রানির বাগানে এতগুলো ছাগল ঢুকে পড়েছে! এরা ঢুকল কীভাবে? এতগুলো ছাগল এই তল্লাটে ছিল। রানি চুপ করে চেয়ে থাকে আর ভাবে। রানির যদি উপায় থাকত তাহলে এক্ষুনি এই ছাগলগুলোকে কশাইখানায় পাঠাত। কশাই-এর কথা মনে পড়তেই রানির জিভ লকলক করে উঠল। কিন্তু উপায় কী? রানির বাগান তো আর রানির নয়! কস্মিনকালেও ছিল না। বাগানটা যে বুড়ির, মানে যে বুড়ি তাকেই এই বাগানে ঝুপড়ি করে থাকতে দিয়েছে তার বয়স বেড়েই যাচ্ছে তবু মরছে না। বুড়ি বেঁচে থেকেও মরে আছে কিন্তু মরে গিয়ে বাঁচার কোনও লক্ষণই দেখাচ্ছে না। বুড়ির বাগানে রোজ নতুন – পুরোনো লোকে ভরে যাচ্ছে। ওরাও কি রানির মতোই ভাবে! ভাবলেও ক্ষতি নেই, ওদের ম্যানেজ করে ফেলতে রানির কোনও অসুবিধে হবে না। অসুবিধে হয়ে গেল এই ছাগল।
ছাগলরা পিলপিল করে ঢুকছে। তাদের উদ্দেশ্য কী বোঝা যাচ্ছে না। তবে তারা এখন ঘাস খাচ্ছে না। তারা বুড়ির ঘরের দিকে দলবেঁধে এগোচ্ছে। রানি অবাক হয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। ছাগলের কী ইন্টেলিজেন্স লেভেল বেড়ে গেল? নাহলে তারা দলবদ্ধ হল কীভাবে? ছাগলদের একেবারে সামনে যে দাড়িওলা রামছাগলটা এগোচ্ছে তার গলাটা বেশ মিঠে। মাঝে মাঝে সে পিছনে মিহি গলায় ব্যা – ব্যা করে ডাক দিচ্ছে। ওমনি পিছন থেকে স্লোগানের সুরে বাকি ছাগলগুলো সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠছে। কাণ্ড দেখে বাগানের বাকি লোকগুলোও বেরিয়ে এল। তবে তারা কেউ রানির মতো অবাক হয়নি। কেন হয়নি রানি বুঝছে না। তবে হয়নি এটা দিব্যি বুঝছে কারণ তাদের কথাবার্তায় ছাগল সম্পর্কে কোনও বাক্যই নেই। বরং তারা বলছে এবারে কীভাবে তারা কাজে যাবে, কাজে না গেলে কেন একদিনের বেতন কাটা যাবে, বেতন কাটা গেলে তারা কীভাবে কোন খাতে খরচ কমাতে বাধ্য হবে এইসব। এইসব ছেঁদো কথা মানুষের পক্ষেই বলা সম্ভব, ছাগলের পক্ষে না ভেবে রানি একা একাই একচোট হি -হি করে হেসে নিল। তারপর ধীরে ধীরে ছাগলদের দিকে এগিয়ে গেল। এগোল কারণ রানি যা ভাবছে ঘটনা যদি তাই হয় তবে এবার তার স্বপ্নপূররণ হতে চলেছে। বুড়ির বাগান রানির হতে চলেছে। এইসময় মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে। ধীরে ছাগলগুলোকে ব্যবহার করতে হবে। ছাগল- জাগরণের ইস্যুটা ঠিকঠাক কাজে লাগানো দরকার। কিন্তু তার আগে জানা দরকার যে, ছাগলগুলো ঠিক কী চায়?
