করে না।
প্রায় প্রতিদিনই উঠানে দড়িতে লটকানো কাপড় দেখে সে ছেলের নাম ধরে ঘন ঘন ডাক দেয় আর বলে, ‘ও। আইজ আসলু? বইসেক, দুইটা গরম ভাত দ্যাও।’
শাশুড়ির কথা শুনে আইজুদ্দিনের স্ত্রী জোবেদা ভ্রু কুঁচকে তাকায়, ‘নিজের ভাতারোক ভাত দিবার কতা মনে নাই। ব্যাটার জইন্যে যত খাতির!’
ছেলের বউয়ের রোষ ধরতে পারে না দয়া মাই। দয়ার্দ্র কণ্ঠে সে বলেই চলে, ‘ও। আইজ ভাত খাবু? একটা ডিম ভাজি দেইম।’
জোবেদা যদি বলে, ‘ওইটা কি তোমার ব্যাটা নাকি? ওইটা তো আব্বার কাপড়। শুকান কাপড় বাতাসোত লতপত করোচে।’
ছেলে বউয়ের কথা শুনে বুড়ি নিজেকে সামলে বলে, ‘ওই কাপড় তুলবার জইন্যেই তো আসনু। ঝড়ি পড়োচে দেকিস না চউকে?’
‘অয় নিজে য্যান খুব চউকে দ্যাকে।’
চোখ তুলে আসমানের দিকে তাকায় দয়া মাই। একা একা কথা বলে, বিস্বাদ জিভে শৈশবের হরেক খাবারের স্বাদ পায়, বিষাদ চোখে হরেক হরেক রঙ দেখে। সে যা দেখে তা যেন আর কেউই দেখে না।
মাথার ওপরে শুড উঁচিয়ে হাতির আকৃতির মেঘের শত শত খন্ড ওর সঙ্গে তাল মিলিয়ে গর্জন করে। এই মেঘের তাল জ্ঞান নেই, যখন তখন বৃষ্টিতে উঠান ভাসাবে। মাকে বিদ্রুপ করতে করতে আইজ সরিষা ঘরে তোলে। গোয়াল ঘরে ঢুকে গাইয়ের শরীরে চট বিছিয়ে দেয়। বিড়বিড় করে দুধেল গাইয়ের সঙ্গে কথা বলে, বৃষ্টির দিন ঠান্ডা যেমন মশাও তেমন, অবলা প্রাণীর দুর্ভোগের শেষ নেই।
আইজের দেহ ঘামে সপসপ করছে। ঠান্ডা হাওয়ায় শরীরের লবণ-পানি শুকিয়ে এলে ওর মাথাটাও ক্রমে ঠান্ডা হয়ে আসে।
‘তালুকদারের ব্যাটার সাতে নাগির গেইচে, আর কাম পায় নাই। অক না কয়া জমি ব্যাচের কায় কইচলো? দিছে এখন ডাইলের কেছ। বছরের পর বছর এখন হাজত খাটির নাইগবে।’
অনাবশ্যক জোরে চেঁচিয়ে উঠে শুকনো কাপড় তুলতে তুলতে জোবেদা শাশুড়িকে তাড়া দেয়।
‘ঘরোত যাও। ঝড়ি আইসবে। অক ছাড়ে আনির মানুষ আছে আরও।’
জানে দয়া মাই, সে ছাড়া পবনের কেউ নাই। ভালোমন্দ কিছু খেতে মন চাইলে ছেলেটা আজও এই ভিটায় এসে দাঁড়ায়। ছেলেটার মুখ দেখলে বুকে মোচড় লাগে, একেবারে গঙ্গার মুখ।
গঙ্গার মুখটা এক হাত দূরে থাকার মতো স্পষ্ট আজও। দৃশ্যের ভেতরে সারি সারি দৃশ্য সেজে উঠেছে যে এত বছর ধরে, তবুও স্পষ্ট।
লাল সবুজ মিনা করা কানপাশা জোড়া পরলে গঙ্গাকে সকলের চেয়ে আলাদা দেখাতো। আড়েঠারে সইকে দেখতো দয়া মাই। দেখতে দেখতে ঐ কানপাশা যে একদিন তার হবে কখনো ভাবেনি দয়া মাই।
কানপাশা জোড়ার দিকে লোভ থাকলেও অমনভাবে ও জিনিস হাতে আসুক কখনো চাননি সে। বর্ডারের দিকে রওনা হবার দিন গঙ্গা নিজেই দয়া মাইয়ের স্বামী মঈনুদ্দিনের হাতে কানপাশা জোড়া গুঁজে দিয়েছিল।
কত কী মনে পড়ে দয়া মাইয়ের। ভাবে, রাতে ভাত খাওয়ার সময় মানুষটাকে জিজ্ঞাসা করবে সেইসব দিনের কথা। জানে দয়া মাই, মানুষটাকে সেসব কথা জিজ্ঞেস করলে আজ সে পরিষ্কার করে কিছু বলতে পারে না। অথচ দয়া মাই আজও সব পরিষ্কার দেখতে পায়।
পবন তখন গঙ্গার কোলে। মায়ের কোলে ঝুলে ট্যাঁ ট্যাঁ করছে। দয়া মাইয়েরও তখন ভরা কোল। নিজের ছেলেকে ঘুম পাড়িয়ে সে পবনের ছোট ভাই তপনকে এক পেট ভাত খাইয়ে মায়ের হাতে তুলে দিয়েছিল। কোলে, হাতে আর পা বরাবর একটা মোট তিন সন্তানকে নিয়ে দেশ ছেড়েছিল গঙ্গা।
এর আগে তিন ছেলেকে কোলে-কাঁখে করে মুসলমান পাড়ায় এসে লুকিয়েছিল ও। গঙ্গার স্বামী অচল বাপকে নিয়ে পিছু পিছু আসবে কথা দিয়েও আসতে পারেনি। ঐ রাতেই আরও অর্ধশত মানুষের সঙ্গে তারা মারা পড়েছিল। চিতার আগুন পায়নি মানুষগুলো, কবরও না।
