‘ সামান্য এই বসতবাটি দুচার বিঘা জমিজিরেত
পান্তা খেয়ে শীতলপাটি, দুধেল গোরু, তিসির ক্ষেত
লিডারবাবু যুক্তি আঁটি, শকুনমুখো পঞ্চায়েত
যেদিন বলে দখল, বলে তোর কিছু না, যাঃ
সেদিন থেকে আমিই আমার রাজা। ‘
— পিনাকী ঠাকুর
গণতান্ত্রিক দখলদারির সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে। গণতন্ত্র যখন ছিল না তখন জমিদারি- দখল, জোতদারের দখল থেকে রাজার দখল পর্যন্ত সব দখলদারির কৌশল ঠিক কী ধরণের পদ্ধতি ব্যবহার করেছে তাই নিয়ে না ভাবলে কিন্তু এই দখলের রাজনীতিকে প্রতিহত করা জটিল হয়ে উঠতে বাধ্য। আপনি হয়তো ভাবতে পারেন ‘ রাস্তাই প্রতিরোধের একমাত্র রাস্তা ‘। আপনি ভুল ভাবেননি কিন্তু পুরোটাও ভাবেননি বলেই দখলদারি অন্য আকারে / ভিন্ন রূপে আবার চেপে কখন ধরবে তার ঠিক নেই।
সৃষ্টিকর্মের মজাই এমন যে দখলদারির প্রক্রিয়ার কোনও অন্ত নেই, আদি বলে কিছু ছিল কিনা বলা যায় না। এই যেমন ধরুন, খাদ্যগ্রহণ তো সূক্ষ্ম অর্থে একরকমের দখলদারিই? কিন্তু এখানে দখলটা করছে কে? গভীরভাবে দেখলে দুজনেই দুজনকে দখল করছে। তাই অন্ন শব্দের অর্থ দুইরকম। প্রথমত যঃ অদ্যতে, মানে যা খাওয়া হয় আর দ্বিতীয়ত ‘ যঃ অদেৎ’ অর্থাৎ যা খায়। এমন অর্থ এই অর্থ প্রকাশ করে যে যাকে খাওয়া হয় সে আসলে শরীরের একটি স্থানকে পূর্ণ করে বা খায় বা দখল করে। তাহলে দখলের যে রাজনীতি সে এত ব্যপ্ত কেন? কারণ,যা সূক্ষ্ম তা সাধারণ মানুষকে স্পর্শ করে না, তারা স্থূলভাবে সম্পদ লুন্ঠনকেই জীবনধর্ম ভাবতে শেখে ও পরের প্রজন্মকে যত্ন সহকারে এই সর্বনেশে সুখ খোঁজ করতে শেখায়।
রবি ঠাকুর বলেছিলেন দখলদারের দুই অস্ত্র যোধন আর রোদন। কিন্তু এই যোধন বা যুদ্ধের যেমন নানান ধরন তেমনই রোদনও নানান কিসিমের। দুর্বলকে বশ করতে সেইসব অস্ত্র কীভাবে প্রয়োগ করা হয় সেই বিষয়ে আসুন একটু ভেবেচিন্তে দেখা যাক। জনসাধারণের বিশ্বাস এই যে অস্ত্র বলতে শুধুই যুদ্ধোপযোগী সরঞ্জাম। ছোরা, চাকু,তলোয়ার থেকে শিল্পবিপ্লব পরবর্তী আগ্নেয়াস্ত্রগুলি ভয় দেখানোর যন্ত্র বলেই এদের সামনে মানুষ ভয় পায়। দখলদার এইসব অস্ত্রে যত বেশি সজ্জিত তার প্রভাব জনমনে তত বেশি, জনসাধারণের এমন ভাবনা যথেষ্ট নয়। একটু ভেবে দেখলেই তারা বুঝতে পারবে যে বাহুবল যেমন,যুদ্ধাস্ত্রও তেমনই দীর্ঘকালীন দখলদারির ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে পারে না। পারলে প্রবল বলশালী সিংহ তার থেকে অনেক দুর্বল মানুষের কাছে বশ মানতো না। মানুষের কাছে নতিস্বীকার সিংহ নিজে করেনি, মানুষই তাকে বশে এনেছে বুদ্ধি বা ইন্টেলিজেন্সিয়া প্রয়োগ করে।অর্থাৎ ইন্টেলেক্ট হল দখলদারর সর্বাধিক ভয়ঙ্কর অস্ত্র। বোধ – বুদ্ধি – অনুভূতি – উপলব্ধির অরূপছোঁয়ায় মানুষ যে ইন্টেলেক্টের দখলদার তার পক্ষে গোটা ব্রহ্মাণ্ড জয় করা অসম্ভব নয়। এই কারণেই আলেকজান্ডারের প্রয়োজন হয় আরিস্ততলের গাইডেন্স আর চন্দ্রগুপ্ত চলেন চাণক্যের রাজনীতিতে ভর করে। আবার এই চাণক্যই সেই চাণক্য, যিনি বলেছেন —
‘ বিদ্যত্বঞ্চ নৃপত্বঞ্চ নৈব তুল্যং কদাচন
স্বদেশে পূজ্যতে রাজা, বিদ্বান সর্বত্র পূজ্যতে ‘