রানি ছাগলগুলোর দিকে এগিয়ে গেল। পিলপিল করে ছাগল ঢুকছে। বুড়ির মূল ভিটে থেকে বাগানের গেট পর্যন্ত রাস্তাটা কেয়ারি পাতাবাহার দিয়ে ঢাকা। মোরাম বিছানো সেই রাস্তা পেরোতে পেরোতে ছাগলরা মাঝেমধ্যে পাতাবাহারের পাতার দিকে তাকাচ্ছে কিন্তু মুখ দিচ্ছে না। আজ মনে হয় তারা নিঃস্বার্থ। মোরাম বিছানো পথের শেষে টানা টানা সিঁড়ি। সিঁড়ি দিয়ে উঠলেই লম্বা বারান্দা। বারান্দা পেরিয়ে বুড়ির ড্রয়িং রুম। জমিদার-বাড়িতে যেমনটা হয় আর কি! বারান্দায় এখন তিন – চারটে রামছাগল পাশাপাশি সার বেঁধে দাঁড়িয়েছে। তারা কেমন যেন অদ্ভুত সুরে দুলে দুলে ব্যা -ব্যা করছে। স্লোগান দিচ্ছে না বক্তৃতা দিচ্ছে বোঝা ভার। রানি দূর থেকে ছাগলদের ধরন-ধারণ পর্যবেক্ষণ করতে লাগল।
ইতিমধ্যে ছাগলের চিৎকার শুনে বুড়ি বেরিয়ে এসেছে, তবে তাকে খুব একটা বিচলিত মনে হচ্ছে না। ছাগলরা যে খুব একটা অনিষ্ট করতে পারবে না এইকথা বুড়ি ভেবেই নিয়েছিল কিন্তু দূরে রানিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বুড়ির কপালে ভাঁজ পড়ল। তবে কি রানিই এই সাতসকালে ছাগলগুলোকে লুলিয়ে দিয়েছে? ছাগলদের দাবিটা শোনা দরকার কিন্তু বুড়ি ছাগলদের ভাষা জানে না। সুতরাং বুড়ি দুহাত তুলে বলল,” ভাইসব! আমি যতদূর দেখতে পাচ্ছি তাতে তোমাদের সংখ্যা ৩০। কিন্তু ভাবো আমরা মানুষেরা এই বাগানে সংখ্যায় ২৩৫। কথাটা শেষ হতে না হতেই ছাগলরা বুড়ির কাপড়ে বাইট দিতে শুরু করল। বুড়ি লাফাচ্ছে। বুড়ি তার কেয়ারটেকার বিনয় গোঁয়ারকে ডাকাডাকি শুরু করল। এতগুলো ছাগলের ব্যা – ব্যা – র আওয়াজ পেরিয়ে বুড়ির ওই মিহি গলার ডাক কীভাবে যে বিনয় শুনতে পেল তা কেউ জানে না। কিন্তু রানি দেখল যে বিনয় গোঁয়ার হলে কী হবে, বুড়ির ডাকের জন্যে বোধহয় সবসময় কান খাড়া করে বসে থাকে নাহলে সে এত তড়িঘড়ি এল কীভাবে কে জানে! তবে এসেই সে কাণ্ডটা ঘটাল। ছাগলদের ভাষা জানে বলেই তাকে বুড়ি কেয়ারটেকার রেখেছিল সত্যি কিন্তু ছাগলের ভাষায় যে সে এত সুন্দর কথা বলতে পারে সেটা রানিও ভাবতে পারেনি। বিনয় একবার চিৎকার করে ব্যা-আ-আ-আ-আ বলে উঠল আর তারপরেই বুড়ির ভাষায় চেঁচিয়ে বলল, ” তোদের তিনদিক থেকে ঘিরে নিয়ে কাটব “।
ছাগলরা কী এবার পিছিয়ে যাবে! ছাগলরা চায় কী? — বুড়ি জানতে চাইল।
বিনয় উত্তেজিত হয়ে চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় তুলে বুড়িকে বোঝাতে লাগল যে, ছাগলগুলো আস্ত পাঁঠা ;ওরা ওদের জঙ্গলের অধিকার চাইতে এসেছে।
বুড়ি এবার বিরক্ত। সে বললে জঙ্গলের অধিকার হঠাৎ কে কাড়ল? ওদের ঘাস কি কম পড়েছে?
