‘দখল’ শব্দটি নিয়ে একটু ভাবতেই আমার মাথায় এল এক জ্যামিতিক বিন্যাস। একটি সমবাহু ত্রিভুজ, যার একেকটি বাহুর নাম যথাক্রমে ‘দ’, ‘খ’, আর ‘ল’। যেহেতু সমবাহু, তাই প্রতিটি বাহুর মাপ ও মান সমান। এভাবে আমরা ‘দখল’-শব্দের তিনটি মাত্রাও পেয়ে যাব, যা সমমাত্রা। এঁকে দেখালে সুবিধে হবে—
তিনটি শীর্ষবিন্দু ছুঁয়ে যে ভুজ বা হাত তিনটি, তা দিয়ে একটুকরো জমি চিহ্নিত করা গেল। ‘দ’ হাত ধরে আছে ‘খ’ ও ‘ল’-এর। পারস্পরিক হাত ধরাধরি করে আছে বলেই ‘দ-খ-ল’ ত্রিভুজ তথা জমিটা একটা বেড় পেল। বলা বাহুল্য, জমির সঙ্গে ‘দখল’-এর একটা সম্পর্ক অনাদিকালের।
এবারে ‘দখল’ শব্দটি নিয়ে একটু খেলা যাক। ‘দখল’-এর ‘দ’ বর্ণটি বাদ দিলে হয় ‘খল’, যার প্রতিশব্দ শঠ, ঠকবাজ, প্রতারক, প্রবঞ্চক, ইত্যাদি। আর কে না-জানে ‘দখল’-এর সঙ্গে ‘খল’-এর সম্পর্ক অবিসংবাদি। মাঝের ‘খ’ বর্ণটি বাদ দিলে, পাই আরেকটি শব্দ— ‘দল’; যা রেফার করে বেশ কিছু আইটেম, আমরা তার মধ্যে একটা বেছে নিই প্রয়োজন অনুসারে। যেমন ‘দল’ বলতে গোষ্ঠী, জোট, পার্টি, মোর্চা, ফ্রন্ট ইত্যাদি বোঝায়; আবার বোঝায় সংগঠন, রাজনৈতিক দল, সৈন্যদল, খেলার দল ইত্যাদি। এই অর্থে ‘দখল’-এর সঙ্গে ‘দল’-এর সম্পর্ক দ্বৈত এবং বিপরীত। যেমন, দল বেঁধে আয়ত্বে আনা তথা দখল করার কাজটি যেমন সহজ হয়; তেমনি দল বেঁধে তা প্রতিরোধ করার কাজটিও অপেক্ষাকৃত সহজ। অর্থাৎ ভাইসভারসা।
খেলার পর লেখা গা-ঘেঁষাঘেঁষি করে থাকে। ‘দখল’ বলতে কী বুঝি? বুঝি আয়ত্বে আনা, অধীনে আনা, আধিপত্য বিস্তার করা, বশে আনা, অধিকারভুক্ত করা, বাগে আনা, কতৃত্বে আনা ইত্যাদি; আবার আত্মসাৎ করা, গায়েব করা, গাপ মারা, হস্তগত করা, হাতিয়ে নেওয়া, ঘাড় ভাঙা ইত্যাদিও। এখন আমি যে ত্রিভুজাকৃতি জমির কথাটা তুলেছিলাম, সেখানে বস্তুত আমরা মানুষেরা অনাদিকাল থেকে এই বিশ্বপ্রকৃতির মাটি-জল-হাওয়া দখল করে আছি। এটা ভুলে গেলে চলে না। যুক্তি একটা আছেঃ মানুষও প্রকৃতজ, তাই তাকে ধারণ করার কাজটি প্রকৃতিরই করতে হবে এবং হচ্ছে। একে দখল বলব কেন? হতে পারে প্রেম-এ দখল; কিন্তু শব্দটি ‘দখল’-ই। অনেকটা বশে এনে দখল, ভাব-ভালোবাসায় হাতিয়ে নেওয়া গোছের এবং একে ভোগদখল বলা ভালো; স্বত্ব নেই, সত্তা আছে। কিন্তু আমরা প্রায়শই ভুলে যাই— “পরের জায়গা পরের জমি/ ঘর বানাইয়া আমি রই/ আমি তো এই ঘরের মালিক নই”। হতে পারে গানটা রূপকার্থে; কিন্তু ‘মালিক’ শব্দটির উপস্থিতি ঘটিয়ে দিল। আর এই মালিকানার সঙ্গে দখল শব্দটি দারুণভাবে সম্পর্কযুক্ত।
ফলে বোঝা যাচ্ছে ‘দখল’ নানাবিধ। জমিটাকে প্রতীক ধরে সমস্ত বস্তু-স্থান-গোষ্ঠী-শ্রেণি-শিল্প-সাহিত্য-কৃষ্টি-সংস্কৃতির ওপর এই দখল-কে বলবৎ করা যেতে পারে। আবার প্রেম-প্রীতি-ভালোবাসায় দখল হতে পারে; জাদুবলে বা মায়াকুহকে দখল হতে পারে; আবার জোর করে দখলও হতে পারে, যেটা বেশিই হয়ে থাকে এবং যাকে এক কথায় বলা যায় ‘জবরদখল’। আমার তো মনে হয় উদ্দীপকে ‘জবরদখল’ কথাটাই অ্যাপ্রোপ্রিয়েট হত। বিশেষত ‘সাম্প্রতিক দুনিয়ার প্রাসঙ্গিকতা’-য়।
‘জবরদখল’ শব্দটি কি জবরদস্তি আনলাম মনে হচ্ছে, হে পাঠক! বস্তুত, দখলের পার্থক্য চিহ্নিত করতে শব্দটির প্রয়োজনীয়তা জরুরি—, এবং মনে করালো সাম্প্রতিক দুনিয়ার যাবৎ ‘দখল’। ‘জবরদখল’ শব্দটি ‘দখল’-এর রূপভেদকে নির্দিষ্টতা দেয়। ‘জবর’ বিশেষণ ‘দখল’ বিশেষ্য-র আগে বসে কাণ্ডটি সম্পাদন করে; যা রেফার করে বলপ্রয়োগদ্বারা দখল, বে-আইনি অধিকার কায়েম, জোর করে আধিপত্য বিস্তার করা, বা, অনৈতিকভাবে অধিকারভুক্ত করা। এরপর থেকে, স্বাভাবিকভাবেই আমার প্রযুক্ত ‘দখল’ শব্দটিকে পাঠক মনে-মনে ‘জবরদখল’ পড়লে বাধিত হব। এখন শব্দটি যখন জায়গা দখল করে নিলই, তখন আগের আঁকা ত্রিভুজটির মান-মাত্রা ভিন্ন হয়ে পড়ল। এখন যেন ‘দ’, ‘খ’ ও ‘ল’, ত্রিভুজের তিনটি বাহু আরও বলবান হয়ে উঠল। ‘খ’ আর ‘ল’, যা মিলে ‘খল’ হয়েছিল, তার গরিমা আরও বেড়ে গেল, এবং দুইয়ে মিলে ‘দ’-কে আয়ত্বাধীন করতে উঠে পড়ে লাগল। এতে তার ছলের অভাব রইল না। আর ‘দ’ আর ‘ল’ বাহু মিলে যে ‘দল’ গঠিত হয়েছিল তা বহুধা-বিভক্ত হয়ে পড়ে দুর্বল হয়ে পড়ল আর প্রকারন্তরে ‘খল’-কেই পুষ্ট করে চলল। বহুরূপীর মতো আচরণ করতে থাকা খলবিরোধী দলগুলির আচরণ এমন হয়ে উঠল যে, ‘দ’ আর ‘ল’ বাহুর মিলনে গঠিত কৌণিক বিন্দুটি যেন আলগা হয়ে যায় বা গেছে। একটি কোণ আলগা হয়ে