কবি কাকডাকা ভোরে নৈঃশব্দ্যের ছায়া মাড়িয়ে౼তুমি বসেছিলে এই বটতলে౼প্রিয় স্ত্রীর হাত ধরে শনাক্ত করতে চাইলে মধুমেলার প্রতিটি কোণার দূরত্ব। শালিকের উড়ে যাওয়া চলচ্ছায়াও মাপতে চাও তুমি౼কারা তোমাকে বেশি মনে রাখে౼কিছুটা গভীরতায় কিছুটা শীর্ণকায় নারীর অট্টহাসিও মেপে নিবে ভূমিকম্পের রিক্টারস্কেলে। মধু; তুমি অ্যালবামে মায়ের ছবি রেখে কাটিয়েছো পরবাসী জীবন। ঈশ্বরের চোখে চোখ রেখে চলেছো পথ౼জলে-স্তলে অশ্রুগ্রন্থির মরিচীকায় ভীষণ যন্ত্রণা নিয়ে বার বার কাছে ফিরতে চেয়েছো স্ত্রীর... যতসব প্রেমিকা ছিল তোমার౼তারাও তোমার মত কবির౼প্রজন্মকথা ভেবে নিতে চেয়েছে শরীরের প্রতিটি পাড়ার অন্তর ছদ্মবেশ౼এসব আলিঙ্গনদৃশ্য౼আমিও দেখেছি শতক... অবশেষে তুমি প্রজন্মের কথা ভেবে౼ শোকাচ্ছন্ন মন নিয়ে সাগরদাঁড়িতে এলে౼বন্ধ ফটকের কাছে দাঁড়িয়ে জড়িয়ে ধরলে পোড়ামাটির ট্যারাকোটা স্পর্শ করে ক্রমশ হয়ে যাচ্ছ স্মৃতিকাতর౼হঠাৎ শুনতে পেলে কিছু উগ্রপন্থি তোমাকে নিয়ে মেতেছে ধর্মভূতগ্রস্ততা ছড়ানোর কাজে। তাদের নাদান-রামছাগল-বলদ বলে সঠিক বাস্তবতা বোঝালে౼তবু এই নরাধম-বোকা-হাদারাম দ্ব›দ্ববাদী-সুবিধাখোররা খোঁজে তোমার পড়ন্ত জীবনের ব্যর্থতা কতটুকু... এবার তুমি দিলে না জবাব౼নবীন প্রজন্মের কথা ভেবে౼নবজাগরণে জাগবে আবার এই প্রজন্ম সত্যতার জবাবে౼এটাই ছড়িয়ে যাক মাইকেল౼যুগ হতে যুগান্তরে...কাল হতে কালান্তরে... এডওয়ার্ডের সুন্দরী রমণীরা... আমার মুখচ্ছবির ভিতরে ভেসে ওঠে౼ কিছু নীলচাষীর জীবন্ত কষ্টের ছবি আর মিথ্যার রাত্রিযাপনের কতিপয় শৈশব। নির্বোধ রাজাদের অসংখ্য জীবননাট্য মিথ্যার তুলিতে আঁকা। আমিও এখন মিথ্যার ছুরিতে প্রতিনিয়ত ক্ষত-বিক্ষত করি নিজের জীবন౼ বিষণ্ণ ফলায় কেটে চলি জীবন পরমায়ু౼ তবুও বুঝি তাদের সারিতে আছি এই বঙ্গে− বন্দে আলী মিয়া, ওমর আলী, আব্দুল গনী হাজারী; সেই অর্থে অনুকূল ঠাকুর ও সুচিত্রা সেনও একই চাঞ্চল্যতার স্তম্ভিত জীবনের সারিন্দা বাজিয়ে দৃষ্টিসীমার বাইরে সান্ধ্যভাষায়, সাজাতে চাই জীবনের ধারাপাত। কিছু কথা মনে উঠলেই আমি দিকভ্রান্ত হয়ে ছুটে চলি হেমায়েত পুরে− থেকে আসি কিছু দিন...কথাটি সত্য বটে−গাছপাড়ার জলিল সাহেব আমার বাসার মালিক; বন্দে আলী সড়কে এক পায়ে দাঁড়িয়ে বুঝতে চাই জীবনের কষ্ট কতখানি গভীর হলে তোমাকে ছোঁয়া যায় - ওহে এডওয়ার্ডের সুন্দরী রমণীরা... বিষণ্ণ মানুষ বিষণ্ণ পৃথিবী খসে খসে পড়ছে জীবনের পলেস্তরা। এখানে মানুষ তবু বাঁচে নিজের জন্য౼বাঁচাটাই খুব দরকার। যেমনটি তুমি সাজালে জীবন౼ চলন্ত ঘোড়ায়; অপরাধবোধের