স্মৃতিগুলি
‘আমার জীবন’। শব্দগুলো ভাবলেই চোখের সামনে ডোরা-কাটা আলোটা দেখতে পাই। ভালো করে দেখলে টের পাই যে এই আলোটা খানিকটা ধূমকেতুর মতো। মাথার উজ্জ্বল দিকটা হলো আমার ছেলেবেলা আর বড়ো হয়ে ওঠা। সববেকে বড়
নিউক্লিয়াসের কেন্দ্রটি আমার শৈশব, যখন আমাদের চরিত্রের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যগুলি তৈরি হয়ে ওঠে। আমি প্রাণপণে মনে করার চেষ্টা করি সেই সময়ের স্মৃতিগুলি, ওই নিউক্লিয়াসটাকে ভেদ করার চেষ্টা করি। কিন্তু ওই তীব্র ঘন অঞ্চলগুলি ভেদ করা কঠিন আর বিপজ্জনক, মনে হয় যেন মৃত্যুর কাছাকাছি চলে যাচ্ছি। পিছনের দিকে ধূমকেতুর পুচ্ছটি পাতলা হয়ে আসে চওড়া আর হালকা। এখন আমি এই পুচ্ছের শেষের দিকে, এই লেখাটি লেখার সময় আমার বয়েস ষাট।
আমাদের জীবনের একেবারে প্রথমদিকের অভিজ্ঞতাগুলি ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে। অন্যের মুখে খানিকটা শুনে, স্মৃতিরও স্মৃতি তৈরি হয়, সেই মুডগুলির ভিত্তিতে স্মৃতি পুনর্নির্মাণ করতে করতে সেগুলি কখনো কখনো জীবন্ত হয়ে ওঠে।
আমার প্রাচীনতম স্মৃতি হলো একটি অনুভূতি। গর্বের অনুভূতি। সদ্য তিন-এ পা দিয়েছি, ঘোষণা করা হলো যে এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ সময়, কারণ আমি নাকি বড়ো হয়ে গেছি। একটা উজ্জ্বল ঘরে আমি বিছানার ওপর থেকে হাত-পা বেয়ে নেমে এলাম মেঝেয় দারুণ পুলকিত হয়ে, কারণ আমি এখন বড়ো হয়ে গেছি। আমার একটা পুতুল ছিল, সেটাকে আমি আমার পক্ষে যতটা সম্ভব সবচেয়ে ভালো নাম দিলাম একটা- কারি স্পিনা। পুতুলটাকে আমি মায়ের মতো স্নেহ করতাম না, বরং কমরেড বা প্রেমিকার মতো দেখতাম।
আমরা থাকি স্টকহোমের সোডার অঞ্চলে, বাড়িতে বাবা আছেন এখনো, কিন্তু শিগগরি চলে যাবেন। আমরা বেশ আধুনিক পরিবার, বাবা-মা-কে বরাবর ‘তুমি’ সম্বোধন-ই করে আসছি। মায়ের বাবা-মাও কাছাকাছি থাকেন। আমার দাদু কার্ল হেলমার ওয়েস্টারবার্গ এর জন্ম ১৮৬০ সালে। জাহাজের কাপ্তেন ছিলেন, আমারও খুব বন্ধু, যদিও আমার থেকে ৭১ বছর বড়ো। অদ্ভূতভাবে, তাঁর সঙ্গে তাঁর নিজের দাদুর-ও ঠিক ততটাই বয়েসের তফাৎ ছিল, ১৭৮৯ সালে তাঁর দাদুর জন্ম। সে-বছর বাস্তিলের দুর্গ অধিকার হলো, আঞ্জালা বিদ্রোহ, আর মোৎজারটের ক্ল্যারিনেট কুইন্টেট লেখা চলছে। সময়ের পিছন দিকে দুটি মাত্র পদক্ষেপ, খুব বেশি লম্বাও নয়, আর আমরা যেন ছুঁয়ে ফেলি ইতিহাস।