লাশগুলো যেখানে মাটিচাপা দেওয়া হয় সেখানে এখন কটিয়ার হাট। মগা তালুকদার ইজারা নিয়েছে। হাটবারের গিজগিজ করা লোকজনের পায়ের নিচে মানুষগুলোর হাড় মটমট করে দৃশ্যটা মনে করে অসময়ে দয়া মাই কেঁদে ওঠে।
একবার তার মনে হয় এ কান্না সইয়ের ছেলে পবনের জন্য, আরেকবার মনে হয় এ কান্না বিছানায় পড়া ভঙ্গুর শরীরের স্বামীর জন্য, নয় শ্বশুরবাড়িতে থাকা মেয়েদের জন্য।
এ কান্নাপ্রবাহ অন্তহীন বলে মৃত ছেলে ধানের কথাও তার মনে পড়ে। ছেলেটার জন্মমাসে ধানও আবাদ হয়েছিল। ক্ষেতের এ প্রান্ত থেকে সেই প্রান্ত সোনালি রঙে ছেয়ে গেছে। তাই দেখে মানুষটা ছেলের নাম রেখেছিল ধান। পুকুরে ডুবে যে বছর ধানের মৃত্যু হলো সে বছর সব ধান চিটা হয়েছিল, মানুষ মরা খরা লেগেছিল ধুমেরকুটিতে।
আকুল দয়া মাই ধানকে ডাকে আর কাঁদে।
কোথা থেকে যে এত রাজ্যের দুঃখ উথলে ওঠে, দিশা পায় না দয়া মাই। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। সে তো কাঁদে। গঙ্গা কাঁদতেও ভুলে গিয়েছিল। দেশে ফিরলে গঙ্গাকে জিজ্ঞেস করেছিল দয়া মাই, ‘ও গঙ্গা, গঙ্গা দেকচিস? শুনছু সেইটা বলে একটা বিশাল নদী, হিমালয় থাকি নাইমছে।’
এক পক্ষকাল হাঁটতে হাঁটতে ওপারে পৌঁছেছিল গঙ্গা। পথে পথে নুড়ি, কাঁকর, জল, জঙ্গল ছাড়া কিছুই দেখেনি। ব্যথায় পা দুটো আর পা ছিল না। শরীরময় ব্যথা আর বেদনার চিহ্ন এঁকে ওপারে গেলেও বিধাতা নতুন কলমে আরও চিহ্ন আঁকতে ভুল করেননি। শরনার্থী শিবিরে তপন কলেরায় মরেছিল। জীবিত ছেলে দুটোও রোগে ভুগে শুকিয়ে কাঠি কাঠি হয়েছিল।
অবরুদ্ধ শোকে এক বুক গঙ্গাজল নিয়ে সে স্বামীর পোড়া ভিটায় ফিরেছিল। সই ফিরলেও তাকে কানপাশা জোড়া ফেরত দিতে পারেনি দয়া মাই। জয় বাংলার লোক বলে গ্রাম ছাড়তে হয়েছিল মঈনুদ্দিনকে। মুক্তিযোদ্ধাদের ভয়ে পাশের গ্রাম পায়রাবতী কৃষ্ণপুর ছেড়ে মিলিটারি পালিয়েছে শুনে ঐ গ্রামে আশ্রয় নিয়েছিল ওরা। প্রাণ নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছাতে পারলেও পথে দয়া মাইয়ের পুঁটলিটা খোয়া গিয়েছিল।
আহারে অমন সুন্দর ফুটফুটি কানপাশা জোড়া! সইয়ের কানে যদি আবার তুলে দিতে পারত!
‘ও গঙ্গা…’
গঙ্গার ফিরে আসার দৃশ্যটা স্পষ্ট দেখতে পায় দয়া মাই। ফিরে এসে সইকে কানপাশার কথা একবারও জিজ্ঞাসা করেনি সে। সই বুঝি অভিমান করেছিল, আমানতের খেয়ানত করেছিল দয়া।
দুই ছেলেকে বুকে জড়িয়ে শোক ভুলেছিল গঙ্গা। এ বাড়ি ও বাড়ি ঝি গিরি করেছে। কাজে যাবার আগে মাঝেমধ্যে সইয়ের কাছে ছেলেকে রেখে যেত গঙ্গা। সেই সুযোগে পবন আবার দয়া মাইয়ের ন্যাওটাও হয়েছিল।
চোখ খচখচ করে দয়া মাইয়ের। চোখের সামনে একটা ভারি পর্দা টেনে দিয়েছে কেউ। ছেলে হাত ছাড়িয়ে বাড়ির বাইরে চলে গেছে।
এইবার আকুল হয়ে কাঁদতে বসে দয়া মাই। এতগুলো বছর কী করে পার হয়ে গেল টেরই পেল না সে। চুল সাদা হলো, চামড়া ঝুলঝুল হলো, হাড়ও মড়মড় হলো তবু কেন সে সব স্পষ্ট দেখতে পায়?
ঐ তো সে দেখতে পাচ্ছে হাতের শাঁখা পলা, প্রিয় কানপাশা জোড়া খুলে তিন সন্তানকে নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে গঙ্গা। দয়া মাই পিছু পিছু ডাকছে, ও গঙ্গা…
সখীকে দেখতে দেখতে ডাকতে ডাকতে পবনের কথা বিস্মৃত হয়ে যায় দয়া মাই, সব ভুলে সে এবার শুধু গঙ্গার জন্য কাঁদে।