================================================================
================================================================
এক
গত ১৫ই অগাস্ট ২০২৩ দেশের ৭৭ তম স্বাধীনতা দিবসে প্রথানুয়ায়ী ভারতের প্রধানমন্ত্রী দিল্লির লালকেল্লা থেকে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলেন৷ নরেন্দ্র মোদির ভাষণে নিয়মমাফিক নানা প্রসঙ্গের পাশাপাশি উঠে এল ‘হাজার বছরের দাসত্ব’-এর কথাও। মোদিজী তাঁর ভাষণের এক জায়গায় বললেন যে কখনও কখনও এমন কোনও ঘটনা ঘটে যার প্রভাব হয় সুদূরপ্রসারী। সেই ঘটনা এতটাই আলোড়ন তোলে যে শতাব্দীর পর শতাব্দী পেরিয়ে গেলেও তার ফলাফল অনুভূত হয়। ঠিক যেমনভাবে আজ থেকে হাজার-বারোশো বছর আগে ভারতের এক ছোট রাজ্যের রাজা বহিরাগত আক্রমণকারীর কাছে হেরে গিয়েছিলেন। মোদিজি বললেন, সেই রাজার পরাজয়ের তীব্রতা এতখানি সর্বগ্রাসী ও সর্বব্যাপী ছিল যে তা আমাদের দেশে দীর্ঘ দাসত্বের সূচনা করে। বিদেশি হানাদারদের পদতলে আমাদের এই দাসত্ব পরবর্তীকালে প্রায় হাজার বছর স্থায়ী হয়েছিল।
দেশবাসী শুনল এই ভাষণ। ‘হাজার বছরের দাসত্ব’ আমাদের দেশের বর্তমান শাসকগোষ্ঠীর খুব প্রিয় একটা শব্দবন্ধ। প্রধানমন্ত্রী কোনও নির্দিষ্ট রাজ্য বা রাজার নামোল্লেখ না করলেও আমরা অভিজ্ঞতা থেকে জানি এবং নির্ভুল জানি যে তিনি এক্ষেত্রে সম্রাট পৃথ্বীরাজ চৌহানের কথা উল্লেখ করলেন। ১১৯২ সালে তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে বীরোচিত লড়াই করেও পৃথ্বীরাজ চৌহান ওরফে তৃতীয় পৃথ্বীরাজ ওরফে রায় পিথোরা হানাদার মহম্মদ ঘোরির কাছে পরাজিত হন৷ হিন্দুত্ববাদীরা এই ঘটনাকে ভারতবর্ষে হিন্দু যুগের অবসান ও মুসলিম রাজত্বের সূচনাবিন্দু হিসেবে তুলে ধরেন। অর্থাৎ হিন্দুত্ববাদীদের মতে, শুধুমাত্র ব্রিটিশ শাসনের ১৯০ বছর ভারতবাসীর পরাধীনতার কালসীমা নয়, তার অনেক আগে থেকেই আমরা অর্থাৎ হিন্দুরা পরাধীন, মুসলমানের হাতে পরাধীন। যে মুহূর্তে মহম্মদ ঘোরির কাছে ‘শেষ হিন্দু নৃপতি’ পৃথ্বীরাজ চৌহানের পরাজয় হল, ঠিক সেই মুহূর্ত থেকেই মুসলিমদের হাতে হিন্দু ভারতের দাসত্বের অন্ধকার যুগ শুরু হল।
শুধু আজ নয়, প্রায় একশো বছর আগে নাগপুরে আরএসএস-এর জন্মক্ষণ থেকে সুকৌশলে এই ন্যারেটিভের বয়ন ও বপন শুরু হয়েছে৷ পৃথ্বীরাজ চৌহানের সভাকবি চাঁদ বরদাই তাঁর কাব্য ‘পৃথ্বীরাজ রাসো’-তে খুব স্বাভাবিকভাবে তাঁর সম্রাটকে উজ্জ্বলতর করে দেখাবেন, এটাই অভিপ্রেত। কাব্য সাহিত্যের সম্পদ, ইতিহাসের উপাদান নয়- একথা মনে রাখলেই কোনও সমস্যা থাকে না। কিন্তু পরবর্তীকালে আমরা বারবার দেখেছি, পৃথ্বীরাজকে ইতিহাস থেকে বিযুক্ত করে কেবল অতিকথার নায়ক হিসেবে জনপরিসরে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা হচ্ছে, যার মধ্যে