একে একে সবাই চলে গেছে, আমি থেকে গেলাম। আমার সাজানো ফ্ল্যাট, বারান্দায় টবের বাগান। আমিও দুয়েকবার ভেবেছি— চলেই যাই। কিন্তু যাই নি, বড়ো মায়া। কথা বলার কেউ নেই, একদিন একটা পাখি কিনে আনলাম। সকাল হলে খাঁচাটা বারান্দায় ঝুলিয়ে দিই, হাওয়ায় দোলে। বারান্দায় গাছ ছিল, এখন পাখিও হলো।
“পাখি, বল্তো— হরে কৃষ্ণ।”
পাখি কিছুই বলে না। রোজ ওকে শেখাই, কিছুই শেখে না। পাখির আমার ধর্মে মতি নেই।
“পাখি, বল্তো এবার— ইনকিলাব জিন্দাবাদ।”
পাখির মুখে কথা নেই। বিপ্লবের মর্ম বোঝে না।
রাগ করে বললুম, “হারামজাদা”। পাখি চুপ। গালাগালও হজম করে নিল নাকি?
রোজ সকালে ওর কানের কাছে বলি— “হারামজা্দা।”
নাহ, পাখি শুধুই ছোলা খায়।
একদিন সকালে উঠে খাঁচার দরজা খুলে, দিলাম ব্যাটাকে উড়িয়ে। এমন গোমড়া পাখি নিয়ে কী করবো আমি। কিছুই করে না, বলে না, কেবল খাঁচার মধ্যে ঘুরপাক। কিন্তু কী কাণ্ড! একটু পরেই দেখি ওটা ফিরে এসে ঢুকেছে খাঁচার মধ্যে। কী আর করি, একমুঠো ছোলা দিলাম। ভেতর থেকে দরজাটা নিজেই বন্ধ করে খাবারে মন দিলো। পরের দিন, তারপরের দিন একই কাণ্ড। উড়িয়ে দিলেও দেখি ফিরে আসছে বারবার। হাল ছেড়ে আমি গাছে জল দিই। খাঁচায় ছোলা দিতে ভুলি না অবশ্য। এইভাবে অনেকদিন কেটে গেল, আমি গাছ ও পাখির পার্থক্য ভুলে গেলাম।
“আমাকে একটা পাখি এনে দাও।” একদিন কে যেন কথা বলে উঠলো। চমকে উঠে জিজ্ঞেস করলাম— কে?
“একটা পাখি কিনে আনো আমার জন্য”। দেখি পাখিটাই কথা বলে উঠেছে হঠাৎ। কী যে আনন্দ হলো! আমি তক্ষুনি পাখিবাজার থেকে একটা মুনিয়া কিনে এনে খাঁচার মধ্যে পুরে দিলাম। বাড়িয়ে দিলাম ছোলার বরাদ্দ, বাটিতে জল একটু বেশি। আমি এখন রোজ সকালে ওদের খুনসুটি দেখি। এ গড়িয়ে পড়ছে ওর গায়ে, ও গড়িয়ে পড়ছে এর গায়ে। মুনিয়াটাই দুষ্টু বেশি। পাখিটা আবার একদিন বলে উঠলো: “আমাদের জন্য একটা বড়ো খাঁচা এনে দাও”। তা দিলাম। এখন তো ওরা দুজন, ওইটুকু খাঁচাতে সংকুলান হবে কেন ওদের? নতুন খাঁচায় ওরা তখন ওড়ার ভান করতে লাগলো। ওটাই ওদের খেলা। ওড়া-ওড়া খেলা। বড়ো মায়া হলো — আবার দিলাম খাঁচার দরজা খুলে। কিন্তু ওরা কিছুতেই বাইরে এলো না, খাঁচার ভেতর থেকেই ওরা আকাশ দেখে আর ডানা ঝাপটায়। এইভাবে আরও অনেকদিন কেটে গেল। একদিন পাখিটা আবার বায়না ধরলো: “আমাকে একটা ছোট্ট খাঁচা কিনে দেবে?”
তুই খাঁচা নিয়ে কী করবি রে, নিজেই তো খাঁচার পাখি— ব্যাঙ্গ করে বললাম ওকে। কিন্তু সম্পর্ক তো অনেক দিনের, পাখিকে আমি ভালোবাসি। ছোট্ট একটা খাঁচা কিনে উপহার দিলাম ওকে। খুশি তো? কিছু বললে না।
পরের দিন ঘুম থেকে উঠে দেখি— মুনিয়াটা বসে আছে বড়ো খাঁচার ভিতর ছোট্ট খাঁচাটার মধ্যে। আমি অবাক হয়ে বড়ো খাঁচায় একমুঠো ছোলা দিলাম। সকালের বরাদ্দ। বড়ো পাখিটা কয়েকটা দানা মুনিয়ার ছোট্ট খাঁচায় রেখে দিল।