নতুন সরকার ক্ষমতা দখল করার প্রথম সপ্তাহের শেষ দিন কয়েকটা গণ্ডার ছেড়ে দেয় রাজধানী শহরে, এবং ঘোষণা দেয় পর্যায়ক্রমে সমগ্র দেশে গণ্ডার ছেড়ে দেয়া হবে, এবং গণ্ডারের সেবা যত্ন করা নাগরিক দায়িত্ব হিসেবে ফরমান দেয়া হয়, ফলে অঞ্চলে অঞ্চলে গণ্ডার কমিটি বা গণ্ডার সুরক্ষা কমিটি তৈরি হয়, পার্টির লোকেরা যেইসব এলাকায় এখনও গণ্ডার পাঠানো হয়নি সেইসব এলাকায় গণ্ডার কমিটি বানিয়ে অধির হয়ে অপেক্ষা করে গণ্ডারের জন্য, ফলে অতি উৎসাহী তাদের কেউ কেউ আর্জি লিখে পাঠায় রাজধানীতে দ্রুত গণ্ডার প্রেরণের জন্যে; কিন্তু জঙ্গলে বা চিরিয়াখানায় পর্যাপ্ত গণ্ডার না থাকায় সাপ্লাই দিতে সমর্থ হয় না দখলদার সরকার, তবে তারা একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থা জারি করে সমগ্র দেশকে গণ্ডারায়ন করার লক্ষে, সেটা হচ্ছে, রাষ্ট্রিয় টেলিভিশন চ্যানেলে চব্বিশ ঘণ্টা লাইভ গণ্ডার দেখান হতে থাকে, যেই গণ্ডার গুলো রাজধানীতে ছেড়ে দেয়া হয়েছে তার উপর কয়েকটা ড্রোন ক্যামেরা সারাদিনরাত ফড়িঙয়ের মতো ঘুর ঘুর করতে থাকে এবং যা লাইভ দেখানো হয় সরকারের টেলিভিশন চ্যানেলে! ফলে, জনগণ যারা পরাজিত শব্দের সমার্থক রূপে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে থাকে কিছুদিন এবং তারা বুঝতে পারে না আচানক আবির্ভূত এই ‘নয়া গণ্ডার ফর্মুলা’, কেনোনা অস্ত্রধারী রাজনৈতিক দলটি জনগণ তথা জনগণের রাষ্ট্রের ক্ষমতা দখল করে নিয়েছে এটা তারা জানে এবং দুই চোখে দেখে, কিন্তু ক্ষমতায় এসেই ময়দানে গণ্ডার কেন ছেড়ে দেয়া হয়েছে এটা কেউ বুঝতে পারে না পুরোপুরি, ফলে জনগণ দিনের আলোতেই হাতড়াতে থাকে এর নিগুম তালাসে; ফলে, শহরে এক নতুন আতঙ্ক জারি হয় যার নাম, ‘গণ্ডার আসছে’; মাঝেমধ্যেই বাচ্চাকাচ্চারা হল্লা করে দৌড়ে বাড়ি এসে ঢোকে কিংবা বাজার এলাকার লোকেদের চিৎকার শোনা যায়, ‘…গণ্ডার গণ্ডার গণ্ডার…ভাগো!’ আসলে জনগণ প্রথম প্রথম তাল মেলাতে পারে না এই ‘গণ্ডার সংস্কৃতি’র সঙ্গে! অন্যদিকে ক্ষমতা দখলের পর সীমিত পরিসরে অফিস আদালত খুলে দেয়া হয়েছে, রাস্তাঘাটে সরকারী পরিবহন এবং সামান্য কিছু ব্যক্তিগত পরিবহন চলাচল শুরু করেছে কিন্তু সমস্যা অন্য যায়গায়, ইদানিং রাস্তায় এক নতুন যন্ত্রণার আবির্ভাব ঘটেছে সেটার নাম ‘গণ্ডার জ্যাম!’ রাস্তার মাঝখানে হয়তো এক অতিকায় গণ্ডার শুয়ে আছে বা খিঁচ মেরে দাঁড়িয়ে আছে, সেটাকে আর সরানো যাচ্ছে না, মৃদু হর্ন দিয়ে নড়ানো যাচ্ছে না, ফলে দীর্ঘ সময় ধরে যানবাহন অপেক্ষায় থাকে বাবা গণ্ডার কখন একটু সরে যাবেন, কেনোনা হাইড্রলিক হর্নের তীব্র কর্কশ শব্দ দিয়ে গণ্ডারকে বিব্রত/ আহত/ আতংকিত বা তার কানের ক্ষতি হয় এমন কাজ করা দণ্ডনীয় হতে পারে (!) এমন এক অঘোষিত ভীতি জনগণ নিজেরাই নিজ থেকে উৎপাদন করে বসে আছে মনে মনে! ফলে, বড় বড় ট্রাক বা কার্গো গাড়ি গুলো বোবার মতন দাঁড়িয়ে থাকে রাস্তায় গণ্ডার সরে যাওয়ার অপেক্ষায়! এবং অভিজাত এক শ্রেণী মনে মনে আকাঙ্খা করে, কবে মার্কিন ফৌজ তাদের বোমা বুলেট আর জঙ্গি বিমান নিয়ে এসে তাদের দেশ থেকে গণ্ডার তাড়াবে, যেহেতু ওরা নিজ দায়িত্বে ফালতু উছিলা ধরে বিভিন্ন দেশ দখল করে থাকে, কিংবা দখলদারদের হাত থেকে নিজেদের দখলে নিয়ে থাকে এবং এই তৎপরতার মধ্যদিয়ে তাদের বুলেট বাণিজ্যের চাকা শক্তিশালী করে থাকে! কিন্তু জনগণের মধ্যে ফিসফাস শোনা যেতে থাকে যে, তাদের মাতৃভূমির নাম পাল্টে ‘গণ্ডারস্তান’ করা হচ্ছে নাকি?! যদিও এইসব মিথ্যা প্রচারণা আমাদের আলোচ্য নয় তবুও ফিসফাস শুনতে ভাল্লাগে আর তাই হঠাৎ শোনা যায় একদিন আইনমন্ত্রী ঘোষণা দিয়ে বসেন, ‘ আজ থেকে আমাদের আর কোন লিখিত সংবিধান থাকছে না! গণ্ডারই আমাদের সংবিধান, আইন আজ থেকে গণ্ডারের মধ্যে!’ ফলে খোদ দখলদার সরকারপন্থী বিচারকেরাও বুঝতে অক্ষম হয়ে যায় যে, আইনমন্ত্রী আসলে কি বলতে কি বললেন বা কি বোঝাতে কি বললেন? ফলে বিচারকেরা কল্পনায় দেখতে পেলেন তাদের মহান চেয়ার গুলোতে একেকটা গণ্ডার বসে আছে! ফলে, পরদিন থেকে আইন বলতে আর কিছুই থাকলো না তবে এক রাতের মধ্যেই জনগণের মনে জন্ম নিলো ‘গণ্ডারতন্ত্র’ নামক এক ভীতি! যার কোন মা বাপ নেই! কেউই জানে না বিধান কি, কেন, কেমন! উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ভিক্ষুককে ভিক্ষা দেয়া দণ্ডনীয় না অবশ্যকর্তব্য সেটা কেউই বুঝে