অর্থাৎ কিনা রাজা যতই শক্তিধর হোন না কেন, বিদ্বানের কাছে তাঁর শক্তি ম্লান হয়ে যায়, কারণ বিদ্ব্বান শুধু স্বদেশে নয় সর্বত্র পূজিত হবেন। এবারে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন বন্ধুরা, যে, চাণক্যের উক্ত এই বিদ্বানই আজকের পরিভাষায় বিদ্বজ্জন? মানে ইন্টেলেকচুয়াল। তাই এই বিদ্বজ্জনেরাই দখলদার হিসাবে সবচেয়ে সাঙ্ঘাতিক, কারণ আপনাকে বুঝতেই না দিয়ে তাঁরা দখল করে নিচ্ছেন আপনার মগজের জ্ঞানভাণ্ডার। আপনি কি তাঁদের পাত্তা দেন না? আপনি তাঁদের অধ:পাত দেখে ক্রুদ্ধ? ভালো করে ভেবে দেখুন তো আপনার এই ক্রোধ আসলে কেন তৈরি হয়। আসলে আপনি ভিতরে ভিতরে গভীরভাবে তাদেরই নির্মিত নৈতিকতার দ্বারা প্রাণিত। তাই আপনি শিখেই ফেলেছেন যে বিদ্বজ্জনরাই সমাজকে পথ দেখাবেন তাই তাঁদের থাকবে ‘ larger than life’ অর্থাৎ একটি মহৎ ও শ্রদ্ধেয় সামাজিক প্রতিমা। আপনার সেই ধারণায় আঘাত লাগলে আপনি রাগ করেন। এতে ইন্টেলেকচুয়ালিজমের বদনাম হয় বলে মনে হলেও আদতে ইন্টেলেক্টের মহত্বই প্রতিবিম্বিত হয়।
গোটা মানবসভ্যতার ইতিহাস অনুসরণ করে দেখলে বারবার এইকথাই ফিরে আসবে যে শাসকের ক্ষমতায় আসার স্ট্র্যাটেজি স্থির করে দেন কোনো না কোনো প্রশান্ত কিশোর। তাহলে এই আন্তর্জাল পাতা ভুবনে ঠিক কোন স্ট্র্যাটেজিতে ঘটে চলেছে গণতান্ত্রিক দখলদারি? কারো মনে পড়ে যেতে পারে এই বিষয়ে মার্ক্সের পথপ্রদর্শন। কিন্তু স্পষ্ট কথায় কষ্ট নেই যে মার্ক্স বা মার্ক্সের এক্সটেনশনে গ্রামশি থেকে ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুল হয়ে সার্ত্রের আন্দোলন ও কৃষক – শ্রমিক ঐক্যের দেখানো রাস্তা আপাতত কিছুদিনের জন্য বিশ্বরাজনীতিতে পরিত্যক্ত। গোটা বিশ্ব যে রাজনীতির শর্তগুলোকে অনুসরণ করে তারই স্বরূপ উন্মোচন করতে গিয়ে ফুকো বলেন ”power is everywhere ‘ এই সর্বব্যাপী ক্ষমতার খেলা এখন এসে পৌঁছেছে ‘ গভর্নমেন্টালিটি’ – তে। অর্থাৎ এখন শাসক আর দমনপীড়নের পথে যাবে না। এখন সে মানুষের উন্নয়নের বার্তা নিয়ে দুয়ারে রেশনের চাল সাপ্লাই করবে, আর সামান্য দান-খয়রাতির লোভে ফেলে মানুষকে বুঝতেই দেবে না যে আসলে তার দায়িত্ব ছিল প্রজাদের স্থায়ী অন্নসংস্থানের ব্যবস্থা করা, কিন্তু নাকের বদলে নরুনের মতো চাকরির বদলে রিলিফ ধরিয়ে দিয়ে শাসক জয় করে ফেলবে প্রজাদের মন। আপনি হয়তো প্রশ্ন করবেন যে, প্রজারাই বা বোকা বনছে কেন? কেন তারা তাদের অধিকারটুকু দাবি করছে না? আসলে এক্ষেত্রেও ক্ষমতার অপূর্ব এক খেলা আছে। সরকার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মধ্য দিয়ে মানুষকে বানিয়ে তুলেছে যুক্তি-বুদ্ধিহীন যন্ত্র। তাই তারা সব,’ আমরা তো অল্পে খুশি, কী হবে দু:খ করে ‘এই মন্ত্র জপ করতে করতে নিদেনপক্ষে রোদনাস্ত্রটুকু প্রয়োগ করতেও ভুলে গেছে।
ব্যাপারটা হচ্ছে যে ‘ গভর্নমেন্টালিটি’ বলে যে পরিভাষাটা আমরা ব্যবহার করলাম সেই পরিভাষা ফুকো উদ্ধৃত করেন ১৯৭৮-৭৯ খ্রিস্টাব্দে তাঁর ‘ কলেজ দি ফ্রাঁসে’ দেওয়া একাধিক বক্তৃতায়। ‘ গভর্নমেন্টালিটি’ বলতে বোঝায় সরকার চালনা করার শিল্প বা বলা যায় শাসন করার শিল্প। অর্থাৎ ফুকোর মতে এই যুগে শাসক তার শাসনপদ্ধতিকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছে। শিক্ষাব্যবস্থা এবং গণমাধ্যমকে ব্যবহার করে শাসক তার অনুকূলে একের পর এক সত্যের জন্ম দিতে থাকে।
Truth is a thing of this world: it is produced only by virtue of multiple forms of constraint. And it induces regular effects of power. Each society has its regime of truth, its “general politics” of truth: that is, the types of discourse which it accepts and makes function as true; the mechanisms and instances which enable one to distinguish true and false statements, the means by which each is sanctioned; the techniques and procedures accorded value in the acquisition of truth; the status of those who are charged with saying what counts as true’ (Foucault, in Rabinow ).
এই নির্মিত সত্যই এখন আপনার – আমার জ্ঞানবুদ্ধিতে ছড়িয়ে দেওয়া হবে। বোঝানো হবে যে পাকা রাস্তা আর ব্রিজ হলেই উন্নয়ন, লক্ষ্মীর ভাণ্ডারে মেয়েদের মাসে ৫০০ টাকা দেওয়া মানে বিরাট দান, দুর্নীতিই বাস্তবতা। আপনি বুঝবেন কারণ আপনি বোকা এমন ভাববেন না। এই যে নারী-স্বাধীনতার নামে নারীশরীরকে উন্মুক্ত করে পণ্য করে তোলা হয়েছে, সেটা কি নারীবাদীরা বুঝবে? বুঝবে না। কারণ তাদের মাথার মধ্যে আগে থেকে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে ব্যক্তি- স্বাধীনতার সত্য। সেই নির্মিত সত্যের কল্যাণে তারা ‘নন্দর নাচ’ কিংবা ‘ খ্যামটা ‘ দেখলে তাকে অশ্লীল বলবে আর বিকিনি পরে ক্যাট-ওয়াককে বলবে স্মার্টনেস। অতঃপর মার্ক্সিয় দর্শন যতক্ষণ না যুগোপযোগী হয়ে ফিরে আসে ততদিন তার সত্যগুলো দিয়ে ‘ গভর্নমেন্টাল ‘ শাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা দেখছি না।
এই যে ঠিক বর্তমানের সংকট সেটা পেরিয়ে যাওয়ার একমাত্র রাস্তাটিকে এখন না দেখা যাওয়ার কারণ কী? সমাজ – দার্শনিক হাবেরমাস এই প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে ফুকোকে সমালোচনা করে বলেছেন যে ফুকো শাসনের শিল্প বিষয়ে যে কাটাছেঁড়া করেছেন তার থেকে প্রতিরোধের পন্থা সম্পর্কে তাঁর নীরবতা দীর্ঘ। যদিও এমন মনে করার খুব বড়ো একটা কারণ কী, সেটা এখনও আমার মাথায় ঢোকেনি। কারণ ফুকোর মতে ”Power is everywhere ‘ অর্থাৎ ক্ষমতা শাসকের ক্ষেত্রেও যেমন আছে তেমনই বিরোধীর ক্ষেত্রেও সে বিদ্যমান। বিরোধীর কাছে অবশ্য গভর্নমেন্টালিটির সুবিধা নেই, কিন্তু ক্ষমতার স্রোতপথকে বাঁকিয়ে দেওয়ার অস্ত্র তার কাছেও সমানভাবে রয়েছে। সেই অস্ত্রটি কী? সত্যজিতের ভাষায় বলতে গেলে সেটি ‘ মগজাস্ত্র’ আর ফুকোর মতে সেটারই রূপ হল ”Will to Knowledge ‘। জ্ঞানের জগৎকে আরও বিস্তৃত করতে পারলে এবং ইন্টেলিজেন্সিয়াকে ঠিকমতো ব্যবহার করতে পারলে এই বিশ্বব্যাপী শাসকের জনকল্যাণকামী মুখোশ খসিয়ে দেওয়া সম্ভব। কিন্তু ইতিহাস বারংবার দেখিয়েছে যে প্রতিবাদী শক্তি শাসনক্ষমতায় বসলেই অন্য রূপ পরিগ্রহ করে। তাহলে কি শাসক – শাসিত চক্রের আবর্ত চিরকালের? হয়তো তাই। তেমনই দখলের মেকানিজমও শেষাবধি সেই মগজধোলাই। তাই পটভূমিকা অন্ধকার হলেও আপন স্বত্বাধিকারের জন্য যদি কলম থামাতে না চান তবে মগজটাকে বাঁচিয়ে রেখে জ্ঞানের উজ্জীবন এবং বাস্তবিক ব্যবহার একমাত্র মহাস্ত্র বলেই মনে হয়।