পড়লে স্বাভাবিকভাবে সেখানে যে ফাঁক সৃষ্টি হয়, সেখান দিয়েই বহির্খলেরা অনুপ্রবেশ ঘটায় ও ত্রিভুজের নিজস্ব চরিত্রটিকে বদলে দিতে সমর্থ হয়। ত্রিভুজে যে জমিটির কথা বলা হয়েছিল, সেও তার আকৃতি হারায় প্রকৃতি নষ্ট করে। ভিজুয়ালাইজ করতে চাইলে ব্যাপারটা অনেকটা নীচের আঁকাটির মতো হবে বা সম্ভাব্য অন্যরকম।
ত্রিভুজ নিয়ে আর একটা প্রসঙ্গ সামনে উঠে আসতে বাধ্য। এতক্ষণ অধিকাংশই বাহু দিয়ে এবং নিয়ে কথাবার্তা চলছিল। এবারে কোণ। ত্রিভুজের একটা প্রতীকতা আছে, বা ত্রিভুজ বলতেই বেশ কয়েকটা সংকেত বা সিম্বল আমাদের সামনে ভেসে ওঠে। যার মধ্যে একটা হচ্ছে শীর্ষবিন্দু উলটে লালরঙা ত্রিভুজ। দেখলে আমার অন্তত কিছুটা ভয় করে। আসলে এটি ‘ডেঞ্জার’ তথা বিপদের সংকেত। পথের বিপথে যেমন এটি টাঙানো থাকে, তেমনি যে-কোনো বিপদে মানসপটে ‘লাল-পান’-এর বদলে ‘লাল ত্রিভুজ’ পানকৌড়ি ভেসে ওঠে।
যে যেভাবেই ভয় পাক, ত্রিকোণ প্রেমের কথা আমরা খুবই শুনতে পাই। ফলে ত্রিকোণ প্রেম যদি এই লাল ত্রিভুজে উপরিপতন করানো যায়, তাহলে বিপদ থাকলেও মজাটা দেখবার মতো, বলবার মতো, আচারের মতো চাটবার। প্রথম ত্রিভুজের ‘দ’ ও ‘ল’ বাহু দিয়ে তৈরি কোণ ধরা যাক ‘ক’ এবং তা ‘দ’ ও ‘ল’-এর মধ্যেকার প্রেম। আবার ‘খ’ ও ‘ল’ এর মধ্যেকার প্রেমকে ‘গ’ কোণে চিহ্নিত করা যাক। ‘ল’ এখানে সাধারণ বাহু বা সাধারণজন; প্রেমিক কিংবা প্রেমিকা। প্রেমিক হলে, ‘দ’ আর ‘খ’ প্রেমিকা; প্রেমিকা হলে, ‘দ’ ও ‘খ’ প্রেমিক। দুটি কোণ আবিষ্কৃত হলো, অথচ একেই ‘ত্রিকোণ প্রেম’ বলা হচ্ছে। কেন? কেন?? কেন??? এখানেই শীর্ষবিন্দুর (ধরা যাক ‘ঘ’) একটা ভূমিকা আবিষ্কার করা যায়। আর সেটা ‘দ’ এবং ‘খ’ এর বৈরিতার সম্পর্ক ‘ল’-কে কেন্দ্রে রেখে। এই ‘ঘ’ কোণটি হচ্ছে রেজাল্টেন্ট কোণ। দুই পারস্পরিক প্রেমের বিপরীতে যার অবস্থান ঠিক বিপরীত ভূমিকা নিয়ে। গোটা ব্যাপারটা পর্যালোচনা করলে ‘ল’ এর ওপর অধিকার বলুন বা ‘ল’-কে এককভাবে আয়ত্বাধীন করার বাসনায় বা মানসিকতায় অপর দুইয়ের মধ্যে পারস্পরিক লড়াইয়ে ঐ কোণটিও (ঘ) একটা বিশেষ মাত্রা পাচ্ছে। ফলে একে ত্রিকোণ প্রেম বললে অত্যুক্তি হয় না।
