
কাশ্মীরি কবি আমিন কামিল-এর কবিতা
আমিন কামিল (১৯২৪-২০১৪) কাশ্মীরি কবিতার একজন প্রতিভাবান ব্যাক্তিত্ব।আধুনিক কাশ্মীরি গজল (প্রেমের কবিতা) তাঁর হাতেই বিশিষ্টতা অর্জন করে।কাশ্মীরি গজলকে তিনি উর্দু ও ফারসি গজল থেকে স্বতন্ত্র এক বৈশিষ্ট্য প্রদান করেন।উর্দু কবিতার আরেকটি ধারা নাজম (বর্ণনামূলক কবিতা)।আমিন কামিলের বেশ কিছু স্মরণীয় নাজম রয়েছে।তাঁর কবিতা তাঁর সমসাময়িকদের এবং পরবর্তী প্রজন্মকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল।কবিতার পাশাপাশি তিনি কিছু ছোটগল্প, একটি উপন্যাস লিখেছেন।সাহিত্য সমালোচক হিসেবেও তিনি যথেষ্ট সমাদৃত হয়েছিলেন।আধুনিক কাশ্মীরি বর্ণমালা নির্মাণে তাঁর ভূমিকা ছিল।সুফি কবিতার তিনটি সংকলন তিনি সম্পাদনা করেন।অনুবাদ করেছেন রবীন্দ্রনাথের ডাকঘর নাটক ও উর্দু কবি ইকবালের কবিতা।দক্ষিণ কাশ্মীরের কাপরিন নামে একটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কলাবিভাগে স্নাতক হন।পরে আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন পাশ করেন।১৯৪৭-৪৯ দুবছর ওকালতি করেন।পরে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন শ্রীনগরের শ্রী প্রতাপ কলেজে।পঞ্চাশের দশকে প্রোগ্রেসিভ রাইটার্স মুভমেন্টে যোগদান এবং এর প্রভাবেই প্রথমে উর্দুতে লেখালিখি করলেও নিজের প্রকাশ-মাধ্যম হিসেবে কাশ্মীরি ভাষাকেই বেছে নেন।১৯৫৮ সালে স্টেট কালচারাল একাডেমি তৈরি হলে সেখানে তিনি কাশ্মীরি ভাষার আহ্বায়ক হিসেবে যোগ দেন।এই চাকরি থেকেই অবসর নেন ১৯৭৯ সালে।অজস্র পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন।১৯৬৭ সালে পেয়েছেন সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার।২০০৫ সালে তাকে দেওয়া হয় পদ্মশ্রী সম্মান।২০১৪ সালে নব্বই বছর বয়সে তিনি জম্মুতে মারা যান।অনুভূতির সতেজতা,পরিশীলিত অভিব্যক্তি,শৈলীর অভিনবত্ব আমিন কামিলের কবিতাকে এক নিজস্ব চরিত্র দিয়েছে।তিনি সুক্ষ্ম হিউমার ব্যবহার করেন তাঁর সময় ও সমাজকে কবিতায় ফুটিয়ে তুলতে এবং তাতে মিশে থাকে তাঁর নিজের পর্যবেক্ষণ।তার কবিতা একইসঙ্গে সরল ও গভীর। অনুসন্ধিৎসু এবং মেটাফিজিকাল তবে তা নিজস্ব শিকড়ে গভীরভাবে প্রোথিত।
একটি গীতোচ্ছ্বাস মহান আমাদের নিয়তি, মহান আমাদের ভাগ্য! লা লা লা! তুষারাবৃত উঁচু পাহাড়ের মধ্যে আমাদের ইলিজিয়াম! লা লা লা! বিজাতীয় কোনো রাজনীতিই এখানে খাটে না, আমাদের জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্য! লা লা লা! নিঃস্ব এক রাজা যোগ্য ছিল না আমাদের রাজা হবার, একশত রাজাকে মেনে চলি আমরা। লা লা লা! তাসের খেলায় রঙিন তাসটি হারিয়ে দিয়েছিল রাজাকে, গণতন্ত্রের এটাই আমাদের উত্তরাধিকার। লা লা লা! সমস্বরে তারা আর্তনাদ করেছিল, “ ও ইউসুফ, ফিরে এসো!” আমাদের প্রয়োজন মর্যাদা ও সম্মান! লা লা লা! 