হিন্দুত্ববাদী ঝোঁক প্রকট। এই ধরনের প্রকল্পের সাহায্যকারী হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে সাতের দশকেই ছোটদের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় চিত্রকাহিনি সিরিজ ‘অমর চিত্রকথা’। আবার সম্প্রতি চাণক্য-খ্যাত ড. চন্দ্রপ্রকাশ দ্বিবেদীর পরিচালনায় মুক্তি পেয়েছে হিন্দি কাহিনিচিত্র ‘সম্রাট পৃথ্বীরাজ’। ছবিটি সাধারণভাবে বস্তুনিষ্ঠতা বজায় রাখলেও একবারের জন্যেও উল্লেখ করল না যে শুধুমাত্র ‘মুসলিম’ মহম্মদ ঘোরি নয়, পৃথ্বীরাজ চৌহানকে নিজের রাজত্বকালে নিরন্তর লড়াই করে যেতে হয়েছিল অপর দুই ‘হিন্দু’ শাসক- গুজরাতের চালুক্য এবং বুন্দেলখন্ডের চান্দেলা রাজবংশের সঙ্গে। অর্থাৎ নিজের রাজ্যের সীমান্ত রক্ষা ও সাম্রাজ্যবিস্তার সেই কালের নরপতিদের সাধারণ যুগধর্ম ছিল, আলাদা করে তাঁদের ধর্মপরিচয় চিহ্নিত করে সেই অনুযায়ী রাজনৈতিক শিবিরভাগ অনেক পরের, আমাদের এই আধুনিক যুগের প্রক্ষেপণ। প্রসঙ্গত, ‘সম্রাট পৃথ্বীরাজ’ চলচ্চিত্রে নামভূমিকায় অভিনয় করেছেন হিন্দি ছবির জনপ্রিয় নায়ক অক্ষয়কুমার। ইনিই সেই ব্যক্তি যিনি দেশে এনআরসি-সিএএ বিরোধী আন্দোলনের উথাল-পাথাল সময়ে প্রধানমন্ত্রী মোদির একটি ‘অরাজনৈতিক’ সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন, প্রধানমন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করছিলেন তিনি আম খেতে ভালোবাসেন কিনা, এবং যদি ভালোবেসে থাকেন তবে আমটি কীভাবে খেতে পছন্দ করেন, টুকরো করে কেটে নাকি আঁটিসমেত। এহেন নায়ক একের পর এক হিন্দি ছবিতে হিন্দুত্বের পোস্টারবয় হয়ে উঠবেন না তো আর কে হবেন! এ এক অদ্ভুত কিন্তু কার্যকরী বাস্তুতন্ত্র!
বলা দরকার, শুধুমাত্র শাসকের ধর্মপরিচয়কে কেন্দ্র করে ইতিহাসের কোনও নির্দিষ্ট সময়কালকে ‘হিন্দু যুগ’ বা ‘মুসলিম যুগ’ আখ্যা দেওয়া এক ধরনের খণ্ডিত চর্চার নিদর্শন এবং আধুনিককালের বিচারে একদেশদর্শী। শুধুমাত্র রাজারাজড়ার যুদ্ধবিগ্রহ ও সাল-তারিখে লাঞ্ছিত যে একমাত্রিক ইতিহাস আমরা ছোটবেলায় পড়ে এসেছি, তার বাইরেও আলোচনার বিস্তৃত ক্ষেত্র রয়ে গেছে, রাজা-রাণীর জীবনকাহিনি থেকে নজর সরিয়ে (মনে আছে, প্রায় আড়াই দশক আগে মাধ্যমিকের আগে টেস্ট পরীক্ষায় এক নম্বরের প্রশ্ন এসেছিল- হর্ষবর্ধনের বোনের নাম কী ছিল?) চর্চার কেন্দ্রে উঠে এসেছে সেই সময়কার সাধারণ মানুষ, তাদের সামাজিক-রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক যাপন, বিচার করে দেখা হচ্ছে যে সেই যুগের অর্থনৈতিক উপাদানগুলি ব্যক্তি ও সমষ্টির যাপনে কীভাবে ক্রিয়াশীল ছিল। ইতিহাসের এই নতুন পাঠের রাস্তা ছেড়ে আমরা যদি শুধুমাত্র যুদ্ধবিগ্রহের নিক্তিতেই সেই সময়কালকে বিচার করি, দেখব- হ্যাঁ, অবশ্যই তা ছিল ভারতীয় উপমহাদেশে বহিঃশক্তির