ভোর ও সন্ধ্যার কথা “নির্লিপ্ত ও প্রতিকূল বিশ্বে মানুষ এক অনন্য নিঃসঙ্গ প্রাণী, যে নিজ কর্মের জন্য দায়ী এবং নিজ নিয়তি নির্ধারণের ব্যাপারে স্বাধীন।“ ―কিয়র্কেগার্ড (১৮১৩—৫৫), ড্যানিশ দার্শনিক রাতজাগানিয়া হাঁপানি রোগীর চোখের মতো নিস্প্রভ আজ আমার ফেলে আসা কৈশোর দিনলিপি। জানি, মানুষ তো কেবলই আকড়ে থাকে তার শৈশব—কৈশোরের দিনের পাণ্ডুলিপি নিয়ে আমৃত্যু—জীবন। আমিও মানুষ বলেই হয়ত... একঘেয়েমি নাগরিক উদ্বাস্তু প্রাণীজ দেহে, যেখানে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছি− অনেক কষ্টেসৃষ্টে অলিগলি দালানের নালা বেয়ে আকাশ দেখা যায়; কবে শেষ এই পথে রেখেছিল পা সূর্যের আলো ভুলে গেছে তা মাটির স্মৃতিকোষ। ধোঁয়ার ঘরে ধুলার চাদর গায়ে তস্কর সাজে গোপন সুড়ঙ্গ কেটে− ক্রমাগত ফাটা বাঁশের ভেতর দিয়ে মাঝেমধ্যে গলে যায় চিকন বাতাস; বাতাসের গায়ে তার কখনও বৃথাই খুঁজে ফিরি ছেলেবেলার বিস্মৃত কচি লেবুপাতার ঘ্রাণ। তাড়া খাওয়া হরিণীর মতো শহরের ছুটন্ত মানুষের দল বাদুড়ের কসরত শিখেছে বেশ আমরা যারা সনাতনী স্কুলের পেছন সারির পড়া না—পারা অভ্যস্ত ছাত্র গণিত মাস্টারের বেতের সাঁইসাঁই শব্দাঘাত সয়ে যাই প্রতিদিন। সেদিন পত্রিকায় রক্তিম শিরোনাম হলো− ‘চিনির বদলে লালপিঁপড়ের দল খুঁটে খেয়েছে পত্ররন্ধ্রের জমানো জলকণিকা’। তবুও কেটে যায় দিন কৈর্বতের ছেঁড়াখোঁড়া মেরামতি পুরানো জালে লেগে থাকা আঁষ্টে গন্ধে—গন্ধে সারাদিন, আর আমাদের স্বপ্নসংসারে অনাগত শিশুর দুধের জলে ক্রমশ অগোচরে মিশে যায় চুনাজল । তারপরও বলে যাই, আমাদেরও কতিপয় জলজ দিন ছিল মাছের মতো আমাদেরও মায়াময় ঘর ছিল তালপাতা তলে বাবুইয়ের ঝোলার মতোন, ভোর ও সন্ধ্যায় আজও বাস করি− যেখানে বসবাস করে তোমাদের নগরী। কাটাকুটি খেলা আমার নিজস্ব একটা তীক্ষ্ণধার ব্লেড ছিল যার ওপর আঙুল চালালে ফালাফালা হতো; তবে রক্ত ঝরতো না। এমন ম্যাজিক দেখে হাততালি দিত জমাট কোলাহল কেউ কেউ শিহরণে কাঁপতো শীতে। প্রথম প্রথম তুমিও ট্যারা চোখে বিস্মিত হয়েছিলে তারপর... একটা সময় আঙুল থেকে হাত, হাত থেকে পা, পা থেকে সর্বাঙ্গ কেটে কেটে যখন তুলে দিলাম তোমার হাতে− তুমি ফোড়ন কেটে বললে− দূর ছাই! এতো দেখি একদমই ভোঁতা ব্লেড, সম্পর্ক ছাড়া যার কিছুই ক্ষমতা নেই কাটার। আমাকে ধরো তোমাকে ধরা আজো হলো না আমার প্রথমবার যখন তুমি বললে− আমাকে ধরো, বেশ লাগলো শুনে। তোমার হাতের ওপর হাত রাখলাম আমি। তুমি বললে, আরে না,− এ তো আমার হাত; তুমি আমাকে ধরো। আরো বিহ্বল হয়ে উঠলাম। অলৌকিক আনন্দে আঁটখানা হয়ে− তোমার কাঁধের ওপর রাখলাম আমার হাত, উত্তরে বললে− আরে ধুর, এ তো আমার কাঁধ; তুমি আমাকে ধরো। গোপন মনে আপ্লুত হতে হতে− নিজের দু—হাতের তলে তুলে ধরলাম তোমার মুখ। কপট রেগে প্রতিক্রিয়া জানালে, আরে বোকা, এ তো আমার মুখ; তুমি আমাকে ধরো। অতঃপর হতবাক হতে শুরু করি