
১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে প্যারিসে রবেয়ার ফ্রাঁসোয়া দামিয়াঁস (Robert Francois Damiens) নামে এক ফরাসি প্রজা একটি শানিত ছুরির সাহায্যে তৎকালীন ফরাসি রাজা পঞ্চদশ লুইকে হত্যার চেষ্টা করেন এবং ব্যর্থ হন। তৎকালীন ফরাসি আইন অনুযায়ী দামিয়াঁসকে অকথ্য নির্যাতনের পর জীবন্ত দাহ করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৭৫-এ প্রকাশিত হয় মিশেল ফুকোর একটি বই Suveiller et punir, যা ১৯৭৭-এ ইংরেজি ভাষায় অনুদিত হয় Michel Foucault : Discipline and Punish : The Birth of Prison নামে। অনুবাদ করেন Alan Sheridan. এই বইটি শুরু হয়েছে সেই ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে রাজহত্যার প্রচেষ্টার কারণে দামিয়াঁসের ওপর যে অবিশ্বাস্য দৈহিক উৎপীড়ন করা হয়েছিল, তার বর্ণনা দিয়ে। সেই ভয়ংকর বর্ণনা আধুনিক মনস্ক মানুষদের বিব্রত করলেও, তৎকালীন আইনের দিক থেকে সেই নিদানের পক্ষে যথেষ্ট যুক্তি ছিল। রাজা হলেন একটি জাতির সংহতি ও শৃঙ্খলার প্রতীক। একটি জাতির ভবিষ্যৎ, উৎকর্ষতা এবং স্থায়িত্ব নির্ভর করে রাজার কর্ম ও কর্মপন্থার ওপর। তাহলে সেই সমাজ গঠনের হোতার ওপর আঘাতের শাস্তি হতে পারে অপরাধীকে অতিশয় দৈহিক যন্ত্রণা সহযোগে হত্যা করা। অর্থাৎ, একটি বৃহৎ ক্ষমতা(সাংগঠনিক ক্ষমতা), যাকে মেনে নেওয়া হয়েছে বা মানতে বাধ্য করা হয়েছে, যা একটি সমাজ তথা জাতির মানোন্নয়নের প্রতিভূ, তাকে যখন একটি ক্ষুদ্র ক্ষমতা(এখানে ব্যক্তিক্ষমতা) যখন আঘাত করতে চায়, তখন সেই ক্ষুদ্র ক্ষমতাকে এমনভাবেই বিনাশ করা হয় যাতে পরবর্তীতে অন্য কেউ বা কারা কল্পনাতেও বৃহৎ ক্ষমতার বিরোধিতার কথা না ভাবে। কিন্তু এই যে দৈহিক যন্ত্রণা প্রদানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতার আধিপত্যকে বুঝিয়ে-দেওয়া—সেই যুগের অবসান হয়ে পরবর্তীতে এল যুক্তির যুগ। রাজতন্ত্রে বিদ্রোহীদের মূল শাস্তি ছিল দৈহিক। কিন্তু যখন ফরাসি বিপ্লব সংঘটিত হল, তখন এই কেন্দ্রিভূত ক্ষমতা তার রূপ বদলালো। একটি বৃহৎ সংগঠন থেকে আর একটি বৃহত্তর সংগঠনে ক্ষমতার স্থানান্তর বা অবস্থান্তর হল ভিন্নরূপে, তথাকথিত কিছুটা সভ্য রূপে। দার্শনিক, ভাবুক, সমাজ-সংস্কারকরা উদ্গ্রীব হয়ে