আক্রমণের কাল। চিরকালই প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর উর্বর সুজলা সুফলা আমাদের দেশ লুঠেরা শক্তি ঈর্ষা ও লোভের কারণ হয়েছে। কিন্তু ভারতীয় উপমহাদেশ শুধু নয়, সেই সময় অর্থাৎ মধ্যযুগ গোটা মধ্য এশিয়া এমনকি ইউরোপ জুড়েও সাম্রাজ্যবিস্তার ও ছোট বড় নানা রাজ্যের পতন ও পুর্নগঠনের কাল। কিন্তু তৎকালীন রাজস্থানের আজমেরে পৃথ্বীরাজ চৌহানের ছোট্ট রাজ্যটির পতনে গোটা ভারতবর্ষে হিন্দু শাসকের আধিপত্যের অবসান তো হয়ইনি, এমনকি চৌহান রাজবংশেরও সমাপ্তি ঘটেনি। পৃথ্বীরাজের পতনের পর তাঁর পুত্র গোবিন্দরাজা অল্প দিনের মধ্যেই ঘোরি সাম্রাজ্যের কবল থেকে বেরিয়ে এসে রণথম্বোরে তাঁর পিতার চেয়েও শক্তিশালী চৌহান রাজবংশের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন, সে কথা হিন্দুত্ববাদীরা কোনওদিন ভুলেও উচ্চারণ করেন না। এই পুনঃপ্রতিষ্ঠিত চৌহান রাজবংশ ১১৯২ থেকে ১৩০১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত নিজেদের আধিপত্য বজায় রেখেছিল। পরবর্তীকালে দিল্লিসহ উত্তরভারতে মুসলিম শাসকদের আধিপত্য বাড়লেও ভারত ভূখণ্ডে হিন্দু রাজার দ্বারা শাসিত রাজ্যের সংখ্যা কম ছিল না, যাদের পরস্পরের মধ্যে অবশ্য ঝগড়াবিবাদ লেগেই থাকত। এই স্বাধীন রাজ্যগুলির রাজারা জানতেনই না যে ভারতীয়ত্ব বা হিন্দুত্ব কী বস্তু বা আদৌ এইরকম কোনও মতাদর্শ থাকতে পারে। তারা শুধুমাত্র নিজের রাজ্যের আধিপত্য ও স্বার্থচিন্তা নিয়ে ভাবিত ছিলেন। বস্তুত, আরএসএস শিবির আফগানিস্তান থেকে মায়ানমার অবধি যে প্রাচীন হিন্দু ভারতের অখণ্ড রাজনৈতিক মানচিত্রের ছবি প্রচার করে, আদপে সেরকম ঐক্যবদ্ধ ও অখণ্ড ভারতবর্ষের কোনওদিনই কোনও অস্তিত্ব ছিল না। মুসলিম আক্রমণের আগে থেকেই এই উপমহাদেশ অসংখ্য ছোট বড় স্বাধীন রাজ্যে বিভক্ত ছিল, যারা সামন্ততন্ত্রের চিরাচরিত নিয়ম মেনেই একে অপরের সঙ্গে রক্তক্ষয়ী বিবাদে লিপ্ত ছিল। বস্তুত, স্বীকার করে নেওয়া দরকার যে ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ উপনিবেশ কায়েম না হলে এবং স্বাধীনতার পরে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল ও তাঁর সচিব ভি পি মেননের মতো বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব না এলে ভারতবর্ষের বর্তমান ও বৃহত্তর রাজনৈতিক মানচিত্র তৈরি হওয়া সম্ভব ছিল না। ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে লর্ড মাউনব্যাটেন ৫৬৭ টি দেশীয় করদ রাজ্যের (যাদের শাসকরা অধিকাংশই হিন্দু রাজা) শাসকদের সামনে ভারত বা পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার অথবা স্বাধীন সত্তা বজায় রাখার তিনটি বিকল্পের মধ্যে যেকোনও একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে বলেন। কিন্তু সর্দার প্যাটেল এরপর এই রাজ্যগুলিকে এক এক করে ভারত যুক্তরাষ্ট্রে যুক্ত করেন (এই সংযুক্তিকরণ, বলাই বাহুল্য, সবসময় সোজা পথে ঘটেনি), তা নিঃসন্দেহে এক অনন্য কীর্তি এবং আলাদা প্রসঙ্গ, কিন্তু এই সংযুক্তিকরণ না ঘটলে রাজনৈতিকভাবে অখণ্ড ভারত একটি কাল্পনিক প্রকল্প ও হিন্দুত্ববাদী প্রোপাগান্ডা হয়েই রয়ে যেত।
