‘বন্ধুরা বিদ্রূপ করে তোমাকে বিশ্বাস করি বলে’। লিখেছিলেন অলোকরঞ্জন। কিন্তু প্রশ্নটা হল কাউকে বিশ্বাস করলে বন্ধুরা বিদ্রূপ করবে কেন? প্রশ্ন যেমন সহজ উত্তরও তেমনই। বিশ্বাস করার অযোগ্য কোনও ব্যক্তিকে বিশ্বাস করলে বন্ধুরা বিশ্বাসকারীকে বোকা বলে মনে করে, তাই বিদ্রূপ করে। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে যে, কে বোকা আর কে নয় সেটা যাকে বোকা বলে মনে করা হচ্ছে সে ঠিক করে না। ঠিক করে তারা যারা বোকাকে দেখছে। আচ্ছা, কোনো একজন যদি অপরকে বোকা বলে তাহলে কি যাকে বোকা বলা হল সে বোকা হয়ে যায়? মোটেই না। বরং যখন অনেকে কোনও একজনকে বোকা বলে দেগে দিতে থাকে তখন কাউকে বোকা বলে ধরে নেওয়া হয়। এবার ভেবে দেখুন ওই ধরে নেওয়া হয় শব্দটা সম্পর্কে। কে চালাক, কে বোকা, কে ভদ্র, কে-ই বা অভদ্র এইসমস্তই আমরা ঠিক করি ধারণার ভিত্তিতে। অর্থাৎ বোকা আসলে একটা পাবলিক পারসেপশন বা গণধারণা।আর পাবলিক পারসেপশানের ডোমেনেই আমাদের ভাবনার দৈন্যগুলো বা বলা যায় গণবোকামিগুলো চালাকির মর্যাদা নিয়ে দাঁড়াবিহীন কাঁকড়ার মতো চিৎ হয়ে থাকে।
ব্যাপারটা এবার আসুন একটু খতিয়ে দেখা যাক। গণধারণা শব্দটা যখন কথাসূত্রে এসেই পড়ল তখন আমাদের খুঁজতেই হবে যে একটা গণধারণা কীভাবে তৈরি হয়, আর সৃষ্টিমুহূর্ত থেকে বিনাশ পর্যন্ত এই একটি ধারণার সঙ্গেই বোকামির চরিত্রগত মিল – অমিল বুঝে নিলে বোকা কাকে এবং কেন বলা হয় সেটা স্পষ্ট হয়ে যাবে বলেই আশা করি।
আসলে আমরা যা অনুভব করি সেটাই প্রকাশ করতে চাই। আর এই প্রকাশের ধরন- ধারণই বুঝিয়ে দেয়, কে চালাক আর কে বোকা। যা আমরা অনুভবই করতে পারি না আমাদের কাছে তার অস্তিত্ব নেই। সুতরাং এই নাস্তির প্রসঙ্গ এই আলোচনায় আসবে না। কিন্তু ভাবুন, যা অনুভব করি তার সবই কি আমরা প্রকাশ করতে চাই? প্রবল যন্ত্রণায় কেউ ‘আ:’ করে ককিয়ে ওঠে আবার কেউ চুপ করে যন্ত্রণা সহ্য করেই আনন্দ পায়। এখন গণধারণা এই চিৎকার আর স্তব্ধতার মামলায় কী রায় দেবে? এক্ষেত্রে কে বোকা? এইবার ভেবে দেখুন যে, গণধারণা এই ক্ষেত্রে দেশকাল – নিরপেক্ষ কোনও একটিইমাত্র রায় দেয় না। সে কোথাও বলে, ‘ না পেলে তোমায়, আমি কি চিৎকার করব না? /বসে থাকব জব্দ অভিমানে? ‘ আবার অন্যত্র সে বলবে, ‘ সহ্য করো, সহ্য করো /সহ্য, সহ্য, অস্ত্রচিকিৎসক /আমি দম নিতে পারছি না ‘। তাহলে ব্যক্তি, পরিস্থিতি, সময় এই সমস্তকিছুর সাপেক্ষে স্থির হবে প্রকাশের ধরন। সুতরাং, যে অভিব্যক্তির কোনও সার্বিক গ্রহণযোগ্যতা নেই সেই অভিব্যক্তির উপরে নির্ভর করে আমরা কীভাবে বিচার করব কে বোকা আর কে বুদ্ধিমান? কিন্তু আমরা করি। কিসের ভিত্তিতে এই বর্গীকরণ করি? আসলে আমরা স্থির করি যে কোনও নির্দিষ্ট সময় এবং স্থানে ব্যক্তির আচরণ, মানে যাকে আমি বলেছি অনুভবের বহি:প্রকাশ সেটা কতখানি যুক্তিযুক্ত ছিল। এইবার এই সূত্রে এসে পড়ল যুক্তির প্রসঙ্গ। এই প্রসঙ্গে বিশ্বজুড়ে কাজ কম হয়নি। মানুষ যে যুক্তিশীল একদিক থেকে সেটা যেমন নির্ধারিত তেমনই অন্যদিক থেকে বলা যায় সব প্রাণীই প্রাকৃতিক নিয়মে যুক্তিশীল; কেবল মানুষই যুক্তিশীল হয়েও যুক্তিকে পেরিয়ে যেতে পারে কল্পনায়। তাই যুক্তিযুক্ত কাজ যে করে সে বোকা নয় এটা বললে ছাগলকেও বুদ্ধিমান এমনকি মানুষের থেকে বেশি বুদ্ধিমান বলতে হয় ; কিন্তু এমনটা বলতে পারা যায় না, কারণ ছাগল যুক্তিশীল বটে, কিন্তু তার বিচার করার দক্ষতা বেশি নেই। তাহলে কথা হল যে যুক্তি-বুদ্ধি ব্যবহার করে পরিস্থিতির সঠিক বিচার করতে পারে সে-ই বুদ্ধিমান। কিন্তু এমনটাই কি সত্যি? শুধু সঠিক বিচার – বিবেচনা করলে তো হবে না, সে যে বিবেচনা করল তার প্রকাশ যতক্ষণ না দেখতে পাব ততক্ষণ জানব কীভাবে যে সে কী বিবেচনা করল? অতএব তার বিবেচনার প্রকাশ চাই। এই প্রকাশটারই নাম সিদ্ধান্ত। আমরা তাহলে কোনো পরিস্থিতিতে কারো সিদ্ধান্তকে খতিয়ে দেখে স্থির করি সে বোকা,না বুদ্ধিমান।