উঠলেন অপরাধীদের দৈহিক শাস্তি না দিয়ে, তাদের ধ্বংস না করে ধীরে ধীরে চিন্তার বদল ঘটিয়ে, সংস্কৃতিবান করে সমাজের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনার পরিকল্পনায়। অর্থাৎ, প্রধান ক্ষমতা, পূর্বে সমাজদ্রোহীকে শারিরিক নির্যাতনের মধ্য দিয়ে বাকিদের এই বার্তা প্রেরণ করতেন যে তোমরাও প্রধানক্ষমতার বিরোধী হলে বা ক্ষতি সাধন করতে এলে এই ভয়াবহ অবস্থার মধ্য দিয়ে যাবে। আর পরবর্তীতে প্রধান ক্ষমতা দ্বারা কৃত আইন বিদ্রোহীর বা অপরাধীর দেহকে শাস্তি প্রদানের লক্ষ্যবস্তু না করে তার মনকে স্থান দিলেন। সেখান থেকে এল আধ্যাত্মিকতা এবং যুক্তির জাল বয়ন হল। ফুকো তাঁর উক্ত রচনায় দেখালেন, কীভাবে যুগে যুগে যে নব নব জ্ঞান ও চিন্তার উন্মেষ হয়, এবং যা প্রকাশিত হয় কথ্যে বা লিখিত আকারে—তা সেই যুগের আইন ও ক্ষমতাকে সমর্থন জানায় এবং গড়ে তোলে এক একটি ক্ষমতার যন্ত্র। ঠিক একইভাবে, বিপ্লবোত্তর ইউরোপে অষ্টাদশ শতকের শেষ থেকে উনিশ শতক পর্যন্ত মনকে কেন্দ্র করে এক ক্ষমতার এক অভিনব অভিনিবেশ গড়ে তোলা হল—যার নাম ‘প্যানঅপটিকন’(Panopticon). যার বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘সর্বদ্রষ্টা’। এই প্রকল্পের আবিষ্কারক ছিলেন জেরেমি বেন্থাম (Jeremy Bentham). এই প্রকল্পের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল সমাজঘোষিত অপরাধীদের কীভাবে পুনরায় ক্ষমতার অধীনে এনে সমাজের মূলস্রোতে মিশিয়ে দেওয়া যায়। অষ্টাদশ শতকের শেষে বেন্থাম ‘প্যানঅপটিকন’ নামে একটি রচনা প্রকাশ করেন। তাতে যে চিত্র পাওয়া যায় তা অনেকটা এইরকম : একটি বিশাল গোলাকৃতি কারাগার, তার কেন্দ্রে অনেক জানালাযুক্ত একটি মিনার। এইসব জানলা দিয়ে দেখা যাবে বৃত্তের পরিধির ভেতরের দিকের সমস্ত অংশ, বৃত্তাকার বাড়ির থাকবে শ্রেণিবদ্ধ ছোটো ছোটো ঘর। প্রতিটি ঘরে থাকবে দুটি জানালা—একটি মিনারের দিকে, আরেকটি বাইরের দিকে—সূর্যালোকের জন্য। এই ঘর বা ছোটো ছোটো সেলগুলিতে থাকবে অপরাধীরা, আর মিনারে থাকবে এক বা একাধিক লোক যারা নজর রাখবে প্রতিটি সেলে এবং সেলের ভেতরে স্থিত অপরাধীদের কর্মকাণ্ডে।
অথচ তাদের কেউ দেখতে পাবে না। আমাদের নিশ্চয়ই মনে পড়ে যাচ্ছে লেখক ফ্রানজ্ কাফ্কা রচিত ক্যাসলের কথা!