ঠিক এমনই আরেকটি ‘কাল্পনিক প্রকল্প’- প্রধানমন্ত্রী বর্ণিত ‘হাজার বছরের দাসত্ব’। এই দাসত্বের ইতিহাস সত্যি হলে, শেষের ১৯০ বছর ব্রিটিশ শাসনের আগের আটশো বছর ধরে মুসলিম দাসত্বের ও ‘অত্যাচার’-এর পর, ‘৪৭ সালে স্বাধীনতার সময় এতগুলি হিন্দু রাজ্যের অস্তিত্ব বজায় রাখা সম্ভব হত না। এমন জটিল, বহুস্তর ইতিহাস হাতের কাছে থাকা সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী স্বাধীনতার দিবসের অরাজনৈতিক ভাষণেও অক্লেশে মিথ্যা বলেন, অর্ধসত্য আওড়ান। একবার নয়, বারবার। প্রধানমন্ত্রীকে এই সুযোগে একটি অপ্রিয় প্রশ্ন করা যেতে পারে। পৃথ্বীরাজ চৌহানের পতনের আগে তিন হাজারের বেশি সময়কাল জুড়ে ৮০ শতাংশ হিন্দু যে সংখ্যালঘু উচ্চবর্ণের পায়ে বর্ণভেদ নামক দাসত্বের শেকলে বদ্ধ, তার কথা কে বলবে? অথবা ২০১৪ পর থেকে প্রধানমন্ত্রী যে গোটা দেশের সাধারণ মানুষকে আদানি-আম্বানির মতো গোটাকতক শিল্পগোষ্ঠীর সামনে বলি দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন, তার হিসেবই বা কে দেবে? না, এগুলি আন্দোলনজীবীদের অশ্লীল কথাবার্তা, এগুলি তাঁর মর্মে পৌঁছবে না। কারণ তিনি শুধুমাত্র আরএসএস-বিজেপি-র প্রধানমন্ত্রী, আজও গোটা দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে উঠতে পারেননি, ভবিষ্যতে হয়ে উঠতে পারার কোনও সম্ভাবনাও নেই। অতএব তাঁকে প্রতিটি মঞ্চে, তা রাজনৈতিক হোক অথবা স্বাধীনতা দিবসে লালকেল্লার ভাষণের মতো অরাজনৈতিক, আরএসএস-এর লাইনে পা ছুঁইয়ে যেতে হয়। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য তাঁর দলের দাওয়াই একটাই- ঢালাও অপরায়ণ এবং তা থেকে উৎসারিত জাতিবিদ্বেষ, বিশেষত মুসলিম বিদ্বেষ। মধ্যযুগের মুসলিম শাসকদের যদি লুঠেরা ব্রিটিশদের সঙ্গে একই বন্ধনীর মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে মুসলিমদের গায়ে বহিরাগতের ও অত্যাচারীর ছাপ ফেলে দিতে সুবিধে হয়। সুবিধে হয়, ভারতবর্ষ হিন্দুদের এবং একমাত্র হিন্দুদের, এই দাবি আরও জোরালো করে তোলা যায়।
দুই