কীভাবে সাম্প্রতিক দুনিয়া আমাদের দুনিয়া হিসেবে উঠে এল, তা কমবেশি সবারই জানা। যেদিন এই পৃথিবীতে একরাট, একেশ্বর, সম্রাট, রাজা, রাজত্ব ইত্যাদির কায়েম হলো, সেদিন থেকেই গোলাকৃতির পৃথিবীতে মানচিত্রের আবির্ভাব ঘটল। কালে কালে আজকের নানা রঙের নানা আকৃতির সীমারেখা দিয়ে ঘেরা একেকটি দেশ। যেদিন থেকে সম্রাট-রাজাদের রাজত্ব বিবৃদ্ধির বাসনা জাগল, অধীশ্বর হওয়ার কামনা জাগল, সেদিন থেকেই লড়াই-যুদ্ধ-হত্যা-হার-জিত, অঞ্চলভিত্তিক শাসনক্ষমতা বাহুবলে বা জোর করে করায়ত্ত করা ও লাভ তোলা শুরু হলো। একে জবরদখল বলা ভালো। এর আগে অবধি আরেকটা ফেজ ছিল; বাণিজ্য করার মানুষেরা বা সাগর পাড়ি দিয়ে নয়া নয়া জায়গা আবিষ্কারের নেশায় মজা ভূ-পর্যটকেরা একেকটি দ্বীপ-অঞ্চল-জায়গা আবিষ্কার করেছেন। তাতে দু-রকমের অবস্থান দেখা যায়। কোথাও জন-প্রাণী না-থাকায় বিনা বাধায় দখল সম্ভব হয়েছিল। আবার কোথাও যোগাযোগ শূন্য স্থানিক মানুষেরা সেই আবিষ্কার কাম আগ্রাসনে বাধা হয়ে দাঁড়ালে সমূলে তা উৎপাটনে নিযুক্ত হয়েছিল। সেটা ছিল জবরদখল। আজকের পৃথিবী আর সেই অবস্থানে নেই। মোটামুটিভাবে বাসযোগ্য অঞ্চল চিহ্নিত ও নানা দেশে বন্টিত; আজ এমনকী সমুদ্র কোন দেশ কতটুকু পরিমাণ নিজস্ব তাঁবে রাখবে তাও নির্দিষ্ট; নোম্যানস্ল্যান্ড বলেও কিছু অঞ্চল স্বীকৃত। তাই আজকের যে কোনো জমির দখল নেওয়া জবরদখলের সামিল।
ভূমি দিয়েই শুরু করলাম। ভূমি দেয় ক্ষমতা-অর্থ-মুনাফা। সেই ক্ষমতা-অর্থ-মুনাফা দেয় মানসিক শোষণের পাসপোর্ট ও ভিসা। তা দিয়েই বিঘ্নিত করা হয় আঞ্চলিক স্থিতি; পর্যুদস্ত করা হয় আঞ্চলিক সংস্কৃতি-শিল্প-সাহিত্য-ভাষা ইত্যাদিকে; আমদানি করা হয় শাসকের মর্জিমত সংস্কৃতি ও শিল্পের বাতাবরণ। কেননা পরাজিতের কোনো নিজস্বতা থাকতে পারে না। এটাই দস্তুর। ভূমির লড়াইয়ে একসময় দেখা গেছে ভূমিতে সম্মুখ সমর। কালে-কালে তা অন্ত্যরীক্ষে ও জলে ব্যাপ্ত হয়ে আজও বিদ্যমান। আজ সমরের পুরোনো রীতি-রেওয়াজ সবই বদলে গেছে। আজ পৃথিবীতে এত সমরাস্ত্রের আয়োজন যে, দশবার পৃথিবীকে ধ্বংস করে দেওয়া যায়। এসবই আমাদের জানা। এর সঙ্গে জুড়েছে অর্থের সমূহ খেলা। বলা হয় অর্থ অনর্থের মূল।