এই পরিকল্পনার উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য গভীর ও গুরুত্বপূর্ণ। এখানে নজরদাতা অর্থাৎ ক্ষমতা অদৃশ্য এবং আকারহীন (যা আমরা কাফ্কার লেখাতেও দেখে থাকি)। যে যুক্তি ও মানবপ্রেমকে সম্বল করে অষ্টাদশশতক এক মুক্তির যুগ হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল, আসলে তা ছিল ক্ষমতায়নের এমন এক পরিশীলিত গঠন যা আমাদের চিন্তাচেতনাকে অধিকার করে বশীভূত করতে চেয়েছিল। বেন্থামের ওই পরিকল্পনাকে স্বীকৃতি দিয়ে সারা উনিশশতকব্যাপী ইয়োরোপ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অনেক কারাগার গড়ে উঠেছিল। এবং আমরা দেখতে থাকি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বেন্থামের এই পরিকল্পনা আরও কার্যকরী ও উন্নত রূপ নিয়ে ক্ষমতার প্রতিভূ হিসেবে পরিণত হয়। যার মধ্য দিয়ে ক্ষমতা তার অধিকার কায়েম করে সুচারু রূপে। আধুনিক সমসাময়িক সমাজে বেন্থামের ‘প্যানঅপটিকন’ কীভাবে মানুষকে শাসনে রাখছে, করছে ক্ষমতার অধিকারভুক্ত জীব, মেনে নিতে বাধ্য করছে ক্ষমতাপ্রদত্ত স্বাভাবিকতাকে—সে বিষয়ে ফুকো বলেন, “স্বাভাবিকতার বিচারক এখানে সর্বত্রবিরাজী। আমরা রয়েছি শিক্ষক-বিচারক, অধ্যাপক-বিচারক, সমাজসেবী-বিচারকের সমাজে। এদের সকলের কাজ স্বাভাবিকতার সার্বভৌম রাজত্ব চালিয়ে নিয়ে যাওয়া।” দমনকারী শক্তিকে সহায়তার করার জন্য বেন্থামের তৈরি এই প্রকল্প বা পদ্ধতি কেন ভালো লেগেছিল তৎকালীন মানুষদের, কেন তারা এর মধ্যে খুঁজে পেলেন মানবপ্রেম! ফুকোর মতে তার কারণ অতীত অভিজ্ঞতা, যা মূলত রাজতন্ত্রবাহী, তা মানুষকে দিয়েছিল এমন এক অন্ধকার, সেই কেন্দ্রীভূত ক্ষমতাকে সরিয়ে কেন্দ্রচ্যুত ক্ষমতা যখন আসীন হল, সে অধিকারের প্রয়োগপদ্ধতি বদলালো। এবং দৈহিক নিপীড়ন থেকে সরে এসে মানসিক চেতনাকে বশীভূত করার প্রকৌশলে ছড়ানো হল আধ্যাত্মিকতা ও মানবপ্রেম। এই উন্নতধরণের ক্ষমতার প্রয়োগপদ্ধতি, যাকে ফুকো বলছেন technology of power. এখন এর সঙ্গে সঙ্গে একটি প্রশ্নেরও উদয় হল। আগে, অর্থাৎ কেন্দ্রীভূক্ত ক্ষমতার শাসনে কে লাভবান হচ্ছে সহজেই বোঝা যেত, কিন্তু কেন্দ্রচ্যুত ক্ষমতার শাসনে কে লাভবান হচ্ছেন, তা নিয়ে দেখা দিল ধোঁয়াশা। এমতাবস্থায় ফুকোর বিশ্লেষণ, তথা স্বত্বাধিকারীহীন ক্ষমতায়ন ঘিরে উদ্ভুত হল বেশ কিছু প্রতর্ক। যদিও ফুকোর রচনায় শ্রেণিগত ক্ষমতার কথা উল্লিখিত, কিন্তু তা একেবারেই মার্ক্সবাদ অনুসারী নয়। কারণ ক্ষমতা এখানে কেন্দ্রচ্যুত, কেন্দ্রীভূত নয়। ফলে কোনও নির্দিষ্ট শ্রেণিকে সরিয়ে এই ক্ষমতার বিলোপসাধন অসম্ভব। এছাড়া শাসক বুর্জোয়া সম্পর্কেও ফুকোর ধারণা মার্ক্সসবাদের পক্ষে নয়, প্রায় বিপরীত। ফুকো শুধু ক্ষমতাকে কেন্দ্রচ্যুতই