১৯২২এ মহারাষ্ট্রের রত্নাগিরিতে বন্দি অবস্থায় থাকাকালীন দামোদর বিনায়ক সাভারকর হিন্দুত্বের যে ডিসকোর্স রচনা করেছিলেন, হিন্দু মহাসভা থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘ, ধর্মীয় সংখ্যাগুরুর আধিপত্যবাদী রাজনীতির সবকটি শাখা সংগঠন তাকেই বেদবাক্য হিসেবে মেনে চলে। এই সংকীর্ণ মতাদর্শকে মাথায় রেখেই গঠিত হয়েছে বিজেপি সরকারের সাম্প্রদায়িক এনআরসি ও সিএএ-র নীতিসমূহ। ‘হিন্দুত্ব: হু ইজ আ হিন্দু’ শীর্ষক গ্রন্থে সাভারকর হিন্দু হওয়ার একটি মোক্ষম সংজ্ঞা নির্ধারণ করেছেন। তা হল, যে জাতির পিতৃভূমি ও পুণ্যভূমি এই ভারতবর্ষ, একমাত্র তারাই হিন্দু এবং এই প্রাচীন ভূমিতে বসবাসের অগ্রাধিকার একমাত্র তাদেরই। একইসঙ্গে পিতৃভূমি অর্থাৎ জন্মস্থান এবং পুণ্যভূমি ভারতবর্ষ, এই যুক্তিতে হিন্দু তো বটেই এমনকি বৌদ্ধ, জৈন, শিখ, ব্রাহ্ম, আর্যসমাজী, দলিত সকলকেই বৃহত্তর হিন্দু সমাজের অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়া যায়, ভারতীয়ত্ব প্রদান করা যায়। বাদ পড়ে শুধু মুসলিম ও খ্রিস্টানরা৷ কারণ প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তাদের জন্ম এই দেশে হলেও, মুসলিম ও খ্রিস্টানদের পুণ্যভূমি যথাক্রমে আরব দেশের মক্কা-মদিনা এবং প্যালেস্টাইনের বেথলেহেম। খ্রিস্টানরা দেশের মোট জনসংখ্যার এক শতাংশ মাত্র, তাই তাদের নিয়ে বেশি মাথাব্যথার কারণ নেই। দরকার হলে গ্রাহাম স্টেইনসের মতো এক-দুজনকে জীবন্ত পুড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে। মূল সমস্যা মুসলমানকে নিয়ে। অথচ ইতিহাস বলছে, বাবর থেকে দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ জাফর, ১৫২৬ থেকে ১৮৫৭ অবধি দীর্ঘ শাসনকালে একজন মুঘল সম্রাটও মক্কায় হজ করতে যাওয়ার কথা ভাবেননি, বরং এ দেশেই নির্মাণ করে দিয়েছেন একের পর এক ইসলামি সাধনক্ষেত্র ও সুফিসাধকের দরগা ও মাজার। অথচ হিন্দুত্ববাদের বিচারে এ দেশ তাঁদের পুণ্যভুমি নয়, তাঁরা এদেশের কেউ নন, প্রত্যেকেই বহিরাগত, হানাদার ও শত্রু। সাভারকরের এই দানবিক সংজ্ঞায়ণ মুসলিম ও খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের ভারতীয়ত্ব থেকে বিযুক্ত করে দিয়েছে আজ থেকে ঠিক একশো বছর আগে। তারা এদেশে থাকতেই পারেন, কিন্তু সেক্ষেত্রে তারা হবেন দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক, সংবিধান প্রদত্ত নাগরিকের সমতা ও অধিকার তাদের জন্য প্রযোজ্য হবে না। সোজা কথা, মুসলিমদের থাকতে হবে হিন্দুদের পায়ের তলায়, কোনওরকম ট্যাঁ-ফোঁ না করে। আর আজ সাভারকরের এই ঘৃণার ইস্তেহার পাশে রেখেই এই রচিত হচ্ছে আমাদের দেশের আইন, নীতি, প্রকল্পসহ প্রতিটি রাষ্ট্রীয় ডিসকোর্স। এনআরসির বুলডোজার চালিয়ে ধর্মভিত্তিক অনুপ্রবেশকারী খোঁজা হচ্ছে। তারপর সিএএ কার্যকর করে মুসলিম বাদে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের নাগরিকত্ব দেওয়া হচ্ছে। জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা এই আইনের প্রতিবাদ করলে রাতে মুখোশধারী গুন্ডা ঢুকছে ক্যাম্পাসে। এমনকি সুপ্রিম কোর্টের ওপর প্রভাব খাটিয়ে সংখ্যাগুরুর ধর্মবিশ্বাসের