উঠতে পারল না! জনগণ মুহূর্তে হয়ে গেলো সদ্যজাত শিশুর মতো নাদান! দুনিয়াদারী তাদের কাছে হয়ে গেলো এক অবুঝ প্রেমের মতন, যেখানে শরিয়ত- মারেফত বা যান্ত্রিক-অযান্ত্রিক কিংবা লেজ-মাথার কোনটার কোন আগামাথা, শুরু-শেষ নাই! কিন্তু সবাই আতঙ্কে বুক টানটান ছাত্রদের মতো লাইনে থাকলো! কেনোনা প্রতিদিন প্রকাশ্যে মানুষ হত্যা করা হতো, যাকেতাকে যখন তখন, লিঙ্গ বিচারে ক্ষমা করা হতো না! ফলে রাষ্ট্রের অনেক খ্যাতিমান সৃজনশীল মানুষদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে রাস্তার মোড়ে মোড়ে রেখে দেয়া হল! এবং এই স্মৃতি জনগণকে মুহূর্তে মুহূর্তে আতঙ্কিত করে রাখতে লাগলো! সারা দেশে নিষিদ্ধ হয়ে গেলো গান বাজনা চিত্রকলা কবিতা গল্প বা শিল্পকলার সকল শাখা, বুদ্ধিজীবী এবং সৃজনশীল মানুষেরা নিরুদ্দেশ হয়ে গেলো; ফলে নাপিতের দোকানে ভিড় বেড়ে গিয়েছিলো সেই কয়েকদিন! এক ধরনের ভোঁথা অনুভূতি ছড়িয়ে পড়লো বাতাসের মধ্যে! টেলিভিশনে শুধু গণ্ডার, তবে এক ছুটিরদিন সকালে সমগ্র দেশের জনগণ খুব আমোদ পেয়ে গেলো, শহরের দুটো গণ্ডার যৌনমিলনে ব্যস্ত হল, তাদের সেই সঙ্গমের জঙ্গম দেখতে পেয়ে ছেলে বুড়ো সবাই এই প্রথম দখলদার সরকারের সামান্য স্তুতি করলো যে, নাহ অন্তত এরা না এলে এভাবে এই জিনিস দেখার আনন্দ পাওয়া যেতো না, কেনোনা সকল বিনোদন যখন রুদ্ধ তখন এই সামান্য আনন্দই তীব্র তীক্ষ্ণ! অন্য দিকে সরকার ব্যস্ততার সঙ্গে গণ্ডার আমদানিতে মনোযোগ দিলো। যেহেতু তাদের দেশের জঙ্গলে গণ্ডার পাওয়া যায় অল্প, এবং সেই অল্প সংখ্যক গণ্ডার এবং তাদের চিরিয়াখানায় থাকা সকল গণ্ডারকে রাজধানীতে ছেড়ে দেয়া হয়েছে; ফলে তারা বিশ্ব দরবারে আহ্বান জানালো গণ্ডারের জন্যে! গণ্ডার প্রবণ দেশ গুলোকে বিশেষভাবে চিঠি পাঠিয়ে গণ্ডার দিয়ে সাহায্য/ বন্ধুত্বকে মজবুদ করার আহ্বান জানালো তারা এবং শান্তিসংঘের কাছে চিঠি পাঠিয়ে আকুতি জানালো যে, ‘তারা যেহেতু সকল বিষয়ে দালালি করে থাকে, ফলে তারা যেন অন্তত তাদের রাষ্ট্রকে কিছু গণ্ডার জোগাড় করে দেয়ার দালালিটা করে দেয়, বিনিময়ে তাদেরকে তদবির খর্চা দেয়া হবে!’ ফলে আন্তর্জাতিকভাবে একটা হই হই রব উঠলো! অনেক দেশ বন্ধুত্বের খাতিরে গণ্ডার পাঠানো কথা ভাবতে লাগলো! সেইসব দেশের পার্লামেন্টে আবার এই প্রস্তাব নিয়ে হল্লা হয়ে গেলো! কেনোনা এই সরকার অবৈধ সরকার হিসেবে চিহ্নিত! আবার কেউ কেউ বল্ল, এটা ঐ দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার এখানে নাক গলানর সুযোগ নেই তাদের! ফলে গণ্ডার সরকারের স্বীকৃতি নিয়ে প্রশ্ন উঠলো! তবে কেউ কেউ মানবিক স্বার্থে(!) কয়েকটি গণ্ডার পাঠানোর চিন্তা করতে লাগলো, কেনোনা ঐ দেশের বেশিরভাগ শহর গ্রাম গণ্ডার বঞ্চিত অবস্থায় ছিল!! এদিকে কংক্রিট, পিচে আবৃত রাজধানীর জমিন, আর দেয়াল দালানের ভিড়ে গণ্ডারদের মন অস্থির হয়ে উঠতে লাগলো! তারা একটু সবুজের খোঁজে একটু বনভূমির শান্তির সন্ধানে চারদিকে ছড়িয়ে যেতে লাগলো! ক্রমে তারা কেউ কেউ রাজধানি ছেড়ে আশপাশের শহর গ্রামে ঢুকে যেতে লাগলো! ফলে ব্যাপারটা দ্বিমুখী আমলাতান্ত্রিক দ্বন্দের জন্ম দিলো! একদল আমলারা বল্ল, ‘এটা ভালো দিক, রাজধানী থেকে সমগ্র দেশে ছড়িয়ে পড়বে গণ্ডার! কেন্দ্র থেকে প্রান্ত দখল!’ অন্য দল আমলারা বলতে লাগলো, ‘রাজধানী গণ্ডার শূন্য হয়ে গেলে অন্য প্রাণী এটাকে দখল নিয়ে ফেলবে! ফলে গণ্ডার বন্দি করার জন্য তারা পরামর্শ দিলো!’ কিন্তু যেই যেই শহরে বা গ্রামে গণ্ডার ঢুকে পড়তে শুরু করলো সেই সেই শহর গ্রাম বা মহল্লার গণ্ডার কমিটির লোকেরা তোরণ বানিয়ে স্বাগত জানাতে লাগলো গণ্ডারকে! যেন দেবতার আশীর্বাদ এসেছে তাদের মাটিতে! কিন্তু গণ্ডার সরকারের কেন্দ্রিয় নেতারা কোন নাক গলানো না এই ব্যাপারে, তারা খেলা দেখতে লাগলো, তাদের ভাষ্য; ‘খেলা শুরু হয়ে গেছে এখন ছড়াবে!’ কিন্তু ভয়ংকর জিনিস ছিল এই সরকারের উদ্ভট ‘গণ্ডার আইন!’ যেহেতু সংবিধানকে বাতিল ঘোষণা দেয়া হয়েছিলো আর গণ্ডারকে সকল ক্ষমতার উৎস বা গণ্ডারকে মানদণ্ড ধরা হয়েছিল সেহেতু বিচার পদ্ধতি একটা নতুন রাস্তা নেয়! কাউকে শাস্তি দেয়ার প্রয়োজন অনুভব হলে, বা কাউকে দমনের জরুরত অনুভব হলে ‘গণ্ডার আদালত’ নামক একটা বিরাট ট্রাক গিয়ে হাজির হয় অভিযুক্তের আস্তানায়, যেই ট্রাকের সামনে একজন বিচারক পেছনে একটা বড় খাঁচায় বন্দি একটা বাচ্চা