করেননি, ক্ষমতাকে বিক্ষিপ্তরূপে দেখেছেন—শ্রেণিস্বার্থের লড়াইয়ের মধ্যে সীমিত না রেখে। বর্তমানে কম্পিউটার শাসিত যুগকে ভালো করে লক্ষ করলে বোঝা যায়, তা আসলে ‘প্যানঅপটিকন’-এর সম্প্রসারিত রূপ। আজ ইনটারনেট ও আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে প্রতিটি নাগরিকের ব্যক্তিগত জীবনের খুঁটিনাটি সম্পর্কে বিশদভাবে খবর রাখা সম্ভব। শুধু তাই নয়, আজ যা আমাদের জীবনে লাগ্জারি আগামীকাল তাকেই আমাদের জীবনের নেসেসিটিতে পরিণত করতে পারে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স। আমাদের ভাবনার চরিত্র ও দিক এমনকি সম্পূর্ণভাবনাটিকেও সে তার মতো করে তৈরি করে দিতে পারে। এর সাহায্যে রাষ্ট্র ও পুঁজিবাদ কখনও পৃথকভাবে কখনও-বা হাত ধরাধরি করে তাদের নিজেদের স্বার্থ অনুযায়ী সংজ্ঞায়িত করতে পারে নাগরিকের দায় ও কর্তব্য, দেশপ্রেম এমনকি জীবনযাপন পদ্ধতি। যদিও ফুকো-র চিন্তায় সমাজ পরিবর্তনের সরাসরি কোনও নির্দেশ পাই না, ফলে তাঁর বিরুদ্ধে বিনাশবাদের অভিযোগও এসেছে, তার কারণ প্রথাসিদ্ধ ঐতিহাসিক চিন্তাকে বর্জন করে তিনি বংশানুচরিত পদ্ধতি গ্রহণ করেছেন। সমস্যার সহজ সুনিশ্চিত সমাধান না খুঁজে অতীত থেকে বর্তমানে যে ভঙ্গুর নিশ্চয়তাকে সমাজ মানবিক দিক দিয়ে দেখিয়েছে, ফুকো তাকে ধাক্কা দিয়েছেন, বিব্রত করেছেন।
———————–
বি: দ্র: এই অতিসামান্য সন্দর্ভের সাহায্যে ফুকোশিয় চিন্তার একবিন্দুও ছোঁয়া যাবে না। এমনকি তাঁর চিন্তার ছায়ার ক্ষণিকের প্রশান্তিও পাওয়া যাবে না। তাঁর চিন্তা যদি সমুদ্রতুল্য হয়, এই লেখাটি একটি বৃষ্টির ফোঁটাও নয়। এই সামান্য সন্দর্ভ ফুকোশিয় বিপুল চিন্তার দু-একটি hint বা ইঙ্গিত মাত্র। এমনকি, ফুকো তাঁর শেষ রচনা The History of Sexuality, মোট চার খণ্ডে বিভক্ত, যা তাঁর magnum opus, যেখানে তিনি তাঁর ক্ষমতা বিষয়ক চিন্তাগুলি আরও ঘনসন্নিবদ্ধ করেছেন, সেই মহান রচনা নিয়ে এখানে তার কোনও উল্লেখ করা হল না। ‘ঐহিক’-এর সম্পাদক দ্বারা অনুরুদ্ধ হয়ে এই লেখা। এই লেখা লেখার জন্য আমি যথেচ্ছভাবে সাহায্য নিয়েছি অমল বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত ‘উত্তর-আধুনিক চিন্তা ও কয়েকজন ফরাসি ভাবুক’ বইটির ‘মিশেল ফুকো বা মানুষের অন্তর্ধান’ রচনাটি থেকে। এছাড়া সাহায্য নিয়েছি—
Michel Foucault : Discipline & Punish : The Birth of the Prison. Translated from French by Alan Sheridan (Vintage Books, A Division of Rnadom House, Inc. New York)
Michel Foucault, power/Knowledge. Selected Interviews and Other Writings. Edited by Colin Gordon, translated by Colin Gordon, Leo Marshall, John Mepham and Kate Soper (Pantheon Books, New York)