আমি। বিপন্ন যোদ্ধার মতো জাপটে ধরি তোমায়। একে একে স্পর্শ করি তোমার দেহের প্রতিটি অঙ্গ—প্রতঙ্গ, একে একে তুমি বলতে থাকো− না, না, না, তুমি আমাকে ধরো। অনন্তকাল ধরে তোমাকে স্পর্শ করে যাচ্ছি− ধরতে পারি না। ঠিকানা অন্তহীন এখানে রেখেছি পা, চিহ্ন তার ধুয়ে গেছে কবে নদীটির জলে। নদীর কী দোষ? আমিই তো বার বার গিয়েছি ফিরে জলজ লোভে। এখানে রেখেছি চিহ্ন, গোপনে গভীর বনে ও জঙ্গলে বেলা—অবেলার পাতাঝরাকালে ঢেকে গেছে তা; মিশে গেছে দাগ কবেকার মাটিরই কঙ্কালে। তোমাদের কাছে, নীরবে ও কলরবে কতশত রেখেছি পা, গোপনে—সরবে শব্দের ভিড়ে মিলে গেছে সব― ফেলে আসা রেখা শব্দেরই ভিড়ে। একদিন আমিও ঘুমিয়ে যাব মায়াহীন ঘুমে বাতাসের গায়ে পদচিহ্ন রেখে, তখন কোথাও নয়; কবিকে খুঁজে নিও বাতাসের ঘ্রাণে। মুক্ত নস্টালজিয়ায় বন্দি [...বসন্তকালের রাত্রির অন্ধকার নয়; তখন ঘোরতল বিকাল, জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষ দিন সেদিন যতক্ষণ পারে আকাশ জুড়ে চড়া রোদ ঝেড়েছে। ঈদের একদিন পর পবিত্র কোরবানির গোরুখাসির রক্ত দীননাথ সেন রোডের এখানে ওখানে শুকিয়ে কালচে হয়ে এসেছে, নিহত জীবজন্তুর নাড়িভুঁড়ি ছড়িয়ে রয়েছে গোটা সতীশ সরকার রোড জুড়ে, তার গন্ধে দমবন্ধকরা গরম বাতাস। এরই মধ্যে তিনতলা বাড়ির ছাদে চিলেকোঠার ফ্ল্যাটে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে পড়েন কায়েস আহমেদ। একটু—আগে—ডুবে—যাওয়া পঞ্চমীর চাঁদের স্মৃতিতে কোমল ও স্নিগ্ধ অন্ধকারে শেষনিশ্বাসটা টেনে নেওয়ার সুযোগ কায়েস আহমেদ নেননি।− আখতারুজ্জামান ইলিয়াস] ভবিষ্যৎগামী মানুষের সম্মুখে হঠাৎ হঠাৎ এসে দাঁড়ায় অতীত বিস্মৃত—স্মৃতি মাঝেমধ্যে দু’হাত টানটান করে আগলে রাখে পথ ছেলেবেলায় পায়ের তলে বেঁধা মরচে—পড়া পেরেকের কথা— কেন যেন হুট করে মনে ভাসে ফুল—তোলা বিছানায় শুয়ে; তবে কী ফুলের সাথে গোপন সাযুজ্য ছিল অথবা আছে পেরেকের কোনো? গোলাপ হলেও না—হয় মেলানো যেত; আমি তো ভালোবাসি শিউলি—গন্ধরাজ—কাঠগোলাপ। পরবর্তনশীল মানুষ বুঝি পাল্টে যেতে চেয়েও পারে না বদলে যেতে কিছুটা অবচেতন মুদ্রাদোষগুলো সময়ের সাথে সাথে মিশে যায় কখনও কখনও রেখা না রেখে, অতীত মানুষগুলোও না—দেখায় হয়ে যায় ক্রমাগত ম্লান, ধাবমান সময়ের চক্রব্যূহে ঘূর্ণায়মান গরিব—বাস্তবতায়— তবুও ফেলে আসা স্মৃতির দূরবর্তী বিন্দু—বাড়ি ভেসে ওঠে শিল্পীর ল্যান্ডস্কেপে। ফেলে আসা দিনকে যারা ভালোবেসে বাঁচতে চায় মৃত্যুর দিন অবধি ছাদের চিলেকোঠার সিলিংয়ের ফ্যানে ঝুলে পড়ে তারা।

গল্পকার, প্রাবন্ধিক ও কবি
জন্ম:ময়মনসিংহ শহরের প্রাণকেন্দ্র গাঙ্গিনারপাড়ের অধুনালুপ্ত লালালজে (স্থানীয় ভাষায় ‘লাইলিপট্টি’ নামে পরিচিত ছিল)। এখন রাজধানী ঢাকাতেই অস্থায়ী বাস।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর। পেশায় সাংবাদিক।
Facebook Comments Box