দোহাই দিয়ে বাবরি মসজিদের জায়গায় তৈরি হচ্ছে রামমন্দির। তারপর স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী গেরুয়া ধারণ করে পূজাপাঠে অংশ নিয়ে রামমন্দিরের শিলান্যাস করছেন৷ একইভাবে নতুন সংসদ ভবনের উদ্বোধন অনুষ্ঠানও সংখ্যাগুরুর ধর্মীয় আচার পালনের কদর্য প্রদর্শন হয়ে দাঁড়াচ্ছে, সংসদের মধ্যেই ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে সর্বধর্ম থেকে সমদূরত্ব যাপনের সাংবিধানিক আদর্শ৷ ইতিহাস ও পাঠ্যসূচির গেরুয়াকরণ চলছে পুরোদমে৷ প্রাচীন মসজিদে লেলিয়ে দেওয়া হচ্ছে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগকে, তারা ইতিহাস খুঁড়ে খুঁড়ে বার করছেন তলায় কোনও হিন্দু মন্দিরের অবশেষ রয়ে গেছে কিনা। বিলকিস বানোর গণধর্ষণকারীদের আইনি সংস্থানের তোয়াক্কা না করে আগাম মুক্তি দেওয়া হচ্ছে। সাধুসন্ন্যাসীদের ধর্মসংসদ থেকে সরাসরি মুসলিম হত্যার ডাক দেওয়া হচ্ছে। বাড়ি ঢুকে ফ্রিজ খুলে গোরুর মাংস খুঁজে বার করে অথবা খুঁজে না পেলেও পিটিয়ে মারা হচ্ছে মুসলিম গৃহকর্তাকে। শার্জিল ইমাম উমর খলিদ বিনা বিচারে জেলে পচছেন। তার একটা বড় কারণ তাঁদের নাম শার্জিল ইমাম এবং উমর খলিদ। গো-রক্ষা জনিত হিংসায় মুসলিম নিগ্রহের ঘটনা বিজেপি জমানায় বেড়ে গেছে বহুগুণ। দশটি রাজ্যে, প্রতিটিই বিজেপি শাসিত, ধর্মান্তর বিরোধী আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। যদিও দেশের বিভিন্ন হাইকোর্ট অধিকাংশ লাভ জেহাদের অভিযোগকে ভিত্তিহীন ঘোষণা করে রায় দিয়েছেন, গোবলয়ে মুসলিম যুবকদের হেনস্থা জারি আছে। এই লেখাটি লিখিত হওয়ার সময়েই খবর এল, উত্তরপ্রদেশের সীতাপুরে একটি হিন্দু মেয়ে একটি মুসলিম ছেলের সঙ্গে পালিয়ে বিয়ে করার ‘অপরাধে’ ছেলেটির বাবা-মা, বছর ৫০-এর মুসলিম দম্পতিকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। রাজস্থানে কর্মরত বাংলার মুসলিম শ্রমিককে লাভ জিহাদের মিথ্যা অভিযোগে গায়ে আগুন দিয়ে সেই নৃশংস ঘটনার লাইভ ভিডিও প্রচার হয় সমাজমাধ্যমে৷ মুসলিমদের বাড়ি বুলডোজার দিয়ে ভাঙতে আদালতের অনুমতির দরকার হচ্ছে না যোগীর উত্তরপ্রদেশে। এমনকি উত্তরপ্রদেশে রীতিমতো শুচিবায়ুগ্রস্তের মতো খুঁজে খুঁজে বদলে দেওয়া হচ্ছে যেকোনও শহর বা অঞ্চলের মুসলিম নাম৷ হরিয়ানায় অস্ত্র নিয়ে প্ররোচনাময় স্লোগান দিতে দিতে মিছিল করছে বজরং দল, পুলিশ তাদের নির্দ্বিধায় তা করার অনুমতি দিচ্ছে। গুজরাট মডেলে পরিকল্পিত গণহত্যা চলছে দক্ষিণ দিল্লিতে, মুজফফরনগরে, হরিয়ানা ও নয়ডার মুসলিম মহল্লায়৷ আরএসএস-এর প্রধানমন্ত্রী দাঙ্গাকারীর পরণের পোশাক দেখেই তাদের ধর্মপরিচয় খুঁজে নিচ্ছেন, নির্বাচনী সভা থেকে হুঙ্কার দিচ্ছেন ‘জয় বজরঙবলী’ বলে। যে আরপিএফ যুবক ট্রেনে মোদি-যোগির জয়ধ্বনি