ছাগলরা বুড়ির প্রশ্ন বুঝতে পেরেছে কিনা বোঝা গেল না। তারা থামল না। বরং আরও উচ্চকণ্ঠে চিৎকার জুড়ে দিল। তারা বোধহয় তিনদিক থেকে ঘিরে মারার ভয় করে না। বিনয়ও গোঁয়ার গোবিন্দ, সে শুধু মারধোর করার জন্যে ব্যস্ত। বুড়ি শেষমেশ বলে, ” শোন ছাগলরা,তোদের যে এখানে লুলিয়ে দিয়েছে সে যদি এই কচি ঘাসজমি হাতে পায় তাহলে তোদের কচি ঘাস তো বাদ দে, প্রাণটাও থাকবে না। কশাইখানার মালিকের কথায় নাচিসনি। ধীরেসুস্থে মাঠে ফের। এখানে ব্যা-ব্যা করে বারান্দাটা নাদি ছড়িয়ে ভরাসনি। নাহলে কিন্তু এবার কশাই ডাকব। “
তবে ছাগলরা যখন জেগে ওঠে তখন তাদের আর অন্য কিছু বোঝানো যায় না। এটাই মওকা। রানিকে যে বুড়ি দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে সে রানিও জানে। রানিকে যে বুড়ি ব্যঙ্গ করল সেটাও রানি বোঝে। কিন্তু এই পরিস্থিতি যখন একবার নিজে থেকে তৈরি হয়ে গেছে তখন আর অপেক্ষা করা যায় না। এই মুহূর্তে ছাগলদের সামনে হাজির হতে হবে। ছাগলদের এখন তাকে দরকার। ছাগল – বিদ্রোহকে হাইজ্যাক করার জন্যে রানি এতটুকুও দেরি না করে বুড়ি আর ছাগলদের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়াল। ছাগলরা যতই বুদ্ধি খাটাক, ছাগল তো ছাগলই, তাই ছাগলরা রানিকে খুব ভালোবাসে। রানি ছাগলদের সঙ্গে ছাগলের ভাষায় অপূর্ব কথা বলতে শিখেছে। ছাগলদের তো আর মন কিংবা মূল্যবোধ নেই, তাদের পোশাকেরও দরকার নেই। শুধু বৃষ্টি এলে ওরা সহ্য করতে পারে না। আর ঘাস – পাতা। ঘাস-পাতা না পেলে ওদের বড়োই কষ্ট হয়। রানি ঠিক এই জায়গাটাতেই হিট করল। দুহাত তুলে ছাগলদের থামিয়ে সে শুরু করল বক্তৃতা।
” আমার প্রিয় পাঁঠা ও ছাগল ভাইবোনেরা নমস্কার এবং আসলাম আলাইকুম — ‘
আসলাম আলাইকুম বলার যে এমন প্রভাব পড়বে সে বুড়ি কেন ছাগলরাও বোধহয় আগে ভাবেনি। বুড়ির বাড়ির ঘাসজমিতেই যে হিন্দু – মুসলমান সমস্যা এত বড়ো আকার নিয়েছে সেকথা বুড়ি কী ভাববে বুড়ির পোষা বানরগুলোও ভাবতে পারেনি। যে ছাগল ঘাস খেয়ে হিন্দু মালিকের ঘরে ফেরে তারা নাকি এতদিন বুড়ির চোখের সামনেই মুসলমান মালিকের ছাগলগুলোকে নিচু নজরে দেখত! উল্টোদিকটাও যে সত্যি এটা বুড়ি একেবারেই জানত না তা নয় তবে বুড়ি বুঝিয়েছিল যে ঘাসের অধিকার আর মাথা গোঁজার ছাদের অধিকারই শ্রেষ্ঠ অধিকার। সেই অধিকার রক্ষা করার জন্যে দু – চারটে ছাগলকে জবাই করলেও ক্ষতি নেই। বুড়ির জমিদারিতে কশাইরা বেশিরভাগই মুসলমান। সুতরাং বুড়ি ভাবত ছাগলরা মুসলমানদের ভয় পায়। কিন্তু সেই ভয়কেই যে রানি ব্যবহার করবে এটা বুড়ি বুঝতে পারেনি। আসলে হল কী ওই আসলাম আলাইকুম বলার সঙ্গে সঙ্গেই কশাইরা সব রানিকে নিজের লোক মনে করল আর ছাগল তো চিরছাগল তারা ভাবল কশাই যেদিকে সেদিকে থাকলেই মুক্তি। ছাগলেরা রানিকে নেতা মেনে নিল। শিঙ বাগিয়ে তারা তাড়া করল বিনয় গোঁয়ারকে।