দাদু কথা বলতেন উনিশ শতকীয় ভঙ্গিতে। তাঁর অনেক লব্জ আজকের তুলনায় খুব সেকেলে মনে হবে। কিন্তু তাঁর মুখে, আর আমার কানে সেগুলি স্বাভাবিক লাগত। বেশ বেঁটে ছিলেন তিনি, শাদা রঙের গোঁফ ছিল, আর বেশ দর্শনীয় বাঁকা নাক ছিল একখানা – তিনি বলতেন ‘তুর্কি দের মতো’। খুব জমজমাট মেজাজের মানুষ ছিলেন, কথায় কথায় রেগে উঠতেন। তাঁর এই মাঝে মাঝে ক্ষেপে যাওয়াটাকে খুব বেশি গুরুত্ব দেওয়া হতো না, এই রাগতেন এই আবার ঠান্ডা হয়ে যেতেন। টানা আক্রমণ করতেন না বেশিক্ষণ, বরং এতটাই মানিয়ে চলতেন যে তাঁকে প্রায় নিরীহ লেবেল মেরে দেয়া যেত। এমন কি আড়ালে যাঁদের সমালোচনা করা যেতে পারে, তাঁদের সম্পর্কেও তিনি বিবেচনাশীল ছিলেন। ‘ক-বাবু একাট আন্ত বজ্জাত’ এমন কথা কেউ বললে তিনি মন্তব্য করতেন, ‘আসলে অতটা ঠিক বলা যায় না, আমরা আর কতটাই বা জানি….।
বাবা-মার ডিভোর্স হয়ে গেলে মা আর আমি অন্য একটা বাড়িতে চলে আসি, নিম্ন মধ্যবিত্ত বস্তি এলাকা, সেখানে নানা কিসিমের লোকজন গায়ে গায়ে বাস করতো। সেই সময়কার স্মৃতিগুলি ৪০ বা ৫০ দশকের ফিল্মের দৃশ্যের মতো সাজানো যায় – একেবারে চরিত্রের তালিকা সহ। সুন্দরী এক মেস-চালিকা, তার গোবেচারা স্বামী, যাকে আমার হিরো মনে হতো কারণ তার গ্যাস পয়জনিং হয়েছিল, অর্থাৎ বিপজ্জনক সব মেশিনের কাছে যাওয়া নিয়ে তার ভয়ডর ছিল না এমন সব চরিত্র।
সেখানে লোকজন যে সবসময় নানা জায়গা থেকে আসা যাওয়া করছে এমনটা নয়। বরং আমাদের পরিচিত মাতালটি সিঁড়ির ওপরেই এক সময় খোঁয়ারি কাটিয়ে ঘরে ঢুকত। সপ্তাহে বেশ কয়েকবার ভিখিরিরা এসে চৌকাঠের বাইরে বিড়বিড় করত। মা তাদের জন্য স্যান্ডুইচ বানাতেন পয়সার বদলে রুটি দিতেন।
আমরা থাকতাম পাঁচতলায়, সবার ওপরে। চারটে দরজা ছিল, আর ছাদে যাওয়ার পথ। একটা দরজায় লেখা ছিল ‘ওরকি, প্রেস। ফটোগ্রাফার। একজন প্রেস ফটোগ্রাফার-এর কাছাকাছি থাকার একটা রোমাঞ্চ ছিল। পাশের ঘরে থাকতেন একজন মাঝবয়েসি ব্যাচেলর, হলদেটে রঙ। বাড়িতে থেকেই কাজ করতেন তিনি, ফোনেই শেয়ারের দালালির কাজ করতেন। ফোনে কথা বলার সাথে সাথেই তাঁর বিকট অট্টহাসি আমাদের ঘরে দেয়াল ভেদ করে ঢুকে পড়ত। আরেকটা নিয়মিত আওয়াজ ছিল কর্ক খোলার শব্দ, সেযুগে বীয়রের বোতলের ছিপি আজকালকার মতো ধাতব ছিল না। ওই দানবিক বিকট অট্টহাসি এবং সশব্দে ছিপি খোলার আওয়াজ করতেন যিনি, তাঁর সঙ্গে মাঝেমাঝে সিঁড়ির গোড়ায় দেখা হলে মনেই হতো না যে এই আচরণগুলো এই ফ্যাকাশে হলদেটে রঙের মাঝবায়সী বুড়ো করতে পারেন। বয়েস বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি খুব সন্দিগ্ধ হয়ে পড়লেন, ঝিমিয়ে পড়লেন।
একবার একটা মারামারি লাগলো। বেশ ছোট তখন আমি। এক প্রতিবেশিকে তাঁর স্ত্রী ঘরে ঢুকতে দিচ্ছেন না, ভিতর থেকে লক খুলবেন না তিনি। মাতাল বর রাগে চেঁচামেচি করছে, দরজা ভেঙে ঢোকার চেষ্টা করছে, ভয় দেখাচ্ছে নানারকম। তার একটি উক্তি বেশ মনে আছে আমার ‘আমাকে যদি কুংশোললেনেও যেতে হয়, আমি থোড়াই কেয়ার করি।’ মাকে জিগ্যেস করলাম এর মানেটা কি। যা বললেন ওটা পুলিশের হেড অফিস। তখন থেকে শহরের ওই অঞ্চল সম্পর্কে আমার একটা ভয় তৈরি হলো। (পরে, ১৯০৯-৪০ সালে আমার সদের ভিতর কোনো অঞ্চল সম্পর্কে এই ধরণের ভয় আরো ঘনীভূত হয়, যখন ফিনল্যান্ড থেকে আসা যুদ্ধে আহত সৈনিকদের সেন্ট এরিক হাসপাতালে দেখি)।