দিতে দিতে মুসলিম যাত্রীদের বেছে বেছে গুলি করছেন, তদন্তে দেখা যাচ্ছে হঠাৎ করে তাঁর কোনও মানসিক বিকৃতি হয়নি, ২০১৬ থেকেই মুসলিম নিগ্রহের অভিযোগ উঠছে তাঁর বিরুদ্ধে৷ এ দেশ মুসলিম শূন্য হলে পরবর্তী আক্রমণের শিকার হবে যারা, সেই দলিত যুবকের ওপর প্রকাশ্য রাজপথে প্রস্রাব করছেন হিন্দুত্ববাদী নেতা। অভিন্ন দেওয়ানি আইনের মতো জরুরি ও জটিল বিধি নিয়ে বিতর্ক ও আলোচনা না করেই তাকে একটি মুসলিম দমনের হাতিয়ার রূপে হাজির করা হচ্ছে৷ এ এক অনন্ত তালিকা। মুসলিম বিদ্বেষ, শুধুমাত্র মুসলিম বিদ্বেষে ভর করে দাঁড়িয়ে আছে বর্তমান ভারতের রাষ্ট্রভাবনা৷
অপরায়ণ ও ঘৃণা ছড়ানো- এই পাখির চোখ থেকে এক মুহূর্তের জন্য বিচ্যুত হয় না বর্তমান শাসকগোষ্ঠী। তারা হয়তো জানে(নাকি জানে না) গণতন্ত্রকে উন্নত করার অর্থ দেশের প্রান্তিক মানুষকে সমস্ত রকম সাধারণ সুযোগ সুবিধা পৌঁছে দেওয়া। রাজনীতির ঘোষিত লক্ষ্য হওয়া উচিত জাতিধর্মনির্বিশেষে দেশের সমস্ত সাধারণ নাগরিকের মৌলিক অধিকারগুলি সুনিশ্চিত করা। তা করতে গেলে যথাসম্ভব আর্থিক ও সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে হয়, শিক্ষা স্বাস্থ্য সামাজিক ন্যায় লিঙ্গসাম্য সমস্ত ধারণার নিরন্তর চর্চা ও উন্নয়ন ঘটাতে হয়। সে বড় কঠিন কাজ, দীর্ঘমেয়াদি ও শ্রমসাধ্য লড়াইয়ের পথ। তার চেয়ে দ্বিতীয় রাস্তাটা অনেক সহজ। অনেক সহজ মানুষকে জাতপাতধর্মেবর্ণে বিভাজিত করে দেওয়া। একটি বা দুটি জনগোষ্ঠীর অপরায়ণের মধ্যে দিয়ে শত্রুর কাল্পনিক ধারণা ও তাদের প্রতি ঘৃণার ভাবনা জনমনে ঢুকিয়ে দিতে পারলে অতি সহজে ভোটব্যাংকের মেরুকরণ ঘটে। আমাদের দেশের বিপুল সংখ্যক নিরক্ষর, ধর্মপ্রাণ, অসাম্যপীড়িত, সদা বিপন্ন, বিক্ষুব্ধ দেশবাসীকে সহজে প্ররোচিত করে ঘৃণার পথের অনুগামী করা যায়। বর্তমান শাসকগোষ্ঠী সাফল্য লাভের সেই সোজা রাস্তাটাই বেছে নিয়েছে আর অনেকখানি সাফল্যও পেয়েছে। কিন্তু ইতিহাস আমাদের শিক্ষা দেয়, সাময়িক ব্যর্থতা শেষ কথা নয়। তাই রাজনীতি-সচেতন নাগরিকদের কাজ হল লড়াইটাকে আবার ঠেলেঠুলে প্রথম ও অপেক্ষাকৃত কঠিন উঠোনটায় নিয়ে ফেলা। যতদিন তা না করা যাচ্ছে, আমাদের গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে সত্যি কথাগুলো বলে যেতেই হবে। আপাতত আমাদের ছুটি নেই।
1Comment
September 16, 2023 at 1:21 pm
বেশ যুক্তি প্রয়োগ করেই ধাপে ধাপে নিজের সিদ্ধান্তে পৌঁছতে চেয়েছেন লেখক। এখানে একটা কথা মনে হয়, বিজেপিওয়ালাদের পূর্বসূরীরা যেহেতু ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেয়নি বা ব্রিটিশদের কাছে সাভারকরের মতো সমর্পন করেছে তাই ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের পরিবর্তে এক ন্যারেটিভ ওদের দরকার, তাই ওই হাজার বছরের….।