আজকের দুনিয়ায় যুদ্ধ কোনো ক্ষণকালীন বিষয় নয়; যুদ্ধ অবিরত, যুদ্ধ নিরন্তর, যুদ্ধ আসময়ের। একবিংশ শতাব্দীটাই ধরা যাক না; কত যুদ্ধ ও গৃহযুদ্ধের সম্মুখীন হলাম আমরা। তারপর রয়েছে ছায়াযুদ্ধ, ঠাণ্ডাযুদ্ধ। আরেকটা বিষয়ও প্রণিধানযোগ্য; যুদ্ধের চেয়ে যুদ্ধের আতঙ্ক কম কিছু নয়। যুদ্ধের তরিকা বেড়েছে; শুধুই সৈন্যদল আর অস্ত্রশস্ত্রে তা আর সম্পন্ন হয় না। যুদ্ধ তেল নিয়ে, বাজার নিয়ে, বিশ্বভর কতৃত্ব নিয়ে এবং স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য। ছোট্ট করে একটা তালিকা প্রস্তুত করা যেতে পারে (সবগুলো তালিকায় নেই)।
যুদ্ধ/গৃহযুদ্ধ/সংঘর্ষ মৃত্যুমাসুল বৎসর যুদ্ধকারী দল দেশ/অঞ্চল
১ ২য় কঙ্গো যুদ্ধ ২৫ লক্ষ- ৫৪ লক্ষ ১৯৯৮-২০০৩ গৃহযুদ্ধ, রাজ ও গণতান্ত্রিক শক্তি মধ্য আফ্রিকা
২ ইতুরি সংঘর্ষ ৬০ হাজার+ ১৯৯৯-২০০৩ লেন্ডু ও হেমু ট্রাইব কঙ্গো
৩ সন্ত্রাসমূলক ২লক্ষ ৭২হাজার-১২লক্ষ ৬০হাজার ২০০১-বর্তমান, সন্ত্রাসবাদী ও তার বিরোধী বিশ্বব্যাপী
৪ আফগানিস্তান যুদ্ধ ৪৭হাজার-৬২হাজার ২০০১-বর্তমান, তালিবানি ও উইএসএসহ অন্যরা, আফগানিস্তান
৫ ইরাক যুদ্ধ ৪লক্ষ ৫হাজার-৬লক্ষ ৫৫হাজার ২০০৩-২০১১ ইরাক ও ইউএসএসহ অন্য দেশ ইরাক
৬ দারফুর যুদ্ধ ৩ লক্ষ+ ২০০৩-বর্তমান এস-আর-এফ ও সুদান ও UNAMID সুদান
৭ কিভু সংঘর্ষ ১ লক্ষ+ ২০০৪- বর্তমান গৃহযুদ্ধ বিভিন্ন গোষ্ঠী ও সরকার কঙ্গো
৮ উত্তর-পশ্চিম পাকিস্তানে যুদ্ধ ৪৬-৭৯হাজার পাকিস্তান-উইএসএ-ইউকে বনাম সন্ত্রাসবাদী পাকিস্তান
৯ মেক্সিকান ড্রাগ ওয়ার দেড় লক্ষ- আড়াই লক্ষ মেক্সিকো বনাম ড্রাগ কার্টেল মেক্সিকো
১০ সিরিয়ান সিভিল ওয়ার ৩লক্ষ ৮৭হাজার- ৫লক্ষ ৯৩হাজার বিভিন্ন গোষ্ঠী সিরিয়া
১১ ইরাকী সিভিল ওয়ার ২ লক্ষ+ ইরাক ও মিলিত শক্তি বনাম আইএসআইএল ইরাক
১২ ইয়েমেনি সিভিল ওয়ার ২লক্ষ ৩৩ হাজার সরকার ও বিভিন্ন গোষ্ঠী ইয়েমেন