বাগানের মানুষগুলো এইবার ঘুরে তাকায়। তারা মজা দেখছে। এমনি এমনি তো আর তারা বিনয়কে গোঁয়ার বলে না! ব্যাটা তাড়া খেয়ে মাথা খাটা! তুই তো ব্যাটা মানুষ, তুই যদি না বুদ্ধি খাটাস তবে কিসের মানুষ! ছাগলতাড়া খেয়ে গোঁয়ার আরও গোঁয়ার্তুমি শুরু করল। একবার বলে, ” ছাগলের জাত, তোরা পাছা দেখ “। সেই শুনে ছাগলগুলো আবার তাড়া করল। তাড়া খেতে খেতে ক্লান্ত বিনয় আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। কেউ বলেনি, এমনকি বুড়িও বলেনি তবু বিনয় একটা গণ্ডগোল করে ফেলল। আসলে সে বুঝতেই পারেনি যে ছাগলরা ভেড়া নয়, তাই ছাগলদের সামনে থেকে কেউ রাস্তা ঠিক করে দেয় না। ছাগলদের চালাতে হয় পিছন থেকে। তাই ছাগলদের পিছনে যে রানি আসছিল বিনয় লক্ষই করেনি। তাই বুঝতেও পারেনি যে ছাগলগুলো আসলে ছুটেছে কশাইখানার দিকে। বিনয় তাড়া খেতে খেতে যেই কশাইখানায় ঢুকল অমনি তার পিছন পিছন একদল ছাগলও শিঙ বাগিয়ে ঢুকল। আর তারপরেই শুরু হল গল্প। এই গল্প সেই গল্প তৈরির গল্প। গল্প তৈরি হয় এমনভাবে যাতে সত্যিটাই মিথ্যে মনে হয় আর মিথ্যেটাই সত্যি। আর ছাগলদের সত্যি – মিথ্যে কোনও জ্ঞান নেই। ছাগলদের দরকার শুধু ঘাস-পাতা। ছাগলদের জন্য ঘাস-পাতার সামান্য একটা ফ্রি – জোন দেওয়া হবে জেনেই ছাগল-বিদ্রোহীরা আহ্লাদে আটখানা।
বিনয়ের মাথা কাটা গেল। ছাগল – বিদ্রোহের অবিসংবাদী নেত্রী রানির স্বপ্ন সফল। বুড়ির বাগানের কেয়ারটেকার এখন সে। ছাগলরাও খুশি। তাদের জন্যে একটা ঘাস-পাতার ফ্রি – জোন করে দেওয়া হয়েছে। শুধু ছাগলরা ছাগলই থেকে গেছে, তাই ফ্রি – জোনের বাইরে যে কত বিচিত্র খাবার রানির জন্যে আর রানির শাগরেদদের জন্যে ফুলেফেঁপে উঠেছে,সেই খাবার যে আসলে তাদেরই ছিল, তাদেরই হতো সে খেয়াল ছাগলে করে না। তারা ঘাস খেতে খেতে যে কুণ্ডটায় নেমে যেতে থাকে রানি সেটা পেতে রেখেছে। কুণ্ড জুড়ে আগুন জ্বলছে ধকধক। ছাগলদের জ্ঞান নেই। নরম কচি পাতার লোভে কুণ্ডের দিকে নেমে যাচ্ছে একটার পর একটা ছাগল। একা একা বারান্দায় বসে এইসব দেখে শুধু বুড়ি। দেখে আর মনে মনে হাসে। শেষ ছাগলটার পুড়ে যাওয়ার জন্যে অপেক্ষা করতে থাকে বুড়ি। ছাগলরানিকে দেখে তার মনে কৌতুক জাগে। মনে হয় সত্যিই মিথ্যে। মনে হয় চালাকি আসলে বড়সড় ছাগলামি ছাড়া আর কিচ্ছু না। কিছুই।

কবি
পেশা – বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা