ছোটবেলায় দুর্গা পুজো এলে খুব আনন্দ হতো। এখন হয়? হয়, তবে ছোটবেলার মতো অতোটা হয় না। কেন হয় না? কারণ বোধহয়, ছোটবেলা আর বুড়োবেলার মধ্যে তফাত আছে। এই, ছোটবেলা থেকে বুড়োবেলা আসলে একটা জার্নি। একটা ভ্রমণ।
ছোটবেলায় আমি গ্রামে থাকতাম। সত্তর, একাত্তর সাল। কংগ্রেস আমল। নকশাল আন্দোলন প্রায় অস্তমিত। আমি তখন আমার সুন্দর বালক বেলা কাটাচ্ছি। আমি তখন আমার বাল্যবেলা পার হয়ে – যেন নদী পার হওয়ার মতো অন্য অচেনা এক বেলায় পৌঁছেছি। তার নাম কিশোরবেলা।
তো আমাদের গ্রামের দুর্গা পুজো (এখন মনে হয়) সে ছিল অনাড়ম্বর কিন্তু বড় আন্তরিক, বড় পবিত্র, বড় নতুনের ছোঁয়া তাতে। প্রতিবছরই মনে হতো আমাদের এই ছোট গ্রামটির কাছে শারদোৎসব নতুন এক উৎসব। দুর্গা পুজোকে পুরনো বা একঘেয়ে মনে হতো না। সে যেন নতুন, সে যেন নতুন শরতের বিরাট নীল আকাশ, সে যেন এক নতুন কাশবন।
আমাদের গ্রামে একটা ছোট বা সরু খাল ছিল। তার পাশ দিয়ে সরু ও উঁচু মাটির রাস্তা। কেউ কেউ বলতেন যে – এই খাল আসলে, অনেক বছর আগের ইছামতী নদী। ইছামতী এই সামান্য জলের রেখাকে ফেলে কোথায় চলে গেছে? কোন দূরে? ইছামতীর কি কোনো মায়াদয়া নাই তার সন্তানের প্রতি? আমার খুব মায়া হত এই অনাথ জল-রেখাটির জন্য। এই খালের দু’পাশে বিভক্ত আমাদের গ্রাম।
দুর্গা পুজোর মণ্ডপ আমাদের বাড়ি থেকে একটু দূরে, একটা ছোট ও স্থায়ী মন্দিরে। সন্ধেবেলা সারা গ্রামের মানুষ পুজো মণ্ডপে যেত। মনে আছে সন্ধেবেলায় খালের পাশ দিয়ে যাচ্ছি পুজো দেখতে, পরনে নতুন জামাকাপড়ের গন্ধ, বাবা হাত ধরে আমাকে নিয়ে হাঁটছেন। যেন আমরা বাবা-ছেলে দুর্গোৎসবের আশীর্বাদ নিতে যাচ্ছি। জোনাকিরা – তারাও আলো জ্বেলে উড়ে উড়ে শারদ সন্ধেকে উদযাপন করছে যেন। জোনাকিদের আলো দেখতে দেখতে, আমরা দূর থেকে দেখতে পেতাম পুজো মণ্ডপের আলো। আলো মানে হ্যাজাকের আলো। আমাদের গ্রামে তখন ইলেক্ট্রিক আসেনি। মণ্ডপে ঢাক বাজছে। পুরোহিত সন্ধ্যারতি করছেন। দেবী দুর্গার ছেলেমেয়েরাও আমাদের মতো গ্রামের বালক বালিকাদের দিকে বিস্ময়ে চেয়ে আছে। তাদের পুজোয় মনে নেই। যেন মায়ের হাত ছেড়ে তারাও আমাদের সঙ্গে খেলতে চায় বা নতুন জামা কাপড় পরে তাদের মায়ের পুজো দেখতে চায়।
দুর্গা পুজো আসার আগে খুব আনন্দ হতো। ঠাকুর বিসর্জন হয়ে গেলে মন খারাপ হতো। মন খারাপ হতো দেবী দুর্গার সঙ্গী সাথীদের জন্য। অসুর সিংহ মোষ কার্তিক গণেশ সরস্বতী লক্ষ্মী – তাদের জন্য। এরা এই ক’দিনে আমাদের ফ্রেন্ড বা বন্ধু হয়ে গেছিল। আমার আর আমার দিদির সঙ্গে একদিন তো সরস্বতী আর লক্ষ্মী, দুই বোন আমাদের বাড়িতে এসেছিল। পাড়ার লোক সবাই আমাদের বাড়ি ভিড় করে এসেছিল সরস্বতী ও লক্ষ্মীকে দেখতে। সরস্বতী তো আমার দিদির হারমোনিয়ামে গানও গাইল, রবীন্দ্রনাথের ‘অমলও ধবলও পালে…’ গানটি। ফলে পুজো শেষ হয়ে গেলে, দুর্গা যখন সবাইকে নিয়ে চলে যেতেন আমাদের খুব মনখারাপ হতো। বিশেষ করে আমার মনখারাপ হতো, কারণ আমাকে আবার পড়তে বসতে হবে। বেশ ছিলাম এই কয়দিন পাঠ্যবই থেকে দূরে।
ইস্কুল যাওয়ার পথে আমাদের গ্রামের পুজো মণ্ডপ পড়ত। যখন দেখতাম, ঠাকুরের কাঠামো তৈরি শুরু হয়েছে, আমাদের সবার মন আনন্দে ভরে যেত। ইস্কুলে গিয়েও ‘পুজো আসছে’ এই আনন্দ মনের চারধারে মৌমাছির মতো গুনগুন করত। স্যার অঙ্ক দিলে বারবার ভুল করতাম।
কাঠামো তৈরি, তারপর মাটি চাপানো, একদম শেষে চক্ষুদান – এই সবের মধ্যে প্রবল ভালোবাসা বা ভক্তি না থাকলে শেষমেশ খড়ের কাঠামো দেবী হয়ে ওঠে না। তা বড়জোর পুতুল হয়ে উঠতে পারে।
এতো এখনকার থিমের পুজো নয়, বা পিতৃপক্ষে উদ্বোধনের পুজোও নয়। এ ছিল অনেক বছর আগের আমাদের এক সহজ সরল গ্রামের সাধারণ দুর্গা পুজো। সাধারণ হয়েও তা ছিল আমাদের এক অসাধারণ উৎসব।
দুর্গা ঠাকুর বানানো এবং দুর্গা পুজো নিয়ে কবি মণীন্দ্র গুপ্তের ‘অক্ষয় মালবেরি’ গ্রন্থে এক অসাধারণ ও আশ্চর্য বিবরণ আছে। সেখানে ‘দুর্গাপুজো’ নিয়ে একটা অসামান্য চ্যাপ্টারই আছেঃ
‘… এখন এই ভরা ভাদ্রে একদিন কার্তিক কুমোর নৌকো করে এসে হাজির হয়, খড় আর পাটের সুতলি দিয়ে সেখানে বাঁশের কাঠামোর উপরে শক্ত করে প্রতিমার বেনা বানিয়ে রেখে যায়। বিকেলবেলা ছায়াভরা দুর্গামণ্ডপে গিয়ে আচমকা দেখি – দশ হাত ছড়িয়ে মুণ্ডহীন খড়ের দুর্গা দাঁড়িয়ে আছেন। দু পাশে কিশোরীশরীর উড়ন্ত পরীর মতো জয়া, বিজয়া, তারাও মুণ্ডহীন…’ – ‘কয়েকদিন পরে বুড়ো কার্তিক কুমোর আবার আসে দু-তিনজন শাগরেদ নিয়ে। শাগরেদরা পাট আর তুষ মিশিয়ে পা দিয়ে মাটি ছানে, খড়ের প্রতিমার গায়ে মাটি চাপায়। বুড়ো কারিগর কার্তিক তার রোগা আশ্চর্য হাতে বাঁশের কাটিম ধরে চটপট প্রতিমার গা থেকে বাড়তি মাটি কেটে, চেঁছে বুকের খাঁজ, পেটের ভাঁজ, উরু ও হাতের সন্ধি বার করে আনে। বুড়ো ওস্তাদের বিদ্যে অবাক হয়ে দেখতে দেখতে একসময় তারা কাজ শেষ করে চলে যায়। আমি একলা দাঁড়িয়ে দেখি ভিজে, নরম, কবন্ধ প্রতিমা যেন নীল জলাশয় থেকে উঠেছে। আমি গণেশের কোমল শুঁড়ে হাত দিই, সিংহের হাঁ মুখে ভয়ে ভয়ে আঙুল ঢোকাই – ভিজে, বিষণ্ণ, যেন পরিত্যক্ত সাপের গর্ত।’ ইত্যাদি ইত্যাদি।