যুদ্ধ কোনো স্থায়ী মঙ্গল দেয় না, জেনেও যুদ্ধ-গৃহযুদ্ধ-সংঘর্ষ-সন্ত্রাসবাদী হামলা, এই-ই আজকের পৃথিবী। এই যুদ্ধের ক্যাজুয়ালিটি লিস্ট আপনারা দেখলেন। এত মৃত্যু-হত্যা-রক্ত কেন? উত্তর নেই কারো কাছেই। দেশের কর্ণধাররা জানলেও বলেন না, বলেন বিশ্বশান্তির জন্য যুদ্ধ বা একটা বিশেষ দেশকে সুরক্ষিত রাখতে যুদ্ধ। রাজনীতির লোকেরাই দেশ শাসন করেন, তাই শাসকের কথাই তাদের কথা। আর শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের তরফে ব্যাখ্যা থাকে আবেদন থাকে; কিন্তু তাতে কেউ কর্ণপাত করে না। যুদ্ধ করাই নিয়তি হয়ে দাঁড়ায়।
ত্রিভুজ নিয়ে যে ত্রিকোণ প্রেমের কথা বলা হয়েছিল; তাতেও বিশ্বজোড়া যুদ্ধ একদা আমরা দেখেছি। নারী হয়তো থাকতেন কেন্দ্রে। তাকে জবরদখল নিয়ে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের রাজ-রাজড়ার যুদ্ধ, যাতে প্রাণ যেত উলুখাগড়ার। সেই দিনের বদল ঘটেছে আজ; মানচিত্রের লড়াই আর নারীকে কেন্দ্রে রেখে হয় না বলেই জানি। হতে পারে এখন সেটা ব্যক্তিক লড়াই ও সামাজিক-সাম্প্রদায়িক লড়াইয়ে পরিণত হয়; আকছাড় হয়; জাতপাতের ভিত্তিতেও হয়। তাতেও কম রক্ত ঝরে না। কম উত্তেজনা ও আশংকার জন্ম হয় না। সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অস্থিরতা সৃষ্টিতে এই ধরনের ত্রিকোণ প্রেমের একটা ভয়াবহ ভূমিকা আছে।
আজকের পৃথিবীতে ত্রিকোণ প্রেমের ভাগীদার মানচিত্রের বিভিন্ন রঙের রাষ্ট্রের বা দেশের। সে যেমন কাছ থেকে গা-ঘেষাঘেষি করে সম্ভব হচ্ছে; তেমনি দূরে বসেও অর্থ আর অস্ত্রের জোগান দিয়েও প্রেমবিলাসিতা সম্পন্ন করা যাচ্ছে। এখানে কৌণিক প্রেমের মূল বিশেষত্ব হচ্ছে জমি তথা তেল, খনিজ, প্রাকৃতিক সম্ভার জবরদখল করা। এখানে নানাতর নীতি-আদর্শর বদলে একটাই নীতি প্রযুক্ত। ‘তোমার শত্রু আমার শত্রু এক; সুতরাং আমরা প্রেমিক-প্রেমিকা যুগল’। সুতরাং মিলিত শক্তিতে ঝাপাও শত্রুর অপেক্ষাকৃত কম শক্তির বিরুদ্ধে, পর্যুদস্ত করো; আর ভাগ বসাও। এর একটা ভালো উদাহরণ হচ্ছে, এই জবরদখলের নেশায় কোনো কোনো রাষ্ট্রের সুহৃদ প্রেমিক বনে বিংশ ও একবিংশ শতাব্দীতে একটি দেশ বা রাষ্ট্র মোট ৯৩ টি যুদ্ধে নিজেকে জড়িয়েছে; বর্তমানেও চালিয়ে যাচ্ছে মানচিত্রের তিনটি জায়গায়। বলা বাহুল্য দেশটির নামঃ ইউএসএ। অনেক ক্ষেত্রে নাক-ক্ষত দিতে হলেও রোগটি তার প্রোলং এবং ক্রনিক। একটা সময়ে সোভিয়েত রাশিয়ার মতো