স্কুল জীবনে প্রেমে পড়া নতুন কিছু না । আজকের অনেক প্রতিষ্ঠিত মানুষও স্কুলবেলায় প্রেমের পাড়ায় ঘুরে এসেছেন । গত শতাব্দীর নব্বই দশকে যারা স্কুলে কাটিয়েছে তাদের মোবাইল, ফেসবুক, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ টিন্ডার ছিল না । মাল্টিপ্লেকসের ঠান্ডা পেলবতা, ক্যারামেল পপকর্ণের সুগন্ধও ছিল না । তবে টিউশন ব্যাচগুলো ছিল । ছিল গার্লস স্কুলের গেটের উল্টো দিকের শ্যাওলা ধরা পাঁচিল, ছিল শেষ বিকেলের মাঠের ঘাসে বসে জল্পনা । বিকেলে বোনা কল্পনা থেকে তৈরি হয়েছে কত প্রেম গাথা । অনেক ক্ষেত্রেই গল্পের শেষে হ্যাপি এন্ডিং হয় না । কিন্ত নির্ভেজাল প্রেম নিয়ে কোন প্রশ্ন ছিল না, থাকতে পারেও না ।
ঠিক এমনই বিশুদ্ধ প্রেম এসেছিল গোরার জীবনে । গোরা হঠাৎ প্রেমে পড়ল । গোরা বন্ধুদের মধ্যে চেহারার দিক থেকে একদম ভিন্ন । স্কুলে বন্ধুদের কাছে চাচা চৌধুরির সাবুর লোকাল ভার্সন গোরা । ওই বিশাল চেহারার ভিতর একটা কোমল আতুপুতু প্রেমিক ছেলে আছে সেটা জানা ছিল না । মেয়েটা গোরার জীবনে প্রবেশ করে জীবন বিজ্ঞানের মাধ্যমে । জীবন বিজ্ঞানের টিউশন পড়ে এক সঙ্গে । আমাদের কাছের বন্ধুদের বিল্টুই ওই একই জায়গায় একই ব্যাচে পড়ে । গোরা পড়ে কম, সেই মেয়ের দিকে তাকিয়ে জীবনের মানে খোঁজে বেশি । গোরার বিশ্বস্ত বন্ধু হিসেবে আমি একটু একটু করে ওর প্রেমের প্রথম কদম ফুলের সন্ধান পাচ্ছি । গোরার কনফিডেন্স লেভেল হাই । এর আগে একটা দু’টো ট্রাই করেনি এমন না, কিন্তু ওগুলো জাস্ট প্রাকটিস ম্যাচও না ।
গোরা নিশ্চিত মেয়েটা নাকি গোরাকে পছন্দ করে । গোরার দিকে তাকিয়ে নাকি এই ক’দিনে আড়াই বার হেসেছে । দু’বার গোরার কাছে ওর বই অথবা টিউশন নোট চেয়ে । তবে ওই বাকি অর্ধেক হাসিটাই তো সম্পদ । সে হাসি তো অকারণে । ওটাই ইঙ্গিত দিচ্ছে চান্স আছে । যদিও বিল্টুর মত ভিন্ন । বিল্টু বলে,” ধুর, হাসি-টাসি গোরার কল্পনা । আর হাসলেও সেটা গোরার কুমড়ো মার্কা চেহারার জন্য । ” গোরা এসব শুনে বিল্টুর জন্য সাজিয়ে দিল ভদ্র সমাজে নিষিদ্ধ একাধিক শব্দ ।
তবে গোরাকে এই নিয়ে দু’একটা উৎসাহ বর্ধক কথা বলে বিকেলে ঘুগনি, ফুচকা এমনকি একদিন আইসক্রিমও জুটল । আমরা বললাম, “হবে গোরা হবে । এগিয়ে যা, আর তোর এই বিশাল চেহারাটা তোর অ্যাডভান্টেজ । আরে তোর এই হাইট, এই চেহারা, আমাদের মধ্যে ক’জনের আছে ?” প্রেমে পড়া মানুষ একটা অন্য জগতে কাটায় । তাই যে কথাগুলো শুনলে আগে খোরাক বুঝতে পেরে খিস্তি মারত সেগুলোই হজম করে শালপাতায় এক প্লেট এক্সট্রা ঘুগনি অর্ডার দিল । কিন্তু সমস্যা এল কিছুদিন পর ।
গোরা এক উদাস বিকেলে মন খারাপ করে খেলার মাঠে ঘাস উপড়াতে উপড়াতে বলল, “বুঝলি অনেকদিন হলো, কিন্তু নতুন কোন সিগন্যাল আসছে না । বিল্টুর কথা না ফলে যায় । প্লাস দুনিয়াতে সুন্দরী মেয়ের খুব অভাব । কেউ তুলে নিল কিনা কে জানে ।” বললাম, “তুই কিছু বলিসনি এই ক’দিনে ?” প্রশ্ন শুনে গোরার বিশাল শরীর কেমন চোপসানো বেলুন হয়ে গেল
। মুখ নামিয়ে উত্তর দিল, “লজ্জা লাগে রে । তাই ভাবছি তোর হেল্প নেব ।” বিপদ বুঝে ঘুগনি, ফুচকার মায়া ত্যাগ করে আগেই বলে দিলাম, “দয়া করে আমাকে দিয়ে তোর প্রপোজ লেটার পাঠাস না । ওই সব পারব না ।”
গোরার মুখ উজ্জ্বল, বলে, ” ধুর তোকে পাঠাব কেন, আমি কিছু কার্ড কিনেছি । তুই তাতে দু’চার কলম বাংলা ইংলিশ বেশ জমাট প্রেমের কথা লিখে দিস । একটু ইংরেজি কোট দিস । ভাল ইমপ্রেশন তৈরি হবে ।” মুখ ফসকে বলে ফেললাম, ” জমাট বলতে, ওই চুমু টুমু দিচ্ছিস এইরকম চাইছিস নাকি? ওসব কিন্তু লিখতে পারব না ।” গোরা হেব্বি রেগে বলে, “ইয়ার্কি মারিস না । শালা বলছি ভালবাসি, কোন চুমু না । বিশুদ্ধ প্রেম ।” আমি ঘুগনি ফুচকার মায়ায় বলতে পারলাম না, গোরার এতদিন ফ্যান্টাসির শুরুই তো ছিল চুমু ।
যাই হোক, এইভাবে বেশ কিছু কার্ডে আমি বিভিন্ন বই থেকে প্রেমের কবিতা, গল্প টুকে আবেগ মাখা কিছু লাইন লিখে গোরার চাহিদা মেটাতে থাকি । তবে গোরা লেখার শেষে নিজের নাম লিখতে বারণ করেছে । মেয়ে নাকি ঠিক বুঝে যাবে । গোরা সুযোগ বুঝে টিউশন ব্যাচে মেয়েটার ব্যাগে কার্ডগুলো চালান করে । একদিন নাকি ওই মেয়েটা গোরার দিকে প্রায় বাইশ সেকেন্ড তাকিয়েছিল । গোরা নিশ্চিত ওষুধে কাজ হচ্ছে । যদিও বিল্টু বলে ওই কার্ডগুলো নিয়ে নাকি মেয়েটা তার বন্ধুদের কাছে হাসি ঠাট্টা করে । তবে ও নাকি বুঝতে পারে না কে দিয়েছে । কিন্তু বিল্টু কোথা থেকে খবর পেল ? চেপে ধরতেই জানা গেল ওই মেয়ের এক নিকট বান্ধবীকে বিল্টু কিছুদিন ট্রাই করছে । সেই বান্ধবীও সম্প্রতি বিল্টুর ডাকে সাড়া দিয়েছে । ওই মেয়ের কাছ থেকেই গোরার চিঠির হালহকিকত জেনেছে বিল্টু ।
গোরা বিশ্বাস করেনি । তবে কিছুটা দমে গেছে । অবশেষে একদিন অগ্নিপরীক্ষায় বসল । আমাকে আইসক্রিম, ঘুগনির চরম লোভ দেখিয়ে বলে বিকেলে ওর সঙ্গে যেতে হবে । কোথায় ? না বাঘের গুহাতে । গোরা অসীম সাহস বুকে নিয়ে নাকি মেয়েটার নোটসের খাতা চেয়েছে । সেটা ফেরত দেবার বাহানা । আর ভিতরে স্পেশাল কার্ড । আমাকে এবার বেশ যত্ন নিয়ে লিখতে হলো । এবার লেখার শেষে গোরা নিজের নাম লিখতে বলল । বিকেলেই ফাইনাল কাউন্টডাউন ।
বিকেলে আমাদের দুটো সাইকেল নিয়ে চলেছি গোরার হবু শ্বশুরবাড়ি । গোরার প্ল্যান মেয়েটার বাড়ির বাইরে অপেক্ষা করবে । কোন কারণে বাড়ি থেকে বেরোলে হাতে ধরাবে ওই খাতা, ভিতরে কার্ড । গোরা বাড়ির এলাকা চেনে । একবার সাইকেল নিয়ে পিছন পিছন এসেছিল । কিন্তু সাহসের অভাবে ঠিক বাড়ির সামনে পর্যন্ত আসেনি । তবে গলিটা জানে । তাই সাইকেল নিয়ে অপেক্ষা, গলি থেকে বেরোলেই ক্যাচ, কট, কট । বিকেল শেষ হতে চলল । এদিকে কন্যার দেখা নেই । আমিও বিরক্ত হয়ে বললাম, “চল ফিরে যাই । তুই বাড়ি চিনিস না । এভাবে দাঁড়িয়ে থাকার মানে হয় না ।” গোরা বিরক্ত হয়ে বলে,” কোন মতেই না, কার্ড না দিয়ে যাব না ।” অগত্যা আরও মিনিট পনেরো কাটল এভাবেই । গোরা সামনের চায়ের দোকানে গিয়ে দুটো চা চাইল । মেয়ের পদবী বসাক । আমি গোরাকে বললাম,” চায়ের দোকানে জিজ্ঞেস কর তো, বসাকদের বাড়ি কোনটা ?” চায়ের দোকানের লোকটা জানায়, “তিনটে বসাক আছে এই পাড়ায় । কোন বসাক খুঁজছ?” এবার বিপদ । গোরা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলে,” ধরুন ভাল হাইট, ফর্সা মাঝ বয়স্ক ভদ্রলোক ।” আমি অবাক হয়ে গোরাকে নিচু গলায় জিজ্ঞেস করলাম, ” তুই ওর বাবাকে চিনিস নাকি?” গোরা উত্তর দেয়,” না রে, ওই মেয়ের চেহারার সাথে মিলিয়ে বললাম ।”
চায়ের দোকানের টেবিলে দু’টো লোক চা সহযোগে আড্ডা মারছে । একজন রোগা ভাঙা চোয়ালের লম্বাটে লোক বলল, “তেমন দেখতে বসাক এই পাড়ায় নেই ।” গোরা বিন্দুমাত্র না দমে বলে, “একটু ভেবে বলুন তো কাকু, যার ক্লাস টেনে পড়া একটা মেয়ে আছে, বেশ ফর্সা ।” লোকটা বলে “আর কী আছে?” গোরা বুঝল ঠিক লাইনে যাচ্ছে । বলে চলে,” আর ওই হিরো ব্রাউন রঙের সাইকেল আছে ।” লোকটা জিজ্ঞেস করে,” আর কিছু ?”গোরা অস্কার পেয়ে গেছে । বলে, ” আর একটা কালো চশমা আছে, সব সময় পরে না । আর শেষ পুজোতে তিনটে নীল রঙের ড্রেস কিনেছে । নীল ওর খুব প্রিয় রঙ ।” চায়ের দোকানের লোকগুলো গোরার এই বর্ণনাটা ঠিক হজম করেছে বলে মনে হচ্ছে না । আমার একটু ভয় লাগছে । গোরা একটু থেমে শুরু করল আবার, ” ভুরুর পাশে একটা কাটা দাগ , আর বাঁ হাতের কুনুইতে একটা আঁচিল আছে ।”
লোকটা একটু গম্ভীর গলায় বলে, ” কী দরকার তোমার বসাকের মেয়েকে ?” গোরা একটু লাজুক হেসে বলে, ” এটা কাকু একটু পার্সোনাল । একটা খাতা দেব ।” চায়ের দোকানদার ওই লম্বাটে, চোয়াল ভাঙা লোকটার দিকে তাকিয়ে বলল , “এ তো আমাদের মুন্নি মনে হচ্ছে ।” গোরা এক গাল হেসে বলে, ” হ্যাঁ হ্যাঁ ওর ডাক নাম মুন্নি, একদম ঠিক ।” লম্বা লোকটা দাঁড়িয়ে বলে, ” খাতাটা দেখি, মুন্নির খাতা বলছ যখন ।” গোরা বিরক্ত হয়ে বলে,” কেন কাকু ? বলছি তো পার্সোনাল ।”
চায়ের দোকানদার গোরার কাছ থেকে পাওয়া কয়েনগুলো গুনতে গুনতে বলল,” উনিই তো মুন্নির বাবা, বসাকদা ।”
দু’টো সাইকেল সাঁই সাঁই করে ছুটছে । গোরার প্রেম, বসাক কাকু, বিকেলে ঘুগনি আইসক্রিম ক্রমশ দূরে চলে যাচ্ছে ।