ভোরে মা কাজে বেরিয়ে যেতেন। ট্রাস বাস কিছু নিতেন না মা, প্রাপ্তবয়স্ক জীবনের পুরোটাই তিনি পায়ে হেঁটে সোডার থেকে অস্টারমাল্ম যাওয়া আসা করেছেন। হেয়দিপ লিওনোরা স্কুলে পড়াতেন মা, বছরের পর বছর ক্লাস থ্রি আর ফোরের দায়িত্বে ছিলেন। খুব নিষ্ঠাবান শিক্ষিকা ছিলেন তিনি, বাচ্চাদের সঙ্গে একেবারে জড়িয়ে থাকতেন। তাঁর পক্ষে অবসর নেয়াটা কঠিন। হওয়াই স্বাভাবিক। আসলে কিন্তু তা হয়নি, অবসর নিয়ে তিনি বরং বেশ রিলিফ পেলেন মনে হলো।
মা কাজ করতেন বলে আমাদের একজন কাজের মাসি ছিলেন। তাঁকে কাজের মাসি বলা হলেও তিনি আমাদের-ই দেখাণনা করতেন। রান্নাঘরের এককোণে ছোট্ট একটা ঘরে শুতেন, সেটাকে ঠিক ঘর হিসবে ধরা হতোনা আমাদের সেই বিজ্ঞাপিত কিচেন-ওয়ালা দো’ঘরা এপার্টমেন্টে।
আমার যখন পাঁচ বা ছয়, তখন দক্ষিন সুইডেনের স্কেন অঞ্চলের এস্লভ থেকে এল আনা-লিসা নামের একজন কাজের মহিলা। তাকে আমার দারুণ আকর্ষণীয়া মনে হতো- কুঁচকোনো ব্লন্ড চুল, নাকটা ঈষৎ ওপরের দিকে বাঁকানো, কথায় স্কেন অঞ্চলের টান।
চমৎকার মহিলা ছিল সে, আজও এস্লভ স্টেশনের ওপর দিয়ে পেলে আমার একটা রোমাঞ্চ হয়। কিন্তু এখনো অব্দি কোনোদিন ওই স্টেশনে পা রাখা হয়নি।
আনা-লিসার সবচেয়ে বড় গুণ ছিল ছবি আঁকায়। ডিজনির চরিত্রগুলি দারুণ আঁকত সে। আমিও ওই সময়টায় একটানা অনেক বছর ছবি এঁকেছি, তিরিশের দশকের শেষ দিক হবে। দাদু নিয়ে আসতেন দোকানপাটে ব্যবহার করার ব্রাউন পেপারের রোল, সেগুলির ওপর যথেচ্ছা ছবি আঁকতাম, নানা কাহিনীর ন্যারেটিভ। বেশ ভালো মনে আছে যে আলি পাঁচ বছর বয়েসে নিজে নিজে লিখতে শিখে গেছিলাম। কিন্তু সেটা খুব ধীর গতির ব্যাপার ছিল। আমার কল্পনা এমন স্পিডে চলছিল যে খুব তাড়াতাড়ি নিজেকে প্রকাশ করবার একটা উপায় সরকার ছিল। ঠিকঠাক ছবি আঁকার ধৈর্যও ছিল না আমার। এক ধরণের শর্টহ্যান্ড স্কেটিং পদ্ধতি আবিষ্কার করলাম, সেখানে ফিগার গুলি প্রচন্ড গতিতে ছুটছে- শ্বাসরোধকারী নাটক, শুধু ডিটেলটুকু ছাড়া। এমন কার্টুন, যা কেবল আমি-ই উপভোগ করতে পারতাম।
তিরিশের দশকের মাঝামাঝি কোনো একটা সময়ে আমি একবার খোদ স্টকহোমে হারিয়ে গেছিলাম। মায়ের সঙ্গে স্কুলে একটা গানের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম, গেট-এর ভিড়ে ধাক্কা খেয়ে মায়ের হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিলাস। মানুষেয় স্রোতে ভেসে গেলাম। এত ছোট ছিলাম যে আমাকে খুঁজে বের করা দুঃসাধ্য। হোটোরগেট-এ অন্ধকার নেমে আসছিল। গেট-এর কাছে পিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম, ততক্ষণে আমার সমস্ত নিরাপত্তার বোধ অন্তর্হিত। আমার চারপাশে লোকজন ছিল, কিন্তু যে যার নিজের কাজে ব্যস্ত। কোনো কিছু আঁকড়ে ধরে থাকব তার জো নেই। সেই প্রথম আমার মৃত্যুর অভিজ্ঞতা হয়েছিল।