সমাজতান্ত্রিক দেশও স্ববিরোধী ‘যুদ্ধং দেহী’ নীতি নিয়ে মানচিত্রের বিভিন্ন জায়গায় হানা দিয়েছিল এবং যুদ্ধে জড়িয়েছিল। এইরকম অবস্থানে আজ আর ত্রিভুজটি একই অবস্থানে থাকতে পারেনি। তার সব কোণই আলগা হয়ে পড়েছে। যে যার নিজের সুবিধামতো গাঁটছড়া বাঁধছে ভাঙছে আবার অন্য কারোর প্রেমে মজে যাচ্ছে। ত্রিভুজটি হয়ে গেছে এইরকম—
সুতরাং, জমি-জিরেত ও ত্রিকোণ প্রেমের ওপর ভর করেই আজকের পৃথিবীর যুদ্ধ-রক্তক্ষয়-সম্পদের ক্ষতি। দেখা যায়, এবং এটা স্বাভাবিকও সবলই (অর্থে, অস্ত্রশস্ত্রে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে) অপেক্ষাকৃত দুর্বলের ওপরে জবরদখলের প্ল্যান বানায় আর প্রয়োগ ঘটায়। এই জবরদখলের সঙ্গেই জড়িয়ে পড়ে সাধারণ মানুষের নানা মানসিক স্তরের এবং সৃষ্টিমূলক কাজের দখলদারি। সমাজে তারই প্রতিফলন ঘটে সব রকমের আগ্রাসনের মাধ্যমে। সংস্কৃতিতে, শিল্প-সাহিত্যে, ভাষায়, লিঙ্গভেদে। ভাষার ক্ষেত্রে একটা উদাহরণ দিয়েই লেখায় ইতি টানব। এখানেও ত্রিকোণ প্রেমের এক সম্পর্ক আছে। এটা অন্তর্ভারতের। আমাদের ভারতে বিভিন্ন ভাষাভাষীর ওপর হিন্দি ভাষার আগ্রাসন। শাসকের প্রেম একটা বলয়ের ভাষার ওপর; তারা সেটাকেই ফেডারল ভারতে নানা কৌশলে এবং কিছুটা জোরের সঙ্গেই বলবৎ করতে চাইছে। সংখ্যাধিক্য মানুষ সেই ভাষা ব্যবহার করে বলে তার জোর যেন বেশি; সেই সবলতার নিরিখে এই আগ্রাসন বিভিন্ন দুর্বল(!) (অপেক্ষাকৃত কম সংখ্যক মানুষ ব্যবহার করে এই অর্থে দুর্বল) ভাষার ওপর। প্রতিবাদ-প্রতিরোধও চলে। সেখানে এই দুর্বল (!) ভাষার মানুষেরা ‘দল’ তৈরি করে। আর ‘ভুবনগ্রাম’ তত্ত্বের কথাও আমরা শুনে আসছি সাম্প্রতিক বিশ্বে; যা এক সবলেরই তত্ত্ব ও ভাষ্য; যাতে করে বদলে যাচ্ছে আমাদের খাদ্যাভ্যাস, পরিচ্ছদ, মুখের ভাষা, সর্বোপরী সংস্কৃতি। কবে কোথায় আমরা বাঙালীরা সর্বজনীন গনেশ পূজা দেখেছি বলুন তো! শীতলা মায়ের পূজা বন্ধ হয়ে যে শূন্যস্থান, তা ভরছে গনেশ পুজোয়; স্রেফ আমাদের সায়ে। নিজেকে ভুললে পরের আশ্রয় বড়ো ভূমিকা গ্রহণ করে। হাজার হাজার লিটার দুধ মাথায় ধরে গনেশ হাসেন; শীতলা মায়ের হাতের ঝাঁটা আর লড়াইয়ে নামে না।