গণ্ডার এবং তার চারপাশে বসে থাকা বন্দুকধারী কিছু সৈনিকের একটা দল থাকে দোষী অনুমানকারীকে দোষী সাব্যস্ত করার জন্য! তারা এসে বলে, ‘এই লোক/ মহিলা এই বাচ্চা গণ্ডারকে হত্যার চেষ্টা করেছে গতকাল’, বা তারা বলে, ‘এই লোক/ মহিলা এই শিশু গণ্ডারের গায়ে থুথু নিক্ষেপ করেছে’, কিংবা তারা বলে, ‘এই লোক/ মহিলা এই নাবালক গণ্ডারের গায়ে পাথর মেরেছে’, তারপর তারা তাকে শাস্তি দেয়! কারো কারো জন্য বরাদ্দ হয় মৃত্যুদণ্ড! এবং সেটা জনসমক্ষে কোন গাছের ডালে ঝুলিয়ে দিয়ে চলে যায় তারা! ফলে লুকিয়ে থাকা বুদ্ধিজীবীরা মার্কিন ফৌজ আকাঙ্খা করে মনে মনে এই খেলায় সামিল হতে, কিন্তু আরেক দল বুদ্ধিজীবী বলে বসে, ‘নিজেদের খেলা নিজেদেরকেই খেলতে হবে! বাইরের লোক ডেকে এনে লাভ নেই ক্ষতি ছাড়া! অন্তত মুক্তি মিলবে না!’ কেনোনা কয়েকদিন আগে একটা ভয়ানক বিচার করেছে দরখলদার সরকারে গণ্ডার ট্রাইব্যুনাল, এক ভাস্কর দম্পত্তিকে তারা হত্যা করেছে প্রকাশ্যে গুলি করে! তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দেয়া হয়েছে তারা নাকি নিজেদের কাপড় খুলে বাচ্চা গণ্ডারকে দেখিয়েছে নিজেদের নগ্ন শরীর! যার পর থেকে মানসিকভাবে বিদ্ধস্ত নাদান গণ্ডারটি! ফলে এলাকার লোকেরা বলে, ‘ঐ ভাস্করেরা যেই ঘিঞ্জি গলির বাড়িতে থাকতো সেই গলিতে বানর, কুকুর ঢুকতে পারলেও গণ্ডার ঢোকার কোন যায়গা নাই, কেনোনা গলিটা এতোটাই সরু!’ কিন্তু গণ্ডার আইন গণ্ডারের মতই! কিন্তু বিপরীত ঘটনা ঘটে গেলো হত্যার পর যখন সৈনিকেরা ঐ দম্পতির ঘর তালাস করতে গেলো, সেখানে তারা দেখল একটা চমৎকার গণ্ডার পরিবারের ভাস্কর্য বানিয়েছে তারা! ফলে এই খবর যখন কেন্দ্রে পৌঁছে গেল তখন নাকি ফিসফাস আলাপ হতে শুরু করলো যে, যেহেতু দুনিয়া তাদেরকে এখনও কোন গণ্ডার দেয় নি সেহেতু সারা দেশের প্রতি মোড়ে মোড়ে কি গণ্ডারের ভাস্কর্য বা মূর্তি বানানো যায় না? যা থেকে জনগণের মনে গণ্ডার সদা জাগ্রত থাকবে? কিন্তু এই পরিকল্পনা আমল পেলো না কেননা দৃশ্যমান মূর্তির পক্ষে এই সরকার না, তারা অদৃশ্য মূর্তি দিয়ে শাসন করতে চায়, হতে পারে সেই অদৃশ্যের জ্যান্ত রূপ গণ্ডার, তবে তা চলমান; স্থির পাথর নয়!
এভাবে কয়েক বছর কেটে যাবার পর বিভিন্ন দেশ কিছু গণ্ডার দিয়ে সাহায্য করলো তাদের! তবে মারাত্মক হয়ে উঠলো জনগণের নীরবতা, জনগণ নীরবে সব সহ্য করে যেতে লাগলো! যেন তারা এই গণ্ডার ব্যবস্থাকে ভালোবাসে! নিয়মিত জীবনের সঙ্গে গণ্ডার মিশে যেতে লাগলো! জনগণ হয়ে উঠলো পাথরের মতো, ভয়ে জড়সড় সর্বদা! কিন্তু সবচেয়ে বাজে কাজটা ঘটিয়ে ফেলল, মেয়েরা! যেহেতু মেয়েদের অফিস থেকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়েছিলো সেহেতু তারা ঘরে বসে নানান অর্থনৈতিক কাজ চালাত এবং অবসর কাটাতে গিয়েই হয়তো তারা মুখে মুখে এক নতুন গান বেঁধে ফেলল! যেই গানের নাম হয়ে উঠলো ‘গণ্ডারগীতি’! এবং দিনে দিনে এই গণ্ডারগীতির সংখ্যা এবং গীতিকার বেড়ে যেতে লাগলো! বোঝা গেলো শিল্প নিজেই নিজের রাস্তা বের করে নেয় পরিস্থিতির সঙ্গে! কিন্তু এইসব গানের কোন জ্যান্ত গীতিকারকে খুঁজে পাওয়া গেলো না! প্রতিটা গান গণ্ডারকে কেন্দ্র করে নানান ব্যথা বেদনার পংতিতে সাজানো! সেই আকুতি যখন গণ্ডার সকারের শীর্ষ মন্ত্রীদের কানে পৌঁছাল তখন তাদের কেউ কেউ সুপারিশ করলো, ‘ব্যাপারটা খারাপ না! গণ্ডার কেন্দ্রিক শিল্প সাহিত্যকে স্বীকৃতি দেয়া যেতে পারে! কিছু অবরোধ তুলে নেয়া হোক, তাতে জনসমর্থন বাড়বে!’ কিন্তু কেন্দ্র পুরোপুরি সমর্থন দিলো না, তারা শুধু এটুকু জানালো, ‘বাঁধা দেয়ার দরকার নেই যা চলছে চলুক! স্বীকৃতি দেয়া যাবে না!’ তবে স্বীকৃতি না দিয়ে ভালোই করেছে তারা কেনোনা, কিছুদিনের মধ্যে দেখা গেলো এই গণ্ডারগীতিতে সরকার বিরোধী কথাবার্তা উঁকিঝুঁকি দিতে লাগলো! ফলে কেন্দ্রের এক মন্ত্রী বলে উঠলো, ‘দেখলে? স্বীকৃতি দিলে সর্বনাশ হয়ে যেতো, আমি জানতাম গান যখন শুরু হয়েছে এরপর গানে গানে সর্বনাশ ডাকা হবে! এখন বন্ধ করাও এই গান!’ ফলে গণ্ডার আইন চড়াও হল, কোথাও কাউকে গাইতে শুনলেই তাকে হত্যা করা হতো, হত্যার আগে একটা সুযোগ দেয়া হতো, এই গানের গীতিকারকে যদি দেখিয়ে দিতে পারে তবে মুক্তি! একজনকে পাওয়া গেলো সে বল্ল, আমি কবি গানটা আমার লেখা, বলে সে গানটা গাইতে শুরু করলো…
হায় গণ্ডার তুমি এক মহা ভুল
মাথাতে বিরাট শিং নেই তাতে চুল
আমাদের ভুবনেতে তুমি কেন এলে
সমাগত বিদ্রোহ তুমি যাবে খেলে
কতদিন কত আর গণ্ডার
সুড়সুড়ি দেই তবু মুখ ভার
মুখ বুজে আর কত খাবো মার?
নড়েচড়ে উঠি আজ এইবার
ধরাপড়ে গেছো তুমি গণ্ডার
গ্যাঁড়াকলে আজ তুমি ছারখার!
ফলে মুহূর্ত দেরি না করে কবিকে গুলি করা হল! এবং যিনি গুলি করলেন তাকে স্বর্ণ পদক দিয়ে সম্মান জানানো হল! কিন্তু বিদ্রোহ কি থেমে থাকে? এই গান তীব্র ক্ষীপ্র ভাবে ছড়িয়ে গেলো! এর বছরখানে পর একদিন দেখা গেলো শহরের এক দেয়ালে একটা গ্রাফিতি, যেখানে আঁকা একটা উল্টে পড়া গণ্ডারের ছবি! তারপরদিন দেশের বিভিন্ন স্থানে কয়েকটা গণ্ডারের মৃতদেহ পাওয়া গেলো! সেইদিন দুপুরে দখলদার সরকারের সকল মন্ত্রী এবং তাদের বাসভবনের সামনে অতিরিক্ত নিরাপত্তা চৌকি দেখা গেলো! শহরে সাঁজোয়া ঘুরতে লাগলো! বাইরের দুনিয়াতেও তখন আচানক তোলপাড় শুরু হ্ল! তবে অন্য দিক থেকে! বিভিন্ন দেশের পশু অধিকার সংগঠন গুলো খুব সোচ্চার হয়ে উঠলো গণ্ডার রক্ষার জন্য! তারা ফৌজ পাঠাতে চায় বন্দুক-বিমান দিয়ে গণ্ডার রক্ষা করতে! যেই দেশ গুলো গণ্ডার পাঠিয়েছিল বন্ধুত্বের স্মারক হিসেবে তারা জানালো তাদের প্রেরিত গণ্ডার তারা ফেরত চায়! ফলে একটা জটিল অবস্থা দাঁড়ালো যে, তাদের প্রেরিত গণ্ডারের ঔরসে যে বাচ্চা হয়েছে সেই গণ্ডার শাবক কার হবে? আন্তর্জাতিক আদালতে একটা মামলা ঠুকে দিলো উৎসাহী কেউ একজন! কিন্তু সেই দেশের জনগণ মুক্তচিঠি ছড়িয়ে দিলো রাস্তায় রাস্তায়, তাতে লেখা ছিল, ‘ আপনাদের প্রয়োজন নেই, দোহাই আপনারা আসবেন না আমাদের দেশে, আমাদের জমিন আমরাই ছিনিয়ে আনবো, যখন মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছে তখন আপনারা চুপ ছিলেন এখন গণ্ডার বাঁচাতে চিন্তিত কেন? গোপন উদ্দেশ্যটা পকেতেই রাখুন!!’ তবে কেউ থেমে থাকলো না, কেননা মুক্ত দুনিয়ায় কেউ কাউকে পাত্তা দেবে না! এটা অস্বাভাবিক না! কিন্তু গণ্ডার সরকারের প্রধান একদিন ভোররাতে স্বপ্নে দেখলেন, একটা গণ্ডারের পিঠে চরে এক যুবক-যুবতী তার বাসভবনের গেট ভেঙে ক্ষিপ্র গতিতে এগিয়ে আসছে সম্ভবত তার শোবার ঘরের দিকে! ফলে তড়িঘড়ি লাফিয়ে উঠে তিনি নিরাপত্তা পরীক্ষা করে নিশ্চিত হলেন এখনও মৃত্যু তার গেটের মধ্যে গণ্ডারে চড়ে আসেনি! তবে খারাপ সংবাদ শুনলেন, গত রাতে দেশের অবশিষ্ট সব গণ্ডার গুম হয়ে গেছে!! এমন কড়া শাসন ব্যবস্থার মধ্যে কি করে গণ্ডারের মতো প্রাণী হাওয়া হয়ে যেতে পারে সেটা ভাবতে ভাবতে তিনি জানতে পারলেন, রাস্তায় রাস্তায় লিফলেট পাওয়া যাচ্ছে, ‘গণ্ডারতন্ত্র নিপাত যাক!’ এবং তিনি এও জানলেন, কয়েক যায়গায় বিদ্রোহীদের এম্বুসে গণ্ডারতন্ত্রের বেশ কিছু সৈনিক এবং কর্মকর্তা নিহত! তিনি তার কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যদেরকে তার বাসভবনে আহ্বান জানালেন অতি গুরুত্বপূর্ণ এক মিটিং ডেকে! কিন্তু কেউ বাইরে বের হতে চাইলো না, তারা জানলো, ফোনে বা ভার্চুয়াল মাধ্যমে তারা মিটিং করতে আগ্রহী কেনোনা রাস্তায় কোন গণ্ডার নেই, জনগণের ভয় আচমকা কেটে গেছে!