পুনর্জন্মের দিকে চেনা-অচেনা মানুষেরা মরে গিয়ে আকাশেবাতাসেজলে ভেসে আমাকে ঘিরছে । ফুরিয়ে আসছে অন্তিম যামিনী । দূরনক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে আমিও বুঝতে পারছি জীবন পুনর্জন্মময় । সুদূর বার্লিনের বাংকারে বসে শয়তান নিজের মাথায় গুলি চালালে ভারতে জন্মাতে তার পাঁচ বছরও লাগে না । খুব সহজভাবে বলতে গেলে, আজ পৃথিবী জুড়ে অন্তত এই কানাঘুষো প্রকট ও সোচ্চার হয়ে পড়েছে যে, নাগরিকজীবনে, যেকোনো দেশের ক্ষেত্রেই, গ্রামে ও শহরে, পর্বতে ও সমতলে, পলিতে ও আগ্নেয় শিলায়, সর্বত্র, রাষ্ট্র-বিশ্ব-জাতীয়তাবাদ একটি বিপরীত সত্যের ভয়াবহ অতিকথন মাত্র । রাষ্ট্রের রাশ করপোরেটের হাতে, বিশ্ব এখন শুধুই একটি বদ্ধ বাজার, যেখানে বিশ্বজনীনতা কেবল আপৎকালীন একটি ট্রেঞ্চ, যা শুধুই হাউসের কাজের সুবিধে করে দেয় । বাদবাকি নিরবচ্ছিন্ন বিশ্বায়নের জুলুমবাজি । জাতীয়তাবাদ সামূহিক অন্ধত্ব নির্মাণের আবশ্যিক ও অপরিহার্য হাতিয়ার । বিশ্বে জাতীয়তাবাদের বড়ো স্তম্ভ হল সংগঠিত ধর্মগুলি । ইসলাম, খ্রিস্টান এবং ইহুদি ধর্ম । আমাদের উপমহাদেশে আর এস এস/হিন্দু মহাসভা/বিজেপি প্রণীত ও প্রযুক্ত তথাকথিত 'হিন্দুত্ব' । যাবতীয় কিছুর কাজ কিন্তু একটাই, করপোরেটকে বেলাগাম মুনাফা অর্জনের সুবিধে করে দিয়ে, সমাজে তর্ক-প্রতর্কহীন একধরণের অন্ধ সমর্থন জুটিয়ে যাওয়া । যাতে যে দল বা গোষ্ঠী করপোরেটসংঘকে সর্বোচ্চ সুবিধে দিতে পারবে তারাই ক্ষমতায় থাকতে পারে । হ্যাঁ, কে কতটা সুবিধে বা লুটের সুযোগ দিতে পারবে তারও নিলাম বসে । সেখানেই সর্বোচ্চ দরদাতার হাতে সেঙ্ঘল তুলে দেওয়া হয় । যেমন, আমরা সবাই জানি, থানাগুলোর নিলাম হয় । প্রমাণ করা প্রায় অসম্ভব কিন্তু কাজকর্মের দিকে একটু নজর রাখলেই বোঝা যায়, আইনশৃঙ্খলা গৌণ বিষয়, আসল কাজ টাকা তোলা এবং শাসকদলের আধিপত্য বজায় রাখা । বিজেপিরও সেই একইরকম । হিন্দুত্ব বা ধর্মও তাদের কাছে দলীয় বৈশিষ্ট্য বজায় রাখার এবং আধিপত্য অটুট রাখার একটা হাতিয়ার মাত্র । যদি তারা বুঝত, রামকে পাশে রাখলে গদি যাবে তখন তারা সর্বধর্মসমন্বয়ের প্রশ্নে, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের প্রশ্নে গুটি ফেলত । স্বাধীনতার আগে থেকেই পেলব হিন্দুধার্মিকতাকে জাতিপরিচয়ের সঙ্গে গুলিয়ে দিয়ে, বর্ণবাদের শিকার দেশের আশি শতাংশ মানুষকে ছদ্মভারতীয় ঐতিহ্যের বিষ গিলিয়ে এসেছে এই কংগ্রেস দলটির মাথারা । তাই রাজীব গান্ধী যে বাবরি মসজিদের তালা খুলে দিয়েছিলেন সেটা একেবারেই বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় । কংগ্রেসের রাজনীতি ও আদর্শের সঙ্গে একশ ভাগ মানানসই একটি পদক্ষেপ । স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত কংগ্রেস দেশের প্রধানতম রাজনৈতিক দল হিসেবে ভারতীয় সমাজের ধর্মীয় মৌলবাদী ধারাগুলির প্রতি কঠোরতম মনোভাব দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে । তাই আজ ভারতে সংঘী রাজনীতির এই বাড়বাড়ন্ত । সামগ্রিক ভাবে ভারতের প্রায় দেড়শ সংসদীয় আসনে কমবেশি বামপন্থী রাজনীতির প্রভাব থাকলেও বামপন্থী দলগুলি শতধা বিচ্ছিন্ন । নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব এই রাজনীতিকে উপমহাদেশে নিরবচ্ছিন্ন প্রাসংগিকতায় পৌঁছতে দেয়নি । তাই আমাদের সামনে এসে পড়েছে মোদী-মৌলবাদ । ক্রুনি-ক্যাপিটালিজমের আশ্চর্য সোহাগা । হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার কৃষ্ণতম অধ্যায়ের সামনে পড়ে নিম্নবর্গ উন্মত্ত দিশাহীন সমর্থকে পরিণত হয়েছে । শিক্ষিত মধ্যবিত্ত হয়ে পড়েছে সংকীর্ণ, লোভী, মেরুদণ্ডহীন । এই অবস্থার প্রেক্ষিতে, পশ্চিমবংগের রাজনীতিতেও শকুনের উল্লাস আমাদের কানে এসে পৌঁছোচ্ছে । এর সংগে লড়াইয়ে উদ্যত মানুষেরা নানা বিচিত্র আবর্তে পড়ে বিহ্বল হয়ে পড়ছেন । চতুর্দিকে মানুষ পুড়ছে । সারা পৃথিবীতে এদিকে ওদিকে জমা মৃত্যুর স্তূপ ভূগোলকে বেশ কিছুটা পাল্টে দিয়েছে বইকি । এইসব নিয়েই আমার ভাবনা-চিন্তা-অবদমন-অক্ষমতার কিছু জরুরি কথা হয়তো এই কবিতাটির মধ্যে বসতি পেয়েছে । আমার উপস্থিতি আমার মত-পথ -হাঁটা সবই প্রত্যাশিত। যা কিছু প্রত্যাশিত তাই অসংগত, এমন নয়। অসুর রোদ্দুর থেকে আমি কুড়িয়ে নিয়েছি জর্দারং কৌটো, গমের শীষের গুচ্ছ বুকে ধরা অনাহারিনীকে বসিয়ে রেখেছি ইতিহাসে। ঝরা পাতার উড়ে যাবার ফিসফিসানির ভেতর শুনে নিয়েছি পাল্টে যাওয়ার পদধ্বনি। হাওয়ায় চাবুক ঘন শিস দিয়ে দূরের অচেনা পাখি টেনে এনে নামিয়েছে বাংলার রক্তের ঝরণায়। সন্ধ্যাকে পাতন করে বুনেছে অন্ধ মদে ধোয়া ঝাঁঝাল শাড়ি, মালোপমা। আগুন এখানেও এক স্বর্গীয় ঘটনা। পুড়ে যাওয়া গোপন উপাসনা। কয়লা-বালি-ধাতুতে ঢাকা কোনও মৃত্যুরই অন্তর্তদন্ত সম্ভব নয়। আমার মত-পথ হাঁটা সেসব মৃত্যুর মতোই প্রত্যাশিত। জন্মের ব্যত্যয় থেকেই আমি অর্জন করেছি অপৌরুষেয় এইসব ষড়যন্ত্রের সংগতি! বিশ্বাস কর, বগটুই গ্রামের দু একটি ভিটের ভস্মের নীচে, বুঝতে পারি, এখনও পড়ে আছে আমার, আমারই প্রেমভর্তি নকশাকাটা ঝোলা আমার উপস্থিতি যদিও অব্যবহৃত... যদিও সেটি এখনও পোড়েনি.....
Facebook Comments Box