প্লেটো বলেছিলেন,Poetry is nearer to vital truth than history.
কথাটি মনে ধরেছিল। আর এক গ্রীক দার্শনিক ও ইতিহাসবিদ প্লুতার্ক ভারি সুন্দর করে বলেছিলেন, Painting is silent poetry, and poetry is painting that speaks. আর শেলী বললেন,A poet is a nightingale, who sits in darkness and sings to cheer its own solitude with sweet sounds.
কবিতা,কবি,কবি জীবন,অকাব্যিক রূঢ় নগ্ন বাস্তবতার প্রাত্যহিকতায় কবিতা ও কবির ভূমিকা, এসব নিয়ে ভাবতে গিয়ে মনে পড়ছিল সুপ্রাচীন ঐতিহ্যসম্পন্ন বাংলা কবিতার কথা।
চর্যাপদের কবিতাকে যদি বাংলা ভাষার কবিতার আদিপর্ব ভাবা হয়,কবিতা তাহলে বাংলা কবিতার ইতিহাস কমবেশি সহস্রাধিক বছরের। একসহস্র বছরের কাব্যচর্চার অনুশীলন নিরবচ্ছিন্ন না হলেও তা পবহুবিধ মণিমুক্ত খচিত এক স্বয়ং সম্পূর্ণ ভূখণ্ড হিসেবেই চিহ্নিত। অষ্টম তফশিলে স্বীকৃত অন্যান্য ভাষার কবিতাচর্চা ও বাংলা কবিতার তুল্যমূল্য বিচার করার মত যোগ্যতা না থাকলেও মনে পড়ছিল এলিয়টের কথা। এলিয়ট বলেছিলেন,প্রকৃত কবিতা নিজেই কমিউনিকেট করে,তাকে আলাদা করে বুঝে নিতে হয় না। এলিয়ট যদি আধুনিক কবিতার জনক হন,তাহলে তার কথাটিও প্রণিধানযোগ্য। প্রকৃত কবিতা স্বতঃপ্রণোদিত ভাবেই কমিউনিকেট করে এবং তাকে যে সকলের বোধগম্য হতেই হবে এমন বাধ্যতা তার নেই। আর এই জায়গা থেকেই বোধহয় বাংলা কবিতা এগিয়ে আর সকলের থেকে অনেকটাই।
একশো দশ বছর পূর্বেই নোবেল প্রাপ্তির অব্যবহিত পরেই একজন রবি ঠাকুর একাই বাংলা কবিতাকে বিশ্বের দরবারে সমাদৃত করে তুলেছিলেন। পরবর্তীতে সেই পতাকাকে বহন করার যোগ্য উত্তরসূরির মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন বিষ্ণু দে,সুধীন দত্ত সহ আরও অনেকেই। এবং অবশ্যই জীবনানন্দ। বাংলা কবিতাকে সম্পূর্ণ অন্য এক অভিজ্ঞানের দিশারী করে তুলেছিলেন যিনি একাই। তার জীবনের বাস্তবতার মতই ভারতীয় কবিতার ইতিহাসে জীবনানন্দ একক।
বাংলা ভাষায় কাব্যচর্চা সাবালকত্ব লাভ করে বহুপূর্বেই। সুপ্রাচীন ধর্মীয় এবং সামাজিক সংস্কৃতির অংশ হিসেবেই গীতি কবিতা,বা গান গাওয়া কবিতার জয়যাত্রা শুরু হয়েছিল সেই শুরুর দিন থেকেই। বাকি ভারতীয় ভাষায় সেই জনমোহিনী অভ্যেস আজও চললেও(ব্যতিক্রম দক্ষিণ ভারতীয় দু একটি ভাষা) বাংলা ভাষা সেই প্রবণতা অতিক্রম করে গত শতকের প্রথম ভাগেই। স্বয়ং কবিগুরুই সে দায়িত্ব তুলে নেন নিজ হাতে। না,এখানে অপর ভাষাভাষী কবিতাকে ক্ষুদ্র দেখিয়ে বাংলা কবিতার জয়গান করতে চাওয়া হয়নি। অপরায়নেও আস্থা নেই। কিন্তু যা বাস্তব তা স্বীকার করতেই হয়। গীতি কবিতা,অন্তমিলের কবিতা মানেই খারাপ একথা বলারও ধৃষ্টতা না দেখিয়েও বলা যায়,ইওরোপীয় কবিতা বহু পূর্বেই এর বাইরে চলে আসে। এবং ইওরোপীয় কলোনির রাজধানী হিসেবে কলকাতা ও তার পার্শ্বস্থ জেলাগুলিতে,পরবর্তীতে সমগ্র অখণ্ড বাংলা জুড়েই আধুনিক বাংলা কবিতা চর্চার শুরু হয় বিশ শতকের শুরুর দিক থেকেই।
বাঙালিকে স্বভাবকবি হিসেবে ব্যঙ্গ্য করা হলেও এ কথা সত্য,কবিতা ও কবিতা কেন্দ্রিক চর্চা ও তার উন্নতির জন্য বাংলা ভাষাভাষী বিবিধ কবি গোষ্ঠী বিভিন্ন সময় কালে তাদের মত করেই পুরনো বাংলা কবিতাকে ভেঙেচুরে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনয়নে সচেষ্ট হয়েছিলেন। রবীন্দ্র পরবর্তী যুগে কল্লোল, কৃত্তিবাসসহ আরও অন্যান্যরাও তাতে যোগদান করেন।
