=========================================================

=========================================================
১.
জামার ভেতর যারা হাফ সোয়েটার পরে, তারা কিছু একটা লুকোতে চায়। যেমন আমরাও চাইতাম, ছোটবেলায়। আমাদের হাফ সোয়েটারগুলো ছিল ছেঁড়া ও ঘোলাটে রঙের। হয়তো মেজোমাসি বুনে পাঠিয়েছিল কবে! বাজারে তখনও এস সাইজ আসেনি। ফলে মা-ও বলে দেয়নি সাইজ। বাধ্য আমরা ডবল এক্সেল সোয়েটার ট্রিপল এক্সেল জামায় ঢেকে ঘুরে বেড়াতাম।
অনেক বড় হওয়ার পর যখন রাষ্ট্রের দিকে তাকালাম, তখন ভুল ভাঙল আমাদের। এখানে ‘রাষ্ট্র’ আসলে আমাদের বিল্টুদা। বয়স হয়েছে, চোখে যথেষ্ট কম দেখে। কিন্তু সে যে কম দেখে, তা কাউকে জানান দিতে চায় না। তাই সারাক্ষণ খালি চোখ রাঙায় আর চোখ রাঙায়। তার চোখ-রঙানির ঠেলায় বসন্তও আর বহুদিন বলতে সাহস পায় না- রাঙিয়ে দিয়ে যাও!
এতক্ষণে নিশ্চয়ই আপনারা বুঝে গেছেন যে আমাদেরও শীত করত ছোটবেলায়। এবং প্রাচীন হাফ সোয়েটারগুলো ছেঁড়াফাটা ছিল বলে লুকোতাম সবসময়, এমনটা নয়। আসলে ‘কনকনে ঠান্ডাতেও দ্যাখ জামাটুকুই যথেষ্ট’, এই ছিল আমাদের ঘোষণার বিষয়। অর্থাৎ লুকোনো। যেমনভাবে রাষ্ট্রও লুকিয়ে ফেলতে চায় তার ভেতরের শীত শীত ভাব।
এখানেও বলে রাখা জরুরি যে শেষতম রাষ্ট্রটিও ঠিক রাষ্ট্র নয়। রাষ্ট্রপতিও নয়।
বিল্টুদা তো নয়ই!
২.
কোনও কোনও মুখের দিকে তাকালে মনে হয়, সে হাসছে। আমিও হেসে ফেলি। তারপর বুঝি, আসল সে হাসেনি। তার মুখটাই হাসিহাসি। আমার রাষ্ট্রের কথা মনে পড়ে।
এই রাষ্ট্র আসলে আমার ছোটবেলার প্রেম। লাল রঙের একটা লেডিবার্ডে স্কুলে আসত সে। খুব হাসিহাসি মুখ ছিল তার। সেই হাসিতেই ভুল বুঝে আমিও হেসে ফেললাম একদিন। আর সে সটান গিয়ে হ্যাডস্যারকে বলে দিল। এক চিলতে হাসির জন্য সে কী মার কী মার!
হাসি যে এত বিপজ্জনক, রাষ্ট্রই আমাকে শিখিয়েছিল প্রথম। মানে আমার লেডিবার্ড-প্রেমিকা। তারপর থেকে আমি বহুদিন হাসিনি। অপেক্ষা করছিলাম রাষ্ট্র অন্তত একটা ভুল করুক। বলা বাহুল্য, বড় হতে হতে রাষ্ট্র অনেকগুলো ভুল করে বসল পরপর।
ঘুমের ভেতরে একদিন দেখলাম গোটা ট্রেন জ্বলছে আর পাঁচিলের গায়ে কেরোসিন ঢালছে রাষ্ট্র, মানে আমার ছোটবেলার প্রেম! আর একদিন দেখলাম, একটা সাপ হাসতে হাসতে গিলে নিচ্ছে সমস্ত উদ্বাস্তু মানুষের মাথা। আর রাষ্ট্র ভাগ চাইছে তার।
এবং শেষবার দেখলাম, একটি দলিত যুবক রাষ্ট্রকে প্রেম নিবেদন করায় রাষ্ট্র তাকে গোরু নিবেদন করছে। ঘুমের মধ্যেই আমার বৃষোৎসর্গ শ্রাদ্ধের কথা মনে পড়ল। এবং হাসি পেল।
এখানেও বলে দেওয়া প্রয়োজন যে হাসিকে হিসির সঙ্গে গুলিয়ে ফেলবেন না। যেভাবে আপনি গুলিয়ে ফেলেননি আমার প্রথম প্রেমিকার সঙ্গে সত্যিকারের রাষ্ট্রকে!
৩.
আচ্ছা বাথরুমে ঢুকলেই কেন এমন হয় বলুন তো? মনে হতে থাকে বাইরে মোবাইল বাজছে। বারবার ট্যাপের মুখ বন্ধ করি। আর শোনার চেষ্টা করি, সত্যি বাজছে? আবার ট্যাপ চালাই। আবার যেন গান বাজতে থাকে। সুতোহীন শরীর বলে-জরুরি ফোন। এক্ষুনি ধরা উচিত। কিন্তু মন বলে ঘন্টার মাথা।
আপনার এমন হয়?
কোনও কোনও দিন বাথরুম থেকে বেরিয়ে দেখি, মিসড কল। নম্বর অজানা। বুঝি যে এটা রাষ্ট্রের মিসড কল ছিল। আসলে সে কলই করতে চেয়েছিল। কিন্তু রাষ্ট্র কীভাবে জানবে যে আমি বাথরুমে?
রাষ্ট্র অনেক কিছুই জানে না আমার। এই যেমন আমি রাত জাগি কিনা, সকালে দাঁত মাজি কিনা, আনমনে নাক খুঁটি কিনা, শোয়ার ঘরে ছিটকিনি লাগাই কিনা, মোবাইল লোকেশন অন রাখি কিনা। আমার লোন চলছে কিনা, ইত্যাদি ইত্যাদি!
সেসব জানার জন্যই সে মাঝেমধ্যে ফোন করে। আচ্ছা রাষ্ট্রের এত জানার ইচ্ছে কেন বলুন তো?
আসলে রাষ্ট্র ঠিক করেছে আমার সবকিছু জেনে ছায়া প্রকাশনীকে দিয়ে দেবে। তারপর একটা মস্ত বই হবে। এবং সেই বই নিয়ে রাষ্ট্র পরের মাধ্যমিক পরীক্ষা পর্যন্ত টানা বিজ্ঞাপন চালিয়ে যাবে।
বলা বাহুল্য, এখানেও রাষ্ট্র একটি অলীক ধারণামাত্র। অথবা অযাচিত ফোনকল। জীবনের অপ্রস্তুত মুহূর্তগুলোতে সে গান গাইতে গাইতে ঢুকে পড়ে। আর দাঁত কেলিয়ে জিজ্ঞাসা করে, কী রান্না হল আজ?