এখানেই কবি মণীন্দ্র গুপ্ত, তাঁর ‘অক্ষয় মালবেরি’ গ্রন্থে, আবার লিখছেন – ‘প্রথম মাটি শুকিয়ে ঝুনো হয়ে যাবার পর আবার একদিন কুমোরেরা আসে। নতুন মাখমের মতো মাটি ছানা হয়। প্রতিমার গায়ে দ্বিতীয় বার মাটি চাপানো হয়, ফাটলগুলো মাটির প্রলেপে বুজিয়ে পাতলা কাদায় ভেজানো ন্যাকড়ার পট্টি সেঁটে দেওয়া হয়। বুড়োর হাতের ধারালো কাটিম প্রতিমার শরীরকে আরো নিখুঁত করে তোলে।’ … ‘দক্ষ হাতে দু-তিন রকম কাটিম দিয়ে অসুর আর সিংহের মুখে, চোখে, নাকের ফুটোয় হিংসা আর দর্প, শক্তি আর ব্যথা ফোটায়। প্রহর কেটে যায়, মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে এইসব দেখি। কুমোরেরা চলে গেলেও নড়তে চাই না। প্রতিমার মধ্যে সুখী প্রাণ এসে গেছে, আমি তাঁর সঙ্গ পাই। কিন্তু আগেকার সেই মুণ্ডহীন, নুলো দুর্গা জয়া বিজয়া এবং লেপাপোঁছা মাথার সিংহ গণেশ অসুর যে অপ্রাকৃত অস্তিত্ব নিয়ে আমাকে ধাক্কা দিত তা এখন অনেক হালকা এবং নরম হয়ে গেছে। সম্পূর্ণ হতে যাওয়া প্রতিমার মুখে এখন হাসি, শরতের আকাশ থেকে তাঁর সারা গায়ে উৎসবের হাওয়া এসে লেগেছে।’ এই লেখা হয়েছিল উনিশ শতকের একদম প্রথমদিকে সম্ভবত। এবং এই অসামান্য লেখাটি তৈরি হয়েছিল, মণীন্দ্রবাবুর ছোটবেলার তৎকালীন বরিশালে। কিন্তু আজও এই লেখা আমার কাছে খুব প্রাণবন্ত।
এবার আমার পাড়াগাঁর পুজোয় আসি। আমাদের সেই গ্রাম, বা অজপাড়াগাঁ আজ আর নেই। সেখানেও ‘গুগল’ তার সব আধুনিকতা নিয়ে ঢুকে পড়েছে। সেই হ্যাজাক জ্বেলে দুর্গা পুজো এখন আর হয় না নিশ্চয়। ইছামতীর স্মৃতি নিয়ে বেঁচে থাকা সেই খাল, সেই জোনাকিদের উপস্থিতি এখনও আমার মনে ঘুরপাক খায়।
এখন আমার এই প্রবীণ বয়সে এসে, ঠাকুর বিসর্জন হয়ে গেলে, ‘আবার পড়তে বসতে হবে’ – এইরকম ভয় বা মনখারাপ হয়তো হয় না। কিন্তু বাড়িতে কোনো প্রিয়জন বা আত্মীয় আসবেন, এসে থাকবেন কিছুদিন, তাতে একটা আনন্দ হতো যেমন, তেমন তাঁরা চলে গেলেও তীব্র মনখারাপ হতো বা মন বিষণ্ণ লাগত। দেবী বিসর্জন হয়ে যাওয়ার পর সেইরকম বিষণ্ণতা বা মনখারাপ এখনো আমাকে গ্রাস করে। কিন্তু আসা ও চলে যাওয়াই পৃথিবীর বা এই জগতের স্বাভাবিক নিয়ম। আমরা সবাই তাকে মেনেও নিই বেঁচে থাকার নিয়মেই।
সেই নিয়ম মেনেই আবার দুর্গা পুজো এসেছে বা বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব এসেছে আমাদের এই আধুনিক, যুদ্ধে আক্রান্ত, সংকীর্ণ রাজনীতি ও রাজনীতিকদের দুর্নীতিতে আক্রান্ত, আমাদের আধুনিকতার আলোয় ভরা পৃথিবীতে – চলুন আমরা আনন্দ করি। শরতের আনন্দ ওই নানান আলোকসজ্জা হয়ে আমাদের যাপনে বাজছে, বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব ওই ফিতে কাটার উৎসবে মেতেছে তীব্র চিৎকারে। চলুন আমরা আনন্দ করি।