রবার্ট ব্রাউনিং এর ভাবনা,the god is perfect poet. অনাস্থা না রেখেও বলাই যায় কবিতায় আধুনিকতা বিষয়ে নীচোক্ত কথাগুলি সর্বৈব সত্য।
Poetry is not a turning loose of emotion, but an escape from emotion; it is not the expression of personality, but an escape from personality. But, of course, only those who have personality and emotions know what it means to want to escape from these things
~Elliot
আর ঠিক এখান থেকেই বাংলা কবিতার উড়াল… হাংরি, নিম, শ্রুতি এবং নতুন কবিতা আন্দোলন বাংলা কবিতার আক্রমণকারী যারা ভাবেন তারা কবিতার অচলায়তনে বিশ্বাসী। আমাদের মনে হয় এই সমস্ত আন্দোলন বা আবহমান কবিতাকে আক্রমনকারী বা ধাক্কা দেওয়া এই সমস্ত ধারাই বাংলা কবিতাকে আদতে পুষ্ট করেছে। বিজ্ঞান যেমন নিত্য পৃথিবীতে ইলেক্ট্রন প্রোটনের যুদ্ধের দ্বারাই সৃষ্টির সন্ধান করে,সেভাবেই বাংলা কবিতাও আসলে এই সমস্ত প্রথাভাঙার খেলায় আদ্যন্ত সমৃদ্ধই হয়েছে। যার কোনো তুলনা এই উপনিবেশের আর কোনো ভাষার ক্ষেত্রেই ঘটেনি বলে মনে করা হয়। ব্যাপারটা এমন নয়,আমরা নিজেদের শ্রেষ্ঠ ঘোষণার জন্য অপরাপর ভাষায় রচিত কবিতাকে ক্ষুদ্র জ্ঞান করছি। বরং বলা যায়,আর কেউ শ্রেষ্ঠত্বের দাবী নিয়ে হাজির হতেই পারেন, কিন্তু এত বৈচিত্র্য এত বৈরিতা এবং সর্বোপরি উত্তর আধুনিকতার চর্চায় বাংলা কবিতা আজ বিশ্বের যে কোনো ভাষায় রচিত কবিতার মতই সম-পারদর্শী।
আসা যাক নিজেদের কথায়। ৩৩এ পা দেওয়া যুবক ঐহিক মূলত গদ্য ও বিষয় ভিত্তিক সংখ্যার জন্যই পরিচিত এবং স্বীকৃতও। বিক্ষিপ্ত ভাবে কবিতা কেন্দ্রিক কিছু কাজ ঐহিক করেছে,যেমন শ্যামল সিংহ,রণজিৎ দাশ ও গৌতম চৌধুরী সম্মাননা সংখ্যা,তবু ঐহিকের পরিচিতি পূর্বোক্ত ক্ষেত্রেই। এবার চৌত্রিশে পা দেওয়া ঐহিক কবিতা ক্ষেত্রেও অংশগ্রহণে ইচ্ছুক। হাজার হোক ভাষা মাতৃকার প্রথম সন্তান তো কবিতাই। তাকে অস্বীকার করে সাহিত্য চর্চা আদতেই অনর্থক।
তাই এবার ঐহিক কবিতার,এবার থেকে নিয়মিত ভাবে গদ্যের পাশাপাশি কবিতারও। এবার ঐহিক বাংলা কবিতার। বাংলা কবিতার সহস্রাব্দ প্রাচীন উত্তরাধিকারকে সম্মান প্রদর্শন করতে এবার ঐহিক অনলাইনের শিরোনাম চর্যাপথ ১। কারণ আগামীতে নিয়মিত কবিতা ও কবি ও কবিতা কেন্দ্রিক চর্চায় থাকবে ঐহিক। এবার ঐহিক চর্যাপথ ১ আ ট্রিবিউট টু বাংলা কবিতা। পাঠক পাশে থাকুন। কবিতা ও কবিতা কেন্দ্রিক চর্চায় আমাদের ইচ্ছে রইল নাইটিংগেল হয়ে ওঠার,যে নিজে অন্ধকারে থেকেও আলোকিত দিনের সন্ধানে ব্যাপৃত। A poem begins as a lump in the throat, a sense of wrong, a homesickness, a lovesickness.
~Robert Frost
ভালোবাসার উড়াল আর
কবিতা সহায়।
একটি ডিসক্লেইমার : বাংলা কবিতার অপরূপ অনিন্দ্যসুন্দর রূপ ও গুণ মাধুরীর এক অতি ক্ষুদ্র ভক্ত রূপেই এই যৎসামান্য নিবেদন। যদি ভুল ত্রুটি থাকে তা আশা করি আপন মনের মাধুরী মিশায়ে মার্জনা করবেন। যদি স্পর্ধিত হয়ে থাকি ক্ষমাপ্রার্থী। আর সংযোজনে বলব,সমগ্র সংখ্যাটি যিনি আপন মাধুরী মিশায়ে লালিত করেছেন,তিনিও একজন আদ্যন্ত কবি,সে বাঙলা ভাষাভাষী কবি সমাজ তাকে স্বীকৃতি দিক বা না দিক। তার প্রতি আমাদের ঋণ অশেষ। তিনি মেঘ অদিতি। আর সর্বজ্ঞাতার্থে বলি,বাংলা ভাষার মাঝে কাঁটাতারে আমাদের বিশ্বাস নেই। ছিলও না কখনো।