মাতম উৎসবে... পিতা একার জীবন−চলছে− চলুক শূন্য পথে−রাস্তার মোড়ে−সাহেবের দোকান; নিঝুম মাঠে−বিস্তৃত আলপথ রাত্রির গাভীনে মোড়ানো সকাল। বিবিক্ত তুমি−যতটা না আমায় চেনো তার চেয়েও বেশি আমি− তোমায় ভালোবাসি তোমার কুসুমীত মন−নক্ষত্রলোকে−সুগন্ধ ছড়ায়, আমি একাকি সুমিষ্ঠ কণ্ঠে− ডেকে আনি ভোর... এই যে এলোমেলো জীবনে তুমি ভাবনা কিংবা জাগরণে বিভোর জীবন বুঝিনি কখনও বৃথায়−তুমি ডাকলে কাছে মাতৃভূমির তরে জীবন ভাসিয়ে দেয় মায়াবীছায়া বুকের মধ্যে দোলে−মাটির বিছানায় শুয়ে বিমর্ষ নয়নে তোমাকে দেখি− হে স্বদেশী বীর বাংলা জন্মের মহান পিতা... অবসান কিসের এতো তাড়া ছিল লজ্জায় তুমি লুকালে জীবন গুছিয়ে নিলে ক্ষণজন্মের ধারাপাত... বঞ্চণায় তুমি সহে ছিলে রৌদ্রের ছায়া হাহাকার নিয়ে নিজেই নিজেকে করলে দংশন... মাঠে মাঠে তুমি সান্ত্বনার ভাষা খুঁজে কাটাতে চাও রহস্যের আদিগন্তের লেশ যে তুমি একদিন পথের মাঝে বসেছিলে আলুথালু জীবনের পয়গম নিয়ে সেই তুমি আজ নদীর অন্ধকারে মেলে দিলে− ফেলে আসা রঙিন জীবনের ছাপ ভেল্কিবাজের নতুন খেলা− খেলে চলে শূন্যের খেলা−লজ্জা উঠেছে জাদুঘরে... বাবার বাড়ি বাবার বাড়ি−ছনের ঘরে তুমি ছিলে−আমরা সবাই শান্ত বাড়ি−মুখের কথায় উঠোন জুড়ে নিঃশব্দ এক; ভীষণ কড়া দাদুর শাসন। পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে− ছাতিম তলে বুড়ো শালিখ−কাঁঠবিড়ালী লম্বা লেজের গুইশাপও মাছরাঙাতে কী যে ভাব−ফুলের শোভা... ইচ্ছে মত বইয়ের র্যাকে রাখা আছে বাবার জীবন−রামায়ণের ছোট্ট জীবন, মহাভারত, কুরআন আর বিষাদসিন্ধু-লালন-রবীন্দ্রনাথ-নজরুল; এই বাড়িতে কত মানুষ− নিশিদিন বাস করেছে, এক পাখি যে রোজ আসত−দিনমানে রৌদ্রে ঠেকায় বুকের ব্যথায় ক্লান্ত আজ−বুড়ো শালিখ। সন্ধ্যাবেলায় নিশ্চিন্তে ঘুমায়−হয়না আড়াল ক্লান্তপথিক−রোজ দেখেছে−রহস্য তার জীবনপাতে রত্ন রাখে−নিদ্রা গভীর হলেই আমি আবগাহনে রাস্তা পেরোই...বাড়ি যাব বলেই এখন... ঈশ্বর সেদিন গভীর রাতে− পাশে বসে আছেন ঈশ্বর আমি অসুস্থ −মাথায় হাত বুলিয়ে− জলপটি মাথায় দিচ্ছেন... হারিকেনের নিভু নিভু আলোয়−আবছা অন্ধকার বাহিরে কৃষ্ণকায় আসমানে বিস্ফালিত হচ্ছে লাল রশ্মি আমি ছুটে যেতে চাই উন্মুক্ত ময়দানে− বাবার কাছে−মায়ের পদতলে রাখতে চাই দেহ... ছুটে চলি দিগভ্রান্ত যুবক আর ডাকি−ঈশ্বর-ঈশ্বর-ঈশ্বর। হাসপাতাল যে যায় সেতো চলেই যায়−আমিও চলে যেতাম সব ছেড়ে কিন্তু আমায় তো আছে পিছুটান। সেই দুঃখে পারি না তোমাকে ছাড়তে−বলতে পারি না−মহারাজ−বিদায়; আমার অনেক কাজ। অনেকের সাথে আড্ডা আছে, সেমিনার, মিটিং, সভা আরও কত কী? বাড়িতে বয়ষ্ক মা, বোনদের কষ্টে ভাসে বুক, বাবার হাপানি, একবেলা খেলে অন্যবেলা থাকে উপস। মাসীমাও এসেছে এই দুঃস্থ হাসপাতালে−বর্ষার জলে ভেসে গেছে মেসোর পুকুর... লুণ্ঠন হয়েছে বিবেক− পুষ্পের সৌরভ বাড়ে হারিয়ে গেলে... নিঃশব্দে বিছানায় পড়ে থাকে দাদু। চুলের স্তরে খুসকিতে ছেয়ে গেছে মাথা− আকাশে মেঘ আমাদের মনেও জমেছে মেঘ−কল্পনায় কত না প্রাসাদ− আসমানধরার−আসমানী কল্পনা। অথচ আমরা এক হাসপাতালে আছি−বিপ্লব অনেক দূর... জীবন যেন চলতে চলতে থমকে গেছে−এগোয়নি...তবুও তোমাকে দেখি আর নীরেন বাবুর কবিতা পড়ি− ‘তারই মধ্যে আমি দেখেছি তোমাকে যে, -তুমি, হাত রেখেছো কাঁটাতারে, চোখ রেখেছ উন্মুক্ত আকাশে।’
বঙ্গ রাখাল কবি ও গবেষক। জন্ম ১২ জুন, ঝিনাইদহ জেলার শৈলকুপা থানাধীন গোলকনগর গ্রামে। তিনি সাভার গণ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রী নেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ঢাকা স্কুল অফ ইকনোমিকস থেকে পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট ডিপ্লোমা ইন ইকোনমিকস ডিগ্রী এবং গণহত্যা-নির্যাতন ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণা কেন্দ্র থেকে গণহত্যার উপর পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রী অর্জনসহ বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ ইতিহাস সম্মিলনীর সদস্য। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থাবলি: সংস্কৃতির দিকে ফেরা (প্রবন্ধ, ২০১৫), লোক মানুষের গান ও আত্ম অন্বেষণ (গবেষণা, ২০১৬), মানবতাবাদী লালন জীবন অন্বেষণ (প্রবন্ধ, ২০১৭), হাওয়াই ডাঙ্গার ট্রেন (কবিতা, ২০১৮), মনীষা বীক্ষণ ও অন্যান্য (প্রবন্ধ, ২০১৮), অগ্রন্থিত রফিক আজাদ (সম্পাদনা, ২০১৯), পাগলা কানাই ও তাঁর তত্ত¡ দর্শন (সম্পাদনা, ২০১৯), লণ্ঠনের গ্রাম (কবিতা-২০১৯), যৈবতী কন্যা ইশকুলে (কবিতা, ২০২০), কবিতার করতলে (প্রবন্ধ, ২০২০), অন্ধ যাজক (কবিতা-২০২১), ছোটবোয়ালিয়া-জয়ন্তীনগর-বসন্তপুর গণহত্যা (অভিসন্দর্ভ-২০২১), জন্মান্ধ ঘোড়া-২০২৩। সম্মাননা ও পুরস্কার: প্রবন্ধ: আবুল মনসুর আহমদ পুরস্কার (প্রবন্ধ-২০২০), ডেইলী স্টার, ঢাকা। কবিতা: জলধি সাহিত্য সম্মাননা (কবিতা-২০২১), ঢাকা। গবেষণা: সাহিত্য সম্মাননা-২০২২ (মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা) শেরপুর সংস্কৃতি পরিষদ, শেরপুর, বগুড়া। সম্পাদনা: নিহারণ, শঙ্খধ্বনি, শব্দকুঠি, দোতারাসহ সম্পাদনা করেছেন বেশকিছু ছোট কাগজ।
Facebook Comments Box