এখন কথা হল, কোন সিদ্ধান্তকে আমরা বুদ্ধিমানের নেওয়া বলব আর কাকে বলব বোকার? এই ক্ষেত্রেই আসবে গণধারণা। গণধারণা আসলে কী? এটা একটা প্রতিষ্ঠানের নেওয়া সিদ্ধান্ত, যে সিদ্ধান্তকে সেই বিশেষ সময়কালে সেই সমাজের সকলে মান্যতা দেয়। প্রতিষ্ঠানের একেবারে তলা থেকে যদি সেই সিদ্ধান্ত আসে তাহলে তাকে বলে সর্বহারার একনায়কতান্ত্রিক; প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাগরিষ্ঠের মতকে যদি মান্যতা দেওয়া হয় তবে সেটা হয় গণতান্ত্রিক, আর যদি উপর থেকে সেই সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া হয় তবে সেটা রাজতান্ত্রিক অথবা এলিটিস্ট বা সম্ভ্রান্ততান্ত্রিক বলে গৃহীত হয়। এখন মজা হল এই প্রত্যেকটি তন্ত্রের মূল বিষয় হল ক্ষমতা, যে অংশের ক্ষমতা বেশি হবে সেই তার সিদ্ধান্ত অন্য আর পাঁচজনের ওপর চাপিয়ে দিয়ে এটা ঠিক করে দিতে চাইবে যে কে বোকা আর কে বুদ্ধিমান। মানুষের ইতিহাসের সুদীর্ঘ যাত্রাপথ পরিভ্রমণ করলে দেখা যাবে, বুদ্ধিই বল অর্থাৎ ক্ষমতা। সুতরাং এটা বলা যেতেই পারে যে প্রতিষ্ঠানের যে অংশ যত বেশি বুদ্ধিমান তার ক্ষমতা তত বেশি। অর্থাৎ সে ঠিক করতে পারে সমাজে বোকা কে? তাই বোকা কখনও ঠিক করতে পারে না যে কে বোকা। বুদ্ধিমানেরা যে সিদ্ধান্ত নেয় তাকেই একটা ডিসকোর্সে পরিণত করে এবং বোকা চিরকাল সেই ডিসকোর্সের দাসত্ব করতে থাকে কিন্তু বুঝতেই পারে না যে সে আসলে একটা ডিসকোর্সের দ্বারা চালিত, সে ভাবে যে, সে নিজেই নিজের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। কিন্তু মজা হল এই সমাজ নামক প্রতিষ্ঠানে সবাই বোকা নয়। যারা বোকা নয় তারা প্রচলিত ডিসকোর্সকে প্রশ্ন করতে থাকে। যতই তারা প্রশ্ন করে ডিসকোর্সকে আঘাত করতে থাকে ততই ওই ডিসকোর্স দ্বারা চালিত সাধারণের মনে হতে থাকে যে, প্রশ্নকারীটি বোকা ; কারণ সে তো ডিসকোর্স মেনে চলে আর ডিসকোর্স তো তাকে শিখিয়ে দিয়েছে যে যারা ডিসকোর্সকে যত মেনে চলবে তারা তত বুদ্ধিমান। ফলে প্রাথমিকভাবে যারা ডিসকোর্সকে প্রশ্ন করছে তাদের মনে হয় বোকা ; কিন্তু এই বোকারা প্রশ্ন করতে করতে একসময় নতুন ডিসকোর্সের জন্ম দেয় অর্থাৎ ডিসকোর্স ফ্লো শুরু হয়। সময় লাগে, কিন্তু হয় আর যেই মুহূর্তে নতুন ডিসকোর্সের পথ চলা শুরু হয় সেই মুহূর্ত থেকেই আগের ডিসকোর্সে যারা বোকা বলে চিহ্নিত হচ্ছিল তারাই নতুন ডিসকোর্সের চালকের আসনে বসে, বোকারা বুদ্ধিমানের মর্যাদা পেতে থাকে আর পুরোনো ডিসকোর্সের অনুসরণকারী অতীত – বুদ্ধিমানরা বোকা বলে পরিগনিত হয়। এভাবেই যেকোনো জ্ঞানতাত্ত্বিক ইতিহাস এগিয়ে চলে। সুতরাং বোকার ধারণা কেবল একটি দেশকালের সীমার সাপেক্ষে সত্য হতে পারে কিন্তু চিরসত্য নয়। সময় পালটায়, পালটে যায় দেশ আর পালটায় ডিসকোর্স। বর্তমানের যে বুদ্ধিমানেরা ডিসকোর্সের অনুগামী, ভবিষ্যতে তারা বোকা বনে যায় আর ভবিষ্যৎ বর্তমানের বোকাদের মাথায় তুলে দেয় নতুন সমাজের শিরস্ত্রান।
তাই বিশ্বাস বড়ো বিশ্বাঘাতক।অবিশ্বাসীই হয়তো জিতে যায় ভবিতব্যের ম্যারাথন।