'প্রবেশাধিকার' ও 'সমর্পণ' দুই-ই আমরা বিক্রির জন্য রেখেছি, এই দোকানটি যেন পরিপূর্ণ থাকে আমাদের ইচ্ছে! লা লা লা! উচ্চ আসন থেকে সে পতিত হয়েছিল, আমাদের সকলের জন্য, আসনে বসেছেন এইজন, আমাদের সকলের জন্য! লা লা লা! উচ্চবংশীয় মোরগ সগর্বে ঢিবিতে চড়ে বসে, সামর্থ্য ও গুণ অর্থহীন সেখানে। লা লা লা! বালিশের নীচে পাওয়া গেছে একবস্তা সোনার মুদ্রা। একে বলা হচ্ছে ঈশ্বরের দান। লা লা লা! গোগ্রাসে গিলছিল যে অসংখ্য ইঁদুর, তারা এখন পেনসনভোগী, বিড়ালটিই এখন সম্মাননীয় সন্ত। লা লা লা! দপ্তর পুড়ে গেছে, কারখানা পুড়ে গেছে, নথিপত্র পুড়ে গেছে। বিচারকেরা বলেছেন বিপর্যয়। লা লা লা! আমাদের বিদ্বজ্জন, ভাব যেন দেদার খরুচে হাতিম। তারা নিয়ে যায় “যদি” ও “কিন্তু” র দিকে। লা লা লা! যাকিছু তুচ্ছ ঘটে তারা বিবৃতি দেন, আমার মত মহাশয়েরাও খুবই জনপ্রিয়! লা লা লা! আমাদের মূঢ়তা অদ্ভুতভাবে ঢেকে আছে আকাশকে। আত্মগত সত্তা রোদ্রহীন! লা লা লা! আমাদের ভালোবাসা সীমাহীন, দিগন্তকে ঘিরে রাখে! ভালোবাসি অনেকানেক রমণীকে! লা লা লা! হাম কো কেয়া মানেগা তুম কো লাট সায়েব!* আমরা দেখাই উর্দু ক্রোধ। লা লা লা! ইলিজিয়াম—গ্রীক পুরাণে উল্লিখিত মৃত পুণ্যাত্মাদের বাসভূমি /স্বর্গ /অমরলোক / দিব্যধাম। ইউসুফ—ইউসুফ শাহ চাক।কাশ্মীরের শেষ স্বাধীন মুসলিম সম্রাট। তাঁর শাসনকাল ১৫৭৯-১৫৮৬। হাতিম—হাতিম আল-তাই ( মৃত্যু-৫৭৮ খ্রীঃ) ছিলেন আরবের তাই উপজাতির শাসক ও কবি।তিনি তাঁর দানধ্যান ও উদারতার জন্য মুসলিম সমাজের কাছে আজও কিংবদন্তি। একটি প্রবাদই আছে 'হাতিমের চেয়েও উদার'। *আমি কী করে তোমায় লাটসায়েব ভাববো? এখানে এই শহরে কোনো পয়গম্বর, কোনো দূত আসেনি, এখানে এই শহরে, শুধু স্বৈরাচারী, কোনো ভগবান জন্ম নেননি, এখানে এই শহরে। অন্যদের ছায়ারা কেবল কৌতুক করে চলে আমাদের হৃদয়ে, ব্যক্তির নিজস্ব সত্তা দেখা যায়নি কখনো, এখানে এই শহরে। বিষণ্ণ পরিবেশ, অন্ধগলি আর থিকথিকে বাড়িগুলি! যে-ই পা রেখেছে হারিয়ে গেছে, এখানে এই শহরে। প্রত্যেকেরই একটি ফতোয়া আছে অথবা মাথা বিকিয়ে দিয়েছে, বা জীর্ণ পোশাক পরিহিত ; আলিঙ্গন করার মত কে কোন সৌন্দর্যকে দেখেছে? এখানে এই শহরে। একবিন্দু জলও নেই পান করার মত, দৈত্যদের শাসন, শবেদের স্তুপ, ছিঁড়ে খাওয়ার জন্য কোনো কাকও নেই, এখানে এই শহরে। পাথরে ফোটা ফুলের কোনো আকাঙ্ক্ষাই তৃপ্ত হয় না, হায়! শুধু বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ, গ্রীষ্মবাতাসের ক্রোধ, এখানে এই শহরে। ও বন্ধু! প্রলুব্ধ হয়ো না কোনো চোখ-ধাঁধানো প্রেমের কামনায়! কোনো উষ্ণ বিস্তার, কোনো অলংকার আর নেই, এখানে এই শহরে। শিশির বাগানে নীরবে এসেছিল শিশির গতরাতে। দুঃখের খবর বলার ছিল তার। সারারাত্রি ধরে সে জানিয়েছিল সেকথাই যা সকল মসজিদ ও মন্দিরের পূজারীরা জানায়, ফুলের কানে কাঁদতে কাঁদতে সে ফিসফিস করে বলে : “ এই পৃথিবী নশ্বর , ক্ষণস্থায়ী তার সকল হাসি আর আনন্দ। কান্না নিয়ে আমরা আসি, আর্তনাদ করে ফিরে যাই।” সকালের সূর্য উঠেছিল, স্বচ্ছ হয়েছিল মনের কুয়াশা আর চোখ আশপাশ দেখতে পাচ্ছিল। শিশিরকণা—গুটিয়ে যায় ভয়ে, পালিয়ে গেল অন্ধকার রাতের দূত। ফুলগুলি হেসে উঠেছিল, কুড়িগুলি— হাততালি দিচ্ছিল আনন্দে আর ফুটে উঠলো লাবণ্যে।