কিছুক্ষণ আতংকে স্তম্ভিত হয়ে থাকার পর আমার মাথা কাজ করতে শুরু করলো। খেয়াল হলো যে আমার পক্ষে নিশ্চয়ই বাড়িতে হেঁটে যাওয়া সম্ভব। বাস-এ এসেছি। আমি সিটের ওপর হাঁটু গেড়ে বসে বাইরে তাকাতে তাকাতে এসেছিলাম। পেরিয়ে এসেছিলাম ড্রোটনিং পাতান। আমাকে তাহলে ঠিক সেই রাস্তা ধরে ফিরতে হবে, একটা একটা করে বাস স্টপ চিনে চিনে ঠিক পথেই চললাম। সেই দীর্ঘ রাস্তার কেবল একটা স্মৃতি পরিষ্কার হয়ে আছে- নোরবো পৌঁছে ব্রিজের তলায় জল দেখতে পাওয়া। সেখানে ট্রাফিক খুব, রাস্তা পার হওয়ার সাহস ছিল না। পাশে এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে ছিলেন, তাঁর দিকে পাশ ফিরে বললাম- ‘এখানে খুব বেশি ট্রাফিক’। তিনি আমার হাত ধরে রাস্তা পার করে দিলেন।
কিন্তু তারপর হাত ছেড়ে দিলেন। আমি আজ-ও জানিনা ওইটুকু একটা ছেলের স্টকহোমের রাস্তায় রাস্তায় ভর সন্ধ্যেয় এবা একা হেঁটে যাওয়াটা কেন ভদ্রলোকের স্বাভাবিক মনে হয়েছিল। কিন্তু ওইরকম-ই ছিল দিনকাল। বাকি রাস্তাটা গামলা স্তান দিয়ে পুরোনো অঞ্চল হয়ে স্লাসেন হয়ে সোডারে ফেরা নিশ্চয়ই জটিল হয়ে থাকবে। খুব সম্ভব কুকুর আর ডাক -পরিবাহী পায়রার সতোই রহস্যময় এক কম্পাস আমাকে গাইড করে থাকবে যেখানেই আমাদের ছেড়ে দিন না কেন, ঠিক চিনে ফিরে আসে।
বাকি রাস্তাটার আর কোনো স্মৃতি নেই। কিন্তু একটা ব্যাপার দিব্যি মনে আছে। ফিরতে ফিরতে আসার আত্মবিশ্বাস আস্তে আস্তে এমন বাড়তে শুরু করলো যে, বাড়ি এসে আমি মহা উত্তেজিত হয়ে পড়লাম। দাদুর সঙ্গে দেখা হলো প্রথমে। বিধ্বস্ত মা তখন পুলিশ স্টেশনে বসে তাদের অনুসন্ধানের পুঙ্খানুপুঙ্খ খবর নিচ্ছেন। দাদুর শক্ত নার্ভ তখনও ফেল করেনি, আমাকে বেশ স্বাভাবিক ভাবেই অভ্যর্থনা জানালেন। খুব রিলিফ পেয়েছিলেন নিশ্চয়ই, কিন্তু টের পেতে দেন নি। সবটাই নিরাপদ আর স্বাভাবিক মনে হলো।
ক্রমশ…
সৌম্য দাশগুপ্ত। আটের দশকের কবি, প্রাবন্ধিক, এবং অগ্রবীজ পত্রিকার অন্যতম সম্পাদক, যিনি আশির দশক থেকেই দুই বাংলার সাহিত্যিকদের নিয়ে সেতুনির্মাণ করে কাজ করে চলেছেন। তাঁর কাব্যগ্রন্থের নাম “রাজার জামা পরা মায়াবী সাতদিন” (১৯৯৪), “কবিতা, ডালাস” (১৯৯৯), “মহাপৃথিবীর ওয়েবসাইট” (২০০০), এবং “আলো, আলোতর, আলোতম” (২০০৮)। এছাড়া অনুবাদ কবিতার বই “কবিতা, ডাউন আন্ডার” (অস্ট্রেলিয়ার কবিতা, ২০০৭), “টোমাস ট্রান্সট্রোমারের কবিতা” (২০১২),সমুদ্রতটে, মৃত গালিভার(২০২৩) পেশায় তিনি আন্তর্জাতিক বিজ্ঞাপন সংস্থা সাচি এন্ড সাচি র কর্মকর্তা, এবং সাদার্ণ ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সংযুক্ত অধ্যাপক।